কুনুতে নাযিলাহ : মুসলিম উম্মাহ'র হারিয়ে যাওয়া হাতিয়ার
ইসলামী শরীআতে নামাজের আভ্যন্তরীণ একটি বিশেষ আমল হচ্ছে দুআ কুনুত (دعاء القنوت)। কুনুত মূলত দুই প্রকার। প্রথমটি القنوتُ في الوترِ, অর্থাৎ বিতরের নামাজের কুনুত, যাকে কুনুতে রাতিবা বলা হয় এবং দ্বিতীয়টি قنوت النوازل, অর্থাৎ বিপদ-আপদের সময় পঠিত বিশেষ কুনুত।
ইসলামী শরীআতে নামাজের আভ্যন্তরীণ একটি বিশেষ আমল হচ্ছে দুআ কুনুত (دعاء القنوت)। কুনুত মূলত দুই প্রকার। প্রথমটি القنوتُ في الوترِ, অর্থাৎ বিতরের নামাজের কুনুত, যাকে কুনুতে রাতিবা বলা হয় এবং দ্বিতীয়টি قنوت النوازل, অর্থাৎ বিপদ-আপদের সময় পঠিত বিশেষ কুনুত।
কুনুতের প্রথম প্রকার, অর্থাৎ বিতরের নামাজের কুনুতের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আহলে সুন্নাতের চারটি মাযহাবেই এটিকে সুন্নাত বলে গণ্য করা হয়। ইমাম আলকামা বলেছেনঃ
إنَّ ابنَ مسعودٍ وأصحابَ النبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم كانوا يَقنُتونَ في الوترِ قبلَ الرُّكوعِ
“আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অন্যান্য সাহাবিরা বিতরের নামাজে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে কুনুত পাঠ করতেন।” [মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবা, ২/৩০২]
হানাফি ও হাম্বলিগণ নিয়মিত বিতরের নামাজের শেষ রাকাতে দুআ কুনুত পাঠ করেন। শাফিয়ীরা ফজরের নামাজে এবং রামাদান মাসের শেষ দশরাত বিতরের নামাজে দুআ কুনুত পাঠ করেন।
কুনুতের দ্বিতীয় প্রকার, যাকে কুনুতে নাযিলাহ বলা হয়, সে সম্পর্কে অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই এ ব্যাপারে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, কুনুতে নাযিলাহ রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং খোলাফায়ে রাশিদীন থেকে প্রমাণিত একটি সুন্নাহ। এ ব্যাপারে অসংখ্য সহীহ হাদীস বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, এটি একটি বিশেষ দুআ, যা মুসলিম উম্মাহ'র ওপর আপতিত বড় কোনো বিপদ-আপদ কিংবা প্রচণ্ড দুর্যোগের (দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প) সময় পাঠ করা হয়। একইসাথে, যখন মুসলিম উম্মাহ'র ওপর কোনো কাফির-যালিম নিপীড়ন করে, তখন কুনুতে নাযিলার মধ্যে তাদের ওপর বদদুআ করা হয়। তৃতীয়ত, এটি কোনো নিয়মিত আমল নয়। ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক বিরোধ কিংবা ছোটখাটো কোনো সংঘর্ষের সময় এটি পাঠ যাবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ অতি-বিশেষ কারণ ব্যতীত কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করতেন না [সহীহ ইবন খুযাইমা]। চতুর্থত, কুনুতে নাযিলায় কখনও ঢালাওভাবে সব অমুসলিমের ওপর বদদুআ করা যাবে না। যাদের দ্বারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ'র স্পষ্ট ক্ষতি হচ্ছে এবং উম্মাহ'র একটি বড় অংশ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, কেবল সেই সকল যালিমের ওপর বদদুআ করা যাবে।
৪র্থ হিজরির শুরুর দিকে রি'ল, যাকওয়ান ও আসিয়্যাহ নামক তিনটি গোত্র মাউনা কূপের পাশে ৭০ জন সাহাবিকে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ এক মাসব্যাপী এ তিনটি গোত্রের ওপর কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করেছিলেন। আনাস ইবন মালিক রা. বলেছেনঃ
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَنَتَ شَهْرًا يَلْعَنُ رِعْلاً وَذَكْوَانَ وَعُصَيَّةَ عَصَوُا اللَّهَ وَرَسُولَهُ
“নবী ﷺ এক মাসব্যাপী কুনুত পাঠ করে রি'ল, যাকওয়ান ও আসিয়্যাহ গোত্রসমূহের ওপর লা'নত করেছেন। কারণ এরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বেঈমানি করেছিল।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি]
কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করার সময় নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে এবং প্রত্যেকের মতের পক্ষে দলিলও রয়েছে। হানাফি ও মালিকি মাযহাবের মতে, কুনুতে নাযিলাহ ফজরের নামাজের শেষ রাকাতে পাঠ করা হয়। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজরের নামাজে কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করেছেন। আনাস ইবন মালিক রা. বলেছেনঃ
أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَنَتَ شَهْرًا فِي صَلاَةِ الصُّبْحِ يَدْعُو عَلَى أَحْيَاءٍ مِنْ أَحْيَاءِ الْعَرَبِ
“রাসূলুল্লাহ ﷺ এক মাসব্যাপী ফজরের নামাজে আরবের কিছু গোত্রের ওপর কুনুত পাঠ করেছেন।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল মাগাযি, সুনান ইবন মাজাহ; কিতাবু ইকামাতিস সালাহ]
প্রক্ষান্তরে শাফিয়ীদের মতে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করা যায়। কারণ একটি বর্ণনামতে রাসূলুল্লাহ ﷺ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেছেনঃ
قَنَتَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم شَهْرًا مُتَتَابِعًا فِي الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ وَصَلاَةِ الصُّبْحِ
“রাসূলুল্লাহ ﷺ এক মাসব্যাপী যুহর, আছর, মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামাজে কুনুত পাঠ করেছেন।” [সুনান আবি দাউদ; কিতাবুস সালাহ]
আবার আরেকটি হাদীসে পাওয়া যায়, রাসূলুল্লাহ ﷺ দুই ওয়াক্ত নামাজে কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করেছেন। বারা ইবনুল আজিব রা. বলেছেনঃ
قَنَتَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي الْفَجْرِ وَالْمَغْرِبِ
“রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজর ও মাগরিবের নামাজে কুনুত পাঠ করেছেন।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল মাসাজিদ]
উল্লেখিত সবগুলো হাদীসই সহীহ। তবে হাদীসগুলোকে সমন্বিত করে এটি অনুধাবন করা যায় যে, ফজরের নামাজে কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করার ব্যাপারে অধিক শক্ত দলিল বিদ্যমান। যেহেতু প্রতিটি হাদীসে ফজরের নামাজের কথা সমানভাবে এসেছে। ইমাম ইবন সীরীন বলেছেনঃ
أَنَّ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ سُئِلَ هَلْ قَنَتَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي صَلاَةِ الصُّبْحِ قَالَ نَعَمْ فَقِيلَ لَهُ قَبْلَ الرُّكُوعِ أَوْ بَعْدَهُ قَالَ بَعْدَ الرُّكُوعِ
“আনাস রা.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ কি ফজরের নামাজে কুনুত পাঠ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করা হলো, রুকুতে যাওয়ার পূর্বে নাকি পরে? তিনি বললেন, রুকু থেকে উঠার পরে।” [সুনান আন-নাসায়ী; কিতাবুত তাত্ববীক]
কুনুতে নাযিলাহ পাঠ করার নিয়ম হচ্ছে, ফজরের নামাজের শেষ রাকাতে রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইমাম বিশেষ দুআ পাঠ করবেন এবং মুসল্লিরা মনে মনে আমীন বলবেন। এরপর যথারীতি সাজদায় চলে যাবেন। কুনুতে নাযিলাহ'র সময় হাত তোলার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। কারণ এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহে হাত তোলা কিংবা না তোলার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে হাত তোলা হোক কিংবা না তোলা হোক, এ দুআর পর হাতদুটি মুখের ওপর মাসেহ করার নিয়ম নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ কুনুতের দুআয় এমনটি করেননি। কুনুতে নাযিলার জন্য একটি মাসনূন দুআ রয়েছে। দুআটি নিম্নরূপ-
اللَّهُمَّ اهْدِنَا فِيمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنَا فِيمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنَا فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لَنَا فِيمَا أَعْطَيْتَ وَقِنَا شَرَّ مَا قَضَيْتَ إِنَّكَ تَقْضِى وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ إِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ. اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَنَا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِهِمْ وَانْصُرْهُمْ عَلَى عَدُوِّكَ وَعَدُوِّهِمْ اللَّهُمَّ الْعَنْ كَفَرَةَ أَهْلِ الْكِتَابِ الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِكَ وَيُكُذِّبُونَ رُسُلَكَ وَيُقَاتِلُونَ أَوْلِيَاءَكَ اللَّهُمَّ خَالِفْ بَيْنَ كَلِمَتِهِمَ وَزَلْزِلْ أَقْدَامَهُمْ وَأَنْزِلْ بِهِمْ بَأْسَكَ الَّذِى لاَ تَرُدُّهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُثْنِى عَلَيْكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَلَكَ نُصَلِّى وَنَسْجُدُ وَلَكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ نَخْشَى عَذَابَكَ الْجَدَّ وَنَرْجُو رَحْمَتَكَ إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكَافِرِينَ مُلْحَقٌ
[বাইহাকী, সুনান আল-কুবরা, ২৯৬০-২৯৬২]
এ দুআটি ছাড়াও সময় এবং উপলক্ষ অনুযায়ী আরবি ভাষায় অন্য দুআও করা যাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রের ওপর নাম ধরে কুনুত পাঠ করেছেন। তবে যদি সেটি করতে সক্ষম না হন, তাহলে উপরোল্লিখিত দুআটি পাঠ করাই শ্রেয়।
পরিশেষে এখানে মূখ্য বিষয়টি হচ্ছে, কুনুতে নাযিলাহ একটি সুন্নাহ। এটি মুসলিম উম্মাহ'র জন্য একটি বড় হাতিয়ার। যখন উম্মাতের ওপর শক্তিশালী শত্রু কিংবা প্রচণ্ড বিপদ-আপদ আপতিত হয়, তখন আমাদের চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা ভুলে যাই যে, সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও আমাদের মালিক আমাদের জন্য তাঁর রাহমাতের দরজা সর্বদা খোলা রেখেছেন। অতএব আমাদেরকে উম্মাতের বিশেষ বিপদ-আপদে এ উত্তম আমলটি করা প্রয়োজন।
-Marjan Ahmad Chowdhury