ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিলেখা পাঠানোর নিয়মাবলীযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

প্রসঙ্গ অকাল মৃত্যু : একটি আত্নঘাতি শব্দ প্রয়োগ

আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামে ঘোষণা করেছেন "প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে"। এই চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই আমাদের।

ইসলামের কন্ঠ
প্রসঙ্গ অকাল মৃত্যু : একটি আত্নঘাতি শব্দ প্রয়োগ

আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামে ঘোষণা করেছেন "প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে"। এই চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। এতে বয়সেরও কোন সময়-সীমা নির্ধারিত নেই। আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, যুবক, শিশু এবং প্রাণী বলতেই কখন যে কার ডাক আসে; তা মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই। যেহেতু হায়াত এবং মউতের খবর একমাত্র তিনিই জানেন।

"অকাল মৃত্যু" এই শব্দটি ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না বরং সাংঘর্ষিক। কারণ প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর মতো তার মৃত্যুক্ষণও অবধারিত এবং সুনির্দিষ্ট। সাধারণ বিবেচনায় কোনো মৃত্যু অকালে ঘটলেও বাস্তবে কিন্তু কোনো মৃত্যুই অকালে ঘটে না। প্রতিটি মৃত্যু তার নিজস্ব কাল বা সময়েই ঘটে। মানুষের জন্মের অনেক আগেই তার মৃত্যুক্ষণ লিখিত হয়ে আছে। সুনির্ধারিত ওই সময়ের এক সেকেন্ড আগে কিংবা এক মুহূর্ত পরেও কারো মৃত্যু হয় না এবং হবেও না।

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আল্লাহ সব কিছুর তাকদীর লিখে রেখেছেন। [মুসলিম শরীফ : ২৬৫৩]

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَاجًا ۚ وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَىٰ وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِ ۚ وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

‘আর আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে। এরপর তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং নারী তার গর্ভে যা ধারণ করে আর যা প্রসব করে, তা আল্লাহর জ্ঞাতসারেই হয়। আর কোনো বয়স্ক ব্যক্তির বয়স বাড়ানো হয় না কিংবা কমানোও হয় না, কিন্তু তা তো রয়েছে কিতাবে; নিশ্চয় তা আল্লাহর জন্য সহজ। [সূরা আল-ফাতির, আয়াত : ১১]

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন,

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

‘তাঁর কাছেই গায়েবী বিষয়ের চাবিসমূহ রয়েছে; এগুলি তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। জলে এবং স্থলে যা কিছু আছে, একমাত্র তিনিই জানেন। তাঁর জানার বাইরে গাছের একটি পাতাও নড়ে না। তাকদীরের লিখন ছাড়া কোনো শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোনো আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্যও পতিত হয় না। [সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ৫৯]

এ আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে, প্রতিটি মানুষের মৃত্যুক্ষণ সুনির্ধারিত। যিনি যখন যেভাবেই মারা যান না কেন; আল্লাহর কাছে তা সুনির্দিষ্ট। অতএব সব মৃত্যুই সঠিক সময়ে হয়। কোনো মৃত্যুই অকালে হয় না। আশি বছর বয়সে একজন লোক মারা গেছেন। আশি বছর বেঁচে থাকা এই সময়ে চাট্টিখানি কথা নয়। অতঃপর বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাভাবিক অবস্থায়ই লোকটা মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কালো বর্ণের ব্যানার টানানো হয় “অমুকের অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত”! লোকটি যে বয়সেরই হোক; মারা গেলেই কালো ব্যানারে শোক প্রকাশ যেন আধুনিকতায় পরিণত হয়ে গেছে! আর শোক-প্রকাশমূলক কথায় ‘অকাল মৃত্যু’ শব্দটি যুক্ত করা 'অবশ্য কর্তব্য বা অঘোষিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে'! কারো ‘অকাল মৃত্যু’ হয় না। মৃত্যু তার আসল কালেই হয়। নির্ধারিত এবং ঠিক সময়েই হয়। জন্মের আধাঘন্টা পর কোনো নবজাতকের মৃত্যু হলেও বুঝতে হবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এই আধাঘন্টাই তার হায়াত নির্ধারিত ছিলো। ‘অকাল মৃত্যু’ বলার দ্বারা দুটি মারাত্মক বিচ্যুতি প্রকাশ পায়-

এক. সবার হায়াত যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং সুনির্দিষ্ট, ‘অকাল’ বলার দ্বারা পরোক্ষভাবে তা অস্বীকার করা হয়।

দুই. আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ধারিত সময়ের আগে বান্দাকে মৃত্যু প্রদানের পরোক্ষ অভিযোগ আরোপ করা হয়। যেন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাকে অভিযোগের সুরে বলা হচ্ছে যে, লোকটি চাইলে আরো অনেকদিন বেচে থাকতে পারতো, আপনি তাকে অকালে মৃত্যু দিলেন কেন?

প্রত্যেক প্রাণীর জন্য ‘মৃত্যু’ যেমন অনিবার্য; তেমনি তার দিনক্ষণও নির্ধারিত। সেই নির্ধারিত সময়েই তার মৃত্যু হবে। এতে নুন্যতম এদিক-সেদিক হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا ۗ

আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেননা, তা সুনির্ধারিত। [-সূরা আলে ইমরান : ১৪৫]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَٰكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ

আল্লাহ্ যদি মানুষকে তাহাদের সীমালংঘনের জন্য শাস্তি দিআর যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের জুলুমের কারণে শাস্তি দিতেন, তবে ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী কোনো প্রাণীকেই রেহাই দিতেন না। কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের নির্ধারিত সময় উপস্থিত হয়, তখন তারা মুহূর্তকাল বিলম্ব অথবা ত্বরা করতে পারে না। [-সূরা নাহল : ৬১]

হায়াত-মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রাণীর জীবনকাল আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে সুনির্ধারিত। অতএব কেউ যদি মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পর মারা যায়, তবে এইটুকুই তার হায়াত। তদ্রূপ কেউ যদি পঁচিশ-ত্রিশ বছরের যৌবনকালে মৃত্যুবরণ করে, এই পঁচিশ-ত্রিশ বছরই তার হায়াত। তার মৃত্যু সেই সময়মতোই হয়েছে বা হয়, যা আল্লাহ তায়ালা তার জন্য নির্ধারিত করেছেন। এমনিভাবে একশ বছর বয়সে কারো মৃত্যু হওয়ার মানে এই নয় যে, সে তার জন্য নির্ধারিত সময়কালের অধিক হায়াত পেয়েছে।

সুতরাং যেকোনো বয়সে যেকারো মৃত্যু হলে, তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো যেতে পারে, মরহুমের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা যেতে পারে, বড় জোর একথা বলা যাবে যে; তার তাকদীরে কত কম হায়াত লিখিত ছিল! কিন্তু এটাকে আবেগের বশে "অকাল মৃত্যু" বলা মোটেই উচিত না। তবে হ্যা! কিছুকিছু মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়, এজন্য আমরা যারা জীবিত আছি, তারা তো আল্লাহর হুকুমকে অমান্য করতে পারি না কিংবা পারবোও না। আর একেকটা মৃত্যু হচ্ছে আমাদের জন্য শিক্ষা। আমরাও যেন তৈরী থাকি আমাদের শেষ গন্তব্যের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, মৃত্যু থেকে আমরা কি শিক্ষা নিই? যদি আমাদের নিকটাত্মীয় বা রক্তসম্পর্কিত কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে কয়েকদিন; অতি সামান্য কয়েকদিন আমরা আবেগের জুড়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে আর বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষ কল্যাণে সোস্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য (!) আদায় করে, আমরা যেই-সেই হয়ে যাই। আমার দেখা এবং আমার আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা কল্পনা তো দুরের কথা- কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। এই মৃত্যুগুলো আমাকে ভাবায় এবং কাদায়! তাইবলে এতে "অকাল মৃত্যু" বলার কোন অবকাশ নেই। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া-ই হবে আমাদের এবং তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপকারের বিষয়।

বিশেষত এই করোনাকালীন মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী অনেক বয়োবৃদ্ধ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুকেও অনেকে দেখেছি "অকাল মৃত্যু" বলে সম্বোধন করতে। যা রীতিমতো বোকামি ছাড়া আমার কাছে আর কিছু মনে হচ্ছে না। কারণ "মহামারি" পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু হয়েছে। অতীতেও মহামারিতে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, এখনো করছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। তবে যারাই মৃত্যুবরণ করবেন, তাদের হায়াত এখানেই সীমাবদ্ধ।

বলাবাহুল্য; করোনা বা কোন মহামারি কিন্তু কারো জন্যই মৃত্যুর কারণ না। বরং আমরাই এজন্য বেশিরভাগ দায়ী। আমি নিজে অচেতন থেকে যদি অন্যকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেই, তাহলে বিষয়টি কেমন দেখায়?

তাই আসুন ‘অকাল মৃত্যু’ বলার এই ভ্রান্ত সংস্কৃতি পরিহার করি। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত হায়াতের উপর সন্তুষ্ট থাকি।