ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিলেখা পাঠানোর নিয়মাবলীযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

কুরবানীর ইতিহাস ও জরুরি মাসাঈল : সংক্ষিপ্ত আলোচনা

ইসলামী শরীয়তে পশু কুরবানী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা সামর্থবান প্রত্যেক নর-নারীর উপর ওয়াজিব। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পবিত্র ত্যাগের স্মৃতির অনুসরণে আমরা প্রত্যেক বছর কুরবানী করি। আল্লাহর নিকট তাঁহার কুরবানী পছন্দনীয় হওয়ার কারণে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর আল্লাহ পাক কুরবানী করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করেছেন।

মোহাম্মদ আব্দুল আজিম
কুরবানীর ইতিহাস ও জরুরি মাসাঈল : সংক্ষিপ্ত আলোচনা

ইসলামী শরীয়তে পশু কুরবানী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা সামর্থবান প্রত্যেক নর-নারীর উপর ওয়াজিব। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পবিত্র ত্যাগের স্মৃতির অনুসরণে আমরা প্রত্যেক বছর কুরবানী করি। আল্লাহর নিকট তাঁহার কুরবানী পছন্দনীয় হওয়ার কারণে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর আল্লাহ পাক কুরবানী করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করেছেন। বর্ণিত আছে-

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، قَالَ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ، قَالَ حَدَّثَنِي كَثِيرُ بْنُ فَرْقَدٍ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَنْحَرُ أَوْ يَذْبَحُ بِالْمُصَلَّى‏.‏

অনুবাদঃ আবদুল্লাহ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) ... ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে নাহর করতেন কিংবা যবেহ করতেন।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে, যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:

মুসলিম জাতির পিতা আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নত হলো কুরবানী করা। তাঁহার পবিত্র ত্যাগের স্মৃতির অনুসরণে আমরা প্রত্যেক বছর কুরবানী করি। কুরবানীর ইতিহাস সম্পর্কে কুরআন শরীফে এসেছে হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে নেক সন্তানের জন্য এই বলে দুআ করলেন-

ﺭَﺏِّ ﻫَﺐ ﻟﻰ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼّـٰﻠِﺤﻴﻦَ .

অর্থাৎ- হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। (আসূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত নং-১০০ )

আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.) কে নেক সন্তান দান করলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। তিনি যখন বাবার সাথে চলা ফেরার উপযুক্ত হলেন তখন ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ঠ হয়ে সন্তানকে কুরবানী দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি ইসমাঈল (আ.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন -

ﺑُﻨَﻰَّ ﺇِﻧّﻰ ﺃَﺭﻯٰ ﻓِﻰ ﺍﻟﻤَﻨﺎﻡِ ﺃَﻧّﻰ ﺃَﺫﺑَﺤُﻚَ . ﻓَﺎﻧﻈُﺮ ﻣﺎﺫﺍ ﺗَﺮﻯٰ ۚ

ইব্রাহীম তাকে বললেনঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কি দেখ । (সূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত নং-১০২)

তাঁর সুসন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.) ও নিজেকে বিলিয়ে দিতে নিবেদিত ছিলেন। তিনি জবাব দিয়েছেন-

ﻳَـٰٓﺄَﺑَﺖِ ﭐﻓْﻌَﻞْ ﻣَﺎ ﺗُﺆْﻣَﺮُ ُ ۖ ﺳَﺘَﺠِﺪُﻧﻰ ﺇِﻥ ﺷﺎﺀَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼّـٰﺒِﺮﻳﻦَ .

অর্থাৎ- “পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।” (আল-কুরআন, প্রাগুক্ত)

তাফসীরের কিতাবে এসেছে হয়েছে ইবরাহীম (আ.) যখন তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে স্বপ্নের কথা বলেন তখন ইসমাঈল (আ.)-এর বয়স ছিল তের বৎসর। ইবরাহীম (আ.) পরপর তিন দিন এই স্বপ্ন দেখেন।

১) প্রথম দিন স্বপ্ন দেখে তিনি সারাদিন চিন্তা-ভাবনায় কাটিয়ে দেন এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের পক্ষ থেকে। তাই এটাকে বলা হয় ﻳﻮﻡ ﺍﻟﺘﺮﻭﻳﺔ (দেখা ও চিন্তাভাবনার দিন)।

২) দ্বিতীয় দিন তিনি একই স্বপ্ন দেখে নিশ্চিত হন যে এটা আল্লাহর পক্ষ হতে। এ দিনকে আমরা আরফার ﻋﺮﻓﺔ (পরিচয়ের) দিন বলি।

৩) তৃতীয় দিন স্বপ্ন দেখে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন এবং কুরবানী ( ﻧﺤﺮ ) করেন। এদিনকে আমরা ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻨﺤﺮ বলি।

অবশ্য প্রথম দু‘টির নামকরণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যাখ্যাও বিদ্যমান।

হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাহে তার সন্তান কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কারণ নবীগণের স্বপ্ন ওহী। রাসূল (সা.)-এর কাছে কখনো কখনো স্বপ্নযুগে ওহী নাযিল হতো। রাসূল (সা.) বলেন -

ﺇِﻧَّﺎ ﻣَﻌْﺸَﺮَ ﺍﻷَﻧْﺒِﻴَﺎﺀِ ﺗَﻨَﺎﻡُ ﺃَﻋْﻴُﻨُﻨَﺎ ، ﻭَﻻ ﺗَﻨَﺎﻡُ ﻗُﻠُﻮﺑُﻨَﺎ ( ﺍﻟﻄﺒﻘﺎﺕ ﺍﻟﻜﺒﺮﻯ ﻻﺑﻦ ﺳﻌﺪ )

অর্থাৎ- ‘আমরা নবীগণ; আমাদের চোখ ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।’

ইসলামে স্বপ্নের গুরুত্ব রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন স্বপ্ন মূল্যহীন। কিন্তু না. মুমিনের স্বপ্নের অর্থ আছে। যদি দ্রষ্টা সত্যবাদী হয়, ওযূর সহিত ঘুমায় আর ভালো সময়ে স্বপ্ন দেখে তাহলে সে স্বপ্নের মূল্য আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “স্বপ্ন হলো নবুওয়াতের ছয়চল্লিশ ভাগের এক ভাগ।”

স্বপ্ন সাধারনত তিন প্রকার। ১) একটা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে, ২) আরেকটা হলো নিজের খেয়াল থেকে, ৩) আর আরেক প্রকার হলো শয়তানের পক্ষ থেকে।

তাফসীরের কিতাবসমূহে পাওয়া যায় ইবরাহীম (আ.) তার পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন কিন্তু গলা কাটছিল না। সে জন্য ইসমাঈল (আ.) তার বাবাকে বলেছিলেন- ‘আপনি আমাকে উপুড়/ কাত করে শুইয়ে দিন। হয়তো আপনি ভালোবাসার ঠিকমতো ছুরি চালাতে পারছেন না। ইবরহীম (আ.) যখন ছুরি চালাতে লাগলেন তখন আল্লাহ তায়ালা ঈসামাইল (আ.)- এর পরিবর্তে বেহেশতী জন্তু পাঠিয়ে এই বার্তা দিলেন তোমরা আমার জন্য সব দিতে প্রস্তুত হলে কিছুই হারাতে হবে না। প্রাণ না দিয়েও তা কুরবানীর মর্যাদা লাভ করবে। যেমনটি কুরআনে এসেছে-

ﻓَﻠَﻤّﺎ ﺃَﺳﻠَﻤﺎ ﻭَﺗَﻠَّﻪُ ﻟِﻠﺠَﺒﻴﻦِ ﴿١٠٣﴾ ﻭَﻧـٰﺪَﻳﻨـٰﻪُ ﺃَﻥ ﻳـٰﺈِﺑﺮٰﻫﻴﻢُ ﴿١٠٤﴾ ﻗَﺪ ﺻَﺪَّﻗﺖَ ﺍﻟﺮُّﺀﻳﺎ ۚ ﺇِﻧّﺎ ﻛَﺬٰﻟِﻚَ ﻧَﺠﺰِﻯ ﺍﻟﻤُﺤﺴِﻨﻴﻦَ ﴿١٠٥ ﴾

অর্থাৎ- “যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত নং-১০৩-১০৪)

ঈসামাইল (আ.)- এর পরিবর্তে জন্তু পাঠিয়ে আল্লাহ এটাও বুঝিয়ে দিলেন নরবলি তিনি পছন্দ করেন না। পিতাকে দিয়ে পুত্রের গলায় ছুরি চালানোও উদ্দেশ্য নয়। এটা ছিল ইবরাহীম (আ.)- এর জন্য মহান পরীক্ষা। কুরআনে এসেছে-

ﺇِﻥَّ ﻫـٰﺬﺍ ﻟَﻬُﻮَ ﺍﻟﺒَﻠـٰﺆُﺍ۟ ﺍﻟﻤُﺒﻴﻦُ ﴿١٠٦﴾ ﻭَﻓَﺪَﻳﻨـٰﻪُ ﺑِﺬِﺑﺢٍ ﻋَﻈﻴﻢٍ ﴿١٠٧﴾ ﻭَﺗَﺮَﻛﻨﺎ ﻋَﻠَﻴﻪِ ﻓِﻰ ﺍﻝﺀﺍﺧِﺮﻳﻦَ ﴿١٠٨﴾ ﺳَﻠـٰﻢٌ ﻋَﻠﻰٰ ﺇِﺑﺮٰﻫﻴﻢَ ﴿١٠٩ ﴾

অর্থাৎ- “নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে।” (সূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত নং-১০৪-১০৯)

তাঁর এ কাজ আল্লাহর পছন্দ হয়ে যায়; তাই একাজকে পরবর্তী উম্মতের জন্য স্মৃতিবাহী রীতি হিসাবে চালু করে দেন।

প্রত্যেক যুগে কুরবানী ছিল:

আল্লাহ সকল যুগে কুরবানীর বিধান দিয়েছেন -

ﻭَﻟِﻜُﻞِّ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺟَﻌَﻠﻨﺎ ﻣَﻨﺴَﻜًﺎ ﻟِﻴَﺬﻛُﺮُﻭﺍ ﺍﺳﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻋَﻠﻰٰ ﻣﺎ ﺭَﺯَﻗَﻬُﻢ ﻣِﻦ ﺑَﻬﻴﻤَﺔِ ﺍﻷَﻧﻌـٰﻢِ ۗ

অর্থাৎ- “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” (আল-কুরআন ২২:২৩)

কিন্তু মানুষ এটাকে বিকৃতভাবে পালন করতে শুরু করে। পশুকে জবাইর পরিবর্তে বলি, এমনকি নরবলির মত কুপ্রথাও সমাজে চালু হয়। ইসলাম এসব কুসংস্কার রহিত করে সুন্দর পথ উপস্থাপন করেছে। কিন্তু অন্য অনেক ধর্মে পশু বলি দেয়ার পর এটা খাওয়ার বিধান নেই। রক্ত দেব-দেবীর উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয়, জাহেলী যুগে কাবার দেয়ালেও ছিটিয়ে দেয়া হত। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা দেন পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বরং আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন, আমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ বলেন-

ﻟَﻦ ﻳَﻨﺎﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻟُﺤﻮﻣُﻬﺎ ﻭَﻻ ﺩِﻣﺎﺅُﻫﺎ ﻭَﻟـٰﻜِﻦ ﻳَﻨﺎﻟُﻪُ ﺍﻟﺘَّﻘﻮﻯٰ ﻣِﻨﻜُﻢ ۚ

অর্থাৎ- এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। (আল-কুরআন ২২:৩৭)

অন্য আয়াতে এসেছে -

ﺇِﻧَّﻤﺎ ﻳَﺘَﻘَﺒَّﻞُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻤُﺘَّﻘﻴﻦَ .

অর্থাৎ- “আল্লাহ র্ধমভীরুদরে পক্ষ থকেইে তাে গ্রহণ করনে।” (আল-কুরআন ৫:২৭)

কুরবানীর ফজিলত:

কুরবানীর ফদ্বীলতে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে -

ﻗﺎﻝ ﺃﺻﺤﺎﺏ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﺎ ﻫﺬﻩ ﺍﻷﺿﺎﺣﻲ ﻗﺎﻝ ﺳﻨﺔ ﺃﺑﻴﻜﻢ ﺇﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﻗﺎﻟﻮﺍ ﻓﻤﺎ ﻟﻨﺎ ﻓﻴﻬﺎ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﺑﻜﻞ ﺷﻌﺮﺓ ﺣﺴﻨﺔ ﻗﺎﻟﻮﺍ ﻓﺎﻟﺼﻮﻑ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﺑﻜﻞ ﺷﻌﺮﺓ ﻣﻦ ﺍﻟﺼﻮﻑ ﺣﺴﻨﺔ . ) ﺳﻨﻦ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﻪ , ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻷﺿﺎﺣﻲ : ﺑﺎﺏ ﺛﻮﺍﺏ ﺍﻷﺿﺤﻴﺔ (

আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে কুরবানী সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নত। আমরা আবার জানতে চাইলাম কুরবানীতে আমাদের জন্য কি রয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কুরবানীর পশুর প্রত্যেক লোম পরিমাণ সওয়ার দান করা হয়...। (ইবনে মাজাহ)

হাদীস শরীফে আরও এসেছে –

ﺍﺳﺘﻔﺮﻫﻮﺍ ﺿﺤﺎﻳﺎﻛﻢ، ﻓﺈﻧﻬﺎ ﻣﻄﺎﻳﺎﻛﻢ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺼﺮﺍﻁ .

অনুবাদঃ “তোমাদের কুরবানীর পশুগুলোকে সুন্দর ও সাস্থ্যবান কর কেননা এগুলো পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে।” (দায়লামী)

কুরবানী না করার ব্যাপারে সতর্কবাণী:

আর যারা নিসাবের মালিক হয়েও কুরবানী করবেন না তাদের ব্যপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন -

ﻣﻦ ﻛﺎﻥ ﻟﻪ ﺳﻌﺔ ﻭﻟﻢ ﻳﻀﺢ ﻓﻼ ﻳﻘﺮﺑﻦ ﻣﺼﻼﻧﺎ

ﺳﻨﻦ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﻪ , ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻷﺿﺎﺣﻲ , ﺑﺎﺏ ﺍﻷﺿﺎﺣﻲ ﻭﺍﺟﺒﺔ ﻫﻲ ﺃﻡ ﻻ .

অনুবাদঃ “যার সামর্থ্য আছে অথচ কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (ইবনে মাজাহ)

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব:

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। -আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫

কুরবানীর পশু কেমন হবে:

পশু হোক বা অন্য যে কোন বস্তু, সর্বোৎকৃষ্টটাই সবার কাছে প্রিয় হয়ে থাকে। এই জন্য কুরবানী বা সাধারণ সাদকাহ, যাই হোক না কেন, আল্লাহর নিদের্শ হলো সর্বোৎকৃষ্ট হতে হবে। তাই তাইতো আল্লাহ পাক বলেছেন -

لن تنالوا البر حتى تنفقوا مما تحبون

অনুবাদঃ “তোমরা যা পছন্দ করেন তা ব্যয় না করা পর্যন্ত পূন্য অর্জন করতে পারবে না।”

তাই কুরবানীর পশু ক্রয় করার সময় সর্বোৎকৃষ্ট পশুটি ক্রয় করতে হবে। আর ভালো করে দেখতে হবে পশু টির মধ্যে কোনরূপ ত্রুটি আছে কিনা। কুরবানীর পশু কি রকম হবে নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-

১. এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; আলমগীরী ৫/২৯৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

২. গরু-ছাগলের অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে না পারে তবে ঐ পশু কুরবানী করা যাবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৮

৩. যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু শিং ভাঙ্গার কারণে মস্তিষ্কে যদি আঘাত না পৌঁছে তাহলে সেই পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয। তাই যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি, সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭

৪. যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের কম হয় তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫; মুসনাদে আহমাদ ১/৬১০; ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮

৫. উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

৬. উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

কুরবানীর পশু জবেহ করার নিয়ম:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে কুরবানীর জন্তু যবেহ করেছেন। কুরবানী দাতা যদি কুরবানীর জন্তু যবেহ করতে সক্ষম হন তাহলে নিজ হাতেই যবেহ করবেন। আর যদি কুরবানীর জন্তু যবেহ করতে না পারেন, তাহলে কুরবানীর সময় কুরবানীর স্থানে উপস্থিত থাকবেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমা (রা.) কে কুরবানীর সময় জন্তুর পাশে থাকতে বলেছেন।

উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলকুম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘بسم الله الله اكبر’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়। (সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ প্রভৃতি।)

কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবেহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবেহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে যবেহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবেহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবেহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ।)

ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)

জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)

এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করা, জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট না দেওয়া অনুচিত।

জবেহকালীন দোয়া :

কোরবানির পশু জবেহ করার সময় অবশ্যই আল্লাহর নাম মুখে অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলতে হবে। কেননা আল্লাহ পাক বলেছেন -

ﻭَﻟِﻜُﻞِّ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺟَﻌَﻠﻨﺎ ﻣَﻨﺴَﻜًﺎ ﻟِﻴَﺬﻛُﺮُﻭﺍ ﺍﺳﻢَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻋَﻠﻰٰ ﻣﺎ ﺭَﺯَﻗَﻬُﻢ ﻣِﻦ ﺑَﻬﻴﻤَﺔِ ﺍﻷَﻧﻌـٰﻢِ ۗ

অর্থাৎ- “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” (আল-কুরআন ২২:২৩)

কোরবানির পশু জবেহ করার সময় বিভিন্ন ধরনের দোয়া কিতাব সমূহের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন-

১) জবেহের সময় বলবে- بسم الله الله اكبر অর্থাৎ- আল্লাহর নামে শুরু করছি, আল্লাহ মহান।

২) بسم الله اللهم تقبل منى ومن اهلي بيتي অর্থাৎ- আল্লাহর নামেশুরু করছি, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হতে।

৩) এখানে কুরবানী অন্যের হলে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন بسم الله اللهم تقبل من فلان ومن اهلي بيته‘ অর্থাৎ- আল্লাহর নামে শুরু করছি, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ হতে। (মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ)

৪) بسم الله الله اكبر اللهم تقبل منى كما تقبل من ابراهيم خليلك‘ অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমার পক্ষ হতে কবুল কর যেমন কবুল করেছ তোমার দোস্ত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে)। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ)

৫) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী)

৬) উপরোক্ত দো‘আগুলির সাথে অন্য দো‘আও রয়েছে। যেমন-

‘اني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض علاء علي بالتي ملتي ابراهيم حنيفا وما انا من من المشركين

ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা ‘আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন।

ان صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين لا شريك له وبذلك امرت وانا من المسلمين

আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা; (মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী) বিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবার’। (বায়হাক্বী ৯/২৮৭; আবু ইয়া‘লা, মির‘আত ৫/৯২; সনদ হাসান, ইরওয়া ৪/৩৫১)

কুরবানীর পশুর গোশত বন্টন :

শরীকদের কারো পুরো নিয়ত যদি গোস্ত খাওয়া হয় বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।

কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে বন্ঠন করবেন। একভাগ নিজের জন্য রাখবেন, আরেকভাগ আত্মীয় স্বজনকে

দিবেন আর আরেকভাগ গরীব-মিসকীনকে দিবেন। এটা সুন্নাত। তবে কুরবানীকারীর যদি বড় পরিবার হয় তাহলে কোরবানীর সম্পূর্ণ গোস্ত খাওয়ার জন্য রাখা যায়েজ আছে। কিন্তু এরকম না করা ভাল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

ﻓَﻜُﻠﻮﺍ ﻣِﻨﻬﺎ ﻭَﺃَﻃﻌِﻤُﻮﺍ ﺍﻟﺒﺎﺋِﺲَ ﺍﻟﻔَﻘﻴﺮَ ﴿٢٨ ﴾

অনুবাদঃ “অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ- অভাবগ্রস্থকে আহার করাও।” (আল-কুরআন: ২২:২৮)

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন -

ﻛُﻠُﻮﺍ ﻭَﺗَﺼَﺪَّﻗُﻮﺍ ﻭَﺗَﺰَﻭَّﺩُﻭﺍ ﻭَﺍﺩَّﺧِﺮُﻭﺍ .

ﻣﻮﻃﺄ ﻣﺎﻟﻚ , ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﻀﺤﺎﻳﺎ : ﺑﺎﺏ ﺍﺩﺧﺎﺭ ﻟﺤﻮﻡ ﺍﻷﺿﺎﺣﻲ

শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১

কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০

কুরবানীর পশুতে আকীকার অংশ: কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।-হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২

মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী: মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; কাযীখান ৩/৩৫২-মুসনাদে আহমাদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫; ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; কাযীখান ৩/৩৫২

অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে: অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নিলে এর দ্বারা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।

চামড়া, গোশত, চর্বি বিক্রি করা: কুরবানীর চামড়া যদি নিজে ব্যবহার করতে পারেন তাহলে করতে পারবেন। আর যদি বিক্রি করেন তাহলে সকল টাকা যাকাতের প্রাপ্য যারা তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন চামড়ার টাকা মসজিদ-মাদরাসা উন্নয়নের জন্য অথবা বেতনের জন্য দেওয়া জায়য নয়। যদি মাদরাসায় গরীব ফান্ড থাকে তাহলে সেখানে দিতে পারেন কিন্তু আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে এই টাকা মাদরাসার উন্নয়নে অথবা কারো বেতনে ব্যয় হচ্ছে না। অন্যথায় আপনার সদকাহ আদায় হবে না।

কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযীখান ৩/৩৫৪; আলমগীরী ৫/৩০১

বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানী অন্যত্র করা: বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয। কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮

কুরবানীর পশুর হাড় বিক্রি: কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। আর জেনেশুনে মহাজনদের জন্য এদের কাছ থেকে ক্রয় করাও বৈধ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযীখান ৩/৩৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযীখান ৩/৩৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

কাজের লোককে কুরবানীর গোশত খাওয়ানো: কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে। -আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬; ইমদাদুল মুফতীন পৃ. ৮০২

জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া: জবাইকারী বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।

কুরবানীর পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫

কুরবানীর আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়েল:

১. কুরবানী এবং যাকাতের মধ্যে পার্থক্য হলো যাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকা আবশ্যক। কিন্তু কুরবানী জন্য এক বৎসর থাকা আবশ্যক নয়। যদি কুরবানীর দিনগুলোতেও কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলেও তাকে কুরবানী করতে হবে।

২. কুরবানী করা নেসাব পরিমান সম্পদের মালিক সকল মুসলমানের উপর ওয়াজিব। অনেকে মনে করেন গত বৎসর আমার পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি এ বৎসর আমার বাবার পক্ষ থেকে অথবা অন্য কারো পক্ষ থেকে দিয়ে দেই। যদি এরকম করেন তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। কারণ কুরবানী যার উপর ওয়াজিব তার পক্ষ থেকেই প্রথমত: কুরবানী আদায় করতে হবে।

৩. কোন মহিলারও যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে তাকে কুরবানী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি এই মহিলার স্বামী স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তাহলে তাকেও কুরবানী করতে হবে। এক কুরবানী দু’জনের পক্ষ থেকে আদায় হবে না। তবে যদি অংশিদার হয়ে কুরবানী করেন তাহলে আদায় হবে।

৪. গরু, মহিষ এবং উট কুরবানীর ক্ষেত্রে এক পশুতে সাত জন অংশিদার হতে পারবেন। তবে শর্ত হলো সাত জনের নিয়ত সহীহ হতে হবে। খালিসভাবে আল্লাহর জন্য কুরবানীর নিয়ত রাখতে হবে। যদি সাত জনের কোন একজনের নিয়তে ভিন্নতা থাকে তাহলে কারো কুরবানী আদায় হবে না।

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোন অংশে অংশীদার হওয়া জায়েয। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ- যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

৫. আপনি খাসী, ভেড়া, দুম্বা দিয়েও কুরবানী করতে পারেন। তবে খাসী, ভেড়া, দুম্বা একজনের পক্ষ থেকেই আদায় করতে হবে। এতে অংশিদার হয়ে কুরবানী করা জায়য নয়। কুরবানী নিজের হাতে দেওয়া উত্তম।

৬. কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫

৭. যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০

৮. সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.কে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়্যত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন। -সুনানে আবু দাউদ ২/২৯, জামে তিরমিযী ১/২৭৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, মিশকাত ৩/৩০৯

কুরবানীর ইহ-পরকালীন উপকার:

কুরবানীর মাধ্যমে আমরা নিজেকে আল্লাহর রাহে কুরবান হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করি। আমাদের কুপ্রবৃত্তি ও নফসে আম্মারাহ দমনের শিক্ষা নেই। তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তাধারার অনুসারী অনেকে প্রশ্ন করে যে কুরবানীর মাধ্যমে তো কেবল পশুর প্রাণ যায়, মানুষের তো কিছু হয় না। জবাবে বলা যায় কুরবানীর পশু ক্রয় করতে তো আমাদের টাকা খরচ করতে হয়েছে। জন্তু কুরবানীর মাধ্যমে এক বিবেচনায় আমাদের অর্থই কুরবানী হচ্ছে। কুরবানীর দ্বারা আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে লাভবান হই। আমরা আল্লাহর নির্দেশ পালন করি, ইবরাহীম ও আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মর্যাদা লাভ করি। পশুর প্রতিটি পশমের পরিমাণ সাওয়াব হাসিল করি।

অন্যদিকে কুরবানীর গোশত আমরা নিজেরা খেতে পারি, আত্মীয়স্বজনকে উপহার দিতে পারি এবং অসহায় ও বঞ্চিতদের সাহায্য করতে পারি। কুরবানীর পশুর কেনা-বেচা ও এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। আর সর্বজনবিধিত অর্থকরি দ্রব্য চামড়া রপ্তানীর মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে গতি আসে। অনেকে আবার পেরেশান হয়ে পড়েন এক সাথে এত পশু নিধনে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায়। আল্লাহর বিধান হলো মানুষ হালাল জন্তুর গোশত ভক্ষন করবে। আর সৃষ্টিকূলের মধ্যেও এ নিয়মই চালু আছে। বাঘ শিয়াল খায়, শিয়াল মোরগ খায়, মোরগ পোকা খায়, আবার পোকা গাছের পাতা খায়, এটাই নিয়ম। কোন প্রাণীর খাদ্য কি হবে সেটা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এখন আপনি পোকা কে নিষেধ করতে পারবেন না যে তুমি গাছের পাতা খেয়ো না। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ করেছেন পশু কুরবানী করতে, তাই আমরা কুরবানী করি।

আইয়ামে তাশরীকর তাকবীর:

পবিত্র যিল-হজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাযের পর থেকে ১৩ তারিখ আসরের নামাযের পর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীর দেওয়া ওয়াজিব। ইহাকে আইয়ামে তাশরীক এর তাকবীর বলা হয়। পুরুষ এবং মহিলা সবাইকে তাকবীর দিতে হবে। জামাতে নামায হোক অথবা একাকী নামায হোক একবার তাকবীর বলা ওয়াজিব। তিনবার বলা মুস্তাহাব। মহিলারা আস্তে আস্তে তাকবীর বলবেন। পুরুষগণ জোরে জোরে তাকবীর বলা মুস্তাহাব। তাকবীরে তাশরীক হলো-
اللَّهُ أَكْبَرُ, اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ, لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَاَللَّهُ أَكْبَرُ, اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হাম্দ্।’
অর্থ : ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।’
নামাযের পর পর তাকবীর দিতে ভূলে গেলে যখনই স্মরণ হবে সাথে সাথে তাকবীর পড়ে নিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।

মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে খালিছ নিয়তে কুরবানী করার এবং এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন ।