ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

কথিত আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের উৎপত্তি-ইতিহাস

তথা কথিত আহলে হাদিস বর্তমান সময়ে ইসলাম এবং মুসলমানের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে। আহলে হাদিস লা মাযহাবীদের উৎপত্তির ইতিহাস এবং ইহুদী খৃষ্টান কর্তৃক তাদের নাম করনের কতিপয় দিক তুলে ধরলাম। প্রিয় পাঠক! “মুযাহেরে হক্ব” কিতাবের স্বনামধন্য লেখক মাওলানা কুতুব উদ্দীন তার “তুহফাতুল আরব ওয়াল আযম” গ্রন্থে গাইরে মুক্বাল্লিদদের বা আহলে হাদীসে দলের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যার সার-সংক্ষেপ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ আজাদ
কথিত আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের উৎপত্তি-ইতিহাস

তথা কথিত আহলে হাদিস বর্তমান সময়ে ইসলাম এবং মুসলমানের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে।
আহলে হাদিস লা মাযহাবীদের উৎপত্তির ইতিহাস এবং ইহুদী খৃষ্টান কর্তৃক তাদের নাম করনের কতিপয় দিক তুলে ধরলাম।

প্রিয় পাঠক! “মুযাহেরে হক্ব” কিতাবের স্বনামধন্য লেখক মাওলানা কুতুব উদ্দীন তার “তুহফাতুল আরব ওয়াল আযম” গ্রন্থে গাইরে মুক্বাল্লিদদের বা আহলে হাদীসে দলের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যার সার-সংক্ষেপ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, মাওলানা ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই রহ. পাঞ্জাবে আগমন করার পরপরই কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর সমন্বয়ে চার মাযহাবের ইমামগণের তাক্বলীদ অস্বীকারকারী নতুন ফিরক্বাটির বা আহলে হাদীস -এর সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়। যারা হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য ছিল। এদের মূখপাত্র ছিল মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত- ১২৭৫ হি) ।

তার এ ধরনের অসংখ্যা ভ্রান্ত কর্মকান্ডের কারনে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. ১২৪৬ হিজরীতে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসীকে মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। তখনই গোটা ভারতবর্ষের সকল ধর্মপ্রান জনগণ, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর খলীফা ও মুরীদগণ হারামাইন শরীফাইনের তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও মুফতীগণের নিকট এ ব্যপারে ফতওয়া তলব করেন।

ফলে সেখানকার তৎকালীন চার মাযহাবের সম্মানিত মুফতীগণ ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও তার অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফিরক্বা (আহলে হাদীস) বলে অভিহিত করেন এবং মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসীকে ক্বতল (হত্যা) করার নির্দেশ প্রদান করেন (এ ফতওয়া ১২৫৪ হিজরীতে তান্বীহুদ্দাল্লীন নামে প্রকাশ করা হয়। এখনো দেশের বিশিষ্ট লাইব্রেরীতে এর কপি সংরক্ষিত রয়েছে)।

মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসীর পলায়ন :

উক্ত ঘটনার পর আব্দুল হক্ব বেনারসী পালিয়ে কোনভাবে আত্মরক্ষা পায়। নিজ শহর বেনারস গিয়ে তার নবআবিষ্কৃত (আহলে হাদীস) দলের প্রধান হয়ে সরলমনা জনাসাধারণের মধ্যে তার বিষাক্ত মতবাদ ছড়াতে থাকে।

(তুহফাতুল আরব ওয়াল আজম, পৃ: ১৬, খ:২, আল-নাজাতুল কামেলা, পৃ:২১৪, তন্বীহুদ্দাল্লীন, পৃ:৩১)

গাইরে মুক্বাল্লিদ আলিম মৌলভী আসলাম জিরাজপুরী তার বিশিষ্ট রচনা “ নাওয়াদিরাত ” -এ লিখেন,

“প্রথমত এ জামাত নিজেদের বিশেষ কোনো নাম রাখেনি। মাও: ইসমাইল শহীদ রহ. এর শাহাদাতের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা দুর্নাম কুড়ানোর কারণে তাদেরকে যখন ওহাবী বলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেরদেকে “মুহাম্মাদী” বলতে থাকে। অত:পর এ নামটি পরিহার করে “আহলে হাদীস” উপাধি চয়ন করে। যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।”

(নাওয়াদিরাত, পৃ: ৩৪২)।

উপরোক্ত বিররণ থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী কর্তৃক ১২৪৬ হিজরীতে ভারতবর্ষে গাইরে মুক্বাল্লিদ তথা লা-মাযহাবী (আহলে হাদীস) নামক নতুন ফিরক্বাটির সূত্রপাত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা “ওহাবী” হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তারা নিজেদেরকে “মুহাম্মাদী” বলে প্রচার করতো। পরবর্তীতে “ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম” এ মর্মে ফতওয়া দিয়ে ইংরেজের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হল়। এ সুযোগে আব্দুল হক্ব বেনারসী সরকারী কাগজ-পত্র থেকে “ওহাবী” নাম রহিত করে আহলে হাদীস নাম বরাদ্দ করতে নিল ।

ভারতবর্ষে ইংরেজ-বিরোধী ও ইংরেজ বিতাড়নে জিহাদে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে ইংরেজ সরকার যখন ওহাবী বলে আখ্যায়িত করেছিল, তখন গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহাবী নামের আখ্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের জন্য “মুহাম্মদী” এবং পরবর্তীতে “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করার সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদদের তৎকালীন মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করে তাদের জন্য “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। এ দরখাস্তগুলোর প্রতি উত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায় (পৃ:২৪-২৬, সংখ্যা:২, খ:১১) প্রকাশ করা হয় যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়। তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য আপনাদের সমীপে তন্মধ্য হতে একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে পেশ করছি।

“বখেদমতে জনাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী,
আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও পার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে “আহলে হাদীস” বলা হয় এবং সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে। যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি পত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।

অতএব, এ দলের প্রতি ওহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভর্নমেন্ট বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন

সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ।

দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্য “ওহাবী” শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করে দেন এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “আহলে হাদীস” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়।

সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভর্নমেন্ট সেক্রেটারী মি: ডব্লউ. এম. এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন।

অতপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ইং সি.পি গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ইং ইউ.পি গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ইং বোম্বাই গভর্নমেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট চিঠি নং ১২৭ এর মাধ্যমে এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ইং বাঙ্গাল গভর্নমেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ বাটালভীকে অবহিত করা হয়।

(এশায়াতুস সুন্নাহ, পৃ:৩২-৩৯, সংখ্যা:২, খ:১১)

কোন মুসলিম জামাআতের নাম খৃষ্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে এটিই প্রথম । যা কেবল হিন্দুস্তানী গাইরে মুক্বাল্লিদদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয় (!) তাই তারা এ ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের সহিত নিজেরদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে তৃপ্তি লাভ করেছেন।
প্রিয় পাঠক-ভারতীয় উপমহাদেশ তথা পৃথিবীর সকল মুসলিম চার মাযহাবের অনুসারী।
যুগযুগ দরে মাযহাবকে অনুসরণ করে আসছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মুসলিম।
বর্তমান সময়ে মাযহাব বিরোধী লিখা এমন কি বক্তব্য দিয়ে,তথা কথিত আহলে হাদিস মূলত সেই ইংরেজদের দেওয়া নাম করনের সার্থকতা প্রকাশ করছে।
অতএব এই সকল ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের সকল ষড়যন্ত্রের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ উলামায়ে কেরামের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

-মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ আজাদ