ইয়াযিদকে বাঁচানোর যত অপচেষ্টা
ইয়াযিদকে যারা কুকর্মের দায়ভার থেকে উদ্ধার করতে চান, তাদের তিনটি যুক্তি রয়েছে। প্রথম যুক্তি হচ্ছে, তারা কারবালা এবং তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহে ইয়াযিদের হাত ছিল না বলে দাবী করেন। এ যুক্তির খণ্ডন আমরা গত লেখনিতে করে এসেছি। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আহলে সুন্নাতের বহু প্রসিদ্ধ ইমামের পরিপূর্ণ মতামত উল্লেখ করিনি। কেবল নাম বলেই বাদ দিয়েছি। প্রয়োজনে তাঁদের মতামত সূত্রসহ উপস্থাপন করতে পারব।
ইয়াযিদকে যারা কুকর্মের দায়ভার থেকে উদ্ধার করতে চান, তাদের তিনটি যুক্তি রয়েছে। প্রথম যুক্তি হচ্ছে, তারা কারবালা এবং তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহে ইয়াযিদের হাত ছিল না বলে দাবী করেন। এ যুক্তির খণ্ডন আমরা গত লেখনিতে করে এসেছি। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আহলে সুন্নাতের বহু প্রসিদ্ধ ইমামের পরিপূর্ণ মতামত উল্লেখ করিনি। কেবল নাম বলেই বাদ দিয়েছি। প্রয়োজনে তাঁদের মতামত সূত্রসহ উপস্থাপন করতে পারব।
উদ্ধারকারীদের দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, ইয়াযিদ একজন তাবিয়ী। তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে, কুস্তিন্তিনিয়া (ইস্তাম্বুল) অভিযান বিষয়ক একটি হাদীস, যা দ্বারা তারা ইয়াযিদকে জান্নাতি দাবী করেন। এ লেখনিতে আমরা এ দুটি যুক্তি পর্যালোচনা করব।
প্রথমত, এটি ঠিক যে, ইয়াযিদ বহু সাহাবির সাক্ষাত পেয়েছে। এমনকি তার পিতাও একজন সাহাবি। কিন্তু পরিভাষার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা বুঝতে পারব যে, সাহাবি ও তাবিয়ী পরিভাষাদুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাহাবি শব্দটি এসেছে صُحبَة (সুহবাত) থেকে, যার অর্থ সঙ্গ বা সাহচর্য। তাবিয়ী শব্দটি এসেছে إتِّبَاع (ইত্তিবা') থেকে, যার অর্থ অনুসরণ। তাই সাহাবি হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাক্ষাত তথা সঙ্গ লাভ করাই যথেষ্ট। কিন্তু তাবিয়ী হওয়ার শর্ত হচ্ছে সাহাবিদেরকে অনুসরণ করা, যেহেতু তাবিয়ী অর্থই হচ্ছে অনুসারী। সাহাবিদেরকে চোখে দেখলেই যদি তাবিয়ী হওয়া যেত, তাহলে উসমান রা.-কে হত্যাকারীরাও তাবিয়ী এবং আলী রা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা খারিজীরাও তাবিয়ী। তারা সাহাবিদেরকে দেখেছে, মুসলমানও ছিল। কিন্তু সাহাবিদের অনুসরণ করেনি বলে তাদেরকে তাবিয়ী বলা হয় না। একই কারণে ইয়াযিদকেও তাবিয়ী হওয়ার মর্যাদা দেয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, যে হাদীসের আলোকে ইয়াযিদকে জান্নাতি দাবী করা হয়, সেটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-
أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِي يَغْزُونَ مَدِينَةَ قَيْصَرَ مَغْفُورٌ لَهُمْ
“আমার উম্মাতের মধ্যে প্রথম যে দল কায়সারের শহরে যুদ্ধ করবে, তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত।” [সহীহ বুখারী, ২৯২৪]
এ হাদীসকে অনেকে কুস্তিন্তিনিয়া তথা ইস্তাম্বুল বিষয়ক হাদীস বলেন। তারা দাবী করেন, ইস্তাম্বুলে মুসলমানদের প্রথম অভিযানের নেতৃত্বে ছিল ইয়াযিদ, তাই সে জান্নাতি। অথচ হাদীসে কুস্তিন্তিনিয়া তথা ইস্তাম্বুলের নামই নেয়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন কায়সার অর্থাৎ রোমান সম্রাটের শহর। সেই সময় রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের হেডকোয়ার্টার ছিল বর্তমান সিরিয়ার হোমস শহর, যেটি মুসলমানরা ১৬ হিজরিতে বিজয় করেছিলেন। তখন ইয়াযিদের জন্মই হয়নি। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন সায়্যিদুনা আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রা. এবং খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রা.। হোমস বিজিত হওয়ার পর রোমান সম্রাট অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়। তাই হাদীসটি এই বাহিনীর দিকে সম্পৃক্ত হওয়াই অধিক যৌক্তিক।
তবুও কেউ যদি জেদ ধরেন যে, হাদীসে ইস্তাম্বুলকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে, তবুও তাতে ইয়াযিদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। কারণ ইস্তাম্বুলে মুসলমানদের প্রথম অভিযানেও ইয়াযিদ ছিল না। মুআবিয়া রা. শাসনভার হাতে নেয়ার পর ৪২ হিজরি থেকে রোমান সম্রাজ্যের পূর্বদিকের এলাকাসমূহে অভিযান শুরু করেন। তবে মুসলমানরা ইস্তাম্বুল পৌঁছেছিলেন আরও পরে, যখন সেনাপতি ছিলেন খালিদ ইবন ওয়ালীদের পুত্র। তাবিয়ী আবু ইমরান বলেছেন, “আমরা মদীনা থেকে আবদুর রাহমান ইবন খালিদের নেতৃত্বে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের জন্য বের হলাম। সেখানে রোমান সৈন্যরা শহরের বহিঃভাগ থেকে প্রতিরোধ করছিল। তখন এক মুসলিম সৈন্য তাদের ওপর হামলা করল। সে সময় আবু আইয়ুব আনসারী রা. আমাদেরকে কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এরপর আবু আইয়ুব রা. বারবার অভিযানে শরীক হতে থাকেন। এক সময় তিনি ইস্তাম্বুলে সমাহিত হন।” [সংক্ষেপিত, আবু দাউদ, ২৫১২]
ওই অভিযানে ইয়াযিদ ছিল না। এরপর রোমান সম্রাজ্যে একের পর এক যুদ্ধ চলতে থাকে। ইয়াযিদ যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, সেটি হয়েছিল ৫০ হিজরিতে। ইবনুল আসীর লিখেছেন-
سَنَةَ خَمْسِينَ سَيَّرَ مُعَاوِيَةُ جَيْشًا كَثِيفًا إِلَى بِلَادِ الرُّومِ لِلْغَزَاةِ وَجَعَلَ عَلَيْهِمْ سُفْيَانَ بْنَ عَوْفٍ وَأَمَرَ ابْنَهُ يَزِيدَ بِالْغَزَاةِ مَعَهُمْ فَتَثَاقَلَ وَاعْتَلَّ فَأَمْسَكَ عَنْهُ أَبُوهُ فَأَصَابَ النَّاسُ فِي غَزَاتِهِمْ جُوعٌ وَمَرَضٌ شَدِيدٌ فَأَنْشَأَ يَزِيدُ فَبَلَغَ مُعَاوِيَةَ شِعْرُهُ فَأَقْسَمَ عَلَيْهِ لَيَلْحَقَنَّ بِسُفْيَانَ إِلَى أَرْضِ الرُّومِ لِيُصِيبَهُ مَا أَصَابَ النَّاسَ
“৫০ হিজরিতে মু'আবিয়া রা. সুফিয়ান ইবন আউফের নেতৃত্বে বিশাল দল রোমান সম্রাজ্যে প্রেরণ করলেন এবং তাঁর পুত্র ইয়াযিদকেও এ দলের সাথে যেতে বললেন। কিন্তু ইয়াযিদ অসুস্থতার ভান করে বসে রইল। তাই তার পিতা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ওদিকে রোমান সম্রাজ্যে মুসলিম সেনাদলকে দুর্ভিক্ষ ও রোগে পেয়ে বসল। এ সংবাদ পেয়ে ইয়াযিদ তাঁদেরকে ব্যঙ্গ করে কবিতা আবৃত্তি করল। যখন মু'আবিয়া রা. এ কথা শুনলেন, তখন তিনি কসম দিয়ে ইয়াযিদকে সেখানে প্রেরণ করলেন, যাতে মুসলিম সেনাদের সাথে তাকেও সেই কষ্টের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়।” [আল-কামিল ফিত-তারিখ, খ. ৩, পৃ. ৫৬-৫৭]
এরপর ইয়াযিদের নেতৃত্বেও ৫০ বা ৫২ হিজরিতে ইস্তাম্বুলে অভিযান হয়েছিল, যে অভিযানে আবু আইয়ুব আনসারী রা. ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে ইস্তাম্বুলের ভেতরে দাফন করা হয়।
আর যদি কেউ মাগফিরাতের হাদীস দ্বারা ইস্তাম্বুল বিজয়কে উদ্দেশ্য করেন, তাহলে সেটি হয়েছিল ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে, সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ-এর নেতৃত্বে। অতএব মাগফিরাতের সুসংবাদ তো যাওয়ার কথা আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ, অথবা খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ, অথবা আবদুর রাহমান ইবন খালিদ, অথবা সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ-এর মধ্যে কেউ একজনের দিকে। কিন্তু কিছু মানুষ সবাইকে সরিয়ে মাঝখান থেকে ইয়াযিদের গলায় এই মালা পরিয়ে দিতে চান। অথচ ইয়াযিদ রোমান সম্রাজ্য, বা ইস্তাম্বুল শহরে প্রথম অভিযান এবং বিজয় কোনোটিতেই উপস্থিত ছিল না।
আসলে নাসিবীয়াত এমন এক রোগ, এটি যাকে পেয়ে বসেছে সে অন্ধ হয়ে গেছে। তাই এরা এদিক ওদিক হাতড়ে সেই ব্যক্তিকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে, যার অপকর্ম এই উম্মাতের হৃদয়কে ছিঁড়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে।
* হাদীস ও অন্যান্য সূত্রের নম্বর মাকতাবাতুশ শামিলা অনুসারে
-Marja Ahmed Chy