ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিলেখা পাঠানোর নিয়মাবলীযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

উনাদের ইয়াযিদ

পবিত্র মুহাররাম আসছে। ইউটিউবে ঢুকলেই শুনতে পাবেন কিছু মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার প্রশংসাস্তুতি গাইছেন। এসব প্রশংসাস্তুতির কিছু ধরণ আছে।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
উনাদের ইয়াযিদ

পবিত্র মুহাররাম আসছে। ইউটিউবে ঢুকলেই শুনতে পাবেন কিছু মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার প্রশংসাস্তুতি গাইছেন। এসব প্রশংসাস্তুতির কিছু ধরণ আছে। যেমন-

১. ইয়াযিদের প্রশংসা 'ইয়াযিদ' দিয়ে শুরু হবেনা। শুরু হবে তার পিতা মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর কৃর্তি দিয়ে। বলা হবে, মু'আবিয়া (রা.) ছিলেন কাতিবে ওহী, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শ্যালক এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশা/খলিফা। এক ঘন্টার বক্তৃতা হলে আধাঘন্টা মু'আবিয়া (রা.)-কে দিয়েই কাটিয়ে দেয়া হবে।

২. ইয়াযিদের প্রশংসাস্তুতি কখনও সিঙ্গেল-লাইন ধরে এগুবেনা। বরং এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করবে। বলা হবে, ইয়াযিদ কন্সটান্টিনোপোলে প্রথম অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর জানাযা পড়িয়েছিলেন, অমুক দিন তমুক 'মহান' কাজ করেছিলেন ইত্যাদি।

৩. প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে যে, ইয়াযিদ তাবেয়ী ছিলেন। ফকীহ ছিলেন, ন্যায়পরায়ণ/বিশ্বস্ত ছিলেন।

৪. এদিক-ওদিক থেকে জোগাড় করে এনে আদা-কাচকলা মার্কা রেফারেন্স দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করা হবে যে, কারবালা এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতে ইয়াযিদের কোনো হাত ছিলনা। এমনকি ইমামের কর্তিত শির মোবারক দেখে ইয়াযিদ কেঁদেছিলেন!

৫. হাররার যুদ্ধ, মদীনা তাইয়্যিবায় আক্রমণ এবং মক্কা শরীফে হামলার পুরো ঘটনাকে চেপে যাওয়া হবে। কারণ, এ তিনটি আক্রমণ সরাসরি ইয়াযিদের নির্দেশে হয়েছিল এবং এগুলোকে ডিফেন্ড করা সম্ভব নয়।

Note 1: আমরা জানি মু'আবিয়া (রা.) সাহাবি ছিলেন, কাতিবে ওহী ছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শ্যালক ছিলেন এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশা/খলিফা ছিলেন। সিফফিনের যুদ্ধে মু'আবিয়া (রা.)-এর রাজনৈতিক ইজতিহাদের সাথে আমরা একমত নই; কিন্তু আমরা কখনও তাঁর সমালোচনা করিনা। তিনি একজন সাহাবি এবং সাহাবিদের সমালোচনা করা আহলে সুন্নাতের আদর্শের বিপরীত। তাই বলে ১০ই মুহাররাম সবকিছু ছেড়ে কেবল মু'আবিয়া (রা.)-এর প্রশংসা করতে হবে? আমরা জানি আসল উদ্দেশ্য কী। উদ্দেশ্য হলো, ইয়াযিদের কুকর্ম ঢাকা। ইয়াযিদের নিজের তো কোনো অর্জন নেই। তাই পিতার অর্জন দিয়ে যদি কিছু করা যায়!

Note 2: আমরা জানি ইয়াযিদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা সিঙ্গেল-লাইনে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সিঙ্গেল-লাইন ধরে এগুলে ইয়াযিদের কর্মকাণ্ড পদে পদে প্রশ্নের সম্মুখিন হবে। তাই এদিক সেদিক ঘুরাফেরা করা ছাড়া গতি নেই। বাই দ্য ওয়ে, কন্সটান্টিনোপোলে মুসলমানদের প্রথম অভিযানে ইয়াযিদ ছিলেন কিনা, সেটি নিয়ে মুহাদ্দিছীন এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে প্রচুর মতপার্থক্য রয়েছে। বিপুল সংখ্যক আলিম-উলামার মতে, প্রথম অভিযানে ইয়াযিদ ছিলেন না।

আর, আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) যে অভিযানে মৃত্যুবরণ করেছিলেন (কন্সটান্টিনোপোলে দ্বিতীয় অভিযান), ইয়াযিদ ছিলেন সে অভিযানের সেনাপতি। তাই তিনি জানাযা পড়িয়েছেন। ইসলামি সংস্কৃতিতে খলিফা, আমির বা সেনাপতিরাই নামাজের ইমামতি করে থাকেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পেছনে অনেক সাহাবি নামাজ আদায় করেছেন। তাতে কি হাজ্জাজের মর্যাদা সাহাবিদের সমপরিমাণ হয়ে গেছে?

Note 3: তাবেয়ীদের যুগে জন্ম হওয়া মানেই যদি কেউ তাবেয়ী হয়ে যান, তাহলে তো উসমান (রা.)-কে হত্যা করতে আসা খারেজিরাও তাবেয়ী।

ইয়াযিদ ফকীহ ছিলেন, এ দাবী আমি অনেকবার শুনেছি। ফিকহী মাসয়ালা জানা থাকলেই কি জান্নাতের সার্টিফিকেট ইস্যু হয়ে যায়? ইয়াযিদ যদি এতো ন্যায়পরায়ণ/বিশ্বস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে মুসলিম উম্মাহ'র একটি হাদীসের কিতাবে ইয়াযিদের রেফারেন্সে একটি হাদীস দেখিয়ে দিন। মু'আবিয়া (রা.) প্রায় ২০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সাহাবি-পুত্র এবং শাসক-পুত্র হিসেবে ইয়াযিদ নিশ্চয়ই পিতার কাছ থেকে কিছু না কিছু জ্ঞান হাসিল করেছিলেন। কেন একজন মুহাদ্দিছ ইয়াযিদের রেফারেন্সে একটি হাদীসও নকল করেননি? সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক, উমর ফারুক, উসমান ও আলী (রা.) তথা পূর্বেকার সব খলিফাদের সন্তানদের রেফারেন্সে আমাদের হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহে অগনিত সংখ্যক হাদীস/আছার/খবর নকল করা হয়েছে। তাহলে উম্মতে মুহাম্মাদির সব মুহাদ্দিছ কেন ইয়াযিদের বেলায় পিছিয়ে গেলেন? কেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলে দিয়েছিলেন, ইয়াযিদের কাছ থেকে কোনো বর্ণনা গ্রহণ করা যাবেনা?

Note 4: তর্কসাপেক্ষে, কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করার 'সরাসরি নির্দেশ' যদি ইয়াযিদের পক্ষ থেকে নাও আসে, তবুও তো ইয়াযিদ নির্দোষী হয়ে যাননা। তিনি যখন শাসক ছিলেন, তখন দায়-দায়িত্বের বাক্স গিয়ে তার কাছেই পৌঁছাবে। হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু ৪ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী তো পাঠিয়েছিলেন, কঠোরভাবে পথ আটকে দেয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন এবং কারবালায় ইমামকে হত্যাকারী একজন সৈন্যেরও বিচার করেননি। তাতে কী প্রমাণিত হয়?

আর, ইয়াযিদ কেঁদেছিলেন বলে এতো গলে যাওয়ার কিছু তো দেখিনা। কাঁদলে কেঁদেছেন, তাতে কী হয়েছে? পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন কারণে-অকারণে কাঁদে। সুতরাং ইয়াযিদের কান্নায় এতো গলে যাওয়ার কিছু নেই।

Note 5: আমরা কিছুই বলব না। সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম- আসলে সুন্নাতের সবচেয়ে মান্যবর দুটি হাদীসের কিতাব খুলে দেখুন মদীনা তাইয়্যিবা এবং মদীনাবাসীর সাথে ন্যুনতম খারাপ আচরণ করার শাস্তি কতোটুকু।

হাফিয ইবনুল জাওযী "তাযকিরাতুল খাওয়াস" কিতাবে ইয়াযিদের শাসনামল সম্পর্কে অসাধারণ একটি উক্তি করেছেন। বলেছেন-

ما رأيكم في رجل حكم ثلاث سنين : قتل في الأولى الحسين بن علي، وفي الثانية أرعب المدينة وأباحها لجيشه، وفي السنة الثالثة ضرب بيت الله بالمنجنيق

অর্থঃ এমন ব্যক্তির শাসন সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা, যার শাসনামল ছিল তিন বছর। প্রথম বছরে হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বছরে মদীনায় ত্রাস সৃষ্টি করা করেছে এবং তার সৈন্যদের জন্য মদীনাকে হালাল করে দিয়েছে। তৃতীয় বছর বাইতুল্লাহ শরীফে আগুনের গোলা দিয়ে আক্রমণ করেছে।

আমাদের আদর্শ ও সংস্কৃতিতে কাউকে লা'নত করার নিয়ম নেই, তাই ইয়াযিদ কয়েকশ কোটি মুসলমানের লা'নত থেকে বেঁচে গেছেন। এটিই যথেষ্ট।