ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

শ্বাসরুদ্ধকর পরিণতির দিকে ইসলামি শিক্ষা

বাংলাদেশে তিনটি ধারায় ইসলামি শিক্ষা চলে। সাধারণ, আলিয়া ও কউমি। এই তিন ধারার মধ্যে যুতসই কোনো সমন্বয় বা নবায়ন কখনও চোখে পড়েনি। আজ এর মধ্যে একটির বিদায়ঘন্টা বেজে গেছে। বাকি দুটি ধারা ব্যর্থতার ছাপ বুকে নিয়ে ধুকে মরছে।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
শ্বাসরুদ্ধকর পরিণতির দিকে ইসলামি শিক্ষা

বাংলাদেশে তিনটি ধারায় ইসলামি শিক্ষা চলে। সাধারণ, আলিয়া ও কউমি। এই তিন ধারার মধ্যে যুতসই কোনো সমন্বয় বা নবায়ন কখনও চোখে পড়েনি। আজ এর মধ্যে একটির বিদায়ঘন্টা বেজে গেছে। বাকি দুটি ধারা ব্যর্থতার ছাপ বুকে নিয়ে ধুকে মরছে।

বাংলাদেশের বর্তমান Est সর্বোতভাবে ইসলাম বিদ্বেষী। সরাসরি বলতে না পারলেও কোলকাতামুখী বাঙালিয়ানা ও পাশ্চাত্যমুখী বেহায়াপনার পতাকা নিয়ে ওরা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করে আছে। ইসলাম বিদ্বেষীরা খুব জানে যে, এ দেশের মাটি থেকে ইসলামের শক্ত শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে ইসলামি শিক্ষা ধ্বংস করা ছাড়া কোনো গতি নেই। তাই দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামি শিক্ষাকে হ্রাস করতে করতে এখন এটিকে প্রায় বিদায় করে দেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে সব বাদ দিয়েছে এমন নয়। তথাকথিত নব্বুই পার্সেন্ট ঘুমন্ত মুসলমানের আচ্ছন্নতার সুযোগে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে পৌঁছেছে ওরা। নতুন শিক্ষানীতিতে ইসলাম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে যা ঢুকেছে, তা শিক্ষার্থীদেরকে হয় ‘অনুভূতিহীন চাকর’, না হয় ‘আবরার-হত্যাকারী’ বানাবে।

আলিয়া মাদরাসা আজ ‘না কলেজ, না মাদরাসা’ পর্যায়ের এক চরম হীনমন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে টিকে আছে। ব্যক্তিগত পরিশ্রম ছাড়া কেবল মাদরাসার জোরে আজ কেউ আলিম হয়ে যাবে, সেটি আমি স্বপ্নেও ভাবি না। সরকারি বেতনের ঠেলায় মাদরাসায় দ্বীনি শিক্ষাই আজ ঐচ্ছিক। ওয়ায মাহফিলে এক অধ্যক্ষকে গর্বভরে বলতে শুনেছি, “এখন মাদরাসা এত উন্নত যে, মাদরাসায় পড়ে ডাক্তার ও পুলিশ হওয়া যায়।” হীনমন্যতা আর কাকে বলে! যদি ডাক্তার বা পুলিশ হওয়াই সাফল্যের মাপকাঠি হয়, তাহলে প্রথমে মাদরাসা তৈরি করলেন কেন? কলেজে পড়েই সফল হওয়া যেত।

কউমি মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে মূলত ইসলামি রাষ্ট্রে বিচারকার্য পরিচালনা করার নিয়মনীতি শেখানো হয়। কারণ দারসে নেজামী চালু হয়েছিল সেলজুক শাসনামলে। পরে ভারতে মোঘল আমলে এটি নবায়ন করা হয়েছিল। সেলজুক ও মোঘল, দুই আমলেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামি আইন প্রচলিত ছিল। তাই কাযী, মুফতি ইত্যাদির প্রয়োজন হতো। আজ এ দেশে ইসলামি আইনের গন্ধও নেই। যেখানে ঘরই নেই, সেখানে দরজার চৌকাঠের ডিজাইন নিয়ে চিন্তা করার কোনো মানে হয়?

মাদরাসায় যা কিছু দ্বীনি শিক্ষা হচ্ছে, সেটি কি বর্তমান যুগের নব্য শিরক, ইলহাদ, বিবর্তনবাদ, অপমনোবিজ্ঞান, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও দাজ্জালি আসক্তি মাড়িয়ে ইসলামের আলো জ্বালতে সক্ষম? মাদরাসায় যে ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হয়, সেটি নিওপ্লেটোনিক যুগের। আজকের উত্তরাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ওসব তত্ত্ব অচল। আজকের চ্যালেঞ্জ-ই ভিন্ন। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বকে ইসলামের নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব ও জীবনদর্শন উপহার দেয়ার মতো কোনোকিছু মাদরাসায় শেখানো হয়? কুরআন ও সুন্নাহ’র ওপর বিশ্বমানের গবেষণা হয়? আল্লাহর কিতাবের চেয়ে বরং ফিকহী মাসয়ালা ও আরবি সাহিত্যের গুরুত্ব এখানে বেশি! কুরআন বললেই ধরিয়ে দেয়া হয় জটিল কোনো তাফসির, যেখানে ঈমানি চেতনা ও কর্মোদ্যমের চেয়ে ব্যাকরণের মারপ্যাঁচ বেশি। অথচ এই কুরআন দিয়েই রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মি আরবদের বুকে এমন নূর প্রজ্বলিত করেছিলেন, যে নূরে পরের হাজার বছর মুসলমানরা সারা পৃথিবীকে রওশন করেছিল। সৃষ্টি করেছিল নতুন জ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি। আজ সেই নূর নিভুপ্রায়।

প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ইসলামি শিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করা প্রবাদপুরুষ, রাহবারে দ্বীন ও মিল্লাত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র একটি বয়ান শুনছিলাম গতকাল। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “দ্বীন রক্ষা করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া তাসবীহ, যিকর, ওয়ায, এমনকি মসজিদ দিয়েও দ্বীন রক্ষা করা সম্ভব হবে না।”

বাংলাদেশে এত আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ। আমার যদি সামর্থ থাকত, প্রত্যেকের পায়ে ধরে মিনতি করতাম যে, বাকি সব কাজ একপাশে রেখে আপাতত দ্বীনি শিক্ষার দিকে নজর দিন। একজোট হয়ে শিক্ষানীতিতে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে বলুন, নতুবা দানদক্ষিণার আশা ছেড়ে নতুন ধারার বেসরকারি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করুন। নইলে অদূর ভবিষ্যতে কেবল বিয়ে পড়ানো নিম-মৌলভী বাকি থাকবে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম বুখারী, ইমাম গাযালী, আলবেরুনী, আল খাওয়ারিজমী বা শাহ ওয়ালিউল্লাহ আর বেরিয়ে আসবেন না।

ওরা এ দেশের মাটি থেকে ইসলামের শেকড় উপড়ে ফেলতে চায়। এ দেশকে ওরা ওপারের বাবুদের সাংস্কৃতিক শৌচালয় বানাতে চায়। আমাদের চুপ্পি তাদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছে। আর আমরা এক পা, এক পা করে আল্লাহর গযবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

[লেখক - কামিল (এম এ), বিএ অনার্স (এম.এ) ঢাবি, ডিপ্লোমা ইন এরাবিক (মিশর), গবেষণারত (জার্মান)। ]