অহংকার ধ্বংসাত্মক কবীরাহ গুনাহ
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সাথে সাথে তাদেরকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ভালো এবং মন্দের সমন্বয় দিয়ে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ. -আমি তাদেরকে দু’টি রাস্তা দেখিয়েছি। (আল কুরআন; সূরা বালাদ, আয়াত-১০)


আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সাথে সাথে তাদেরকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ভালো এবং মন্দের সমন্বয় দিয়ে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ.
-আমি তাদেরকে দু’টি রাস্তা দেখিয়েছি। (আল কুরআন; সূরা বালাদ, আয়াত-১০) সুতরাং তারা ইচ্ছা করলে ঈমান আনতেও পারে আবার ইচ্ছা করলে অস্বীকারও করতে পারে। ঈমান আনার পর একজন মুমিনের অনেক দায়িত্ব। আল্লাহর নির্দেশকৃত বিষয় মেনে চলা নিষেধকৃত বিষয় পরিহার করা। এ ক্ষেত্রেও দু’টি রাস্তা। ভালো এবং মন্দ। দুই রাস্তা থাকার কারণ হলো আমাদের মধ্যে কে উত্তম আমল করে এটা পরীক্ষা করার জন্য।
الذي خلق الموت والحياة ليبلوكم أيكم أحسن عملا. (سورة الملك- اية ২)
অনুবাদ : যনিি সৃষ্টি করছেনে মরণ ও জীবন, যাতে তােমাদরেকে পরীক্ষা করনে-কে তােমাদরে মধ্যে র্কমে শ্রষ্ঠে? তনিি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।(আল কুরআন; সূরা: আল মুলক, আয়াত-০২)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যে সকল বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন তন্মধ্যে একটি হলো অহংকার। মানুষের মনের যে সকল রোগ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগ হলো অহংকার।
কুরআনে এসেছেÑ
نَّهُ لا يُحِبُّ المُستَكبِرينَ ﴿٢٣﴾
-নশ্চিতিই তনিি অহংকারীদরে পছন্দ করনে না।(আল কুরআন; সূরা: আন নাহাল, আয়াত-২৩)
অন্য আয়াতে এসেছে-
إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ مُختالٍ فَخورٍ ﴿١٨﴾
নশ্চিয় আল্লাহ কােন দাম্ভকি অহংকারীকে পছন্দ করনে না। (আল কুরআন; সূরা: আল লুকমান, আয়াত-১৮)
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে-
عبد الله بن مسعود رضي الله عنه عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ.
-হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-যার অন্তরে শরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
অহংকার বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। কথা-বার্তা, আমাদের চলা-ফেরা, আচরণ সব কিছুর মাধ্যমে অহংকার হতে পারে। কখনো কখনো অহংকার মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির পর ফিরিশতাদেরকে এবং ইবলিসকে নির্দেশ করেছিলেন আদম (আ.) কে সিজদাহ করার জন্য। কিন্তু ইবলিস করে নি। কুরআন শরীফে এসেছে أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الكَافِرِينَ সে অস্বীকার করলো এবং অহংকার করলো, ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হলো। (আল কুরআন; সূরা বাকারাহ, আয়াত-৩৮) ইবলিস তার অহংকার থেকে আল্লাহর সাথে যুক্তি দেখালো
أَنَاْ خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ.
-আমি তার থেকে উত্তম। আপনি আমাকে বানিয়েছেন আগুন থেকে আর তাকে বানিয়েছেন মাটি থেকে। (আল কুরআন; সূরা আ’রাফ, আয়াত-১২)
দেখা যাচ্ছে অহংকারই ইবলিসকে সিজদা করতে বাধা দিয়েছিল।
অহংকার বিভিন্নভাবে হতে পারে। চলা-ফেরায় অহংকারের ব্যপারে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ.
-তোমরা দাম্ভিক হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিককে পছন্দ করেন না। (আল কুরআন; সূরা লুকমান, আয়াত-১৮)
কাজেই অহংকারকে আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত। এটা একদিনের বিষয় নয়। ধীরে ধীরে আপনার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রন করে অহংকার দূর করতে হবে। কোন লোক যদি বলে আমি অহংকারী নই, তাহলে তার এই কথার মধ্যেও অহংকার থাকতে পারে। মনে আসতে পারে আমি ভালো মানুষ।
অহংকারের কারণে আমাদের সামাজে অশান্তি আসে। পরস্পর আন্তরিকতা নষ্ট হয়। মনে করুন, আপনি কোন অফিসের প্রধান। আপনি যদি আপনার অধীনস্ত লোকদের সামনে অহংকার করেন তাহলে আপনার দু’টি ক্ষতি হতে পারে। একটিÑ হলো আপনি তাদের কাছে নীচ বলে গন্য হবেন। অন্যদিকে হলো আপনার এই অধীনস্ত কর্মচারী আরেক জনের কাছে আপনার দোষ বলবে, ফলে আপনি তাকে গীবত করতে বাধ্য করলেন।
আল্লাহ কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় ব্যক্তি হলো অহংকারী ব্যক্তি।
রাসূল (সা.) অহংকার সম্পর্কে বলেন-
الكِبْرُ بَطَرُ الحقّ وغَمْطُ الناسِ.
-অহংকার হলো জেনে বুঝে সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে অবজ্ঞা করা।
মক্কার কাফিররা রাসূল (সা.) কে তাদের সন্তানাদি থেকে আরো বেশি জানতো। কিন্তু তারা অনেকে ঈমান আনে নি তাদের অহংকারের কারণে। নেতৃত্ব হারিয়ে ছোট হওয়ার ভয়ে।
অহংকার সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসে কুদসীতে এসেছে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
عن أبي هريرة قال : قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : قال الله عز وجل : الكبرياء ردائي ، والعظمة إزاري ، فمن نازعني واحداً منهما قذفته في النار.
-হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ফরমান অহংকার আমার চাদর আর মহত্ত্ব হলো আমার লুঙ্গি । যে আমার এই দু’টির কোন একটি নিয়ে ঝগড়া করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।
অহংকার করার একমাত্র যোগ্য হলেন আল্লাহ। একমাত্র তিনিই অহংকার করতে পারেন। আল্লাহর একটি সিফাতি নাম হচ্ছে অহংকারী (المتكبر)তাঁর সৃষ্টির অন্য কেউ অহংকার করতে পারে না। যদি সৃষ্টির মধ্যে কেউ অহংকার করার যোগ্য থাকেন তাহলে তিনি দু’জাহানের বাদশাহ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু তিনিও যখন নিজের প্রশংসা বর্ণনা করতেন তখন বলতেন এটা আমি অহংকার বশত: করছি না। তিনি রাসূল হিসাবে তার উপর আবশ্যক ছিল নিজের পরিচয় তুলে ধরা। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ আমি হলাম আদম সন্তানদের সরদার। সাথে সাথে রাসূল (সা.) বলেছেন وَلا فَخْرَ এতে আমি কোন অহংকার করছি না। এতে বুঝা গেল কেউ নিজের কোনো গুণের কথা প্রকাশ করতে হলেও বিনয়ের সাথে করতে হবে।
আমরা চিন্তা করবো আমি কি ছিলাম, কি হয়েছি। আল্লাহ আপনাকে কিভাবে গড়েছেন। এ সব চিন্তা করলে আপনার অহংকার আসবে না। প্রখ্যাত বুযুর্গ আহনাফ (র.) বলেন-
عجبت لمن يجري في مجرى البول مرتين، كيف يتكبَّر.
-আমি আশ্চর্য্য হই তাদের ব্যাপারে যাদের চলাচল প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে তারা কিভাবে অহংকার করে।
মুতাররাফ ইবন আবদিল্লাহ এর কাছে এক অহংকারী এসে বললÑ আপনি জানেন আমি কে? তিনি বললেন হ্যা জানিÑ
أولك نطفة قذرة، وآخرك جيفة قذرة، وأنت بين ذلك تحمل العَذِرَة.
-তোমার সূচনা হলো নিকৃষ্ট পানি, শেষে হবে পঁচা স্তুপ। আর মধ্যখানে তুমি যতদিন বেঁচে আছো ততদিন ময়লা বহন করছো।
মানুষ যে অবস্থানেই থাকুক সে অহংকার করতে পারবে না। অহংকার একটি মানসিক রোগ। এটা শুধু বড়লোকের মাঝে থাকে এমন নয়। আমীর, ফকীর সবারই অহংকার থাকতে পারে। প্রত্যেকের নিজ অবস্থান থেকে অহংকার করে। তবে বাহ্যিকতা শুধু উত্তম তথা-পোষাকের উপর নির্ভর করে অহংকারী বলা যাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে-
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه، عن النبي صلي الله عليه وسلم قال لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال ذرة من كبر. قال رجل: إن الرجل يحب أن يكون ثوبه حسناً ونعله حسناً. قال: إن الله جميل يحب الجمال، الكِبْرُ بَطَرُ الحقّ وغَمْطُ الناسِ.
-হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যার অন্তরে শরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সাহাবীদের কোন একজন জানতে চাইলেন কেউ যদি ইচ্ছা করে তার পোষাক, জুতা সুন্দর হোক তাহলে সেটা কি অহংকার হবে। রাসূল (স.) বললেন আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য্য পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে অস্বীকার করা আর মানুষকে ঘৃনা করা।
সুতরাং কেউ যদি উন্নত পোষাক পরেন তাকে অহংকারী বলা যাবে না। পোষাকের দ্বারাও অহংকার প্রকাশ পায়। যারা টাখনুর নিচে কাপড় পরেন তাদেরকে অহংকারী বলা হয়েছে। টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারীর নিন্দায় অনেক হাদীস এসেছে।
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন
لاَ يَنْظُرُ اللَّه يَوْم القِيامةِ إِلى مَنْ جَرَّ إِزارَه بَطَراً.
-যে টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। অন্য হাদীসে এসেছে
ما أسفل من الكعبين من الإزار ففي النار.
-টাখনুর নিচে কাপড় থাকলে সে অংশ দোযখে যাবে।
হযরত উমর (রা.) মুমূর্ষ অবস্থায় এক যুবক কে দেখলেন তার টাখনু কাপড় দিয়ে ঢাকা। তিনি তাঁকে ডেকে রাসূল (সা.)-এর হাদীস শুনালেন। সুতরাং আমাদের কাপড় যাতে টাখনু অতিক্রম না করে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আমাদের মধ্যে অনেকে বংশ নিয়ে গৌরব করেন। বংশ নিয়ে অহংকার করা ঠিক না। কিয়মতের দিন আল্লাহর তাআলার নিকট কারো বংশ পরিচয় ধর্তব্য হবে না। কুরআনে এসেছে-
فَإِذا نُفِخَ فِى الصّورِ فَلا أَنسابَ بَينَهُم يَومَئِذٍ وَلا يَتَساءَلونَ ﴿١٠١
-অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্নীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না।(আল কুরআন; সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত-১০১)
তাকওয়াই হচ্ছে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ.
‘আল্লাহর নিকট সেই সবচেয়ে মর্যাদাবান, তোমাদের মধ্যে যে খোদাভীরু। (আল কুরআন; সূরা হুজরাত, আয়াত-১৩)
আমাদের সকল কে অহংকার থেকে দূরে থাকতে হবে। অহংকারীকে আল্লাহ জান্নাতে দিবেন না। হাদীস শরীফে এসেছে, একবার জান্নাত এবং জাহান্নামের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলো। জাহান্নাম বলল আমার মধ্যে থাকবে সকল ক্ষমতাধর এবং অহংকারীরা। জান্নাত বলল আমার মধ্যে থাকবে সকল দূর্বল এবং মিসকীনরা। আল্লাহ তাআলা তাদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বললেন জান্নাত আমার রহমত। আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দয়া করব। জাহান্নাম আমার আযাব। আমি যাকে ইচ্ছা তাকে শাস্তি দিব।
আরেক হাদীসে এসেছে কিয়ামতের তিন আল্লাহ আসমান যমীনকে তার হাতের মধ্যে নিবেন এবং বলবেন আমিই ক্ষমতাধর, আমিই রাজা। কোথায় দুনিয়ার ক্ষমতাধররা, কোথায় অহংকারীরা?
অনুলিখন- মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
২-১০-২০১৫
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সালাত ও সালাম পাঠের গুরুত্ব
11226188_684693344999890_967414023034115171_n
-মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী
#মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন কারীমে আমাদেরকে বিভিন্ন ইবাদাতের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন নামায আদায় করার নির্দেশ, সাওম ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ, বিভিন্ন ভালো কাজের নির্দেশ। কিন্তু এর কোনটি আল্লাহ তাআলা করেন না। শুধু একটি আমল করার নির্দেশ আমাদের দিয়েছেন যা আল্লাহ তাআলা নিজে এবং ফিরিশতারাও করেন। সেটা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পড়া। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
-নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর দুরূদ পড়েন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর উপর দুরূদ পড়ো এবং যথাযথ সালাম প্রদান করো। (আল-কুরআন: সূরা আহযাব, আয়াত-৫৬)
এটা আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিশেষ দয়া যে তিনি তাঁর একটি কাজের সাথে আমাদেরও শামিল করেছেন। তবে এখানে জানার বিষয় হলো আল্লাহ তাআলার এবং আমাদের দুরূদের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা যখন দুরূদ শরীফ পড়ি তখন সেটা আমাদের ইবাদত হয়। আল্লাহ তাআলা নবীর উপর দুরূদ পড়ার অর্থ হলো উর্দ্ধজগতে মহান আল্লাহ নবীর প্রশংসা বর্ণনা করেন। উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম বুখারী (র.) উল্লেখ করেন-
قال ابو العالية صلاة الله ثناؤه عليه عند الملائكة ، وصلاة الملائكة الدعاء.
-আবুল আলিয়া (র.) বলেন- আল্লাহর দুরূদ হলো ফিরিশতাদের সামনে নবীর প্রশংসা করা, আর ফিরিশতাদের দুরূদ হলো দু’আ।
এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নির্দেশ দিলেন يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ (হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর উপর দুরূদ পড়ো)। আমরা তো সরাসরি اصلي علي النبي (আমি নবীর উপর সালাত পেশ করছি) বলতে পারি। কিন্তু এভাবে না বলে আমরা যখন দুরূদ পড়ি তখন বলি اللهم صل علي سيدنا محمد )হে আল্লাহ আপনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর সালাত পেশ করুন)। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিলেন আর আমরা আল্লাহকে বলি সালাত পেশ করার জন্য। এর কারণ কি? উলামায়ে কিরাম এর ব্যাখ্যায় বলেন কোন উম্মতের পক্ষে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যথাযথ হক আদায় করা করে সালাত পেশ করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা বলি اللهم صل হে আল্লাহ আপনি সালাত পেশ করুন। এর অন্তর্নিহিত কথা হলো হে আল্লাহ আমরা আপনার নির্দেশ মান্য করি। কিন্তু আমরা আপনার নবীর হক, তাঁর মহান মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সুতরাং আপনি আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীর শান এবং মান অনুযায়ী দুরূদ পেশ করুন।
দুরূদ শরীফ পড়ার হুকুম
কুরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নবীর উপর দুরূদ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই আয়াত থেকে ফুকাহায়ে কিরাম বলেন জীবনে একবার নবীর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা ফরয। যে কোন মাজলিসে প্রিয় নবীর নাম উচ্চারিত হলে প্রথমবার দুরূদ শরীফ পড়া ওয়াজিব আর পরের বার মুস্তাহাব। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব শামীতে এসেছে প্রতিবার পড়া ওয়াজিব। নামাযের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে সম্বোধন করে সালাম দেওয়া ওয়াজিব।
দুরূদ শরীফের ফদ্বীলত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পড়া উত্তম আমল সমূহের অন্যতম, প্রিয় নবীর ভালোবাসা অর্জন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من صلَّى عليَّ واحدةً صلَّى الله عليه عشرًا.
-যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরূদ পাঠ করবে মহান আল্লাহ তার প্রতি দশটি রহমত নাযিল করবেন। অন্য বর্ণনায় আছে দশটি গুনাহ মাফ করবেন, দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।
প্রিয় নবীর উপর বেশি বেশি দুরূদ পড়া ঈমানের দাবী। কেননা দুরূদ পাঠ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুহাব্বাত সৃষ্টি হয়। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মুহাব্বাত রাখাই হলো ঈমান। বুখারী শরীফে এসেছে
عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ্রلاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَগ্ধ
– হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের নিজেদের থেকে, তোমাদের পিতা-মাতা থেকে এবং সকল মানুষ থেকে প্রিয় না হই।
আপনি বুঝবেন কিভাবে যে, আপনার অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাব্বাত সৃষ্টি হয়েছে? হাদীসে এসেছে من احب شيئا اكثر ذكره যে যা ভালোবাসে তার আলোচনা বেশি করে। প্রিয়নবীর আলোচনা শুনলে আপনার ভালো লাগবে, দুরূদ শরীফ পাঠ করলে ভালো লাগবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান-মান শুনলে আনন্দিত হবেন। সারাক্ষণ শুধু নবীর কথা স্মরণ হবে। কারো মনে হতে পারে সারাক্ষণ শুধু নবী নবী করে কি লাভ? নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের বাণী রয়েছে, যে সব সময় দুরূদ শরীফ পেশ করবে তার কোন দুঃশ্চিন্তা থাকবে না, সে গুনাহ থেকে পরিত্রান পাবে। হযরত উবাই ইবন কা’ব (রা.) বলেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার উপর অধিক দুরূদ পড়তে চাই। আমি আমার সময়ের কত অংশ আপনার দুরূদের জন্য রাখবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার ইচ্ছা। আমি বললাম এক চতুর্থাংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার ইচ্ছা তবে আরেকটু বাড়িয়ে নিলে তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম তাহলে অর্ধেক? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার ইচ্ছা তবে যদি আরেকটু বেশি পড় তাহলে তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম দুই তৃতীয়াংশ আপনার দুরূদের জন্য রাখবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার ইচ্ছা তবে যদি আরেকটু বেশি পড় তাহলে তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি আমার (দুআ-দুরূদের) পুরো অংশ আপনার দুরূদের জন্য রাখবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন তুমি যদি এমন করো তাহলে তোমার সকল দুঃশ্চিন্তা অবসানের জন্যে যথেষ্ঠ হবে, তোমার সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
সাহাবায়ে কিরামের অন্তর নবী প্রেমে ভরপুর ছিল। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.)-এর পায়ে ঝি ঝি ব্যাথ্যা উঠলো। তার পাশে উপস্থিত একজন বললেন আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তির নাম স্মরণ করুন। তিনি সাথে সাথে বললেন يا محمد ( হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। হাদীসটি ইমাম বুখারী তার আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন।
অন্য দিকে এই হাদীস থেকে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে ইয় রাসূলাল্লাহ বলে সম্বোধন করার প্রমাণও পাওয়া যায়।
আমাদের সকলের কর্তব্য হলো বেশি বেশি দুরূদ পাঠ করা। তিরমিযী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.)-এর সূত্রে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
أَوْلَى النَّاسِ بِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلَاةً (الترمذي).
-কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আমার সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী থাকবে যে আমার উপর বেশি বেশি দুরূদ পাঠ করে।
হাদীস শরীফে এমন বর্ণনাও আছে যে কিয়ামতের দিন যখন আমলনামা ওযন করা হবে তখন একজনের আমলনামায় গুনাহ বেশি হয়ে যাবে। ফলে তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হবে। এমন সময় অত্যন্ত সুন্দর নূরানী চেহারার অধিকারী একজন এসে বলবেন আমার সামনে আবার ওযন করো। তখন আবারো ওযন করা হবে এবং আগের ন্যায় গুনাহ’র দিকটা বেশি হবে। তখন তিনি তার পকেট থেকে এক টকরো কাগজ নেকীর দিকে রাখবেন, সাথে সাথে নেকীর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এই লোকটি তখন জানতে চাইবে আপনি কে? আমার এই কঠিন বিপদের সময় আমাকে সাহায্য করলেন। তিনি উত্তর দিবেন আমি হলাম তোমার নবী। আর যে কাগজের টুকরো দিয়েছি সেটা হলো দুরূদ শরীফ যা তুমি আমার উপর পড়তে। আমি তা আমার কাছে জমা রেখেছিলাম।
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে হযরত আব্দুর রাহমান ইবন আঊফ (রা.) বলেন একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এতো দীর্ঘ সিজদাহ দিলেন, আমি মনে করলাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকাল হয়েছে। তিনি কাদঁতে লাগলেন। দীর্ঘ সিজদাহ পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন কি হয়েছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এতো দীর্ঘ সিজদাহ দিয়েছেন আমি মনে করেছি আপনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন হযরত জিবরাঈল আমাকে সুসংবাদ দিলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন আমার উম্মতের মধ্যে যে আপনার উপর দুরূদ পড়বে আমি তার প্রতি রহমত নাযিল করবো আর যে আপনার প্রতি সালাম দিবে আমি তাকে সালাম দিব। এ সুসংবাদ শুনে শুকরিয়া আদায়ের জন্য আমি আল্লাহকে সিজদাহ করেছি।
আমরা যে দুরূদ পাঠ করি সে দুরূদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পেশ করা হয়। আবূ দাঊদ শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন فَإِنَّ صَلاتَكُم مَعْرُوْضَة عَلَيَّ তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পেশ করা হয়।
দুরূদ শরীফ যত বেশি পরিমাণ সম্ভব পাঠ করা উচিত। আমরা যে কোন সময় দুরূদ পড়তে পারি, ওযূ না থাকলেও দুরূদ পড়তে পারি তবে ওযূ অবস্থায় পড়া উত্তম, মহিলারা অপবিত্র অবস্থায়ও দুরূদ পড়তে পারেন। বুযুর্গানে কিরাম বলেন দৈনিক কমপক্ষে দুইশতবার দুরূদ শরীফ পাঠ না করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হক আদায় হয় না। সে জন্যে আউলিয়ায়ে কিরাম দালাইলুল খায়রাত কিতাব পড়ার কথা বলেন। এই কিতাবে সপ্তাহের সাত দিনের অংশ ভাগ করে দেওয়া আছে। প্রতিদিন একাংশ পাঠ করলে দৈনিক দুরূদ শরীফের হক আদায় হয়। কিতাবখানা লিখার পিছনে একটি ঘটনা আছে। কিতাবের লিখক শায়খ সুলাইমান আল-জাজুলী (র.) উচু স্তরের একজন বুযুর্গ ছিলেন। একদিন তিনি তাঁর মুরীদীনসহ সফরে বের হলেন। পথিমধ্যে আসরের সময় হলো। কিন্তু তাদের সাথে কোন পানি নেই যা দিয়ে ওযূ করবেন। আশপাশে খোঁজ করে একটি কুয়া পাওয়া গেল কিন্তু কুয়ার পানি অনেক নিচে। পানি উঠানোর কোন পাত্র নেই। সুলাইমান আল জাজুলী পেরেশান হয়ে গেলেন। তখন কুয়ার পাশের একটি কুটির থেকে একজন ছোট বালিকা এসে কুয়ায় থুথু ফেললো। সাথে সাথে পানি উপরে উঠে এলো। নামায শেষ করে শায়খ জাজুলী বালিকাকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে বললেন কোন আমলের কারণে তোমার জিহ্বায় এত বরকত আল্লাহ দান করেছেন। বালিকা বললেন আমি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর একটি দুরূদ পাঠ করি। দুরূদটি হলো-
اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰي سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَلٰوةً دَائِمَةً مَّقْبُوْلَةً تُؤَدِّيْ بِهَا عَنَّا حَقَّهُ الْعَظِيْمِ.
এই দুরূদকে “দুরূদে বী’র” বলা হয়। এরপর সুলাইমান আল জাজুলী ইচ্ছা করলেন দুরূদ শরীফের একটি কিতাব লিখবেন। তখন লিখলেন দালাইলুল খায়রাত।
শুক্রবারে অধিক পরিমাণ দুরূদ পড়ার প্রতি হাদীস শরীফে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
أكْثِرُوا مِنَ الصَّلاةِ عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ.
-তোমরা শুক্রবারে অধিক হারে আমার উপর দুরূদ পড়ো।
সকাল-সন্ধায় দুরূদ পড়ার ফদ্বীলতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে সকালে দশবার বিকালে দশবার আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে আমার শাফা’আত তাকে খোঁজে নিবে।
দুরূদ শরীফ না পড়ার পরিণতি
কোন মুসলমান দুরূদ শরীফ না পড়ার কথা চিন্তা করতে পারে না। ইমাম যায়নুল আবেদীন (রা.) বলেন দুরূদ শরীফ পাঠ করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলামত। দুরূদ পড়লে কেবল তারই খারাপ লাগে যার অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাব্বাতে কমতি রয়েছে।
عن الحسين بن عليٍّ – رضي الله عنهما – أن النبي – صلى الله عليه وسلم – قال البخيلُ الذي ذُكِرتُ عنده فلم يُصَلِّ عليَّ. أخرجه أحمد والترمذي
-হযরত হুসাইন ইবন আলী (রা.) হতে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন সে-ই কৃপন যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হলো আর সে আমার উপর দুরূদ পড়লো না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন
رغِمَ أنفُ رجلٍ ذُكِرتُ عنده فلم يُصلِّ عليَّ.
তার নাক ধূলা মলিন হোক (অপমানিত হোক) যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হলো আর সে আমার উপর দুরূদ পড়লো না।
عَنِ الْحُسَينِ بْنِ عَلَي رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ – صلى الله عليه وسلم -: ্রمَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَخَطِىءَ الصَّلاَةَ عَلَىَّ خَطِئ طَرِيْقَ الْجَنَّةِ (رواه الطبراني).
-হযরত হুসাইন ইবন আলী (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হলো আর সে আমার উপর দুরূদ পড়তে ভুলে গেল সে জান্নাতের পথ ভুলে গেল।
মুনাজাতের শুরুতে এবং শেষে আল্লাহর প্রশংসার পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দুরূদ পড়া উচিত। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে-
عن أنس بن مالك – رضي الله عنه – عن النبي – صلى الله عليه وسلم – قال كل دعاء محجوب حتى يصلي على النبي صلى الله عليه وسلم.
-হযরত আনাস ইবন মালিক (রা.) হকে বর্ণিত নবী কারীস সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন নবী কারীস সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ না পড়া পর্যন্ত সকল দুআ আবৃত থাকে (কবূল হয় না) [আল-কাওলুল বাদী, ইমাম সাখাবী র.]
عن عمر بن الخطاب – رضي الله عنه – قال ذكر لي أن الدعاء يكون بين السماء والأرض لا يصعد منه شيء حتى يصلي على النبي – صلى الله عليه وسلم.
-হযরত উমর (রা.) বলেন আমাকে বলা হয়েছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ না পড়া পর্যন্ত দু’আ আকাশ এবং যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে থাকে, উপরের দিকে যায় না (কবূল হয় না)। [আল-কাওলুল বাদী, ইমাম সাখাবী র.]
কয়েকেটি ফদ্বীলতপূর্ণ দুরূদ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সনদে দুরূদে ইবরাহীমীর বর্ণনা হাদীসে পাওয়া যায়। সে জন্যে অনেকে মনে করেন দুরূদে ইবরাহীমী ছাড়া অন্য দুরূদ পড়া ঠিক হবে না। এটা ঠিক না। কারণ আমরা জানি মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীসের সনদ বর্ণনার সময় قال رسول اللهলিখার পর লিখেন صلي الله عليه وسلم । যারা দুরূদে ইবরাহীমী ছাড়া অন্য দুরূদ পড়তে বাধা দেন তারাও যখন হাদীস পড়েন তখন এই দুরূদ-ই পড়েন। এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে স্থানে যে দুরূদ প্রজোয্য সেখানে সে দুরূদ পড়া হয়। বুযুর্গানে কিরামের পঠিত দুরূদ স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুমোদনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সকল দুরূদ শরীফের মধ্যে দুরূদে ইবরাহীমী উত্তম এবং হাদীসে বর্ণিত দুরূদ পাঠের ফদ্বীলত বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
হাফিযুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন আবদুর রহমান সাখাবী (র.) তাঁর কাউলুল বাদী’ কিতাবে উল্লেখ করেন, বারযালীর ‘মানামাত’-এ ইবনু মুসদীর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- আমি ইমাম শাফিঈ (র.) কে স্বপ্নে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আল্লাহ তাআলা আপনার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, আমার জন্য জান্নাতে বালাখানা সজ্জিত করা হয়েছে যেমনিভাবে নতুন বরের জন্য বাসর সজ্জিত করা হয়, আমার জন্য (পুষ্পরাজি) ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যেমনিভাবে নতুন বরের জন্য ছড়িয়ে রাখা হয়। আমি বললাম, কিসের মাধ্যমে আপনার এ অবস্থা অর্জিত হয়েছে? তখন কোন একব্যক্তি আমাকে বললেন, ‘কিতাবুর রিসালা’য় লিখিত দুরূদ শরীফ পাঠের কারণে। আমি তাকে বললাম, ঐ দুরূদ শরীফ কোনটি? তিনি বললেন-
اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ كُلَّمَا ذَكَرَهُ الذَّاكِرُوْنَ، اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ كُلَّمَا غَفَلَ عَنْ ذِكْرِهِ الْغَافِلُونَ.
‘আল কাউলুল বাদী’ কিতাবে আরো উল্লেখ আছে, দুরূদ পাঠের দ্বারা পানিতে ডুবে মারা যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে আল্লামা ফাকিহানী তার ‘ফাজরুম মুনীর’ কিতাবে বর্ণনা করেন, হযরত শায়খ সারেহ মূসা যরীর আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি একদা লোনা সাগরে জাহাজে আরোহণ করেন, তিনি বলেন, সে সময়ে সাগরে আকলাবিয়া নামক ঝড় শুরু হলো, এমতাবস্থায় মনে হলো খুব কম সংখ্যক লোকেরই ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকার আশা রয়েছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, স্বপ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সান্নিধ্য লাভ হলো, তিনি আমাকে বললেন, জাহাজের যাত্রীদেরকে বলো তারা যেন উল্লেখিত দুরূদ খানা এক হাজার বার পাঠ করে।
অত:পর আমি জাগ্রত হয়ে জাহাজের আরোহীদের আমার স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলাম। আর আমরা তিনশত বার এ দুরূদ পড়ার সময়েই দুরূদ শরীফের ওসীলায় আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ বিপদ থেকে মুক্ত করে দিলেন এবং ঝড়কে শান্ত করে দিলেন। ঘটনাটি ভাষাবিদ আল-মাজিদ স্বীয় সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এর শেষে তিনি হাসান বিন আলী আসওয়ানী থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি এ দুরূদখানা প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ, স্বাভাবিক ও বিপদাপদের সময়ে পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে তা থেকে মুক্তি দান করবেন এবং তার আশা পূর্ণ করবেন।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) “আদ-দুররুস সামীন” কিতাবে লিখেন- আমার বাবা (শাহ আব্দুল রহীম মুহাদ্দিসে দেহলবী র.) আমাকে নিম্নোক্ত সালাত (দুরূদ) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর পাঠ করতে আদেশ করলেন-
اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰي سَيِّدِنَا مُحَمَّدِنِ الـنَّبِيِّ الاُمِّيِّ وَاٰلِهِ وَبَارِكْ وَسَلِّمْ.
অতঃপর বললেন, আমি স্বপ্নে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে এ দুরুদটি পাঠ করেছি, তিনি এটা পছন্দ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে সালাম প্রদানের গুরুত্ব
কুরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا তোমরা নবীকে যথাযথ সালাম প্রদান করো। নামাযের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে সালাম দেওয়া ওয়াজিব।
নামাযের বাহিরেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে সালাম দেওয়া যায়। আমরা মীলাদ শরীফে তাকে সালাম দেই। আমাদের সালাম তার নিকট পৌছে। নাসাঈ শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
إِنَّ لِلَّهِ مَلائِكَةً سَيَّاحِينَ فِي الأَرْضِ يُبَلِّغُونِي عَنْ أُمَّتِيَ السَّلامَ (سنن النسائى).
-পৃথিবীতে বিচরণকারী আল্লাহ তাআলার কিছু ফিরিশতা আছ্নে যারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌছান।
অন্য বর্ণনায় আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সালামের জবাব প্রদান করেন। আউলিয়ায়ে কিরামের অনেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সালামের জবাব নিজ কানে শুনেছেন। আপনার ধারণা আসতে পারে আমি তো সালামের জবাব শুনছি না, মনে হয় আমার সালাম পৌছে নি। কিন্তু না, আপনি যেখান থেকেই সালাম প্রদান করুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সালাম পৌছানো হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযুগে অনেক বুযুর্গকে সালাম দিয়েছেন, কখনো আবার কারো মাধ্যমে সালাম দিয়েছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কবর শরীফে স্বশরীরে জীবিত এবং তিনি উম্মতের সালামের জবাব দেন।
দুরূদ শরীফ পাঠের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুহাব্বাত সৃষ্টি হয়। ফলে অনেকের সাথেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাত হয়। দুরূদে তুনাজ্জিনার কথা বর্ণনা আছে যে, ঈশার নামাযের পর কিবলামুখী হয়ে জায়নামাযে বসে ৭০ বার দুরূদে তুনাজ্জিনা পাঠ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দীদার লাভ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে দীদার হওয়ার জন্য দুরূদ শরীফের আমলের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আমালের সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। আর যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি যথাযথভাবে বেশি পরিমাণে সালাত ও সালাম পেশ করেন আশা করা যায় দুরূদের বরকতে তাদের ব্যক্তিগত আমলও আল্লাহ তাআলা সংশোধন করে দিবেন।
– মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী
অনুলিখন : মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
২৮-০৮-২০১৫