ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিলেখা পাঠানোর নিয়মাবলীযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

The Philosophy of Seerah (সীরাতের দর্শন)

বাইতুল্লাহ শরীফের পাশে অবস্থিত ক্ষুদ্রকায় একটি পাথুরে পাহাড়। নাম 'ছাফা'। ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে পাহাড়টির শীর্ষদেশে ওঠে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি। মক্কার হাজার-দেড় হাজার অধিবাসীর মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তাঁকে চিনেনা।

ইসলামের কন্ঠ
The Philosophy of Seerah (সীরাতের দর্শন)

বাইতুল্লাহ শরীফের পাশে অবস্থিত ক্ষুদ্রকায় একটি পাথুরে পাহাড়। নাম 'ছাফা'। ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে পাহাড়টির শীর্ষদেশে ওঠে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি। মক্কার হাজার-দেড় হাজার অধিবাসীর মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তাঁকে চিনেনা। তিনি মক্কার কিংবদন্তীতূল্য নেতা আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (ﷺ)। মক্কাবাসী জানে, দণ্ডায়মান ব্যক্তি সত্যবাদী, বিশ্বস্ত। আজ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি নির্দেশ এসেছে-

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ

হে চাদরাবৃত ব্যক্তি, উঠুন এবং সতর্ক করুন। এবং আপনার রবের মাহাত্ম্য বর্ণনা করুন। [সুরা মুদ্দাচ্ছির : ১-৩]

বার্তাটি নতুন নয়। ইবরাহিম ও ইসমাঈল (عليهما السلام)-এর হাত ধরে এ বার্তা ইতোপূর্বেও আরবের মরুভূমিকে আন্দোলিত করেছিল। কিন্তু অকৃতজ্ঞ আরবরা সে বার্তাটিকে কবেই কবর দিয়েছে! তাওহীদের সুমহান সৌধরূপে মক্কাভূমিতে স্থাপিত হওয়া বাইতুল্লাহ শরীফ আজ বারোভূতের আড্ডাখানা।

৬১০ খ্রিস্টাব্দের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে মক্কাবাসীকে চুড়ান্ত-চির সত্যের প্রতি আহ্বান করার মাধ্যমে সূচিত হওয়া এ মহিমান্বিত আন্দোলন পরবর্তী দু'দশকে মহীরুহ হয়ে দাঁড়ালো। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে (৮ম হিজরি) ১০ হাজার সাহাবা নিয়ে বিজয়ীর পতাকা হাতে মক্কা মুকাররামায় প্রবেশ করলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় এক বিজয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পর আল্লাহর নবী (ﷺ) সেই ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে উপবিষ্ট হয়ে মক্কাবাসীর বাই'আত গ্রহণ করলেন, ২১ বছর পূর্বে যে ছাফা পাহাড়ের ওপর দণ্ডায়মান হয়ে তিনি দীনের দাওয়াত শুরু করেছিলেন। সেদিন ছিল দাওয়াতের সূচনালগ্ন, তিনি ছিলেন দণ্ডায়মান। আজ সমাপ্তিলগ্ন, তাই তিনি উপবিষ্ট। প্রকৃত ও রূপক- উভয় অর্থে জাযিরাতুল আরবে প্রতিষ্ঠিত হলো আল্লাহর দীন।

পার্থিব জীবনের পরবর্তী দু'বছর জাযিরাতুল আরবের বাইরে ইসলামকে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা আল্লাহর নবী (ﷺ) নিজ হাতেই সূচনা করে গিয়েছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের ২৪ বছরের মধ্যে নববী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খলিফাগণ প্রায় অর্ধপৃথিবীতে দীনের পতাকা উড্ডীন করলেন। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই গেল...।

কুরআনুল কারীমের ভাষ্যমতে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন হয়েছিল সমগ্র মানবজাতির কাছে তাওহীদের বার্তা পৌঁছে দেয়া (تبليغ دين) এবং পৃথিবীতে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা (إقامة دين) করার লক্ষ্যে। সে লক্ষ্য তো আজও পূর্ণাঙ্গতা পেলনা! 'ধর্ম' হিসেবে ইসলাম কারও অজানা নয়। তবে 'দীন' হিসেবে ইসলাম কতোটুকু প্রতিষ্ঠিত? তাহলে কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার পেছনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলার উদ্দেশ্য অপূর্ণাঙ্গ থেকে গেল? সময় এসেছে এ প্রশ্নের জবাব তালাশ করার। সমগ্র মানবজাতির কাছে কি আল্লাহর দীন পৌঁছেছে? না পৌঁছালে কেন পৌঁছায়নি? পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব কাদের ওপর? পৌঁছে দেয়ার পদ্ধতি কী? কতোটুকু প্রতিষ্ঠা হলে দীনকে আমরা 'দীন' বলতে পারব?

পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রেরণের পেছনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা ২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন।

১. সমগ্র মানব জাতির কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়া। ইরশাদ করা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ

হে রাসূল, মানুষের কাছে পৌঁছে দিন, যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। [সুরা মায়েদা : ৬৭]

২. আল্লাহর দীনকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা। ইরশাদ করা হয়েছে-

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ

তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্ম/মতের ওপর জয়যুক্ত করেন। [সুরা ছফ : ২৮]

প্রথম লক্ষ্যকে আমরা বলতে পারি تعريف (পরিচয়) এবং দ্বিতীয় লক্ষ্যকে تشريع (আইন প্রণয়ন)।

আবার পবিত্র কুরআনের দিকে তাকিয়ে দেখি, উক্ত লক্ষ্যদ্বয়ে উপনিত হওয়ার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর নবীকে কিছু কর্তব্য/করনীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বলা হয়েছে-

يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَة

রাজ্যাধিপতি, পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমন্ডলে। তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। [সুরা জুম'আ : ১-২]

উক্ত আয়াত থেকে ৪টি কর্তব্য/করনীয় নির্গত হয়। যথাক্রমে-

১. সৃষ্টির সামনে স্রষ্টার আয়াত/নিদর্শনসমূহ পাঠ করা। আরও সহজভাবে বললে, পবিত্র কুরআনের আলো ছড়িয়ে দেয়া, যেন এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর পরিচয় লাভ করে।

২. মানুষের আত্মীক পরিশুদ্ধি ঘটানো।

৩. কিতাব তথা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা (শরী'আহ) সম্পর্কে মানুষকে অবগত করা, যেন 'আল্লাহর খলিফা' হিসেবে মানবজাতি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

৪. মানুষকে হিকমত তথা প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়া, যাতে উম্মত কখনও অবিবেচক-মূর্খের মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে। প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানের চূড়ান্ত ধাপ, যেখানে পৌঁছালে জ্ঞান 'উপকার' দিতে শুরু করে।

উপরিউক্ত আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, আল্লাহ তাঁর রাসূলের ওপর অর্পিত ৪টি কর্তব্যের সাথে নিজের ৪টি গুণবাচক নামের অপরূপ সম্মিলন ঘটিয়েছেন। প্রথম আয়াতে আল্লাহর ৪টি সিফাত যথাক্রমে الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ উল্লেখ করা হয়েছে। এবার যদি দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত ৪টি দায়িত্বের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখি, ক্রমানুসারে প্রতিটি সিফাত হচ্ছে একেকটি দায়িত্বের مصدر বা উৎসস্থল।

১. الْمَلِكِ অর্থ রাজ্যাধিপতি। একজন রাজার কৃতিত্ব/নিদর্শনাবলী সে রাজার পরিচয় বহন করে। তাই মহামহিয়ান রাজ্যাধিপতি আল্লাহ তাঁর নিদর্শন তথা পবিত্র কুরআনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মানুষ এর মাধ্যমে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়।

২. الْقُدُّوسِ অর্থ পবিত্র। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের অন্তরকে যাবতীয় কলুষ ও কালিমা থেকে পবিত্র করা।

৩. الْعَزِيزِ অর্থ পরাক্রমশালী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তৃতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর কিতাব তথা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শরী'আহকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা। কারণ, চূড়ান্ত ও চিরসত্য হুকুম কেবল তাঁর, যিনি মহাপরাক্রমশালী।

৪. الْحَكِيمِ অর্থ প্রজ্ঞাময়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চতুর্থ দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষকে প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়া।

তাছাড়া, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় গুণদুটি পাশাপাশি উচ্চারণ করার আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে যে, কেবল পরাক্রমশালী হলেই কারও আদেশ বাস্তবায়ন করা যায়না, যদিনা তিনি প্রজ্ঞাময় হন। কারণ প্রজ্ঞাবিহীন ক্ষমতা সর্বদা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আর, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা একইসাথে মহাপরাক্রমশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।

উপরিউক্ত ২টি লক্ষ্য ও ৪টি কর্তব্যকে সফলভাবে সম্পন্ন করার নিমিত্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর রিসালাতের জীবনে কিছু সুসংহত কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন।

রিসালাতের জীবনে গৃহীত কর্মসূচী আলোচনা করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যক্তি জীবনে আলোকপাত করা আবশ্যক। সম্ভব নয় জেনেও আমরা 'ব্যক্তি' হিসেবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনদর্শন অঙ্কন করার চেষ্টা করেছি, ওয়া বিল্লাহিত তাউফিক।

১. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন ছিল প্রিয়জন হারানো জীবন। চোখ মেলে নিজের বাবাকে দেখেননি। ৬ বছর বয়সে হারিয়েছেন মমতাময়ী মা-কে, ৮ বছর বয়সে অভিভাবক দাদাকে। শিয়াবে আবু তালিবে ৩ বছর বয়কটের পর সামান্য সময়ের ব্যবধানে হারিয়েছেন গৃহিণী-বন্ধু খাদিজা এবং অভিভাবক চাচা আবু তালিবকে। উহুদ যুদ্ধে চাচা হামযাকে, মু'তার যুদ্ধে ভাই জাফরকে। ৭ সন্তানের মধ্যে ৬ জনকে নিজের জীবদ্দশায় নিজ হাতে কবরে শায়িত করেছেন আমাদের নবী। হারানোর এ দীর্ঘ তালিকায় সর্বশেষ সংযুক্তি ছিল কারবালায় প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হুসাইনের শাহাদাত, যে সংবাদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক আগে থেকেই জানতেন। জিবরাইল আ. বড় সত্য কথা বলেছেন-

يا محمد عش ما شئت فإنك ميت وأحبب من شئت فإنك مفارقه...

হে মুহাম্মদ (ﷺ), যেভাবে ইচ্ছা জীবন যাপন করুন, আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। যাকে ইচ্ছা ভালোবাসুন, আপনি তার থেকে পৃথক হবেন...। [মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ৭৯৯১]

২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন ছিল সদা দারিদ্র্যের চাদরে মুড়ানো। যার ঘরে লালিত হয়েছেন, সে চাচা আবু তালিব ছিলেন অতি দরিদ্র ব্যক্তি। বাল্যবয়সে আমাদের নবী আবু তালিবের মেষ চরিয়েছেন। স্ত্রী খাদিজা রা.-এর হাত ধরে সম্পদ আসলেও সে সম্পদ বেশিদিন টিকেনি। দু'হাত ভরে দান করে দিয়েছেন উম্মতের কল্যাণে। পরবর্তী স্ত্রীদেরকে জীবনযাপনের ন্যুনতম রসদের জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। আয়েশা রা. বলেছেন- মাসের পর মাস আমাদের ঘরে চুলা জ্বলেনি। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করার সময় আমাদের নবী পেটে পাথর বেঁধে খুন্তি হাতে নিয়েছিলেন, যেন ক্ষুধার তাড়নায় ক্লান্ত শরীর মাটিয়ে পড়ে না যায়!

৭ম হিজরির পর যখন সম্পদ আসতে শুরু করল, তখনও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের জন্য কিছুই বেছে নেননি। কন্যা ফাতিমা এসেছিলেন একটি চাকরের সন্ধানে। প্রাণপ্রিয় কন্যাকে বলেছেন- মা, এসব পার্থিব সুখ আমাদের জন্য নয়। ইন্তেকালের সময় একটি খচ্চর, একটি আটা পিষার চাকি ও পানি খাওয়ার একটি মশক ব্যতীত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা।

৩. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রিসালাতের প্রথমাংশ অর্থাৎ মাক্কী জীবন ছিল নিপিড়িত-বঞ্চিত মানুষের জীবন। দিনের পর দিন মক্কাবাসী তাঁকে অবজ্ঞা করেছে। চোখের সামনে কতো সুমাইয়া শহীদ হয়েছেন, কতো বিলালের রক্ত ঝরেছে, কতো খাব্বাবের গলিত মাংসে হিংসুকের আগুন ঠাণ্ডা হয়েছে, কতো আম্মারের রোনাজারিতে মক্কা প্রকম্পিত হয়েছে, কতো সুহাইবের মালামাল লুট হয়েছে! তবুও আল্লাহ প্রতিবাদ করার অনুমতি দেননি। তিনি নামাজে দাঁড়িয়েছেন, পেছন থেকে চাদর দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেজদায় গিয়েছেন, তো মরা উটের পঁচা নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। একটু শান্তির আশায় যে তায়েফে গিয়েছিলেন, সে তায়েফও তাঁর রক্তের সাক্ষী হয়েছিল। উহুদের ময়দানে মাথা ফেটেছে, দাঁত ভেঙ্গেছে। ইহুদিরা বারবার বিষপ্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা করেছে। ইন্তেকালের সময় যে রোগযন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছেন, চিন্তা করলেই হৃদয় শূন্য হয়ে আসে। আমি-আপনি যে কষ্ট, যে যাতনা, যে পীড়ন কল্পনাও করতে পারিনা, আমাদের নবী তারচেয়ে অনেক বেশি পীড়ন সহ্য করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দার সংগ্রামী জীবনের চিত্র এখানেই শেষ নয়, শেষ করা সম্ভবও নয়। প্রশ্ন আসে, এ ত্যাগ তিনি কেন স্বীকার করেছেন? কাদের জন্য করেছেন?

নববী জীবনের ৩টি সংগ্রামী দিক (গত পর্বে) উল্লেখপূর্বক আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর নবীকে মানব জীবনের করুণ বাস্তবতার সাক্ষী বানিয়েছেন, যেন তিনি (ﷺ) রিসালাতের কঠিন দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে প্রস্তুত হন। যেমন-

১. প্রিয়জন হারানোর শোক থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিখেছেন ইয়াতিম-অনাথের বিয়োগব্যাথা। আল্লাহ নিজেই জানিয়ে দিচ্ছেন-

أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَىٰ

তিনি কি আপনাকে ইয়াতিমরূপে পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। [সুরা দ্বোহা : ৬]

২. দারিদ্র্য থেকে শিখেছেন দরিদ্রদের জীবন সংগ্রাম। যেভাবে আল্লাহ বলেছেন-

وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَىٰ

তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন। [সুরা দ্বোহা : ৮]

শুধু তাই নয়। জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা শিখেছেন, তা কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন, সেটিও আল্লাহ বলে দিয়েছেন-

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ

সুতরাং আপনি ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। যাঞ্চাকারীকে (ভিক্ষুক) ধমক দেবেন না। [সুরা দ্বোহা : ৯-১০]

৩. বাল্যবয়সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মেষ চরিয়েছেন। অতি স্বাভাবিক এ জাগতিক কাজের মধ্যেও কতো মাহাত্ম্যপূর্ণ শিক্ষা নিয়োজিত, তা আল্লাহর নবী (ﷺ) নিজে বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

ما بعث الله نبيا إلا رعى الغنم فقال أصحابه وأنت فقال نعم كنت أرعاها على قراريط لأهل مكة

আল্লাহ এমন কোনো নবীকে পাঠাননি, যিনি মেষচারক ছিলেন না। তখন সাহাবিরা বললেন- আপনিও? তিনি (ﷺ) জবাব দিলেন- হ্যাঁ, আমি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর মেষ চরিয়েছি। [সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইজারাহ, ২১৪৩]

ইমাম আসকালানী মেষচারণের কতিপয় হিকমত বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মেষপালকে একত্রিত করে রাখা, একা একা কোনো মেষকে ছেড়ে না দেয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে দলে ফিরিয়ে আনা, শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচানো এবং সর্বোপরি মেষচারণের মাধ্যমে বিনয় ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেয়া। একটি উম্মাহকে শক্ত হাতে ধরে রাখার অনুশীলন হয়ে যায় মেষচারণের মাধ্যমে।

৪. বিবাহের পূর্বে খাদিজা রা.-এর ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়ার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিখেছেন হালাল পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করার পদ্ধতি।

৫. সম্পদের দ্বার খুলে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীকে দান-খয়রাতের অনুশীলন করিয়েছেন। প্রথমবার ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খাদিজার কাছে এসেছিলেন, তখন খাদিজা রা. নবীর চরিত্রের সাক্ষী দিয়েছিলেন এভাবে-

فوالله لا يخزيك الله أبدا والله إنك لتصل الرحم وتحمل الكل وتكسب المعدوم وتقري الضيف وتعين على نوائب الحق

আল্লাহর কসম, কখনও না। আল্লাহ কখনও আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সহযোগিতা করেন। [সহীহ বুখারী, কিতাবু বাদঈল ওহী, ৩]

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল।

৬. সম্মানিত সহধর্মিণীগণ ও প্রিয় কন্যা ফাতিমা রা. প্রমুখের দরিদ্রোচিত জীবন ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য আরেকটি বড় শিক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবী (ﷺ) ও আহলে বায়েতকে দুনিয়া বিমুখতা এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ তাওয়াক্কুলের অনুশীলন করিয়েছিলেন।

৭. সম্ভবত, সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি এসেছিল অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হওয়ার মাধ্যমে, ঘাম-রক্ত-অশ্রু ঝরার মাধ্যমে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর নবীকে এবং নবীর মাধ্যমে উম্মতকে এ শিক্ষাটি দিয়েছেন যে, দীনের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর উম্মতকে মাঠে নেমেই আঞ্জাম দিতে হবে। মু'জিযার মাধ্যমে বা ফুঁৎকার দিয়ে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হবেওনা।

মাক্কী জীবনে গৃহীত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাওয়াতি কর্মসূচী-

১. আল্লাহর কিতাব তথা আল-কুরআনুল কারীমকে হেদায়াতের সিলেবাসস্বরূপ গ্রহণ করা।

পবিত্র কুরআন হচ্ছে সে রজ্জু, যার দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরো উম্মতকে একিভুত করেছেন। সে জ্যোতি, যার দ্বারা তিনি উম্মতের হৃদয় আলোকিত করেছেন। তিনি নিজেকে কুরআনের জীবন্ত উদাহরণ বানিয়েছেন (كان خلقه القرآن) এবং ইন্তেকালের সময় কুরআনকেই তাঁর 'রুহানী খলিফা' হিসেবে উম্মতের জন্য রেখে গিয়েছেন। যায়েদ ইবনে আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবনের শেষদিকে খুতবা দেয়ার সময় বলেছেন-

أنا تارك فيكم ثقلين أولهما كتاب الله فيه الهدى والنور فخذوا بكتاب الله واستمسكوا به فحث على كتاب الله ورغب فيه

আমি তোমাদের কাছে দুটো ভারী/দামী জিনিস রেখে যাচ্ছি। তন্মধ্যে প্রথমটি হলো আল্লাহর কিতাব, যাতে রয়েছে হেদায়াত ও নূর। অতএব তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ করো এবং শক্তভাবে আঁকড়ে রাখো। অতঃপর তিনি আল্লাহর কিতাবের প্রতি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিলেন। [সহীহ মুসলিম, কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪০৮]

২. সমাজের প্রতিটি স্তরে তাওহীদের বার্তা পৌঁছে দেয়া।

মাক্কী জীবনের ১৩টি বছর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করেছেন, তা ছিল Street Preaching. অর্থাৎ মানুষের দ্বারে দ্বারে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া। কখনো পুরো মক্কাবাসীকে একত্রে দাওয়াত দিয়েছেন, কখনো একটি দল বা গোত্রকে, কখনো কেবল এক ব্যক্তিকে। সম্ভব-অসম্ভব, স্বপ্নিল-বাস্তবিক কোনো পন্থাই আল্লাহর নবী (ﷺ) বাদ দেননি। তাঁর দাওয়াতের মূলনীতি ছিল একনিষ্ঠতা ও অবিরাম প্রচেষ্টা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটিবারও এ কথা ভাবেননি যে, একদিনের আহ্বানেই সারা দুনিয়ার মানুষ কালিমা তাওহীদের ছায়াতলে চলে আসবে। তিনি জানতেন, পথ অনেক লম্বা এবং কন্টকময়।

৩. 'ইয়াকীনওয়ালা' ঈমানের বলে বলিয়ান একটি জামা'আত তৈরি করা।

এ দাওয়াতের প্রাথমিক লক্ষ্য আইনপ্রণয়ন বা রাষ্ট্রগঠন ছিলনা; লক্ষ্য ছিল একটি জামা'আত গঠন করা। তখনও উম্মাহ'র ধারণাটি প্রণিধানযোগ্য ছিলনা। উম্মাহ অনেক পরের বিষয়। আপাতত কিছু মানুষ প্রয়োজন। রক্তে-মাংসে গড়া, ভুলে-শুদ্ধে মিলিয়ে, মোটায়-পাতলায়, লম্বায়-খাটোয়, সাদায়-কালোয় সম্মিলিত কিছু মানুষ, যারা এটুকু পণ করবে, জীবনে-মরণে আমরা আপনার সাথে থাকব ইয়া রাসূলাল্লাহ। ১৩ বছরের অক্লান্ত রক্তস্নাত পরিশ্রমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাত্র শ-দু'শ মানুষ জোগাড় করতে পেরেছিলেন। এ শ-দু'শ মানুষই পৃথিবীতে দীনের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন।

ইয়াকীনওয়ালা ঈমান বলতে বুঝিয়েছি, যাদের ঈমান ইয়াকীনের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দীনের সূর্য উদিত করতে এ ধরণের মানুষই প্রয়োজন। নইলে পৃথিবীতে 'চার কালিমা মুখস্থ করা মুসলমানের' অভাব নেই।

৪. তাযকিয়ায়ে নাফস-এর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া।

ওপরে 'ইয়াকীনওয়ালা ঈমানদার' বলতে যাদেরকে বুঝিয়েছি, তাঁদেরকে তৈরি করতেই প্রয়োজন ছিল তাযকিয়ায়ে নাফস-এর কার্যক্রম। মাক্কী জীবনে মুসলমানদের সামনে ফরজ ইবাদত বলতে প্রায় কিছুই ছিলনা। ছিল কেবল আত্মীক পরিশুদ্ধি ও চারিত্রিক উন্নতির প্রয়াস। যার অন্তরে অহংকার বাসা বেধেছে, যে হৃদয় হিংসায় জ্বলেপুড়ে, যার চিন্তাজুড়ে লোভের সম্রাজ্য, যে চোখ শুধু প্রতারণা করতে চায়, যে কান কেবল গীবত শুনে, যে মুখ অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, যে হাত অপরের ক্ষতি করতে চায়, যে পা দুর্বলকে পিষ্ঠ করে, যে ঈমানে ঘোর সংশয়- এরূপ মানুষের কাফেলা নিয়ে তো দীন কায়েম করা যায়না। এসব মানবিক দুর্বলতা থেকে হৃদয়কে পরিষ্কার করার কার্যক্রম হচ্ছে তাযকিয়ায়ে নাফস।

৫. অবর্ণনীয় নিপিড়নের মুখেও তাওহীদের রজ্জু ছেড়ে না দেয়া।

মাক্কী জীবনে যে নির্যাতন-নিপিড়ন আল্লাহর নবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবিরা সহ্য করেছিলেন, তার সিকিভাগ চিত্রায়ন করাও সম্ভব নয়। গালিগালাজ, অপমান, অবজ্ঞা, অপবাদ, অবরোধ, নারী ও সম্পদের লোভ দেখানো, সাহাবিদেরকে অত্যাচার করার মাধ্যমে নবীকে মানসিকভাবে দুর্বল করা এবং সর্বশেষ তাঁর নিজের ওপর শারীরিক আক্রমণ- এক এক করে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। তবুও তাওহীদের রজ্জু শক্তহাতে আঁকড়ে ধরতে হবে- এ ছিল রবের নির্দেশ।

৬. পদতলে শক্ত ভিত্তি স্থাপনের পূর্বে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত না হওয়া।

মুশরিকদের সংখ্যা হাজার-দেড় হাজার হলে মুসলিমদের সংখ্যাও তো শ-দু'শ ছিল। ইটের বিনিময়ে পাটকেল ছোড়া যেতো। কিন্তু অনুমতি ছিলনা। চাই তোমার মাথা কেটে টুকরো করে ফেলুক, তবুও নড়তে পারবেনা- এ ছিল রবের নির্দেশ।

৭. সমাজের নানারূপ মানুষের মানসিকতা বুঝে দাওয়াতের কৌশল প্রণয়ন করা।

সব মানুষ সমান নয়, সবার মানসিকতাও এক নয়। এমনও ছিলেন, যাদেরকে সে অর্থে দাওয়াত দেয়ারই প্রয়োজন হয়নি। এমনও ছিলেন, যারা দাওয়াত কবুল না করলেও শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পাশে ছিলেন। এমনও ছিলেন, যাদের রক্তের মাঝেও বিষ মিশ্রিত। সুতরাং দাওয়াতের কৌশল ও পদ্ধতিকে সর্বদা অভিন্ন রেখে এগিয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নত ছিলনা।

কর্মসূচী এখানেই শেষ নয়।

মাক্কী জীবনের শেষদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বুকভরা আশা নিয়ে পাহাড়ে-শহর তায়েফে গমন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, রিসালাতের জন্য নতুন একটি ঠিকানা তালাশ করা। তায়েফ তাঁর নতুন ঠিকানা তো হলোই না, বরং তায়েফের মাটিতেই প্রথমবার আল্লাহর নবীর জীবন-সংহারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। পাথরের আঘাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন-তিনবার অচেতন হয়েছিলেন। শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত প্রবাহিত হয়ে পরিহিত জুতাকে পায়ের সাথে আটকে দিয়েছিল। কোনোমতে নিজেকে টানতে টানতে একটি বাগানের ছায়ায় উপবিষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাত ওঠিয়েছিলেন- পরম করুণাময়, আমি তোমার কাছে আমার নিজের দুর্বলতা পেশ করছি। তুমি ওদেরকে ক্ষমা করে দাও। [ইমাম তাবরানী প্রণীত আল-মু'জামুল কাবীর গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসের মর্মার্থ]

'ক্ষমা মহৎ গুণ' এতোদিন শুনেই আসছি। আমাদের নবী (ﷺ) তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন।

তায়েফবাসীকে ক্ষমা করার আরেকটি কারণ হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আশা করেছিলেন, একদিন তায়েফের যমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হবে। বিলম্ব হতে পারে, তবে হবে ইনশাআল্লাহ। আজ যদি তায়েফ ধ্বংস হয়ে যায়, তবে কাল এ অন্ধকারে আল্লাহর নূর প্রজ্জ্বলিত হওয়ার সম্ভাবনাটুকু রদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত কষ্টের তীব্রতায়ও তিনি তাঁর মূল দায়িত্বকে সামান্যতম চোখের আড়াল করেননি।

'নিষ্ঠা মহৎ গুণ' এতোদিন শুনেই আসছি। আমাদের নবী (ﷺ) তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন।

এরপর রবের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসলো, মক্কা ছেড়ে দাও। তবে একেবারে যে চলে যাচ্ছো তা নয়। বরং-

إِنَّ الَّذِي فَرَضَ عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لَرَادُّكَ إِلَىٰ مَعَادٍ

যিনি আপনার প্রতি কুরআনের বিধান দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনবেন। [সুরা কাসাস : ৮৫]

ইয়া রাসূলাল্লাহ, আজ যাদের নির্যাতনের মুখে আপনি মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, কাল তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে আপনি আপনার মাতৃভূমিতে প্রবেশ করবেন। আল্লাহর দীন বিজয়ী হবেই হবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুরো জীবন একটি মহান বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। একটি জাতির অন্তঃস্থ ও বহিঃস্থ যে আমূল পরিবর্তন তিনি সাধিত করেছিলেন, মানব ইতিহাসে তার নজির নেই। এ মহান বিপ্লবের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল হিজরত। তবে, বেশিরভাগ মানুষ হিজরতের তত্ত্ব-দর্শন বুঝতে পারেনি।

ইসলাম ও মুহাম্মদ (ﷺ) সম্বন্ধে পশ্চিমাদের (ইহুদি-খ্রিস্টান) মনে একটি ধারণা শেকড় গেড়েছে। তা হলো- "নবী হিসেবে মুহাম্মদ (ﷺ) ব্যর্থ, কিন্তু রাজনীতিবিদ (Statesman) হিসেবে সফল।"

তাদের ধারণাকে ফু দিয়ে উড়িয়ে না দিয়ে একবার ভেবে দেখা উচিৎ যে, কেন বা কিসের ভিত্তিতে এরূপ উদ্ভট ধারণার জন্ম হলো? আমাদের মনে হয়, খ্রিস্টানরা তাদের নবী যীশু খ্রিস্টকে (আমরা যাকে ঈসা ইবনে মারইয়াম বলে সম্বোধন করি) সামনে রেখে আমাদের নবীকে মূল্যায়ন করেছে।

নবী ঈসা (عليه السلام) তেত্রিশ বছর পৃথিবীতে ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ের দাওয়াতে তিনি কেবল ১২ জন মানুষকে দীনের পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে একজন (জুডাস) পরবর্তীতে তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। খ্রিস্টান সূত্রমতে, ইহুদিদের চূড়ান্ত বিরোধিতার শিকার হয়ে ঈসা (عليه السلام) ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। মুসলিম সূত্রানুযায়ী, আল্লাহ তাঁকে জীবিত অবস্থায় উঠিয়ে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা তো দুরের কথা, ঈসা (عليه السلام) দাওয়াতের ক্ষেত্রেও বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেননি।

এবার ঈসা (عليه السلام)-এর জীবনকে মাপকাঠি ধরে যদি মুহাম্মদ (ﷺ)-এর জীবনকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যায়, মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মাক্কী জীবন ঈসা (عليه السلام)-এর জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; মাদানী জীবন নয়। মাক্কী জীবনে মুহাম্মদ (ﷺ) ঠিক সেভাবে মুশরিকদের নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন, যেভাবে ঈসা (عليه السلام) তাঁর পুরো জীবনে ইহুদিদের নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। যেভাবে ঈসা (عليه السلام) পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছিলেন, মুহাম্মদ (ﷺ) ও সেভাবে মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এজন্য ইহুদি-খ্রিস্টানরা এ ধারণা পোষণ করে যে, "মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মাক্কী জীবন ছিল নবুয়্যাতি জীবন। নবুয়্যাতের দায়িত্বে ব্যর্থ হয়ে তিনি মক্কা থেকে মদীনায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর মাদানী জীবন ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন, যেখানে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।"

আমরা জানি, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মূলত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুরো জীবন মিলিয়ে একটি বিপ্লব। মাক্কী জীবনে যেভাবে তিনি নবী ও রাসূল ছিলেন, মাদানী জীবনেও ছিলেন। তাঁর রিসালাতের উদ্দেশ্য ছিল, সমগ্র মানব জাতির কাছে আল্লাহর দীন পৌঁছে দেয়া এবং পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যেই তিনি এগিয়েছেন।

এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উদাহরণ হলো, খ্যাতিমান মনিষী Michael H. Hart রচিত The 100 নামক বই। এ বইয়ে লেখক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের তালিকা প্রণয়ন করেছেন এবং তালিকার ১ম নামটি হচ্ছে মুহাম্মদ (ﷺ)। লেখক এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- "মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সর্বাগ্রে বেছে নেয়ার কারণ হলো, তিনিই মানব ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় এবং সেক্যুলার উভয় ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে সফল (Supremely successful) ছিলেন।"

প্রশ্ন আসে, সেক্যুলার ক্ষেত্র আবার কোনটি? জবাব হলো, ইহুদি-খ্রিস্টানসহ পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে ধর্ম হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তিগত ইবাদত-উপাসনা ও প্রথা-পার্বণের সমষ্টি। আর, বাকি সমস্ত জীবন হচ্ছে সেক্যুলার জীবন। প্রক্ষান্তরে ইসলামের ফিলোসফি হচ্ছে, ইসলাম আল্লাহর মনোনিত দীন। না এটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয়, না এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার দাবী করে। মূলত, ইসলামের সাথে অন্য ধর্ম/মত/তন্ত্রের দ্বন্ধের জায়গা হচ্ছে এখানেই। ইসলামের ধর্মবিশ্বাস ও ইবাদত নিয়ে কারও কোনো সমস্যা নেই। এমনকি, আমেরিকায় গিয়ে রোজা রাখলে এক-আধদিন হোয়াইট হাউজে ইফতার করার সুযোগ পেয়ে যাবেন। দ্বন্ধ হচ্ছে ইসলাম নামক দীনের সাথে। যাদের কাছে ইসলাম দীন নয়; বরং কেবল ধর্মবিশ্বাস, তারা কিভাবে হিজরতের ফিলোসফি বুঝতে পারবে?

এবার 'দীন' হিসেবে ইসলামকে সামনে রেখে আমরা যদি হিজরতকে মূল্যায়ন করি, তাহলে বুঝতে পারি-

হিজরত মানে নবুয়্যাতের সমাপ্তি নয়

হিজরত মানে পালিয়ে যাওয়া নয়

হিজরত মানে ব্যর্থতা নয়

হিজরত মানে ধর্ম ছেড়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করা নয়;

হিজরত হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ-পরিপূর্ণ বিপ্লবের দ্বিতীয় অধ্যায়। মাক্কী জীবনের দাওয়াত ও সংযমের ফলস্রুতিতে মদীনা তাইয়্যিবা ও মাদানী জীবন ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলার একটি উপহার। এ তত্ত্বটি পবিত্র কুরআনে খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-

فَإِن يَكْفُرْ بِهَا هَٰؤُلَاءِ فَقَدْ وَكَّلْنَا بِهَا قَوْمًا لَّيْسُوا بِهَا بِكَافِرِينَ

অতএব, যদি এরা আপনার নবুয়্যাত অস্বীকার করে, তবে আমরা এর জন্য এমন সম্প্রদায় নির্দিষ্ট করেছি, যারা এতে অবিশ্বাসী হবে না। [সুরা আন'আম : ৮৯]

এখানে বলা হয়েছে, মক্কাবাসী যদি অস্বীকার করে, তাহলে আমি মদীনাবাসীকে প্রস্তুত করে রেখেছি।

আকাবার শপথের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুস'আব ইবনে উমায়ের রা.-কে ইসলাম প্রচারের জন্য মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। মাত্র দু'বছরের দাওয়াতে মদীনার প্রতিটি ঘরে ঘরে ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল, বিনা রক্তপাতে। এরপর বিপ্লবের দ্বিতীয় অধ্যায়কে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় গমন করেছিলেন। এটিই হচ্ছে হিজরতের ফিলোসফি।

ইবরাহিমী ধর্মের অনুসারী হয়েও ইহুদি-খ্রিস্টানরা কেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান বিপ্লবকে বুঝতে ও স্বীকৃতি দিতে নারাজ? আমরা কিছু কারণ খুঁজে বের করেছি-

১. খ্রিস্টানরা নবী-রাসূল বলতে বুঝে সমাজবিমুখ ফকির-সন্ন্যাসী। কারণ তাদের নবীদ্বয়, ঈসা ও ইয়াহইয়া (عليهما السلام) নেহায়েত দরবেশি জীবনযাপন করেছেন। দুজনের কেউই বিয়ে করেননি। ব্যক্তি হিসেবে ইয়াহইয়া (عليه السلام) কিছুটা অন্তর্মুখী ছিলেন। এজন্য খ্রিস্টান ধর্মে তাঁকে John The Baptist বলা হয়। দাওয়াতি জীবনে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্যও চোখে পড়েনা। বরং সারাটি জীবন তাঁরা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

অপরদিকে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) ছিলেন পুরাদস্তুর সামাজিক। তিনি মানুষের সাথে মিশে চলতেন, রাগ করতেন, খুশি হতেন, খাবার খেতেন, বাজারে যেতেন, বিয়ে করেছেন, সন্তানাদিও ছিল। কোনো নবী এতোটা সামাজিক হতে পারেন, এটি সম্ভবত খ্রিস্টানদের ধারণায় আসেনা। নইলে নবী ঈসা (عليه السلام) তাদেরকে বলে গেছেন-

وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ

এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তার নাম আহমদ। [সুরা ছফ : ৬]

অতএব Ignorance Plead (অজ্ঞতার ওজর পেশ) করার কোনো সুযোগ খ্রিস্টানদের হাতে নেই।

২. খ্রিস্টানরা তাদের নবীকে দেখেছে দীনের দাওয়াত দিতে এবং নিগ্রহের শিকার হতে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেখেনি। তাই তাদের কাছে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মাক্কী জীবন হচ্ছে নবুয়্যাতি জীবন এবং মাদানী জীবন হচ্ছে নিরেট রাজনৈতিক জীবন। এ ভুল চিন্তাই তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামগ্রিক বিপ্লবকে স্বীকার করতে বাধা দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে।

৩. ইহুদিরা স্বীকার করেনি তাদের কপটতা ও হিংসার কারণে।

কপটতা হচ্ছে, ইহুদিদের ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় যে, তারা যুগের পর যুগ কোনো এক উদ্ধারকারীর আশায় বসে থাকে। যখন সেই 'উদ্ধারকারী' আসেন, তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রায় ১৪শ বছর ইহুদিরা একজন মাসীহ'র আশায় বসে রয়েছিল। যখন সে মাসীহ অর্থাৎ ঈসা (عليه السلام) আসলেন, তখন তারা তাঁকে অস্বীকার করল। কেবল অস্বীকার করেই শেষ নয়; তারা তাঁকে কাফির, মুরতাদ, যাদুকর এমনকি জারজ সন্তান বলেও অপবাদ দিল। এরপর তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। যদিও আল্লাহ ঈসা (عليه السلام)-কে উদ্ধার করে নিয়েছেন। সেই থেকে আজ অব্দি ইহুদিরা একজন মাসীহ'র অপেক্ষায় বসে আছে!

ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে শেষ নবীর কথা উল্লেখিত আছে। তাঁর পরিচয় ও গুণাগুণের বর্ণনাও দেয়া আছে। এমনকি মুসা (عليه السلام) তাদেরকে ঐ নবীর অনুসরণ করার আদেশ দিয়ে গেছেন। কিন্তু যখন শেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর আগমন হলো, তখন অনুসরণ করা তো দুরের কথা; ইহুদিরা তাঁর প্রাণের শত্রুরূপে আবির্ভূত হলো!

হিংসা এ কারণে যে, মুহাম্মদ (ﷺ) ইসহাক (عليه السلام)-এর বংশধর অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের ভেতর থেকে আসেননি। তিনি ইসমাইল (عليه السلام)-এর বংশ থেকে এসেছেন। তিনি যখন আমাদের নন, অতএব আমরা তাঁকে মানবো না। নইলে ইহুদিরা খুব ভালোভাবে জানত যে, মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। এ কথার প্রমাণ রয়েছে পবিত্র কুরআনে-

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাকে চেনে, যেভাবে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে। [সুরা বাকারা : ১৪৬]

কপটতা এবং হিংসা ইহুদিদেরকে সত্য থেকে বিমুখ করে রেখেছে।

৪. যদিও ইহুদি-খ্রিস্টানদের কিতাবে Kingdom of Heaven on Earth নামক ধারণা বিদ্যমান, তবুও তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান বিপ্লবকে স্বীকার করেনা। এর কারণ হতে পারে, Kingdom of Heaven on Earth বা 'আল্লাহর হুকুমত ও মানব-সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণ ইতিহাসে মাত্র ২টি। প্রথমটি হয়েছিল নবী দাউদ ও সুলাইমান (عليهما السلام)-এর হাত ধরে, জেরুজালেমে। দ্বিতীয়টি হয়েছিল নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবিদের হাত ধরে, মদীনায়। এছাড়া অন্য কোনো নবী-রাসূল পৃথিবীতে আল্লাহর দীন এবং ন্যায় ও সাম্য ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। উদাহরণের স্বল্পতাই অজ্ঞতার কারণ হতে পারে।

৫. আধুনিক পশ্চিমা বিশ্ব রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান বিপ্লবকে বুঝতে না পারার একটি কারণ হতে পারে 'নববী বিপ্লবের ব্যাপ্তি'। উদাহরণস্বরূপ-

গণতন্ত্রের ধারণা দিয়েছিলেন জন লক, ভল্টেয়ার, জ্যাঁ জ্যাক রুশো প্রমুখ মনিষীগণ। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে'র হাত ধরে। ততদিনে লক, রুশো, ভল্টেয়ার কেউই জীবিত নন।

পুঁজিবাদের ধারণা দিয়েছিলেন এডাম স্মিথ। আর তা কার্যকর হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের সময়। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই এডাম স্মিথ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

কমিউনিজমের স্বপ্ন দেখেছিলেন কার্ল মার্ক্স, ইংল্যান্ডে বসে। আর কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ায়, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের হাত ধরে। ততদিনে কার্ল মার্ক্স পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

অপরদিকে মুহাম্মদ (ﷺ) যা যা বলেছেন, তা নিজে করে দেখিয়েছেন। তিনি আল্লাহর একত্ববাদ, মানবমুক্তি, সমতা ও ন্যায়বোধের কথা বলেছেন এবং এ আদর্শের ভিত্তিতে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে দেখিয়ে গেছেন।

অন্যদিকে, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনো বিপ্লব মানুষের আমূল পরিবর্তন সাধিত করতে পারেনি। ফরাসি বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন, শিল্প বিপ্লব ছিল অর্থনৈতিক আন্দোলন, মার্ক্সবাদ মূলত অর্থনৈতিক আন্দোলন, গৌতম বুদ্ধের দর্শন ছিল ধর্মীয় আন্দোলন।

প্রক্ষান্তরে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর আন্দোলনটি মানুষের ব্যক্তিগত-ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী, এরকম সর্বব্যাপী বিপ্লব পৃথিবী আর দেখেনি। এমন বিপ্লবকে অনুধাবন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আমরা মুসলমানরাই আজ পর্যন্ত নববী বিপ্লবের ফিলোসফি ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। পারলে কি আর মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতাম?

মদীনায় যাওয়ার পর পরই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ২টি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক রূপ দান করেছিল।

১. মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন।

প্রথমত, আদর্শিক বিবেচনায় বিশ্বাসীরা পরস্পর ভাই-ভাই। এ ভ্রাতৃত্বের ওপর রয়েছে স্বয়ং আল্লাহর স্বীকৃতি-

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। [সুরা হুজুরাত : ১০]

এরপর সাংগঠনিক সহযোগিতার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক মুহাজিরের সাথে একজন আনসারের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করে দিলেন। অভূতপূর্ব এ পদক্ষেপকে বলা হয় المؤاخاة (পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব)। ৫ম পর্বে "ইয়াকীনওয়ালা ঈমানের বলে বলিয়ান একটি জামা'আত" তৈরি করার যে কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করেছিলাম, উক্ত مؤاخاة হচ্ছে সেই কর্মসূচীর সাংগঠনিক রূপ।

প্রসঙ্গতঃ আদর্শ ও সাংগঠনিক ভ্রাতৃত্বের সাথে সাথে মুসলমানদের ওপর আরেকটি ভ্রাতৃত্বের দাবী রয়েছে। সেটি হচ্ছে- الاخوة البشرية তথা মানবিক ভ্রাতৃত্ব। ইমাম গাযালী বলেছেন, আমরা প্রথমে آدمية (আদম-সন্তান), এরপর إبراهيمية (ইবরাহিমী ধর্মের অনুসারী) এরপর محمدية (মুহাম্মদ ﷺ-এর উম্মত)। সুতরাং আমাদের ভ্রাতৃত্ব প্রথমত সমগ্র মানব জাতির সাথে। এরপর আদর্শিক ভিত্তিতে আমাদের ভ্রাতৃত্ব স্বতন্ত্র হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা উম্মতে মুহাম্মাদি হয়ে যাই। এটিই আমাদের চূড়ান্ত পরিচয়। দীনি বিবেচনায়, এরচেয়ে স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন কোনো পরিচয়ের সুযোগ বা প্রয়োজনিয়তা কোনোটিই নেই।

২. মদীনা সনদ প্রণয়ন।

মদীনার অধিবাসী মুসলিম, অমুসলিম, ইহুদি এবং মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি সম্মিলিত প্রতিরক্ষা চুক্তি (Joint Defense Pact) প্রণয়ন করলেন, ইতিহাসে যার নাম الميثاق المدينة বা মদীনার সনদ। উক্ত সনদে আদামিয়্যা এবং ইবরাহিমিয়্যা'র ভিত্তিতে সবাইকে এক জাতির মর্যাদা দেয়া হলো। এ চুক্তির মাধ্যমে মদীনায় একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা হলো, যার প্রশাসক ও প্রধান বিচারপতি হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। অমুসলিম ও ইহুদিরা নিজ নিজ ধর্মীয়-পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়াদি নিজেদের মতো করে পালন করার অধিকার পেল। সিদ্ধান্ত হলো, মদীনা বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই এক হয়ে প্রতিরোধ করবে। ইতিহাসে সেই প্রাচীন বাঁকে এরূপ সম্মিলিত চুক্তি আজও আমাদেরকে বিস্মিত করে।

প্রশ্ন আসে, মদীনায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র?

মদীনায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ৫টি মূলনীতির কারণে অন্যান্য রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আলাদা। মূলনীতি নিম্নরূপ-

১. আল্লাহর হুকুমত (সার্বভৌমত্ব)

সৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর, সৃষ্টির সার্বভৌমত্বও আল্লাহর। আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ চূড়ান্ত বিধানদাতা (حاكم المطلق) নন। মানুষ কখনও মানুষের সামনে মাথা ঝুঁকাবেনা। তাওহীদের দাবী হচ্ছে, এক আল্লাহর সামনে নিজের ইচ্ছা এবং অস্তিত্বকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা হালাল করেছেন, তা হালাল। যা হারাম করেছেন, তা হারাম। ইসলামি রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ-প্রদত্ত্ব ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রদর্শিত পথকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে কোনো আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেনা। এ মূলনীতির প্রমাণ পবিত্র কুরআনের আয়াত-

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ

আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। [সুরা ইউসুফ : ৪০]

২. মুসলমানদের খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব)

মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করার সময় আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন-

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি তৈরি করতে যাচ্ছি। [সুরা বাকারা : ৩০]

অতএব বিশ্বাসীরা প্রত্যেকেই আল্লাহর প্রতিনিধি। যখন মুসলমানরা তাঁদের মধ্য থেকে কোনো একজনের হাতে তাঁদের সবার/অধিকাংশের প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা অর্পণ করে, তখন ঐ ব্যক্তি মুসলমানদের প্রতিনিধি (খলিফা) মনোনিত হন। এমন নয় যে, ক্ষমতা পেয়েই তিনি সবার মাথায় চড়ে বসবেন। বরং তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্যরা তাদের প্রতিনিধিত্বের দাবী/অধিকার সাময়িকভাবে তাঁর হাতে অর্পণ করেছে, যেন তিনি সবার পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যতক্ষণ শরী'আতের অধিন, ততক্ষণ তাঁর আনুগত্য করা আবশ্যক। একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যতীত অন্য কারও আনুগত্য প্রশ্নাতীত নয়। সুতরাং কোনো বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার, দল, কোনো গ্রান্ড মুফতি বা আয়াতুল্লাহ ইসলামি রাষ্ট্র-ক্ষমতার মালিক বা একক দাবীদার নন।

৩. পরামর্শ-ভিত্তিক শাসন

শরী'আতের মূলনীতি (أصول) ও উদ্দেশ্যকে (مقاصد) সামনে রেখে পরামর্শের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালিত হবে। ইসলামি রাষ্ট্রের আইন ও শাসনব্যবস্থা কারও খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভরশীল নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে কুরআনের আয়াত-

وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ

আর যারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে...। [সুরা শুরা : ৩৮]

সুতরাং যেখানে শরী'আতের নির্দিষ্ট বিধান নেই, সেখানে ইসলামি রাষ্ট্রের আইনসভা পরামর্শের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করুক কিংবা বাজারনীতি- সবই এর এখতিয়ারভূক্ত, যদি তাতে শরী'আতের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপ প্রয়োগ করার ক্ষমতা এখানে নেই।

৪. ন্যায়-ভিত্তিক স্বাধীন বিচারব্যবস্থা

পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে-

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ

আমরা আমাদের রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। [সুরা হাদীদ : ২৫]

অর্থাৎ, বিচারব্যবস্থায় কারও 'উপরহাত' নেই। আইন সবার জন্য। তবে কেবল বিধিবদ্ধ আইনের (Codified Law) ভিত্তিতেই বিচার হবেনা; বরং ব্যক্তির মানবিক অবস্থা ও পরিস্থিতি বিচারকের বিবেচনার আওতাভুক্ত থাকবে। যদি কোনো নাগরিক মনে করে যে, রাষ্ট্রের কোনো আইন শরী'আহ কিংবা নাগরিক-স্বার্থের বিপরীত, তাহলে সে বিনা দ্বিধায় আদালতের দরজায় কড়া নাড়তে পারবে।

৫. মানবজাতির সার্বিক মুক্তি, মর্যাদা ও কল্যাণকামিতা

মানুষ মাত্রই মর্যাদার দাবীদার। স্বয়ং মানুষের সৃষ্টিকর্তা বলছেন-

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্টবস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। [সুরা ইসরা : ৭০]

ইসলামি রাষ্ট্রের ওপর মুসলিম-অমুসলিম সবার নির্দিষ্ট অধিকার, সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে। এ লক্ষ্যেই দাওয়াতের প্রসার, এ লক্ষ্যেই জিযিয়া-যাকাত গ্রহণ, এ লক্ষ্যেই সুদ-জুয়া-মজুতদারী নিষিদ্ধকরণ, এ লক্ষ্যে হিজরত-জিহাদ-হুদুদ-কিসাস সবই।

উপরিউক্ত মূলনীতি ছিল মদীনায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি। এসব মূলনীতি কোনো 'খেয়ালি পোলাও' নয়, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেবল বয়ান করে গেছেন। বরং তিনি এসব মূলনীতির আলোকে একটি সিস্টেম কায়েম করে দেখিয়ে গেছেন। অতএব এ আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম-ই হবে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা।

মূলনীতি সংরক্ষণের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা পার্লামেন্টারি হবে নাকি প্রেসিডেন্সিয়াল, ইউনিটারি নাকি কনফেডারেট, নির্বাচন হবে নাকি নির্ধারণ, শাসককে খলিফা বলা হবে নাকি রাষ্ট্রপতি, যুদ্ধ করবে নাকি চুক্তি করবে, পাটের ব্যবসা করবে নাকি গমের ব্যবসা, সামরিক সক্ষমতা কতোটুকু থাকবে, মুক্তবাজার কতোটুকু মুক্ত হবে- এগুলো ইজতিহাদ ও পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। আর, মূলনীতি যদি সংরক্ষিত না হয়, তাহলে যতোই ইসলামিক রিপাবলিক কিংবা মামলাকাতুস সাউদিয়া নাম দেয়া হোক- সেটি মদীনা রাষ্ট্রের অনুসারী হবেনা।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিপ্লবী জীবন-দর্শনের গুরুত্ববহ একটি দিক হচ্ছে জিহাদ। একইসাথে, ইসলামি দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে Misunderstood এবং Misinterpreted অধ্যায় হচ্ছে জিহাদ। জিহাদের দর্শন আলোচনা করার পূর্বে জিহাদকে ভুল বুঝার কিছু কারণ ও এসবের জবাব উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণসমূহ নিম্নরূপ-

১. জিহাদকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারার মূল কারণ হলো ইসলামকে 'দীন' হিসেবে না দেখে কেবল 'ধর্ম' মনে করা।

আমরা বারবার বলে আসছি, ইসলাম কেবল ধর্ম নয়; ইসলাম একটি দীন। ধর্ম হচ্ছে কতিপয় বিশ্বাস ও গ্রন্থবদ্ধ ইবাদতের সমষ্টি। দীন হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা জীবনের প্রতিটি দিক ও ক্ষেত্রকে সমন্বয় করে মানুষকে এক আল্লাহর হুকুমের সামনে 'বান্দা' হিসেবে দাঁড় করায়। দীনের মধ্যে ধর্ম এসে যায়, ধর্মের মধ্যে দীন আসেনা।

২. জিহাদকে ভুল বুঝার আরেকটি বড় কারণ হলো, নববী-দর্শন বা নববী বিপ্লবকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারা।

আমরা এটিও বলে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেবল ধর্মপ্রচারক হিসেবে পৃথিবীতে আসেননি; এসেছিলেন আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কেবল ধর্মপ্রচারক হলে তাঁকে এতো গালিগালাজ, এতো অপবাদ, এতো অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হতোনা। সাহাবিদের জামা'আত গঠন করতে হতোনা, হিজরত করতে হতোনা, জিহাদের তো প্রশ্নই আসেনা। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব ছিল إقامة دين বা দীন প্রতিষ্ঠা। কুসংস্কারের গাছের ডালে যে শয়তান অনাচারের বাসা বেঁধেছে, সে ডাল কাটতে গেলে শয়তান তো চিৎকার করবেই। আর, আমাদের নবী (ﷺ) কেবল ডাল কাটেননি; বরং ঐ বিষবৃক্ষকে শেকড়সহ উপড়ে ফেলেছেন। فداك ابي وأمي يا رسول الله

৩. জিহাদ (جهاد) ও কিতাল (قتال)-কে এক/সমার্থক মনে করা।

জিহাদের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কিতাল (অস্ত্রের যুদ্ধ) হচ্ছে জিহাদের সর্বশেষ স্তর। জীবন চলার পথে একজন ঈমানদারকে পদে পদে জিহাদ করতে হয়। কিন্তু কিতাল করতে হয়না। একটি অথোরিটি প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে কিতালের অনুমতিও নেই। যেভাবে মাক্কী জীবনে সাহাবিদের কাছে প্রতিরোধের অনুমতি ছিলনা।

৪. মুসলমানদের সব যুদ্ধ-বিগ্রহকে জিহাদের নাম দিয়ে দেয়া।

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, মুসলমানদের রাজ্যাভিযান কি জিহাদ নয়? জবাব হলো, যদি নববী-আদর্শকে শতভাগ সমুন্নত রেখে জিহাদ করা হয়, যেভাবে করেছেন খোলাফায়ে রাশিদীন, তাহলে নিঃসন্দেহে তা জিহাদ। নচেৎ আদর্শহীন খুনখারাবি ও রাজ্যবিজয় তো আলেক্সান্ডার, এটিলা, চেঙ্গিস খাঁন-রাও করে গেছেন। ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলমানদের অনেক যুদ্ধকে প্রথমে জিহাদের নাম দেয়া হয়েছিল। পরে দেখা গেছে, সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল নেহায়েত ভূমি দখল করা, মালামাল লুণ্ঠন করা, অন্য ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করা কিংবা কমিউনিস্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। 'জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ' হয়ে গেছে 'ফাসাদ ফি সাবিলিল্লাহ'!

৫. পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক জিহাদের ভুল ব্যাখ্যাদান।

পশ্চিমা বিশ্ব জিহাদকে বলে "Holy War" এবং তাদের দেখাদেখি আমাদের পণ্ডিতরা বলেন "ধর্মযুদ্ধ"। কিন্তু কুরআন শরীফের একটি আয়াতেও পবিত্রযুদ্ধ বা ধর্মযুদ্ধের কথা উচ্চারণ করা হয়নি। কুরআনে যা আছে, তা হলো "আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকার করা" (جهاد في الله), যা আল্লাহর নবী (ﷺ) মাক্কী জীবনে করেছেন এবং "আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা" (جهاد في سبيل الله), যা তিনি (ﷺ) মাদানী জীবনে করেছেন।

৬. অতি-আবেগী, আদর্শহীন, মূর্খ লোকদের দ্বারা সংঘটিত জঙ্গিবাদ।

জিহাদকে ভুল বুঝার অন্যতম কারণ হচ্ছে জঙ্গিবাদ। তবে জঙ্গিবাদ যেহেতু আমাদের বিষয়বস্তু নয়, সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

এবার, জিহাদ বলতে ইসলাম কী বুঝিয়েছে, তা স্পষ্ট করা জরুরি।

জিহাদ শব্দটি جَهد (জাহদ) বা جُهد (জুহদ) থেকে নির্গত, যার অর্থ হলো কোনোকিছুর জন্য প্রচেষ্টা করা (To strive for something)। এ দুটি শব্দ থেকে جهاد (জিহাদ) শব্দ গঠিত হয়। জিহাদ অর্থ কোনোকিছুর বিরুদ্ধে চেষ্টা বা শক্তি ব্যয় করা (To struggle against something)।

জিহাদের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যেমন-

১. জীবন ধারণের জন্য জিহাদ

প্রত্যেক প্রাণীকে জীবন ধারণের উপকরণ সংগ্রহ করার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এটি জিহাদের নিম্নতম স্তর। জীবন ধারণের এ সংগ্রামকে ইসলাম অত্যন্ত প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে, যদি তা বৈধ উপায়ে হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

طلب كسب الحلال فريضة بعد الفريضة

আল্লাহর ফরজের পর একটি ফরজ হলো হালাল জীবিকা অন্বেষণ করা। [মিরকাত শারহে মিশকাত, ২৭৮১]

আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

التاجر الصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء

সৎ-বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গী হবে। [জামে তিরমিযি, ১২০৯]

২. অধিকারের জন্য জিহাদ

অন্যান্য প্রাণীকুল খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও মানবজীবন কেবল খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষ অন্যান্য অধিকার সম্পর্কেও সচেতন। যখন কেউ সে অধিকারকে নিষ্পেষিত করতে চায়, তখন মানুষ তার অধিকার ফিরে পেতে চেষ্টা করে। এটি জিহাদের মধ্যম স্তর। হোক সেটি ক্ষুদ্র অধিকার, হোক সেটি বড় অধিকার। সাঈদ ইবনে যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

من قتل دون ماله فهو شهيد ومن قتل دون أهله فهو شهيد ومن قتل دون دينه فهو شهيد ومن قتل دون دمه فهو شهيد

যে নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল, সে শহীদ। যে তার পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল, সে শহীদ। যে নিজের দীন রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেল, সে শহীদ। যে নিজের জীবন রক্ষার্থে প্রাণ দিল, সে শহীদ। [সুনানে নাসায়ী, ৪০৯৫]

প্রসঙ্গতঃ মানুষের অধিকারসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুমানের অধিকার হচ্ছে স্বাধীনতা।

৩. আদর্শের জন্য জিহাদ

আদর্শের জন্য জিহাদ বলতে কোনো ভাবধারা বা আদর্শকে পদ্ধতিরূপে (as a system) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করা। এটি জিহাদের উচ্চতম স্তর। কারণ এখানে অন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম (struggle against) করতে হয়। একটি নতুন সিস্টেমকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পুরোনো সিস্টেমের সুবিধাভোগীরা বাধা দেবেই। ঘাতের বিনিময়ে প্রতিঘাত আসবে। উদাহরণস্বরূপ, রাজতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকালে রাজা-বাদশারা কি এমনি এমনি গদি ছেড়ে দিয়েছিল?

ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শের জন্য জিহাদকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়।

১. ব্যক্তিগত জীবনে আত্মীক ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির জন্য কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। এটিকে 'তাযকিয়ায়ে নাফস' বলা হয়।

২. ধর্মীয়-সামাজিক অপসংস্কৃতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে জিহাদ। কল্যাণের আদেশ, অকল্যাণ থেকে নিষেধ এবং উত্তমপন্থায় বিতর্ক করার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবনভর এ জিহাদ চালিয়ে গেছেন।

৩. প্রতিকূল পরিবেশে ইসলামের ওপর টিকে থাকা এবং তা প্রচার করে যাওয়া। মাক্কী জীবনের ১৩টি বছর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ জিহাদ করে গেছেন। ধৈর্য এবং অধ্যবসায় হলো এ জিহাদের অস্ত্র।

৪. আল্লাহর দীনকে শাসনব্যবস্থার নিয়ামক পদ্ধতিরূপে (as a politico-socio-economic system) প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ।

এ জিহাদ দাওয়াতের মাধ্যমে হতে পারে, যেমন- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন সম্রাজ্যে দূত মারফত চিঠি প্রেরণ করেছিলেন। এ জিহাদ চুক্তির মাধ্যমে হতে পারে, যেমন- মুসলিম না হয়েও বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্র চুক্তির মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্বীকার করেছিল। এ জিহাদ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ (قتال) হতে পারে। যুদ্ধ হলে তা রক্ষণাত্মক হতে পারে, যেমন- উহুদ ও খন্দক যুদ্ধ। আক্রমণাত্মক হতে পারে, যেমন- বদর, খায়বার, হুনাইন, তাবুক ইত্যাদি। আবার কোনো বড় শক্তির বিপক্ষে অসহযোগ আন্দোলনও হতে পারে। সবই বৈধ পদ্ধতি।

জেনে রাখা দরকার যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাউকে মুসলমান বানানোর জন্য কোনো যুদ্ধ করেননি। কাউকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা ইসলামি আদর্শের বিপরীত। তিনি যুদ্ধ করেছেন আল্লাহর দীনকে শাসনব্যবস্থার নিয়ামক পদ্ধতিরূপে (as a politico-socio-economic system) প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

কারও মনে জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বলে রাখি, জঙ্গিবাদ হচ্ছে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির মারপ্যাঁচে তৈরি হওয়া একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ইসলামের সাথে এর আগাগোড়া কোনো সম্পর্ক নেই।

আমরা এযাবৎ নববী বিপ্লবের যে কয়েকটি অধ্যায় আলোচনা করেছি তা হলো-

১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনদর্শন : বিয়োগব্যথা, দারিদ্র্য, নির্যাতন এবং এর থেকে গৃহীত শিক্ষা

২. দাওয়াত : সূচনা, পদ্ধতি ও দর্শন

৩. জামা'আত : গঠন, দর্শন ও প্রয়োজনিয়তা

৪. হিজরত : উদ্দেশ্য ও দর্শন

৫. নববী বিপ্লবকে ভুল বুঝার কারণ

৬. জিহাদ : পরিচয়, উদ্দেশ্য ও দর্শন

শেষ যে অধ্যায়টি আমরা আলোচনা করব, তা হলো- خاتم النبيين (খাতামুন নাবিয়্যিন)। খাতামুন নাবিয়্যিন অর্থ, এর মাহাত্ম্য, চাহিদা এবং খাতামুল উম্মাহ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।

এটিই আমাদের শেষ অধ্যায়। হয়তো দু'তিনটি পর্ব নিয়ে অধ্যায়টি আলোচনা করা হবে। সাথে থাকুন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন-

مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ

মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। [সুরা আহযাব : ৪০]

পবিত্র কুরআনের নির্দেশনায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, সায়্যিদুনা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তাবিল আল-হাশেমী আল-কুরাইশী (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল এবং শেষ নবী।

প্রসঙ্গ ১ : নবী এবং রাসূলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রত্যেক রাসূল প্রথমত নবী, কিন্তু সব নবী রাসূল নন।

আল্লাহর পক্ষ থেকে যার প্রতি 'প্রত্যক্ষ' এবং 'দীনি' ওহী (Revelation) অবতীর্ণ হয়েছে, তিনি নবী। 'প্রত্যক্ষ' এবং 'দীনি' শব্দদ্বয় উল্লেখ করার কারণ হলো, নবী ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তি এমনকি প্রাণীদের প্রতিও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করেছেন মুসা (عليه السلام)-এর মায়ের প্রতি [সুরা কাসাস : ৭]। সায়্যিদা মারইয়ামের প্রতি জিবরাইল প্রেরিত হয়েছেন [সুরা মারইয়াম : ১৭]। মৌমাছির প্রতিও আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করেছেন [সুরা নাহল : ৬৮]। তবে এসব ওহী প্রত্যক্ষ এবং দীনি নয়; পরোক্ষ এবং পার্থিব। তাই এরা কেউ নবী নন। নবী হওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ এবং দীনি ওহী অবতীর্ণ হওয়া আবশ্যক।

নবীদের মধ্যে যেসব নবীর প্রতি স্বতন্ত্র শরী'আহ (Divine Guidance) অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন রাসূল। নবীদের কাজ হচ্ছে তাঁদের ঠিক পূর্ববর্তী রাসূলের শরী'আহ অনুসরণ করা এবং এর দাওয়াত পৌঁছানো। রাসূলদের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ শরী'আহকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করা। হাদীসে নবীদের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৩১৩ জন ছিলেন রাসূল। রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ৫ জন ছিলেন নূহ, ইবরাহিম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মদ (عليهم الصلاة والسلام), যাদেরকে أولو العزم من الرسل বলা হয়।

প্রসঙ্গ ২ : নবী ও রাসূলের মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, রাসূলদের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির ওপর আল্লাহর আদালত (পুরষ্কার ও শাস্তির বিধান) প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ, কোনো জাতির প্রতি একজন রাসূল আগমন করার পর ঐ জাতি যদি সম্মিলিতভাবে সে রাসূলের দাওয়াত অস্বীকার করে, তবে আল্লাহ ঐ জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। উদাহরণস্বরূপ নূহ, হুদ, সালেহ, লুত (عليهم السلام) প্রমূখ রাসূলদের উম্মতকে আল্লাহ সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। নতুবা ঐ রাসূলকে আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিতাল তথা যুদ্ধ করার আদেশ দেন। উদাহরণস্বরূপ, মুহাম্মদ (ﷺ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন।

কিন্তু নবীদের মাধ্যমে পৃথিবীতে 'আল্লাহর আদালত' স্থাপিত হয়না। তাই কোনো নবীকে অস্বীকার করার পরিনামে আল্লাহ ঐ জাতিকে সমূলে ধ্বংস করেননি।

বি.দ্রঃ এ বিধান কেবল পার্থিব শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পরকালীন শাস্তি স্বতন্ত্র বিষয় এবং তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন।

বি.দ্রঃ 'আল্লাহর আদালত' শব্দটি ইসলামি বা কিতাবি পরিভাষা নয়। ভালো কোনো প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি বলে বুঝানোর স্বার্থে এটি ব্যবহার করেছি।

প্রসঙ্গ ৩ : কোনো রাসূল উম্মতের হাতে 'নিহত' হতে পারেন না। তাঁরা স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। কারণ রাসূল নিহত হওয়া মানে 'আল্লাহর আদালত' ভেঙ্গে যাওয়া। কিন্তু নবী নিহত হতে পারেন। বনী ইসরাঈল শতশত নবীকে হত্যা করেছে।

প্রসঙ্গ ৪ : যদিও একজন রাসূলকে সম্মিলিতভাবে অস্বীকার করার ফলে আল্লাহ ঐ উম্মতকে সমূলে ধ্বংস করে দেন, তথাপি একটি উম্মত এর ব্যতিক্রম। উম্মতটি হলো বনী ইসরাঈল, যারা ঈসা (عليه السلام)-কে সম্মিলিতভাবে অস্বীকার করেছে এবং তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। ইহুদি-খ্রিস্টান সূত্র অনুযায়ী তারা তাঁকে হত্যাও করেছে। তবুও আল্লাহ বনী ইসরাঈলের ওপর 'সর্বধ্বংসকারী আযাব' দেননি। এর কারণ সামনে বর্ণনা করা হবে।

যদিও উপরোক্ত আলোচনা খাতামুন নাবিয়্যিন-এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, তবুও লিখলাম। কারণ বিষয়টি একেবারে গুরুত্বহীন নয়। খাতামুন নবিয়্যিন সংক্রান্ত আলোচনা বুঝার পূর্বে নবী ও রাসুলের মধ্যকার পার্থক্য বুঝা জরুরি। এবার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে।

খাতামুন নাবিয়্যিন-এর দুটি অর্থ রয়েছে। একটি আইনগত (Legal), আরেকটি আকীদাগত (Doctrinal)।

★ আইনগত দিক থেকে 'খাতামুন নাবিয়্যিন' অর্থ শেষ নবী। অর্থাৎ যে নবীর পর আর কোনো নবী আসবেন না। ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

انا خاتم النبيين لا نبي بعدي

আমি শেষ নবী। আমার পর আর কোনো নবী নেই। [জামে তিরমিযি, ২২১৯]

'খাতামুন নাবিয়্যিন' একটি আইনগত বিষয় এজন্য যে, 'খাতামুন নাবিয়্যিন' দ্বারা নবুয়্যাতের সিলসিলা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর আর কারও পক্ষে নবুয়্যাতের দাবী করা বৈধ নয়। তথাপি আমরা দেখি, যুগে যুগে কিছু ভণ্ড ব্যক্তি নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করে আসছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

لا تقوم الساعة حتى يبعث دجالون كذابون قريب من ثلاثين كلهم يزعم أنه رسول الله

ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা, যতক্ষণ না কিছু দাজ্জাল-মিথ্যাবাদী বের হবে। যাদের সংখ্যা ৩০ জনের মতো। এরা প্রত্যেকে নিজেদেরকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করবে। [সহীহ মুসলিম, ১৫৭]

অতএব খাতামুন নাবিয়্যিন-এর আইনগত চাহিদা হচ্ছে, মুহাম্মদ (ﷺ)-এর পর যে ব্যক্তি নিজেকে নবী/রাসূল বলে দাবী করবে, সে মিথ্যাবাদী এবং মুরতাদ। ইসলামি আইনে মুরতাদের যে শাস্তি রয়েছে, তা তার ওপর প্রযোজ্য হবে।

মুহাম্মদ (ﷺ) শেষ নবী- এ বক্তব্যটি ধ্রুবসত্য। তবে এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার প্রশ্ন আসেনা। বিষয়টি এরূপ, একটি সিলসিলা একজনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল, আরেকজনের হাত ধরে শেষ হয়েছে। এখানে কারও মর্যাদা-অমর্যাদার প্রশ্ন নেই। খাতামুন নাবিয়্যিন হিসেবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা নিহিত আছে আকীদাগত (Doctrinal) অর্থের মধ্যে।

★ আকীদাগত দিক থেকে 'খাতামুন নাবিয়্যিন' অর্থ পরিপূর্ণকারী নবী। অর্থাৎ যে নবীর মাধ্যমে নবুয়্যাত পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। বিষয়টি এরূপ, আদম (عليه السلام)-এর হাত ধরে নবুয়্যাতের সিলসিলা শুরু হয়েছিল। এরপর সময়ে সময়ে এটি বিকাশিত হয়েছে। এক সময় মুহাম্মদ (ﷺ)-এর হাতে এসে নবুয়্যাত চূড়ান্ত এবং পরিপূর্ণ (مكمل) রূপ লাভ করেছে। সুতরাং মুহাম্মদ (ﷺ)-এর পরে আর কোনো নবী কেবল আসবেন না তা নয়; আর কোনো নবী আসার প্রয়োজনও নেই। বিদায় হজের মাহেন্দ্রক্ষণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা জানিয়ে দিয়েছেন-

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম। [সুরা মায়েদা : ৩]

এখানেই রয়েছে মর্যাদার প্রশ্ন। দীন কার হাতে পূর্ণাঙ্গতা (تكميل) লাভ করেছিল? নিয়ামত তথা আল্লাহ-প্রদত্ত্ব হেদায়াত কার হাত ধরে সম্পূর্ণ (تتميم) হয়েছিল? কোন নবীর দীনকে আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পছন্দনীয় জীবনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন? তিনি সায়্যিদুনা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ, যিনি শিখিয়েছিলেন এক আল্লাহর সামনে মাথা নত করতে, যিনি শিখিয়েছিলেন আর কারও সামনে মাথা নত না করতে। অত্যাচার ও কৌলিন্যপ্রথার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দিয়ে যিনি ঘোষণা করেছিলেন- "অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আরবের ওপরও অনারবের কোনো কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার ওপরও কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর, যে অধিক পরহেজগার। তোমরা সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। তোমাদের একের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম অন্যের কাছে পবিত্র। তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে তোমাদের পরিবারের, তোমাদের দাসদাসীর, এতিম-অনাথের, অসহায়-নিপিড়িত-দুর্বলের। সাবধান! একদিন তোমরা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করবে।"

فداه آباؤنا وامهاتنا، وصلواة الله وسلامه عليه وعلى اصحابه وأنصاره وأهل بيته أجمعين

ইসলামের ঘোরতর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও H.G Wells স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন- Although the sermons of human freedom, fraternity and equality were said before also. And we find lot of such sermon in Jesus of Nazareth. But it must be admitted, that it was Muhammad, who, for the first time in history, established a society based on these principles. [Concise History of the World]

যদিও মানবমুক্তি, মানবিক ভ্রাতৃত্ব ও সমতার ভাষণ পূর্বেও দেয়া হয়েছিল। এবং এরকম অনেক ভাষণ আমরা নাজেরাথের যীশুর (ঈসা) বক্তব্যে খুঁজে পাই। কিন্তু এ কথাটি স্বীকার করতেই হবে যে, মুহাম্মদ একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মানব ইতিহাসে প্রথমবার এসব আদর্শের ভিত্তিতে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছিলেন।

فداك أبي وأمي يا رسول الله

সর্বশেষ ও পরিপূর্ণকারী নবী হিসেবে 'খাতামুন নাবিয়্যিন'-এর ২টি দাবী রয়েছে।

১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুমহান মর্যাদা ও তাঁর প্রতি ভালবাসা।

২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ, তথা নববী বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা।

খাতামুন নাবিয়্যিন-এর প্রথম দাবীতে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ সফল। সাহাবি-তাবেঈন, শুহাদা-আউলিয়া, ইমাম-আইম্মা থেকে শুরু করে একটি সাধারণ মুসলিম-হৃদয়ে সায়্যিদা আমিনার ইয়াতিম পুত্রের জন্য যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মিনার নির্মিত আছে, পৃথিবীর অন্য কারও ভাগ্যে সেটি জুটেনি। উম্মত তো উম্মত; যে মহান রবের কদমে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেজদা করেছেন, সে রব ঘোষণা দিচ্ছেন-

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি। [সুরা ইনশিরাহ : ৪]

চেয়ে দেখুন, 'মুহাম্মদ' নামটি ভেসে বেড়াচ্ছে আযানের সুরে, নামাজের দুরুদে, কবির কবিতায়, সাহিত্যিকের কলমে, সুরকারের সুরে, আলিমের বয়ানে, আশিকের সালামে, শিশুদের নামে, কালিমা শাহাদাতের নিশানে। মানব ইতিহাসে এমন শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নজির দ্বিতীয়টি নেই।

খাতামুন নাবিয়্যিন-এর দ্বিতীয় দাবী, তথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রেখে যাওয়া বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করার দিক থেকে মুসলিম উম্মাহ সফল নয়। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটি সত্য।

আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিছু কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আদর্শবান ব্যক্তিজীবন, দাওয়াত, জামা'আত, হিজরত ও জিহাদ। নববী জীবনাদর্শের প্রভাব পড়েছিল সাহাবিদের ওপর, দাওয়াতের ফলে আরবের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাওহীদের বাণী, হিজরতের ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছিল ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা, জামা'আত (দল) বিকাশিত হয়ে গঠিত হয়েছিল উম্মাহ (জাতি), জিহাদের ফলে সুরক্ষিত হয়েছিল আল্লাহর দীন, সুউচ্চ হয়েছিল আল্লাহর কালিমা। জাযিরাতুল আরবে 'নববী বিপ্লব' সফল ও পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পন্ন হয়েছিল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পরপরই সাহাবিরা 'নববী বিপ্লব' নিয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। খোলাফায়ে রাশিদীনের খেলাফতকালে আল্লাহর দীন পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য এলাকাজুড়ে রঙ ছড়িয়েছিল। মুসলমানরা যে জায়গায় গিয়েছেন, সে জায়গাতেই লেগেছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া। এক সময়ের নিরক্ষর আরব জাতি তখন নব-নব জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছিল, মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর দাসত্বের ছায়াতলে সন্নিবেশিত করেছিল। অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক কুসংস্কার উপড়ে ফেলে মুসলমানরা দিয়েছিল নতুন বিশ্বাস, নতুন সংস্কৃতি, নতুন ব্যবস্থা, নতুন দর্শন। নববী বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। শয়তান ভেবেছিল, পৃথিবীর মাটিতে আমার আস্তানা বুঝি আর বাকি রইলনা! এমনই ছিল সে বিপ্লবের দ্যোতি, এমনই ছিল বিপ্লবীদের তেজ। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের সদস্য এবং ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রসৈনিক MN Roy যথার্থ স্বীকৃতি দিয়েছেন- "মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ/সর্বব্যাপী বিপ্লব ছিল সেটি, যা মুহাম্মদের হাত ধরে এসেছিল।" [The Historical Role of Islam : MN Roy, Lahore, 1920]

এরপর হঠাৎ করে যেন সুর কেটে গেল! যত দ্রুত গতিতে নববী বিপ্লবের কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছিল, ততটুকু আচমকাভাবে থেমে পড়ল। ৪১ হিজরির সেই দিন থেকে আজকের দিন- বিশ্ববাসী নববী বিপ্লবের 'পূর্ণাঙ্গ নমুনা' চোখে দেখেনি। মুসলমানরা নানা সময় নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। দু'একজন আধা-আধুরা সাফল্য এনেছিলেন, বাকিরা নিজেদের আখের গুছিয়ে চলে গেছেন। রাজ্য বিজয় তো অনেক হয়েছে, দাওয়াত-তাবলীগ আজও চলছে, মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দেড়শ কোটি ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু 'নববী বিপ্লব' এখনও মাঝপথে থেমে আছে...।

কেন এমনটি হলো? এ ব্যর্থতার পরিনাম কী?

নববী বিপ্লবের ফলস্বরূপ প্রথমে মদীনায় এবং পরবর্তীতে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। সংক্ষেপে সেগুলো ছিল- আল্লাহর হুকুমত (সার্বভৌমত্ব), মুসলমানদের খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব), অংশীদারিত্ব ও পরামর্শ-ভিত্তিক শাসন, ন্যায়ভিত্তিক স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর খোলাফায়ে রাশিদীন এসব মূলনীতিকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তাই তাঁদের শাসনব্যবস্থাকে خلافة على منهاج النبوه বা 'নবুয়্যাতের আদর্শের ওপর প্রতিস্থাপিত খেলাফত' বলে আখ্যায়িত করা হয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ছায়াতলে মানবিক সমতা, অংশীদারিত্ব ও ন্যায়বোধের অনুপম দৃষ্টান্ত রচনা করেছিলেন সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক, উমর ইবনে খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান, আলী ইবনে আবি তালিব এবং কিছুদিনের জন্য হাসান ইবনে আলী (رضوان الله عليهم)। এ পাঁচজনের খেলাফত একত্র করলে ৩০ বছর (১১ হিজরির রবিউল আউয়াল থেকে ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল পর্যন্ত) পূর্ণ হয়।

এরপর মুসলিম উম্মাহ'র ঘাড়ে চেপে বসে রাজতন্ত্রের যাঁতাকল। এমনটি যে হবে, তার ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল। সাফীনা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

الخلافة في أمتي ثلاثون سنة ثم ملك بعد ذلك

আমার উম্মতের মধ্যে ৩০ বছর খেলাফত থাকবে। এরপর আসবে রাজতন্ত্র। [জামে তিরমিযি, ২২২৬]

রাজতন্ত্র আসার সাথে সাথে ইসলাম হয়ে গেল ধর্ম, রাষ্ট্র হয়ে গেল রাজার খেয়াল-খুশির বস্তু। 'মুসলমানদের খেলাফত' নামক আদর্শকে কবর দিয়ে শাসনব্যবস্থা একটি বংশের (বনু উমাইয়া) হাতে বন্দী হয়ে গেল। রাজা-বাদশারা অংশীদারিত্ব, পরামর্শ, বিচারিক ন্যায়বোধ, জবাবদিহি- সবকিছুর উর্দ্ধে ওঠে বসলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যথেচ্ছা খরচ করতে শুরু করলেন। জায়গির প্রথার উদ্ভাবন হলো। আহলে বায়েতকে 'শত্রু' আখ্যা দিয়ে তাঁদের ওপর চরম নিপিড়ন শুরু হলো। সব খারাবি এক দিনে আসেনি, সময়ে সময়ে এসেছিল। একটি ভবিষ্যদ্বাণীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ রাজতন্ত্রের যথার্থ নাম দিয়েছিলেন- ملكًا عاضًا (দাত দিয়ে কামড়ে ধরা রাজতন্ত্র)।

শুনতে খারাপ লাগলেও বলে রাখি, খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন করার কাজটি যার হাত ধরে হয়েছিল, তিনি মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রা.। সমালোচনা উদ্দেশ্য নয়; কিন্তু সত্যকে স্বীকার করতেই হবে।

ইসলামকে নিছক ধর্ম বানিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যথেচ্ছা ব্যবহার করার প্রতিবাদে উম্মতে মুহাম্মাদির পক্ষ থেকে প্রথম যে মানুষটি ওঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ইমাম হুসাইন ইবনে আলী রা.। তাঁর প্রতিবাদ কেবল ইয়াযিদের বিপক্ষে নয়; তাঁর প্রতিবাদ ছিল 'দাত দিয়ে কামড়ে ধরা' একটি অত্যাচারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে।

সেই থেকে নববী বিপ্লবের সূর্য অস্তমিত। কিন্তু মুসলমানরা (আরবরা) তরতর করে এগিয়ে গেলেন। এক সময় উমাইয়া বংশের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেল আব্বাসি বংশের হাতে। আরব সম্রাজ্যবাদ তখনো এগিয়ে যাচ্ছিল, রাজ্য বিজয় হচ্ছিল, উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু তাতে নববী আদর্শের গন্ধও ছিলনা। এরপর ৪০০ বছরের ব্যবধানে এমন ৩টি ধাক্কা আসলো, যা মুসলিম (আরব) অগ্রসরতাকে চিরতরে রুখে দিল। প্রথম আক্রমণ আসলো ক্রুসেডারদের পক্ষ থেকে, এর দু'শ বছর পর আসলো তাতারিদের (মোঙ্গল) হাতে, এর দু'শ বছর পর মুসলমানরা আন্দালুস (স্পেন) থেকে বিতাড়িত হলেন। যদিও ক্রুসেডারদের হাতে বিজিত জেরুজালেম পুনঃবিজয় করেছিলেন কুর্দি বংশোদ্ভূত সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী, কিন্তু তাতে পতন ঠেকানো গেলনা। তাতারিদের হাতে আব্বাসি সম্রাজ্য ধ্বংস হলো। স্পেন থেকে বিতাড়নের ফলে মুসলিম উম্মাহ'র ওপর থেকে আরব জাতির নেতৃত্ব চিরতরে বিলিন হয়ে গেল।

এরপর মুসলমানদের নেতৃত্ব টুকরো টুকরো হয়ে চলে গেল ককেশীয়দের হাতে। মামলুক, সেলজুক, অটোমান, মোঘল- এরা সবাই মূলত ককেশীয় বংশোদ্ভূত। আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হলো-

وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ

যদি তোমরা (আল্লাহর দীন থেকে) মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। [সুরা মুহাম্মদ : ৩৮]

অটোমান সম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম বিশ্ব ইউরোপিয়ান সম্রাজ্যবাদের কলনিতে পরিণত হলো। একে একে সে যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে মুসলমানরা শৌর্যহীন-শক্তিহীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল। আজকে এ তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের না আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, না আছে রাজনৈতিক দক্ষতা, না ঐক্য, না বল। আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কখনো একে অপরের ওপর বোমা মারছে, কখনো অন্যের পা তলে পিষ্ঠ হচ্ছে। এ সবকিছুর শেকড় জড়িয়ে আছে ঐ জায়গায়, যেখানে মুসলমানরা নববী বিপ্লবকে পিঠ দেখিয়ে এসেছিলেন।

বিপর্যয় এখানেই শেষ নয়। সামনে আসছে মহাবিপর্যয়। মুসলমানদের উচিৎ সেই চুড়ান্ত বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

শেষ করার আগে আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ'র দায়িত্ব কী?

The Philosophy of Seerah (সীরাতের দর্শন) শীর্ষক নিবন্ধে আমরা চেষ্টা করেছি নববী বিপ্লবের নমুনা, উদ্দেশ্য ও দর্শন কিছুটা ফুটিয়ে তুলতে। সবাই যে সব কথার সাথে একমত হবেন, সেটি আশা করছিনা। তাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, মুসলিম উম্মাহ'র ওপর ওয়াজিব হলো নববী বিপ্লবকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করা। যদি আমরা ঐ আদর্শে প্রত্যাবর্তন করতে পারি, তবে আমাদের প্রতি আল্লাহর দৃঢ়তর ওয়াদা রয়েছে-

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا

তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন, যেভাবে তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববতীদেরকে। এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় (বিজয়ী) করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন। এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থাকে পরিবর্তন করে তাদেরকে শান্তি দান করবেন। [সুরা নূর : ৫৫]

(আয়াতটি দ্বিতীয়বার পাঠ করার অনুরোধ রইল)

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, নববী বিপ্লবকে কিভাবে পুনর্জীবিত করা হবে?

নববী বিপ্লবকে ঠিক সেভাবেই পুনর্জীবিত করতে হবে, যেভাবে সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে ঐ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। ইমাম মালিক যথার্থ বলেছেন-

لا يصلح آخر هذه الأمة إلا بما صلح به أولها

সেই পদ্ধতি ব্যতীত এ উম্মতের পরবর্তী অংশের ইসলাহ (সংশোধন) হবেনা, যে পদ্ধতিতে পূর্ববর্তী অংশের ইসলাহ (সংশোধন) হয়েছিল।

অতএব লক্ষ্য হবে তাঁদের লক্ষ্য, কর্মসূচী হবে তাঁদের কর্মসূচী। কোনো শর্টকাট পদ্ধতি কিংবা কেবল মু'জিযা-কারামতের ভিত্তিতে এ বিপ্লব আগেও আসেনি, এখনও আসবেনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সবচেয়ে বড় মু'জিযা হচ্ছে, প্রায় কোনো রকম মু'জিযা ছাড়াই তিনি আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছিলেন।

নববী বিপ্লবকে পুনর্জীবিত করার জন্য ৩টি স্তরে মনোনিবেশ করা আবশ্যক।

১. ব্যক্তিজীবন

প্রত্যেক মুসলমান বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ'র একেকটি ক্ষুদ্রতম ইউনিট। আমি কাউকে নসিহত করছিনা, কারণ আমার মধ্যেই কোনো আমল নেই। তবুও মনে করি, প্রত্যেক মুসলমানের ব্যক্তিজীবনের দর্শন হওয়া উচিৎ নিম্নুক্ত আয়াত-

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين

আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ শুধুমাত্র বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। [সুরা আন'আম : ১৬২]

২. সমবায়ী জীবন (জামা'আত)

একা নিজেকে সংশোধন করেই কর্তব্য সমাধা হবেনা, যদি এ সংশোধনী সমাজে বিকাশিত না হয়। অতএব মুসলমানরা যখনই সাংগঠনিকভাবে কাজ করবেন, তখন ঐ ৪টি কর্তব্যের ভিত্তিতে করবেন, যা আল্লাহ তাঁর রাসূলের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। অর্থাৎ ১. কুরআনের আলোকে দাওয়াত, ২. তাযকিয়ায়ে নাফস, ৩. আল্লাহর হুকুমের বাস্তবায়ন (শরী'আহ) এবং ৪. হিকমত (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা)। [সুরা জুম'আ : ২]

এ ৪টি কর্তব্যের একটিকেও হাতছাড়া করলে নববী বিপ্লবের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।

৩. সমুদয়/বৈশ্বিক জীবন (উম্মাহ)

নববী বিপ্লবকে কার্যকরীভাবে পুনর্জীবিত করার কাজটি মুসলিম উম্মাহকে সম্মিলিতভাবেই করতে হবে। কারণ, এ অকৃতজ্ঞ উম্মত সম্মিলিতভাবে নববী বিপ্লবকে পিঠ দেখিয়ে এসেছিল, যার পরিণাম আজ হাড়েহাড়ে ভোগ করতে হচ্ছে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে নববী বিপ্লবকে ফিরিয়ে আনতে হলে, মুসলিম উম্মাহ'র লাঞ্চনীয় অবস্থাকে পরিবর্তন করতে হলে আবার সম্মিলিতভাবেই দাঁড়াতে হবে। অহেতুক বিভক্তি বাঁচিয়ে রেখে মুখে বড় বড় কথা বলা যাবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবেনা। তাই আল্লাহর নির্দেশ হলো-

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তহাতে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা। [সুরা আলে-ইমরান : ১০৩]

এ কথাটি মোটেও ভাবা উচিৎ নয় যে, আমাদের সফলতা-ব্যর্থতার ওপর আল্লাহর দীনের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে। না, আল্লাহর দীন কোনোভাবেই আমাদের মুখাপেক্ষী নয়। আল্লাহ নিজেই জানিয়েছেন-

يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর জ্যোতি (দীন) নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর জ্যোতিকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন, যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপছন্দ করে। [সুরা ছফ : ৮]

ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-

إن الله زوى لي الأرض فرأيت مشارقها ومغاربها وإن ملك أمتي سيبلغ ما زوي لي منها

আল্লাহ আমার জন্য পৃথিবীকে সংকোচিত করে দিয়েছিলেন। তখন আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম দেখলাম। নিশ্চয়ই আমার উম্মতের কর্তৃত্ব ততটুকু জায়গা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, যতটুকু আমাকে সংকোচিত করে দেখানো হয়েছে। [সুনানে আবু দাউদ : ৪২৫২]

সুতরাং প্রশ্ন এটি নয় যে, নববী বিপ্লব পুনরায় আসবে কি না। চাই সহস্র দাজ্জাল সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াক, চাই الملحمة الكبرى বা কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত মহাযুদ্ধে (বাইবেলে যাকে Armageddon বলা হয়েছে) মুসলমানরা মহাবিপর্যয়ের শিকার হোক, বিপ্লব আসবেই। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে সে নিশ্চয়তা দিয়ে গেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই বিপ্লবের অংশ হতে পারব?

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই বিপ্লবের সূচনা করতে পারব?

হ্যাঁ-না দুটি পথই খোলা আছে। আজ আমরা যে পথটি বাছাই করব, আমাদের ভবিষ্যত সেভাবেই নির্মিত হবে। এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক।