ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

খেলাফত থেকে কারবালা : একটি ঐতিহাসিক বিতর্ক

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, তখন তিনি তাঁর ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- اني جاعل في الأرض خليفة অর্থঃ আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি তৈরি করতে যাচ্ছি। (সুরা বাকারা : ৩০) পৃথিবীপৃষ্ঠে আল্লাহর প্রথম খলিফা ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.)। তিনি একইসাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রথম নবী ছিলেন।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
খেলাফত থেকে কারবালা : একটি ঐতিহাসিক বিতর্ক

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, তখন তিনি তাঁর ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-

اني جاعل في الأرض خليفة

অর্থঃ আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি তৈরি করতে যাচ্ছি। (সুর বাকারা : ৩০)

পৃথিবীপৃষ্ঠে আল্লাহর প্রথম খলিফা ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.)। তিনি একইসাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রথম নবী ছিলেন। তাঁর হাত ধরে শুরু হওয়া নবুয়্যাতের মোবারক সিলসিলা সমাপ্ত হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে। সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ নবীদ্বয়ের মধ্যখানে একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুলদের আগমন ঘটেছিল, যাদের বৃহদাংশ ছিলেন বনি ইসরাইল তথা ইবরাহিম (আ.)-এর বংশধর থেকে। বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের সিলসিলা ছিল এরূপ যে, একজন নবী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে আরেকজন নবী তাঁর খেলাফত গ্রহন করতেন এবং পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও বাস্তবায়ন এবং তদ্বীয় উম্মতের শাসনভার হাতে নিতেন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে নবুয়্যাতের মোবারক সিলসিলা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রথমবার এ পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও বাস্তবায়ন এবং উম্মতের শাসনভার অর্পিত হয় এমন মানুষদের হাতে, যারা নবী নন। নবী নন, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনিত নন; বরং উম্মতের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-

كانت بنو إسرائيل تسوسهم الأنبياء، كلما هلك نبي خلفه نبي، وأنه لا نبي بعدي وسيكون خلفاء فيكثرون

অর্থঃ বনি ইসরাইলের নবীরা তাঁদের উম্মতকে শাসন করতেন। যখন একজন নবী মারা যেতেন, আরেকজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলিফা হবেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু আহাদীছিল আম্বিয়া, ৩২৬৮)

যদিও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে নবুয়্যাতের সিলসিলা সমাপ্ত হয়েছিল, তথাপি কিছু মিথ্যাবাদী যুগেযুগে নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করে এক মহা বিশৃঙ্খলতার জন্ম দিয়েছিল। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لا تقوم الساعة حتى يبعث دجالون كذابون قريب من ثلاثين كلهم يزعم أنه رسول الله

অর্থঃ কিয়ামত সংঘটিত হবেনা, যতদিন না ত্রিশজনের মতো মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে। প্রত্যেকে দাবী করবে, সে আল্লাহর রাসুল। (মুত্তাফাক আলাইহি, জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২২১৮)

মিথ্যাবাদী ভণ্ড নবীদের ফিতনার মূলোৎপাটন করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ নবী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে-

ما كان محمد أبا أحد من رجالكم ولكن رسول الله وخاتم النبيين وكان الله بكل شيء عليما

অর্থঃ মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।

(সুরা আহযাব : ৪০)

রাসুল (সা.) দ্ব্যর্থহীন ও খোলাখুলিভাবে ভণ্ড নবীদের মিথ্যা দাবীর মূলোৎপাটন করে, নিজের প্রকৃত পরিচয় আমাদের সামনে উন্মুচিত করে গেছেন। জুবায়ের ইবনে মুত্ব'ইম (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

أنا محمد وأنا أحمد وأنا الماحي الذي يُمحى بي الكُفر وأنا الحاشر الذي يحشر الناس على عقبي وأنا العاقب والعاقب الذي ليس بعده نبي

অর্থঃ আমি মুহাম্মদ (পরম প্রশংসিত), আমি আহমদ (প্রশংসাকারী), আমি মাহী (বিলুপ্তকারী) এমন ব্যক্তি যে, আমার মাধ্যমে কুফরকে মুছে দেয়া হবে। আমি হাশির (একত্রকারী) এমন ব্যক্তি যে, আমার পেছনে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে। আমি আকিব। আকিব ঐ ব্যক্তি যার পরে কোন নবী নেই।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ফাদ্বায়িল, ২৩৫৪)

অন্যান্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরচেয়ে সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা তাঁর খাতমে নবুয়্যাত তথা নবুয়্যাতের সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। ছাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

وأنا خاتم النبيين لا نبي بعدي

অর্থঃ আর, আমি নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোন নবী নেই।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২২১৯)

সুতরাং যে ব্যক্তি সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবীরূপে স্বীকার করবেনা, সে সরাসরি ইসলামের সীমা থেকে নিজেকে বহিষ্কার করে নেবে। ইসলামি আকীদার মৌলিক ভিত্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবী ও রাসুল বলে বিশ্বাস করা এবং স্বীকৃতি দেয়া। এ স্বীকৃতি ব্যতীত কোন ব্যক্তি ঈমানদার বলে গণ্য হবেনা।

যে মুসলিম ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছেন এবং সেই ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন, ইসলামি পরিভাষায় তাঁকে সাহাবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। নবী-রাসুলদের পর "সাহাবি" পরিভাষাটি ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সবচেয়ে সম্মানজনক পদবী। সাহাবির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন-

الصحابي من لقي النبي صلى الله عليه وسلم مؤمنا به ومات على الإسلام

অর্থঃ সাহাবি তিনি, যিনি ঈমানের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন।

(আল-ইসাবাহ ফি তামঈযিস সাহাবা : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সাহাবিদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-

محمد رسول الله والذين معه أشداء على الكفار رحماء بينهم تراهم ركعا سجدا يبتغون فضلا من الله ورضوانا سيماهم في وجوههم من أثر السجود

অর্থঃ মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল এবং তাঁর সহচরগণ অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন।

(সুরা ফাতহ : ২৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সাহাবিদেরকে সালাম দিয়েছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে-

قل الحمد لله وسلأم علي عباده الذين اصطفي

অর্থঃ বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের উপর সালাম।

(সুরা নমল : ৫৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এখানে নির্বাচিত বান্দা দ্বারা সাহাবিদেরকে বুঝানো হয়েছে।

(তাফসিরে আহকামিল কুরআন : ইমাম কুরতুবী)

সাহাবায়ে কেরাম এ উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

خير امتي قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم

অর্থঃ সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হচ্ছে আমার যুগের উম্মত, এরপর তৎপরবর্তী যুগ, এরপর তৎপরবর্তী যুগ।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৫০)

সাহাবিরা জাহান্নাম থেকে মুক্ত। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لأ تمس النار مسلما رآني او رآى من رآني

অর্থঃ সে মুসলিমকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা যে আমাকে দেখেছে। অথবা যারা আমাকে দেখেছে, তাদেরকে দেখেছে।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৮৫৮)

আল্লাহর নবী (সা.)-এর সাহাবিদেরকে গালি দেয়া পাপাচারিতা ও ধর্মদ্রোহিতার শামিল। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لا تسبوا أصحابي فوالذي نفسي بيده لو أنفق أحدكم مثل أحد ذهبا ما بلغ مد أحدهم ولا نصيفه

অর্থঃ আমাদের সাহাবিকে গালি দিওনা। কসম সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, তথাপি আমার আমার সাহাবিদের একমুষ্টি দানের সমপরিমাণ হবেনা। এমনকি আধামুষ্টিও নয়।

(সুনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সুন্নাহ, ৪৬৫৮)

সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করতে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

الله الله في أصحابي لا تتخذوهم غرضا بعدي فمن أحبهم فبحبي أحبهم ومن أبغضهم فببغضي أبغضهم ومن آذاهم فقد آذاني ومن آذاني فقد آذى الله ومن آذى الله يوشك أن يأخذه

অর্থঃ সাবধান! আমার সাহাবিদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানিও না। যে আমার সাহাবিদেরকে ভালবাসল, সে আমার ভালবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালবাসল। আর, যে আমার সাহাবিদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করল, সে আমার প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই তাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করল। যে আমার সাহাবিদেরকে কষ্ট দিল, সে আমাকে কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল, সে আল্লাহকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিল, আল্লাহ শীঘ্রই তাকে পাকড়াও করবেন।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৮৬২)

দ্রষ্টব্যঃ ইমাম তিরমিযি উক্ত হাদিসের সনদকে গরিব বলেছেন।

সাহাবিদেরকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ভেবে তাঁদের ব্যাপারে মন্দ কথা বলা গুরুতর অন্যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেছেন-

لا تسبوا أصحاب محمد صلي الله عليه وسلم فلمقام أحدهم ساعة خير من عبادة احدكم اربعين سنة

অর্থঃ তোমরা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের ব্যাপারে বিদ্রূপ-সমালোচনা করোনা। তাঁদের একটি মুহূর্ত তোমাদের চল্লিশ বছরের ইবাদত থেকে উত্তম।

(ফাদ্বায়িলুস সাহাবা : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ১৫২৯)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মর্যাদা বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন-

إن الله نظر في قلوب العباد فوجد قلب محمد صلى الله عليه وسلم خير قلوب العباد فاصطفاه لنفسه فابتعثه برسالته، ثم نظر في قلوب العباد بعد قلب محمد فوجد قلوبَ أصحابهِ خيرَ قلوبِ العبادِ فجعلهم وزراَء نبيهِ يُقاتِلون على دينه

অর্থঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে দৃষ্টিপাত করলেন। তিনি মুহাম্মদ (স.)-এর অন্তরকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অন্তর হিসেবে পেলেন। তিনি তাঁকে নির্বাচিত করলেন এবং রিসালাতের জন্য মনোনিত করলেন। অতপর বাকি বান্দাদের অন্তরে দৃষ্টিপাত করলেন। তিনি সাহাবিদের অন্তরকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অন্তর হিসেবে পেলেন। অতএব তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবী (সা.)-এত সহকারী এবং দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারকারী হিসেবে মনোনিত করলেন।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ১/৩৭৯)

আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আত দৃঢ়ভাবে স্বীকৃতি দেয়, সাহাবায়ে কেরাম এ উম্মতের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা প্রত্যেকেই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন এবং তাঁদের ঐক্যমত ইসলামি শরী'আতের অকাট্য দলিল। সাহাবিদের ঈমান ও নিয়ত, ইসলামের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ভালবাসা ও প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা ঘোরতর অবিচার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা এসব ব্যক্তিদেরকে তাঁর প্রিয়নবী (সা.)-এর মোবারক সাহচর্যে ধন্য করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সাহাবিদের দ্বীন ও জ্ঞানের পরিপক্বতা সম্পর্কে বলেছেন-

والصحابة أبر هذه الأمة قلوبا وأعمقها علما وأقلها تكلفا وأقومها هديا وأحسنها حالا، اختارهم الله لصحبة نبيه صلى الله عليه وسلم وإقامة دينه، فحبهم سنة والدعاء لهم قربة والاقتداء بهم وسيلة والأخذ بآثارهم فضيلة

অর্থঃ সাহাবিগণ হৃদয়ের দিক থেকে এ উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিবর্গ। জ্ঞানের দিক থেকে পরিপক্ব, মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সামান্য, হেদায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বলিষ্ঠ, চারিত্রিক অবস্থার বিচারে সবচেয়ে সুন্দর। আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর নবী (সা.)-এর সাহচর্য এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য মনোনিত করেছেন। তাঁদেরকে ভালবাসা সুন্নাত, তাঁদের জন্য দু'আ করা পূণ্যময় কাজ, তাঁদের অনুসরণ করা মুক্তির মাধ্যম এবং তাঁদের শিক্ষা গ্রহন করা মাহাত্মপূর্ণ কাজ।

(আল-আকীদাহ, ১/৮১)

তবে আহলে সুন্নাত একথা বলতেও দ্বিধাবোধ করেনা যে, সাহাবায়ে কেরাম ভুলত্রুটির উর্দ্ধে নন। কেবল নবী-রাসুলগণ ভুলত্রুটির উর্দ্ধে, কারণ আল্লাহ তাঁদেরকে ওহীর দ্বারা দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেহেতু সাহাবিদের প্রতি ওহী বা ঐশী দিক-নির্দেশনা অবতীর্ণ হয়না, সুতরাং তাঁদের ইজতিহাদ তথা চিন্তা ও গবেষণায় মানবিক ভুলত্রুটি হতে পারে, তথ্য বিস্মৃত হতে পারে। এজন্য কোন বিষয়ের উপর সাহাবিদের ঐক্যমত ইসলামি শরী'আতের দলিল হলেও কোন একক সাহাবির প্রতিটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে গ্রহন করা উম্মতের উপর ওয়াজিব নয়। হতে পারে, একটি আইনি জটিলতা কিংবা একটি রাজনৈতিক সমস্যায় একজন সাহাবি একটি রায় দিয়েছেন, আরেকজন ভিন্ন রায় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যে কোন একজনের মতামতকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। আবার, সাহাবিদের চিন্তা ও গবেষণাগত ত্রুটির জন্য তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে সমালোচনা করা জগন্য অপরাধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সাহাবিদের যাবতীয় ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে-

والسابقون الأولون من المهاجرين والأنصار والذين اتَّبعوهم بإحسان رضي الله عنهم ورضوا عنه

অর্থঃ আর যারা হিজরতকারীদের মধ্যে অগ্রগামী এবং আনসারদের মধ্যে এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।

(সুরা তাওবাহ : ১০০)

সুতরাং আল্লাহ যাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন, তাঁদের সমালোচনা করা ঈমানের লক্ষণ নয়। ইমাম আবু যার'আ বলেছেন-

إذا رأيت الرجل ينتقص أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فاعلم أنه زنديق

অর্থঃ যখন দেখবে কোন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একজন সাহাবিরও সমালোচনা করেছে। জেনে রাখবে, সে ধর্মদ্রোহী।

(আল-ইসাবাহ ফি তামঈযিস সাহাবা : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)

আহলে সুন্নাত বিশ্বাস করে, সাহাবিরা সবাই সমমর্যাদার নন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে-

لا يستوي منكم من أنفق من قبل الفتح وقاتل أولئك أعظم درجة من الذين أنفقوا من بعد وقاتلوا وكلا وعد الله الحسنى

অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা তাদের চেয়ে বেশি, যারা পরে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন।

(সুরা হাদীদ : ১০)

এ আয়াতের ব্যবহারিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর সিদ্ধান্তে। তিনি তাঁর খেলাফতকালে সাহাবিদেরকে ইসলাম গ্রহনের সময় অনুসারে ১২টি স্তর বা শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছিলেন। স্তর অনুযায়ী সাহাবিদেরকে বাইতুল মাল থেকে ভাতা দেয়া হতো। উক্ত বিন্যাসে উমর (রা.) সর্বাগ্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ এবং আহলে বায়েতকে রেখেছিলেন। এরপর অন্যান্য সাহাবিদেরকে।

আহলে বায়েত (اهل البيت) শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ঘর বা পরিবারের সদস্যবৃন্দ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গকে ইসলামি পরিভাষায় আহলে বায়েত বলে আখ্যায়িত করা হয়। আহলে বায়েতের প্রথম সদস্য হচ্ছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ। আল্লাহ তাঁদেরকে সাধারণ নারীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছেন। কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে-

يا نساء النبي لستن كاحد من النساء

অর্থঃ হে নবীপত্নীগন! তোমরা অন্যান্য নারীদের মতো নও।

(সুরা আহযাব : ৩২)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীদের সাথে আল্লাহ প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির একটি অনন্য সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছেন। কুরআনে জানিয়ে দেয়া হয়েছে-

النبي أولى بالمؤمنين من أنفسهم وأزواجه أمهاتهم

অর্থঃ নবী মু'মিনদের জন্য তাদের প্রাণাধিক প্রিয় এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা।

(সুরা আহযাব : ৬)

এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পুত্র-কন্যাগণ। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চারজন কন্যা এবং তিনজন পুত্র ছিলেন। কন্যারা যথাক্রমে যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলছুম ও ফাতিমা (রা.)। তিন পুত্র যথাক্রমে কাসিম, আব্দুল্লাহ ও ইবরাহিম (রা.)। তন্মধ্যে আব্দুল্লাহ'র উপাধি ছিল তাহির এবং তাইয়্যিব। তিন পুত্রই বাল্যবয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। কন্যাদের সন্তান-সন্ততি ছিলেন। তন্মধ্যে কনিষ্ঠা কন্যা ফাতিমা (রা.)-কে রাসুল (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই আলী (রা.)-এর সাথে বিবাহ দেন। আলী-ফাতিমা দম্পতির সন্তানরা বিশেষভাবে আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত এবং বর্তমানে তাঁদের বংশধররাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশধর বলে পরিচিত। আহলে বায়েতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দুই সদস্য ছিলেন আলী-ফাতিমা দম্পতির দুই পুত্র ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.) ও ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.)। যখন সুরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়, যাতে আল্লাহ আহলে বায়েতকে পবিত্র করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন (রা.)-কে একত্র করে আল্লাহর সামনে পেশ করেছিলেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

خرج النبي صلى الله عليه وسلم غداة وعليه مرط مرحل من شعر أسود فجاء الحسن بن علي فأدخله ثم جاء الحسين فدخل معه ثم جاءت فاطمة فأدخلها ثم جاء علي فأدخله ثم قال: إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

অর্থঃ নবী (সা.) এক সকালে বের হলেন। তাঁর পরনে ছিল কালো নকশাকৃত একটি পশমি চাদর। অতপর হাসান ইবনে আলী আসলেন এবং রাসুল (সা.) তাঁকে চাদরের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতপর হোসাইন ইবনে আলী আসলেন। তিনি তাঁকেও চাদরের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতপর ফাতিমা আসলেন। তিনি তাঁকেও চাদরের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতপর আলী আসলেন। তিনি তাঁকেও চাদরের ভেতর প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতপর (কুরআনের আয়াত) তিলাওয়াত করলেন- আহলে বায়েত! আল্লাহ চান তোমাদের থেকে যাবতীয় অপবিত্রতা দুর করে তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূতঃপবিত্র করে দিতে।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪২৪)

নাজরানের অধিবাসী খ্রিস্টানদের সাথে বিতর্ক যখন মুবাহালা বা পরস্পর ধ্বংস কামনা করার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন (রা.)-কে নিয়ে ময়দানে গিয়েছিলেন। যদিও পরে খ্রিস্টানরা ভয় পেয়ে মুবাহালা করা থেকে বিরত থেকেছিল। সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

لما نزلت هذه الآية فقل تعالوا ندع أبناءنا وأبناءكم دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم عليا وفاطمة وحسنا وحسينا فقال اللهم هؤلاء أهلي

অর্থঃ যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল- "চল, আমরা আমাদের এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততিকে আহ্বান করি", তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইনকে ডাকলেন এবং বললেন, আল্লাহ! এরাই আমার পরিবার।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪০৪)

এরপর বৃহত্তর অর্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রপিতামহ হাশিম ইবনে আবদে মানাফের বংশধর তথা বনু হাশিম গোত্র এবং এর অন্তর্গত বনু আব্দুল মুত্তালিব ও বনু আব্বাস গোত্র, অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা, ফুফু, চাচাতো ভাই-বোনও আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত। এদের সবার জন্য যাকাত গ্রহন করা হারাম। উল্লেখ্য, আহলে বায়েত হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া শর্ত। কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে আহলে বায়েত বলে গণ্য করা হয়না।

আহলে বায়েত প্রথমত সাহাবিদের অন্তর্ভূক্ত বলে একটি মর্যাদায় আসীন। এরপর আহলে বায়েত হিসেবে দ্বিগুণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাঁরা উম্মতের কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমানত। যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

ألا أيها الناس فإنما أنا بشر يوشك أن يأتي رسول ربي فأجيب وأنا تارك فيكم ثقلين أولهما كتاب الله فيه الهدى والنور فخذوا بكتاب الله واستمسكوا به فحث على كتاب الله ورغب فيه ثم قال وأهل بيتي أذكركم الله في أهل بيتي أذكركم الله في أهل بيتي أذكركم الله في أهل بيتي

অর্থঃ হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ। অচিরেই আল্লাহর নিকট থেকে (মৃত্যুর) দূত আসবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মধ্যে দুটি মহান বিষয় রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি হল আল্লাহর কিতাব (কুরআন), যাতে রয়েছে হেদায়াত এবং নুর। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। অতপর তিনি (সা.) আল্লাহর কিতাবের উপর গুরুত্বারূপ করলেন এবং উৎসাহ প্রদান করলেন। এরপর বললেন- এবং (দ্বিতীয়টি হল) আমার আহলে বায়েত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়েতের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়েতের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়েতের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪০৮)

নবী-পরিবারের সদস্যদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা লালন করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানের শর্ত। ইবনে আবি লাইলা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لأ يؤمن عبد حتي اكون احب اليه من نفسه واهلي احب اليه من اهله وعترتي احب اليه من عترته وذاتي احب اليه من ذاته

অর্থঃ কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মু'মিন হবেনা, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব। এবং আমার পরিবার তার কাছে তার নিজের পরিবার থেকে প্রিয় হবে। এবং আমার বংশধর তার কাছে তার নিজের বংশধর থেকে প্রিয় হবে। এবং আমার সত্ত্বা (ব্যক্তিত্ব) তার কাছে তার নিজের সত্ত্বা থেকে প্রিয় হবে।

(মু'জামুল কাবীর : ইমাম তাবরানী; শু'আবুল ঈমান : ইমাম বায়হাকী)

দ্রষ্টব্যঃ উক্ত হাদিসের সনদে দুর্বলতা রয়েছে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা উম্মতে মুহাম্মাদিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার পূর্বেই তাঁর নবী ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে এ উম্মতের নামকরণ করেছিলেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে-

ملة أبيكم إبراهيم هو سماكم المسلمين من قبل وفي هذا ليكون الرسول شهيدا عليكم وتكونوا شهداء على الناس

অর্থঃ তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম, এর পূর্বেও এবং এই কুরআনেও। যাতে রাসুল তোমাদের সাক্ষ্যদাতা হন এবং তোমরা সমগ্র মানবজাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা হও।

(সুরা হাজ্জ : ৭৮)

কুরআনুল কারীমের অন্য আয়াতে مسلم (মুসলিম) শব্দটি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হলেও উপরোক্ত আয়াতে مسلم (মুসলিম) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ্যরূপে। সুতরাং তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্যদানকারী প্রতিটি ব্যক্তিই মুসলিম বলে গণ্য হবে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

من صلى صلاتنا واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم الذي له ذمة الله وذمة رسوله فلا تخفروا الله في ذمته

অর্থঃ যে আমাদের ন্যায় নামাজ আদায় করে, আমাদের কিবলার দিকে মুখ ফেরায়, আমাদের যবেহ করা প্রাণী খায়- সে মুসলিম। তার জন্য আল্লাহ ও রাসুল যিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারীতে বিশ্বাসঘাতকতা করোনা।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুস সালাত, ৩৮৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতকে বৃহদার্থে মুসলিম বলে গণ্য করলেও তাঁর ইহলোক ত্যাগের পর এ উম্মতের মধ্যে নানাবিদ দল-উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সবাই মুসলিম, তবুও কিছু চিন্তাগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও কর্মের সাথে কুরআন-সুন্নাহ'র মৌলিক শিক্ষার বিশাল ফারাক রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যে দলটি সাহাবায়ে কেরামের জামা'আত ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, ইতিহাসে তারা الخوارج বা খারাজি নামে পরিচিত। ৩৭ হিজরিতে আমিরুল মু'মিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ও সিরিয়ার গভর্নর মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর মধ্যে সংঘটিত সিফফিন যুদ্ধের সালিস মীমাংসায় নাখুশ হয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহব আর-রাসিবীর নেতৃত্বে ৬ হাজার খারেজি খলিফা আলী (রা.)-এর দল ত্যাগ করে আলাদা হয়ে যায়। অপরদিকে আরেকদল লোক আলী (রা.) ও আহলে বায়েতের সম্মান ও ভালবাসায় চরম বাড়াবাড়ি করতে শুরু করে এবং নিজেদেরকে شيعة علي (শিয়াতু আলী) বা আলীর দল বলে পরিচয় দেয়। আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক ব্যক্তি শিয়াদের বিশ্বাসগত বিচ্যুতিতে জ্বালানির যোগান দিয়েছিল। প্রথমে রাজনৈতিক মতাদর্শের আকারে জন্ম নিলেও ৬১ হিজরিতে সংঘটিত কারবালার হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের ফলস্রুতিতে شيعة علي বা আলীর দলখ্যাত লোকেরা নিজেদেরকে একটি আকীদাভিত্তিক গোষ্ঠীরূপে গড়ে তুলে। একদিকে খারেজি সম্প্রদায় যেমন সাহাবায়ে কেরামের আকীদা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, অপরদিকে শিয়ারাও আকীদার ক্ষেত্রে নানাবিদ বাড়াবাড়ির আশ্রয় নিয়েছিল। যারা রাজনৈতিকভাবে আমিরুল মু'মিনীন আলী (রা.)-এর পক্ষে ছিলেন, তাঁদেরকে সাধারণ অর্থে তাফদ্বিলী শিয়া বলা হয়। তাফদ্বিলী শিয়াদের মধ্যে আকীদাগত কোন বিচ্যুতি ছিলনা। বরং আহলে বায়েতের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যবৃন্দ এ দলের অংশ ছিলেন। কিন্তু এ দল বেশিদিন টিকতে পারেনি। শীঘ্রই আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার অনৈসলামিক আকীদাকে কেন্দ্র করে সাবায়িয়্যাহ আকীদার একদল চরমপন্থী শিয়া আত্মপ্রকাশ করে। এই সাবায়িয়্যাহ আকীদার শিয়াদেরকে রাফেজি শিয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর আরো নানাবিদ ছোটখাটো আকীদাভিত্তিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল। তবে এক মু'তাযিলা (অতি যুক্তিবাদী গোষ্ঠী) ব্যতীত বাকি সবাই ইতিহাসের গহ্বরে বিলিন হয়ে গেছে। এতসব দল-উপদল ও বিচ্যুত বিশ্বাসের ভিড়েও একটি বৃহৎ জামা'আত সর্বদা আল্লাহর কিতাব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও সাহাবায়ে কেরামের মানহাজের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং এখনো আছে। পরিচয়ের সুবিধার্থে উম্মতে মুহাম্মাদির এই বৃহদাংশকে اهل السنة الجماعة (আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আত) বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ নামকরণের পেছনে মূল সূত্র হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মোবারক বাণী। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إفترقت اليهود على إحدى وسبعين فرقة، وافترقت النصارى على اثنتين وسبعين فرقة، وستفترق هذه الأمة على ثلاث وسبعين فرقة كلها في النار إلا واحدة، قيل: من هي يا رسول الله؟ قال : من كان على مثل ما أنا عليه وأصحابي. وفي بعض الروايات : هي الجماعة

অর্থঃ ইহুদিরা ৭১টি উপদলে বিভক্ত হয়েছিল, খ্রিস্টানরা ৭২টি উপদলে। আমার উম্মত ৭৩টি উপদলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক উপদল জাহান্নামে যাবে, কেবল একটি ব্যতীত। জিজ্ঞেস করা হলো- ইয়া রাসুলাল্লাহ! এরা (জাহান্নাম থেকে মুক্ত) কারা? তিনি (সা.) বললেন, যারা এ পথে থাকবে যে পথে আমি ও আমার সাহাবিরা আছি। অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- এরা হবে জামা'আত (বৃহৎ দল)।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ঈমান, ২৬৪১ এবং সুনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সুন্নাহ, ৪৫৯৭)

উল্লেখিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আত কোন ফিরকা বা উপদল নয়। আহলে সুন্নাত হচ্ছে একটি মানহাজ এবং উম্মতে মুহাম্মাদির সেই বৃহদাংশ, যারা নিজেদেরকে সর্ববিদ দলাদলি এবং বিশ্বাসগত নব-উদ্ভাবন থেকে মুক্ত রেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাতের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের প্রস্তাবিত কর্মপন্থা সুস্পষ্টরূপে বিদ্যমান। ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়াহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

أوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وإن عبد حبشي فإنه من يعش منكم يرى اختلافا كثيرا وإياكم ومحدثات الأمور فإنها ضلالة فمن أدرك ذلك منكم فعليه بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذ

অর্থঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার এবং (নেতার আদেশ) শ্রবণ ও মান্য করার আদেশ দিচ্ছি, যদিও সে একজন হাবশি গোলাম হয়। তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু মতবিরোধ লক্ষ্য করবে। তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবন থেকে বিরত থাকবে, কারণ তা ভ্রান্ততা। তোমাদের মধ্যে কেউ সে যুগ পেলে, সে যেন আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত পথপ্রদর্শক খলিফাদের সুন্নাতের উপর অবিচল থাকে। এসব সুন্নাতকে তোমরা দাঁতের সাহায্যে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ইলম, ২৬৭৬)

উম্মতের বৃহদাংশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাওয়াদে আ'জম বা বৃহৎ দল এবং সুরক্ষিত মানহাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إن أمتي لا تجتمع على ضلالة فإذا رأيتم اختلافا فعليكم بالسواد الأعظم

অর্থঃ আমার উম্মত কখনো ভ্রান্তির উপর একমত হবেনা। সুতরাং যখন মতবিরোধ দেখবে, তখন তোমরা সাওয়াদে আ'জমকে অনুসরণ করবে।

(সুনানে ইবনে মাজাহ : কিতাবুল ফিতান, ৩৯৫০)

উপরোক্ত হাদিসের পর আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতকে আর কোন সংজ্ঞা দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়েনা। যারা আল্লাহর কিতাব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কেরামের আকীদার অনুসারী, তাঁরাই আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আত বলে গণ্য হয়। প্রচলিত অর্থে আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের অনুসারীদেরকে সুন্নী বলে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমান বিশ্বে ৮০-৮৫ শতাংশ মুসলমান সুন্নী আকীদার অনুসারী। এ স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাবী তথা সাওয়াদে আজমের সত্যতা প্রমাণ করে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আত সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আস্থা পোষণ করে। আহলে সুন্নাত দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর যে চারজন সাহাবি ক্রমানুসারে খেলাফত তথা উম্মতের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন সুপথপ্রাপ্ত এবং সুপথ-প্রদর্শক। উক্ত চারজন সাহাবির খেলাফতের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং এ চারজন খলিফার খেলাফতকে অমান্য করা স্পষ্ট ভ্রান্ততা। উপরন্তু তাঁদের খেলাফতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। সাফিনা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

خلافة النبوة ثلاثون سنة ثم يؤتي الله الملك أو ملكه من يشاء

অর্থঃ নবুয়্যাত-ভিত্তিক খেলাফত চলবে ত্রিশ বছর। এরপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে রাজত্ব দান করবেন।

(সুনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সুন্নাহ, ৪৬৪৬)

ইসলামের ইতিহাসে "নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত"-এর চারজন খলিফা হলেন-

১. আবু বকর সিদ্দিক ইবনে আবি কুহাফা (রা.)

খেলাফতকাল- ১১ হিজরি থেকে ১৩ হিজরি

২. উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)

খেলাফতকাল- ১৩ হিজরি থেকে ২৩ হিজরি

৩. উসমান ইবনে আফফান (রা.)

খেলাফতকাল- ২৩ হিজরি থেকে ৩৫ হিজরি

৪. আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

খেলাফতকাল- ৩৫ হিজরি থেকে ৪০ হিজরি

খোলাফায়ে রাশিদীনের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আস্থা পোষণ করার পরও আহলে সুন্নাত এমন দাবী করেনা যে, উক্ত চার খলিফা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বা এঁদের কোন ঐশী ক্ষমতা ছিল কিংবা রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে চার খলিফার মধ্যে কাউকে স্পষ্টভাষায় তাঁর "উত্তরাধিকারী" নির্ধারণ করে গেছেন। বরং আহলে সুন্নাত বিশ্বাস করে, মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত উক্ত চার খলিফাকে যথাসময়ে নিজেদের শাসকের আসনে আসীন করেছে। যেহেতু চার খলিফার খেলাফতের উপর প্রায় সমস্ত সাহাবিদের ইজমা তথা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে ইঙ্গিত বিদ্যমান রয়েছে, তাই আহলে সুন্নাত খোলাফায়ে রাশিদীনের খেলাফতকে বিশুদ্ধ এবং যথার্থ বলে স্বীকৃতি দেয়।

উম্মতের নেতৃত্বের ব্যাপারে শিয়া আকীদাভুক্ত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পুর্ণ ভিন্ন। আহলে সুন্নাত যেভাবে খোলাফায়ে রাশিদীনের খেলাফতের উপর আস্থাশীল, শিয়ারা তারচেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ইমামত নামক আরেকটি মতবাদের উদ্ভাবন করেছেন। শিয়া আকীদা অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর আলী (রা.) এবং তাঁর বংশধর থেকে ৭ জন মতান্তরে ১২ জন ইমাম কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। তাঁরা মনে করেন যে, ইমাম ও ইমামতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওসিয়ত রয়েছে। শিয়া মতাদর্শী আলিম আল্লামা আল-কামী "আকাঈদুস সুদুক" কিতাবের ১০৬ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন-

يعتقدون أي الشيعة بأن لكل نبي وصياً أوصى إليه بأمر الله تعالى

অর্থঃ আমাদের অর্থাৎ শিয়াদের আকীদা হল, প্রত্যেক নবীর একজন উত্তরাধিকারী থাকেন। উক্ত নবী আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তাঁকে উত্তরাধিকার দিয়ে যান।

শিয়ারা আলী (রা.)-কে নবুয়্যাতের পর শেষ উত্তরাধিকারী বলে গণ্য করেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, বনি ইসরাইলের একজন নবী ইন্তেকাল করলে আরেকজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। শিয়াদের বিশ্বাস, যেহেতু সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী, অতএব তাঁর উত্তরাধিকারীই হবেন শেষ উত্তরাধিকারী। তাঁরা আলী (রা.)-কে উক্ত উত্তরাধিকারীর আসনে আসীন করেন। শিয়া আলিম আল্লামা মুহাম্মদ বাকির আল-মাজলিসি "বিহারুল আনওয়ার" কিতাবের ৩৯তম অধ্যায়/পরিচ্ছেদে বলেছেন-

أن علياً هو آخر الأوصياء

অর্থঃ নিশ্চয়ই আলী (রা.) সর্বশেষ উত্তরাধিকারী।

শিয়া আকীদা অনুযায়ী, "ইমামত" তত্ত্বটি منصوص তথা কুরআন-হাদিসের ভাষ্যে গ্রন্থবদ্ধ এবং এ তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিয়া আলিম আল্লামা মুহাম্মদ হোসাইন "আসলুশ শিয়া" কিতাবের ৮৫ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন-

أن الإمامة منصب إلهي كالنبوة، فكما أن الله سبحانه يختار من يشاء من عباده للنبوة والرسالة، ويؤيد بالمعجزة التي هي كنص من الله عليه.. فكذلك يختار للإمامة من يشاء ويأمر نبيه بالنص عليه وأن ينصبه إماماً للناس من بعده

অর্থঃ ইমামত হল নবুয়্যাতের মত একটি ঐশী অবস্থান। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাঁকে নবুয়্যাত ও রিসালাতের জন্য নির্বাচিত করেন এবং তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠ (লিখিত নির্দেশ) স্বরূপ মু'জিজা দ্বারা সমর্থন করেন; সেভাবে আল্লাহ ইমামতের জন্য কাউকে নির্বাচিত করেন এবং লিখিত নির্দেশের মাধ্যমে তাঁর নবীকে আদেশ দেন, যেন ঐ (নির্বাচিত ব্যক্তিকে) নবীর পর মানুষের জন্য ইমাম নির্ধারণ করেন।

বর্তমানে শিয়াদের বৃহদাংশ إثني عشرية (Twelver Shia) নামে পরিচিত। তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরে ১২ জন ইমামকে উম্মতের দায়িত্বশীল বলে গণ্য করেন। ক্রমানুসারে ঐ বারজন ইমাম হলেন-

১. সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

২. ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)

৩. ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.)

৪. ইমাম আলী ইবনে হোসাইন যাইনুল আবেদীন (রহ.)

৫. ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির (রহ.)

৬. ইমাম জা'ফর আস-সাদিক (রহ.)

৭. ইমাম মুসা আল-কাযিম (রহ.)

৮. ইমাম আলী আর-রিদ্বা (রহ.)

৯. ইমাম মুহাম্মদ জাওয়াদ ত্বকী (রহ.)

১০. ইমাম আলী হাদী (রহ.)

১১. ইমাম হাসান আল-আসকারী (রহ.)

১২. ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী (আ.)

সর্বশেষ ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী হচ্ছেন সেই ইমাম যিনি কিয়ামতের পূর্বে উম্মতের নেতৃত্ব দিতে পৃথিবীতে আসবেন। ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী (আ.)-এর আগমনের বিষয়টি সুন্নী-শিয়া উভয়ের নিকট গ্রহনযোগ্য। আহলে সুন্নাতের আকীদা হচ্ছে, কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের ফিতনার সময় ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তিনি আহলে বায়েত তথা আলী (রা.)-এর বংশধর হবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে গেছেন। সুন্নীদের কাছে ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী শিয়া আকীদার ইমামদের ন্যায় "ইমাম" বলে বিবেচিত হননা; বরং উম্মতের নেতা হিসেবে "ইমাম" এবং আল্লাহর ওলী বলে বিবেচিত হন। শিয়াদের আকীদা হচ্ছে, ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী অনেক আগেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তিনি গুপ্ত আছেন। সময়মতো তিনি প্রকাশিত হবেন। তাই শিয়ারা তাঁকে মুহাম্মদ আল-মুনতাযির (অপেক্ষমাণ মুহাম্মদ) বলেও আখ্যায়িত করেন। শিয়াদের "গাইবাহ" বা গুপ্ত নামক আকীদাটি ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।

গ্রন্থবদ্ধ ইমামতের মতবাদকে ভিত্তি করে শিয়া সম্প্রদায় দাবী করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর তাঁর "উত্তরাধিকারী" আলী (রা.) খলিফা বা ইমাম হওয়ার একমাত্র দাবীদার ছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী তিন খলিফা যথাক্রমে আবু বকর সিদ্দিক (রা.), উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এবং উসমান ইবনে আফফান (রা.) জোরপূর্বক খেলাফত "দখল" করে নিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের মতবাদের স্বপক্ষে যে কতিপয় প্রমাণ পেশ করেন, তা আমরা পর্যালোচনা করব।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের চারদিন পূর্বে তাঁর ঘরে সাহাবিদের উপস্থিতিতে একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা শিয়া-সুন্নী উভয় প্রান্তে উত্তপ্ত আলোচনার জন্ম দেয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

لما حضر رسول الله صلى الله عليه وسلم وفي البيت رجال فيهم عمر بن الخطاب قال النبي صلى الله عليه وسلم هلم أكتب لكم كتابا لا تضلوا بعده فقال عمر إن النبي صلى الله عليه وسلم قد غلب عليه الوجع وعندكم القرآن حسبنا كتاب الله فاختلف أهل البيت فاختصموا منهم من يقول قربوا يكتب لكم النبي صلى الله عليه وسلم كتابا لن تضلوا بعده ومنهم من يقول ما قال عمر فلما أكثروا اللغو والاختلاف عند النبي صلى الله عليه وسلم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم قوموا قال عبيد الله فكان ابن عباس يقول إن الرزية كل الرزية ما حال بين رسول الله صلى الله عليه وسلم وبين أن يكتب لهم ذلك الكتاب من اختلافهم ولغطهم

অর্থঃ যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় আগত হল, তখন তাঁর ঘরে অনেক লোক জমা হল। তন্মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ও ছিলেন। নবী (সা.) বললেন, এসো, আমি তোমাদেরকে কিছু লিখে দেব যাতে পরবর্তীতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। তখন উমর (রা.) বললেন, নবী (সা.)-এর উপর রোগযন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠেছে, আর তোমাদের নিকট কুরআন রয়েছে। আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। ঘরে উপস্থিত লোকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিল। তাঁরা বাদানুবাদে লিপ্ত হলেন। তন্মধ্যে কেউ কেউ বললেন, কাগজ-কলম পৌঁছে দাও। নবী (সা.) তোমাদের জন্য কিছু লিখে দেবেন, যাতে পরবর্তীতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। আবার কতিপয় উমর (রা)-এর কথামতো কথা বলতে লাগলেন। এভাবে নবী (স.)-এর সামনে তাঁদের মতভেদ ও বাকবিতণ্ডা বেড়েই চলল। তখন রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা উঠে চলে যাও।

বর্ণনাকারী উবায়দুল্লাহ বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলতেন, বড় মুসিবত হল লোকদের মতভেদ ও বাকবিতণ্ডা, যা রাসুল (সা.) ও তাঁর সেই লেখার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল মারদ্বা, ৫৩৪৫)

তাবেয়ী সাঈদ ইবনে জুবায়েরের সূত্রে উক্ত হাদিসের ভাষ্য নিম্নরূপ-

قال ابن عباس يوم الخميس وما يوم الخميس ثم بكى حتى بل دمعه الحصى فقلت يا ابن عباس وما يوم الخميس قال اشتد برسول الله صلى الله عليه وسلم وجعه فقال ائتوني أكتب لكم كتابا لا تضلوا بعدي فتنازعوا وما ينبغي عند نبي تنازع وقالوا ما شأنه أهجر استفهموه قال دعوني فالذي أنا فيه خير أوصيكم بثلاث أخرجوا المشركين من جزيرة العرب وأجيزوا الوفد بنحو ما كنت أجيزهم قال وسكت عن الثالثة أو قالها فأنسيتها

অর্থঃ কোন একসময় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) "হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার দিন" বলে কেঁদে ফেলেন। এমনকি তাঁর অশ্রুধারায় সামনের কংকর ভিজে যায়। সাঈদ ইবনে জুবায়ের বলেন, আমি বললাম, হে ইবনে আব্বাস! বৃহস্পতিবার দিন কী হয়েছিল? তিনি বললেন, সেদিন রাসুল (সা.)-এর রোগযন্ত্রণা বেড়ে যায়। তিনি বললেন, এসো, আমি তোমাদেরকে একটি লিপি লিখে দেই যাতে তোমরা পরবর্তীতে পথভ্রষ্ট না হও। তখন উপস্থিত সাহাবিরা পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হলেন, অথচ নবী (সা.)-এর সামনে তর্কবিতর্ক করা অনুচিত। তাঁরা বললেন, নবী (সা.)-এর অবস্থা কী হল? তিনি কি (রোগের প্রকোপে) অর্থহীন কথা বলতে পারেননা? তোমরা তাঁর কথা বুঝার চেষ্টা করো। বর্ণনাকারী বলেন, নবী (সা.) বললেন, তোমাদেরকে তিনটি বিষয়ে ওসিয়ত করছি। মুশরিকদেরকে জাযিরাতুল আরব থেকে বহিষ্কার করে দাও। প্রতিনিধি দলসমূহকে উপহার-উপঢৌকন দাও, যেভাবে আমি তাদেরকে দিতাম। বর্ণনাকারী বলেন, ইবনে আব্বাস তৃতীয়টি থেকে নিরব থাকেন। অথবা তিনি বলেছিলেন, কিন্তু আমি ভুলে গেছি।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ওসিয়্যাহ, ১৬৩৭)

উক্ত হাদিসকে হাদিসে কিরত্বাস বলা হয়। শিয়া সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন আলী (রা.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উমর (রা.) ও বাকি লোকজন সুকৌশলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তা করা থেকে বিরত রেখেছেন। আমরা উক্ত হাদিস এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখব, তাঁদের দাবী সঠিক কি না।

প্রথমত, হাদিসের ভাষ্যের আলোকে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কথাটি আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে থাকাকালে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পারস্পারিক তর্কবিতর্ক উত্তম কাজ ছিলনা। যেভাবে তিনি বলেছেন-

فتنازعوا وما ينبغي عند نبي تنازع

অর্থঃ তখন উপস্থিত সাহাবিরা পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হন, অথচ নবী (সা.)-এর সামনে তর্কবিতর্ক করা অনুচিত।

সাহাবিরা দুনিয়া-আখেরাতে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। উম্মতের সমস্ত আলিম-উলামা, ওলী-বুযুর্গ একত্রিত হলেও একজন সাহাবির সমপর্যায়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু সমস্ত সাহাবিদের সমন্বিত সম্মান-মর্যাদা একত্রিত করলেও সায়্যিদুল মুরসালিন নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর পায়ের ধুলিকণা বরাবরও হবেনা। তবে এ কথা দ্বারা এমনটি ভাবা উচিৎ নয় যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের উপর অসন্তুষ্ট থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেছিলেন। বরং আমরা বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদিসে পাই, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের পূর্বে ঘরের পর্দা সরিয়ে মসজিদে নববীতে সাহাবিদেরকে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পেছনে নামাজ পড়তে দেখে খুশি হয়েছিলেন এবং সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। হাদিসে কিরত্বাসের ভাষ্য থেকে সাহাবিদের বাদানুবাদের দরূণ রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক যে অসন্তুষ্টির চিত্র পাওয়া যায়, তা ছিল সাময়িক বিরক্তি। বস্তুত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা এবং তাঁর প্রিয়নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সমস্ত সাহাবিদের উপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর উপর সন্তুষ্ট।

হাদিসে কিরত্বাসের ব্যাখ্যায় আহলে সুন্নাতের পক্ষ থেকে কিছু কথা নিম্নরূপ-

১. শিয়াদের দাবী হল, উমর (রা.) কূটকৌশলবশত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কিছু লেখা থেকে বিরত রেখেছিলেন। তাঁদের এ দাবী নিতান্তই অনভিপ্রেত এবং একপেশে। বস্তুত, উমর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রোগের তীব্রতা দেখে তাঁকে অধিকতর কষ্ট না দিতেই লেখা থেকে বিরত রেখেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শেষদিকে রোগযন্ত্রণার তীব্রতার কথা উল্লেখ করে উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছেন-

ما رأيت أحدا أشد عليه الوجع من رسول الله صلى الله عليه وسلم

অর্থঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে অধিক রোগযন্ত্রণা ভোগকারী আর কাউকে দেখিনি।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল মারদ্বা, ৫৩২২)

২. কেউ কেউ এ দাবীও করেন যে, কিভাবে উমর (রা.) কেবল পবিত্র কুরআনকে আমাদের জন্য যথেষ্ট বলতে পারেন, যখন কুরআন-হাদিস উভয়েই ইসলামি শরী'আতের উৎস?

মূলত, উমর (রা.)-এর উক্তিটি ছিল সাময়িক এবং খণ্ডিত। অর্থাৎ তিনি কুরআনকে শরী'আতের একমাত্র উৎস বলে দাবী করেননি। বরং তিনি সাময়িক পরিস্থিতির বিচারে কুরআনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) সারাজীবন পবিত্র কুরআনকেই তাঁর হেদায়াতের সিলেবাসস্বরূপ উল্লেখ করে গেছেন। যতবার তিনি (সা.) তাঁর ইহলোক ত্যাগের পর ফিতনার আশঙ্কা করতেন, ততবারই তিনি সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনকে আঁকড়ে ধরার কথা বলতেন। এর পরে আসত হেদায়াতের অন্যান্য উৎসের কথা। সুতরাং একটি কথা তো নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পার্থিব জগতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা যিনিই হয়ে থাকুন; শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআনুল কারীম-ই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রুহানি খলিফা হয়ে থাকবেন।

৩. উমর (রা.)-এর উপর যারা কূটকৌশলের অভিযোগ উত্তাপন করেন, তাঁরা উমর (রা.)-এর অবস্থান অনুধাবনই করতে পারেননি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দক্ষিণবাহু উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এমন ব্যক্তি ছিলেন না যে, তিনি আলী (রা)-কে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করার জন্য কোনরূপ হীন কূটকৌশলের আশ্রয় নেবেন। উমর (রা.) তো সেই ব্যক্তি, উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لو كان بعدي نبي لكان عمر بن الخطاب

অর্থঃ যদি আমার পরে কেউ নবী হতেন, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাব হতেন।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৪/১৫৪ এবং মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ৪৪৯৫)

উমর (রা.) আর দশজনের মতো সাধারণ মুসলমান ছিলেন না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لقد كان فيما قبلكم من الأمم محدثون فإن يك في أمتي أحد فإنه عمر

অর্থঃ তোমাদের পূর্বেকার উম্মতদের মধ্যে অনেক মুহাদ্দাছ ছিলেন। আমার উম্মতের মধ্যে যদি কেউ মুহাদ্দাছ হয়ে থাকেন, তিনি উমর।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৮৬)

উল্লেখ্য, মুহাদ্দাছ সে ব্যক্তি, যিনি নবী নন অথচ তাঁর হৃদয়ে ঐশী সত্য অবতীর্ণ হয়।

৪. উমর (রা.) কিভাবে আলী (রা.)-এর খেলাফতের বিরূদ্ধাচরণ করতে পারেন, যে উমর (রা.) খলিফা থাকাকালে মদীনার বাইরে সফরে যাওয়ার সময় সর্বদা আলী (রা.)-কেই ভারপ্রাপ্ত খলিফার দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। সিরিয়া ও জেরুজালেমে দীর্ঘ সফরের সময় উমর (রা.) আলী (রা.)-কে খলিফার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। এসব রাষ্ট্রীয় সফর অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এবং উমর (রা.) জানতেন যে, তিনি মারা গেলে ভারপ্রাপ্ত খলিফার দায়িত্বে থাকা আলী (রা.)-ই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। এমনকি ইন্তেকালের পূর্বে খলিফা উমর (রা.) পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের জন্য যে ছয় সদস্যের শুরা কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন, তাতে প্রথমেই ছিল আলী (রা.)-এর নাম, তারপর ছিল উসমান (রা.)-এর নাম। এরপর সুস্থ বিবেক কিভাবে একথা মানতে পারে যে, আলী (রা.)-কে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করতে কূটকৌশলবশত উমর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কিছু লেখা থেকে বিরত রেখেছিলেন?

৫. উল্লেখিত হাদিস অর্থাৎ হাদিসে কিরত্বাস রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের চারদিন পূর্বেকার ঘটনা। এ ঘটনার পরও ইন্তেকালের পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদেরকে আরো কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এমনকি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এই হাদিসের ভাষ্যে পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন মৌখিকভাবে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যদি তিনি আলী (রা.)-কে খলিফা মনোনিত করতে চাইতেন, তাহলে ইতোপূর্বে বা এর পরে সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা আলী (রা.)-কে খলিফা মনোনিত করে যেতেন।

৬. যদি ইমাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হতেন, যেভাবে শিয়ারা বিশ্বাস করেন এবং ইমামকে নির্বাচিত করে যাওয়া নবীর দায়িত্ব হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনোই সেটি করতে বাকি রাখতেন না; চাই যে পরিস্থিতিই সামনে আসুক না কেন। যিনি মক্কাবাসীর এতো নির্যাতনের পরও কালিমা তাওহীদের রজ্জু ছেড়ে দেননি, তিনি কিভাবে উমর (রা.)-এর একটি কথায় এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি হেদায়াত উম্মতকে জানানো থেকে বিরত রইলেন?

বস্তুত খলিফা কিংবা ইমাম নির্বাচন করে যাওয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাতের দায়িত্বের মধ্যে ছিলনা। যদি তা ঈমান-ইসলামের আবশ্যকীয় কোন বিষয় হতো, তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা তা উম্মতকে জানিয়ে যেতেন, যেভাবে তিনি (সা.) অন্য সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়ে দেয়াই তো ছিল তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেছেন-

ياأيها الرسول بلغ ما أنزل إليك من ربك وإن لم تفعل فما بلغت رسالته والله يعصمك من الناس

অর্থঃ হে রাসুল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন । আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন।

(সুরা মায়েদা : ৬৭)

৭. ইমামত নামক আকীদাটি যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হতো, তবে এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ'তে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকত। কিন্তু পবিত্র কুরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদিসসমূহে এমন একটি বর্ণনাও নেই, যেখানে আল্লাহ কিংবা রাসুল (সা.) সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা আলী (রা.)-কে খলিফা কিংবা ইমাম মনোনিত করেছেন।

৮. শিয়াদের দাবীর বিপক্ষে আহলে সুন্নাতের কতিপয় উলামা সম্পুর্ণ বিপরীত একটি দাবী করেছেন। ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা ও আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার মতে, হাদিসে কিরত্বাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে খলিফা মনোনিত করে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁদের দাবীর স্বপক্ষে দলিল হচ্ছে একটি ঘটনা, যা উপরোক্ত ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে ঘটেছিল। কাসিম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-

قالت عائشة وا رأساه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ذاك لو كان وأنا حي فأستغفر لك وأدعو لك فقالت عائشة وا ثكلياه والله إني لأظنك تحب موتي ولو كان ذاك لظللت آخر يومك معرسا ببعض أزواجك فقال النبي صلى الله عليه وسلم بل أنا وا رأساه لقد هممت أو أردت أن أرسل إلى أبي بكر وابنه وأعهد أن يقول القائلون أو يتمنى المتمنون ثم قلت يأبى الله ويدفع المؤمنون أو يدفع الله ويأبى المؤمنون

অর্থঃ আয়েশা (রা.) বলেছিলেন, হায় যন্ত্রণায় আমার মাথা গেল! তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যদি এমন হয় (তুমি মৃত্যুবরণ করো) আর আমি জীবিত থাকি, তাহলে আমি তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং দু'আ করব। আয়েশা (রা.) বললেন, আফসোস! আল্লাহর কসম, আমার ধারণা আপনি আমার মৃত্যুকে পছন্দ করেন। তাহলে আপনি পরের দিনই আপনার অন্য স্ত্রীদের নিকট গমন করতে পারবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, বরং আমিই এখন "যন্ত্রণায় মাথা গেল" বলার অধিক যোগ্য। আমি তো ইচ্ছাপোষণ করেছিলাম বা চেয়েছিলাম যে, আবু বকর ও তাঁর ছেলেকে ডেকে আনব এবং (একটি বিষয়ে) ওসিয়ত করে যাব। যেন (এ বিষয়ে) লোকদের কিছু বলার অবকাশ না থাকে এবং আকাঙ্ক্ষাকারীদের কোন আকাঙ্ক্ষা করার সুযোগ না থাকে। পরে ভাবলাম, আল্লাহ (আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে) এ ব্যাপারে অপছন্দ করবেন এবং মু'মিনগণও তা বর্জন করবেন। অথবা আল্লাহ তা প্রতিহত করবেন এবং মু'মিনগণ তা অপছন্দ করবেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল মারদ্বা, ৫৩৪২)

অপর বর্ণনায়, উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

عن عائشة قالت قال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم في مرضه ادعي لي أبا بكر أباك وأخاك حتى أكتب كتابا فإني أخاف أن يتمنى متمن ويقول قائل أنا أولى ويأبى الله والمؤمنون إلا أبا بكر

অর্থঃ আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) রোগশয্যায় থাকাকালে আমাকে বললেন, তোমার পিতা আবু বকর ও তোমার ভাইকে ডাকো। আমি একটি পত্র লিখে দিয়ে যাই। আমি আশঙ্কা করছি, কোন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা করবে এবং কেউ দাবী করে বসবে যে, আমিই এ বিষয়ের হকদার। অথচ আল্লাহ ও মু'মিনগণ এ ব্যাপারে আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে মেনে নেবেন না।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৩৮৭)

উক্ত হাদিসদ্বয়ের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-কে কোন একটি বিষয়ে ওসিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি (সা.) ভাবলেন যে, এমনটি করার প্রয়োজন নেই। কারণ আবু বকর (রা.) ব্যতীত অন্য কাউকে আল্লাহ এ পদে অধিষ্ঠিত করবেন না এবং মু'মিনগণও আবু বকর (রা.) ব্যতীত অন্য কাউকে এ পদে আসীন হওয়া থেকে প্রতিহত করবেন। সুতরাং তিনি (সা.) ওসিয়ত করা থেকে বিরত রইলেন। এখানে "একটি বিষয়ে ওসিয়ত" বলতে নিশ্চিতভাবেই খেলাফতের ব্যাপারে ওসিয়ত করার কথা বুঝা যাচ্ছে। এ হাদিসের আলোকে কতিপয় সুন্নী উলামা দাবী করেন যে, হাদিসে কিরত্বাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.)-কেই তাঁর খলিফা মনোনিত করতে চেয়েছিলেন, যদিও তিনি করেননি।

আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকেই খলিফা বা ইমাম নির্বাচিত করে যাননি। পার্থিব নেতৃত্বের এ বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলার ইচ্ছা এবং উম্মতের সার্বিক বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর উম্মত ভুল-ভ্রান্তির উপর ঐক্যমত পোষণ করবেনা। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إن الله لا يجمع أمتي أو قال أمة محمد صلى الله عليه وسلم على ضلالة ويد الله مع الجماعة ومن شذ شذ إلى النار

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মত, অথবা বলেছেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতকে ভ্রান্তির উপর একমত করবেন না। জামা'আতের উপর (উম্মতের বৃহদাংশের উপর) আল্লাহর হাত রয়েছে। আর যে জামা'আত থেকে বিচ্ছিন হয়, সে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জাহান্নামের দিকে পা বাড়ায়।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২১৬৭)

দ্রষ্টব্যঃ ইমাম তিরমিযি এই হাদিসের সনদকে গরিব বলেছেন।

শিয়া সম্প্রদায় আলী (রা.)-কে প্রথম ও একমাত্র খলিফা বা ইমাম বিশ্বাস করার পেছনে হাদিসে কিরত্বাস ব্যতীত আরো কতিপয় প্রমাণ পেশ করেন। এরমধ্যে বেশিরভাগ প্রমাণ তাঁদের নিজেদের সূত্রে বর্ণিত। সুতরাং আমরা সেদিকে যাবনা। কারণ আহলে সুন্নাতের ইমামগণ শিয়াদের বর্ণনাসূত্রে "তেমন" আস্থা পোষণ করেননা। তবে দুটি প্রমাণ তাঁরা সুন্নীদের সূত্র থেকে পেশ করেন। প্রমাণদ্বয় নিম্নরূপ-

১. রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে খুম নামক স্থানে আলী (রা.)-এর হাত ধরে বলেছিলেন, আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা। যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

من كنت مولاه فعلي مولاه

অর্থঃ আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭১৩)

২. তাবুক অভিযানে বের হওয়া সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে মদীনার দায়িত্বে রেখে যাচ্ছিলেন। তখন আলী (রা.) সাথে যাওয়ার বাসনা করলে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্নেহাস্পদ আলী (রা.)-এর প্রতি আস্থা ও ভালবাসা ব্যক্ত করেছিলেন। ইবরাহিম তাঁর পিতা সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে বলেছেন-

أما ترضى أن تكون مني بمنزلة هارون من موسى

অর্থঃ তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার জন্য সেরূপ, যেরূপ মুসা (আ.)-এর জন্য ছিলেন হারূন (আ.)।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৫০৩)

শিয়া সম্প্রদায় এ দুটি প্রমাণের দ্বারা আলী (রা.)-কে রাসুল (সা.)-এর খেলাফতের উত্তরসূরি বলে দাবী করেন। আমরা প্রমাণদ্বয়কে ব্যাখ্যা করব।

প্রথম হাদিসঃ শিয়াদের দাবী হচ্ছে, مولي (মাওলা) শব্দ দ্বারা উত্তরাধিকারী উদ্দেশ্য। সুতরাং রাসুল (সা.) আলী (রা.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনিত করে গেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে مولي (মাওলা) শব্দের অর্থ উত্তরাধিকারী নয়। مولي (মাওলা) শব্দটি ولي (ওলী) শব্দ থেকে উদ্ভূত বা নিষ্পন্ন। আরবি ولي (ওলী) শব্দের অর্থ বন্ধু বা প্রিয়জন। পবিত্র কুরআনে ولي (ওলী) শব্দটি বন্ধু অর্থে এসেছে। আল্লাহ বলেছেন-

الأ ان اولياء الله لاخوف عليهم ولأ هم يحزنون

অর্থঃ জেনে রেখো! যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা।

(সুরা ইউনুস : ৬২)

অপর আয়াতে আল্লাহ সরাসরি مولي (মাওলা) শব্দটি উল্লেখ করেছেন-

ذالك بان الله مولي الذين امنوا وان الكافرين لأ مولي لهم

অর্থঃ এটি এজন্য যে, আল্লাহ ঈমানদারদের হিতৈষী বন্ধু। আর অবিশ্বাসীদের কোন হিতৈষী বন্ধু নেই।

(সুরা মুহাম্মদ : ১১)

এখানে مولي (মাওলা) যদি খলিফা কিংবা উত্তরাধিকারী অর্থে ধরে নেই, তাহলে আয়াতের অর্থ হবে- আল্লাহ মু'মিনদের খলিফা এবং অবিশ্বাসীদের কোন খলিফা নেই। এতে আয়াতের অর্থ তো বদলে যাবেই; উপরন্তু কথাটি কুফরের দিকে পতিত হবে।

কেবল কুরআনের আয়াতেই নয়; বরং হাদিসেও مولي (মাওলা) শব্দটি অন্যান্য ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। বারা ইবনে আজিব (রা.) বর্ণনা করেন-

قال لزيد أنت أخونا ومولانا

অর্থঃ রাসুল (সা.) যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)-কে বলেছেন, তুমি আমাদের ভাই এবং আমাদের মাওলা।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুস সিলাহ, ২৫৫৩)

এখানে কি এটি ধরে নেয়া যৌক্তিক হবে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)-কে তাঁর খলিফা বা উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছেন? এমনটি তো শিয়ারাও বিশ্বাস করবেন না।

বস্তুত, উল্লেখিত হাদিস, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে মাওলা বলেছেন, তা একটি বিশেষ মুহূর্তের বর্ণনা। জামে তিরমিযি, আবওয়াবুল মানাকিব অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় কিছু লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আলী (রা.)-এর কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অভিযোগ উত্তাপন করেছিলেন। এর জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) উক্ত হাদিস ইরশাদ করেছেন।

ইমাম বায়হাকী বলেছেন, এ হাদিস দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আলী (রা.)-কে খেলাফতের উত্তরাধিকার দেয়ার কথা প্রতিষ্ঠিত হয়না। আমরা এ হাদিসটি মর্যাদা বিষয়ক কিতাবে উল্লেখ করেছি, যার দ্বারা রাসুল (সা.)-এর কথার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করা যায়। আর তা হল- যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর বা বিচারকরূপে প্রেরণ করেছিলেন, তখন সেখান থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনেক অভিযোগ আসল। তিনি (সা.) ইচ্ছাপোষণ করলেন যে, আলী (রা.)-এর ব্যাপারে তাঁর ভালবাসার কথা প্রকাশ করবেন এবং ইয়ামেনবাসীকে আলী (রা.)-এর মর্যাদা ও ভালবাসার উপর রাজি করাবেন। তখন তিনি (সা.) বলেছিলেন, আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (সা.) এও বলেছিলেন-

اللهم وال من والاه وعاد من عاداه

অর্থঃ আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তাকে ঘৃণা বা শত্রুতা পোষণ করো, যে আলীকে ঘৃণা করে।

(আল-ই'তিকাদ ওয়াল-হিদায়াতু ইলা সাবিলির রাশাদ : ইমাম বায়হাকী)

যদি ولي (ওলী) এবং তার থেকে নির্গত مولي (মাওলা) শব্দ দ্বারা খলিফা বা উত্তরাধিকারী অর্থ নেয়া হয়, তাহলে উক্ত হাদিসের অর্থ হবে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে খলিফা ভাবো যে আলীকে খলিফা ভাবে! এই অর্থ কতোটুকু অবাস্তব হবে, তা তো সহজেই অনুমেয়।

দ্বিতীয় হাদিসঃ শিয়াদের দাবী হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক অভিযানকালে আলী (রা.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে গিয়েছিলেন এবং একইসাথে মুসা (আ.)-এর সাথে হারূন (আ.)-এর সম্পর্ক উল্লেখ করে আলী (রা.)-কে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছিলেন।

কথা হচ্ছে, এটি নিয়ে কোন সংশয় নেই যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক অভিযানকালে আলী (রা.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে গিয়েছিলেন। আর এটি প্রথমবার নয়। মক্কা থেকে হিজরত করার সময়ও রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে নিজের বিছানায় শুইয়ে নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। এর কারণ হল, রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। আলী (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। আলী (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরেই লালিতপালিত হয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমা (রা.)-কে আলী (রা.)-এর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। আলী (রা.)-এর জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালবাসা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু তাবুক অভিযানকালে আলী (রা.)-কে স্থলাভিষিক্ত করার দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠিত হয়না যে, আলী (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর প্রথম এবং একমাত্র খলিফা হবেন। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সাহাবিকে তাঁর প্রতিনিধিস্বরূপ বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতেন। এর অর্থ তো এটি নেয়া যায়না যে, এরা সবাই প্রথম খলিফা বা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তরাধিকারের দাবী করে বসবেন! জীবদ্দশায় কোন একটি বিশেষ সময়ের জন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করার অর্থ এই নয় যে, ইন্তেকালের পর তাঁর হাতেই উত্তরাধিকারের ভার অর্পিত হবে।

তাছাড়া এখানে আরেকটি কথাও উল্লেখযোগ্য। তা হল- রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-এর সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মুসা (আ.)-এর সাথে হারূন (আ.)-এর সম্পর্কের উদাহরণ দিয়েছিলেন। বস্তুত হারূন (আ.) কেবল মুসা (আ.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন; মৃত্যুর পরে নয়। কারণ মুসা (আ.)-এর জীবদ্দশায়ই হারূন (আ.) পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। মুসা (আ.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর খলিফা মনোনিত হয়েছিলেন ইউশা ইবনে নূন (আ.)। সুতরাং মুসা (আ.) ও হারূন (আ.)-এর উদাহরণ দ্বারা কিভাবে আলী (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেলাফতের প্রথম ও একমাত্র উত্তরাধিকারী বলে গণ্য করা যায়?

এসব যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমরা কেবল একটি কথাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছি। তা হল- রাসুলুল্লাহ (সা.) কোন সাহাবিকে প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা তাঁর খলিফা মনোনিত করে যাননি। বরং সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে প্রথম খলিফা মনোনিত করেছিলেন। এরপর করেছিলেন উমর (রা.)-কে, এরপর উসমান (রা.)-কে এবং এরপর আলী (রা.)-কে। আমরা কোনভাবেই এটি বুঝাতে চাচ্ছিনা যে, আলী (রা.) খলিফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। আল্লাহ এরূপ নিকৃষ্ট বিষয় কল্পনা করা থেকেও আমাদেরকে রক্ষা করুন। আলী (রা.) উম্মতের খলিফা হওয়ার শত-সহস্রভাগ যোগ্য ছিলেন এবং তিনি হয়েছিলেনও। আমাদের কোন যুক্তি থেকে কেউ যেন একথা ভেবে না বসেন যে, আমরা আলী (রা.)-কে ঘৃণা করি। আল্লাহর শপথ, আমরা আলী (রা.)-কে প্রাণাধিক ভালবাসি। কারণ, আলী (রা.)-কে ভালবাসা মুসলমানদের ঈমানের পরিচয় বহন করে। আলী (রা.) নিজে বর্ণনা করেছেন-

والذي فلق الحبة وبرأ النسمة إنه لعهد النبي الأمي صلى الله عليه وسلم إلي أنه لا يحبني إلا مؤمن ولا يبغضني إلا منافق

অর্থঃ শপথ সেই সত্ত্বার, যিনি বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম করেন এবং জীবকুল সৃষ্টি করেন। নবী (সা.) আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মু'মিন ব্যতীত কেউ আমাকে ভালবাসবেনা এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করবেনা।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ঈমান, ৭৮)

খেলাফত থেকে কারবালা - ২

(একত্রিত এবং সংযোজিত)

আবু যুবায়ের বলেন-

قلت لجابر كيف كان علي فيكم؟ قال ذلك من خير البشر، ما كنا نعرف المنافقين إلا ببغضهم إياه

অর্থঃ আমি জাবির (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের (সাহাবিদের) মধ্যে আলী (রা.)-এর অবস্থান কিরূপ? তিনি বললেন, তিনি আমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিত্ব। আমরা মুনাফিকদেরকে পরিচয় করি, আলী (রা.)-এর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করার দ্বারা। অর্থাৎ মুনাফিক ব্যতীত কেউ আলী (রা.)-এর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করেনা।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ২/৬৭১-৬৭২)

শিয়াদের মধ্যে কেউ কেউ আলী (রা.)-এর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রশংসাপূর্ণ বাক্যসমূহ উল্লেখ করে আলী (রা.)-কে প্রথম এবং একমাত্র খলিফা হওয়ার দাবীদার বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের দাবীটি আংশিক সত্য। প্রকৃতপক্ষেই, প্রথম তিন খলিফার মর্যাদাব্যাঞ্জক হাদিসসমূহ একত্রিত করা হলেও আলী (রা.)-এর মর্যাদাব্যাঞ্জক হাদিসসমূহের সমান হবেনা। কিন্তু মর্যাদাব্যাঞ্জক হাদিসের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে তো "প্রথম এবং একমাত্র" খলিফা বা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তরাধিকারী মনোনিত করা যায়না। নয়তো আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর মর্যাদায় যেসব বর্ণনা এসেছে, তাতে প্রায় স্পষ্টরূপে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আবু বকর (রা.)-ই প্রথম খলিফা হওয়ার দাবীদার ছিলেন।

প্রথমত, আবু বকর (রা.) একমাত্র ব্যক্তি যাকে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা পবিত্র কুরআনে "সাহাবি" বলে সম্বোধিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

إذ أخرجه الذين كفروا ثاني اثنين إذ هما في الغار إذ يقول لصاحبه لا تحزن إن الله معنا

অর্থঃ যখন অবিশ্বাসীরা তাকে বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি তার সাহাবিকে বললেন, বিষন্ন হয়োনা। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সুরা তাওবাহ : ৪০)

এ আয়াতে হিজরতের সময় গারে সুর নামক গুহায় অবস্থান করার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ উক্ত আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেছেন দু'জনের একজন। অপরজন ছিলেন আবু বকর (রা.)। যদি দু'জনের প্রথমজন রাসুলুল্লাহ (সা.) হন, তাহলে আবু বকর (রা) তো আপনাআপনি দ্বিতীয়জন হয়ে যান।

দ্বিতীয়ত, আবু বকর (রা.) একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় মসজিদে নববীতে ১১ ওয়াক্ত নামাজের জামাতে ইমামতি করেছিলেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেছেন-

مروا أبا بكر فليصل بالناس

অর্থঃ আবু বকরকে বলো মানুষকে নিয়ে নামাজ আদায় করতে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুস সালাত, ৪১৮)

রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ থাকাবস্থায় একদিন আবু বকর (রা.) মসজিদে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন মুসল্লিরা উমর (রা.)-কে ইমামতি করতে বললেন। উমর (রা.) নামাজে দাড়িয়ে তাকবির উচ্চারণ করতেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইমামতির ব্যাপারে বারণ করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উতবাহ থেকে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনে যাম'আহ (রা.) বলেছেন-

لما سمع النبي صلى الله عليه وسلم صوت عمر قال ابن زمعة خرج النبي صلى الله عليه وسلم حتى أطلع رأسه من حجرته ثم قال لا لا لا ليصل للناس ابن أبي قحافة يقول ذلك مغضبا

অর্থঃ যখন নবী (সা.) উমর (রা.)-এর তাকবিরের আওয়াজ শুনলেন, তখন উঠে এসে ঘর থেকে মাথা বের করে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললেন- না, না, না! আবু কুহাফার পুত্র (আবু বকর) যেন লোকদের ইমামতি করেন।

(সুনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সুন্নাহ, ৪৬৬১)

এছাড়াও আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদাব্যাঞ্জক কিছু আয়াত ও অসংখ্য হাদিস রয়েছে, যার একটি অংশ আমরা আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত অধ্যায়ে উল্লেখ করব। কিন্তু এসব হাদিস উল্লেখপূর্বক আমরা এ দাবী করছিনা যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কাধে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছিলেন। বরং আমরা এখানেও সে কথাটি বলছি, যা এর আগে বলে এসেছিলাম। তা হল- রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনিত করে যাননি। উম্মতে মুহাম্মাদির বৃহত্তর কল্যাণের বিবেচনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা ক্রমানুসারে চারজন সম্মানিত ব্যক্তির হাতে উম্মতের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং উম্মত উক্ত চারজনের খেলাফতের উপর ঐক্যমত পোষণ করেছিল। বস্তুত, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলাই চুড়ান্ত কর্মবিধায়ক।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সূত্রে আল্লামা ইবনে কাছীর বর্ণনা করেছেন, উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) খলিফা থাকাকালে এক ব্যক্তি আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতের বাই'আত সম্বন্ধে কটুক্তি করে। তখন উমর (রা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে সেসময়কার পরিস্থিতি লোকদেরকে জানিয়ে দেন। আবু বকর (রা.)-এর বাই'আতের ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ-

১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর ঘরে জমা হয়েছেন আলী (রা.), ফাতিমা (রা.), আবু বকর (রা.) প্রমুখ। এ সময় উমর (রা.) এসে আবু বকর (রা.)-কে ঘর বেরিয়ে আসতে বললেন। আবু বকর (রা.) অপারগতা প্রকাশ করলে উমর (রা.) পুনরায় তাঁকে জোর দিলেন। অগত্যা আবু বকর (রা.) ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে উমর (রা.) তাঁকে জানালেন, সাকীফা বনু সাঈদা নামক বাগানে মদীনার আনসার সাহাবিরা নিজেদের মধ্যে থেকে খলিফা নির্বাচনের জন্য একত্রিত হয়েছেন। উমর (রা.) বললেন, চলুন আমরা আমাদের আনসার ভাইদের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলে আসি। যদিও উপস্থিত কয়েকজন ব্যক্তি এ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিতে বলেছিলেন। তবুও আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.) আনসারদেরকে বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। উভয়ে দ্রুতগতিতে সাকীফায় গমন করলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন যে, আনসারগণ সা'দ ইবনে উবাদা (রা.)-কে খলিফা মনোনিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন উমর (রা.) কিছু বলতে উদ্যত হলে আবু বকর (রা.) তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আনসারদেরকে উদ্দেশ্যে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করলেন। প্রথমে তিনি আনসারদের মর্যাদাব্যঞ্জক হাদিসসমূহ স্মরণ করলেন। বললেন- হে মদীনার আনসারগণ! রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لو سلك الناس واديا وسلكت الأنصار واديا، سلكت وادي الأنصار

অর্থঃ যদি সব মানুষ এক উপত্যকা দিয়ে চলে এবং আনসারগণ আরেকটি উপত্যকা দিয়ে চলে, তবে আনসারদের দিকেই যাব।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৯০১)

কিন্তু হে আনসারগণ! উম্মতের নেতৃত্ব কুরাইশদের হাতে থাকাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, বহির্বিশ্বে কুরাইশরা নেতৃস্থানীয় বলে স্বীকৃত। আরবের অন্যান্য গোত্রগুলো কুরাইশ ব্যতীত অন্য কাউকে নেতা হিসেবে মেনে নেবেনা। হে সা'দ, আপনি তো সেসময় উপস্থিত ছিলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন-

قريش ولاة هذا الأمر فبر الناس تبع لبرهم، وفاجرهم تبع لفاجرهم

অর্থঃ কুরাইশরা এ (নেতৃত্ব) বিষয়টির অধিক উপযুক্ত। সুতরাং মানব সমাজের ভাল লোকেরা কুরাইশদের ভাল মানুষদের অনুগামী এবং মন্দ লোকেরা এদের মন্দদের অনুগামী।

তখন সা'দ ইবনে উবাদা (রা.) বললেন-

صدقت نحن الوزراء وأنتم الأمراء

অর্থঃ আপনি সত্য কথা বলেছেন। আমরা উযির এবং আপনারা নেতা।

তখন আনসারদের মধ্য থেকে একব্যক্তি বললেন-

منا أمير ومنكم أمير يا معشر قريش

অর্থঃ হে কুরাইশ ব্যক্তিবর্গ! আমাদের মধ্য থেকে একজন নেতা হোক এবং আপনাদের মধ্য থেকে একজন হোক।

তাঁকে জানানো হল, এরূপ হলে উম্মত দুইভাগ হয়ে যাবে। তখন আবু বকর (রা.) বললেন-

قد رضيت لكم أحد هذين الرجلين: عمر بن الخطاب، وأبو عبيدة بن الجراح

অর্থঃ আমি আপনাদের জন্য উমর ইবনে খাত্তাব অথবা আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ থেকে যে কোন একজনকে বেছে নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করছি।

উল্লেখ্য, উমর (রা.)-এর মর্যাদা মুসলমানদের নিকট সমুন্নত হলেও আবু উবায়দাহ (রা.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অনেকে ওয়াকিবহাল নন। আবু উবায়দাহ (রা.) একেবারে শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহনকারী সাহাবিদের অন্যতম এবং আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إن لكل أمّة أميناً، وإن أميننا أيتها الأمة أبو عبيدة بن الجراح

অর্থঃ প্রত্যেক উম্মতের একজন দায়িত্বশীল থাকেন। আমাদের অর্থাৎ আমার উম্মতের দায়িত্বশীল হচ্ছেন আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ। (সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪১৯)

ইমাম নাসায়ীর সূত্রে বর্ণিত, উমর (রা.) আনসারদের উদ্দেশ্যে বললেন-

يا معشر الأنصار ألستم تعلمون أن رسول الله قد أمر أبا بكر أن يؤم الناس، فأيكم تطيب نفسه أن يتقدم أبا بكر، فقالت الأنصار نعوذ بالله أن نتقدم أبا بكر

অর্থঃ হে আনসারগণ! আপনারা কি জানেন না, রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে মানুষের নেতৃত্ব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন? এখন আপনাদের মধ্যে কে আছেন যিনি আবু বকর (রা.) থেকে অগ্রগামী হওয়ার মনোবাসনা ব্যক্ত করেন? আনসারগণ বললেন, আমরা আবু বকর (রা.)-এর সামনে অগ্রগামী হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।

আল্লামা ইবনে ইসহাকের সূত্রে বর্ণিত, উমর (রা.) বললেন-

يا معشر المسلمين إن أولى الناس بأمر النبي الله ثاني اثنين إذ هما في الغار، وأبو بكر السباق المسن

অর্থঃ হে মুসলমানরা! আল্লাহর নবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া কাজ সম্পন্ন করার জন্য অগ্রাধিকারী এবং সর্বাধিক উপযুক্ত হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ছিলেন (গারে সুর) গুহায় দুজন ব্যক্তির দ্বিতীয়জন এবং সবার চেয়ে অগ্রণী ও বয়োজ্যেষ্ঠ- তিনি আবু বকর (রা.)। এ কথা বলতে বলতে উমর (রা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর হাত ধরে সামনে বাড়িয়ে দিলেন এবং নিজেই সর্বপ্রথম বাই'আত জ্ঞাপন করলেন। এরপর উপস্থিত মুহাজির ও আনসারগণ আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর হাতে বাই'আতে খেলাফত জ্ঞাপন করলেন। তবে সা'দ ইবনে উবাদা (রা.) শেষপর্যন্ত এ বাই'আতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বিধায় তিনি বাই'আত দেয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন। এমনকি তিনি উমর (রা.)-এর খেলাফতেও বাই'আত জ্ঞাপন করেননি। দুই খলিফার কেউই তাঁকে বাই'আতের জন্য জোরাজুরি করেননি।

সাকীফার বাই'আতটি ছিল প্রাথমিক বাই'আত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খলিফা নির্বাচনের এ ঘটনাটি ইঙ্গিত করে যে, উম্মতকে এক এবং সুসংহত রাখার জন্য খলিফা নির্ধারণ করা কতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুসলিম জাতিকে এক মুহূর্তের জন্যও নেতৃত্বশূন্য রাখা তখন অকল্পনীয় ছিল। আর আজকে সেই জাতি ছোটখাটো পার্থিব-অপার্থিব মতভেদ এবং পারস্পারিক বিদ্বেষ বুকে লালন করে শত-সহস্রভাগে বিভক্ত! একটি সম্মিলিত মুসলিম উম্মাহ'র স্বপ্ন যেন অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইমাম বায়হাকী আবু সাঈদ খুদরী (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, পরদিন মসজিদে নববীতে যখন পরিপূর্ণ বাই'আত গ্রহন করা হচ্ছিল, তখন আলী (রা.) এবং যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) তথায় উপস্থিত ছিলেন না। আবু বকর (রা.) তাঁদেরকে ডেকে পাঠালেন। যুবায়ের (রা.) উপস্থিত হলে তিনি বললেন, হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ফুফাতো ভাই ও নিবেদিতপ্রাণ সহযোগী! আপনি কি মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছেন? যুবায়ের (রা.) তৎক্ষণাৎ বললেন-

لا تثريب يا خليفة رسول الله

অর্থঃ হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা! আমার পক্ষ থেকে আপনার ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই।

অতপর তিনি বাই'আত জ্ঞাপন করলেন। অতপর আলী (রা.)-কে ডাকা হল। তিনি বাই'আতে অংশ নিতে পারেননি, কারণ আহলে বায়েতের দায়িত্বশীল হিসেবে তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গকে সুসংহত রাখার দায়িত্ব তাঁর উপরেই ছিল। তিনি মসজিদে আসলে আবু বকর (রা.) সসম্মানে জিজ্ঞেস করলেন- হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই ও প্রিয়তম জামাতা, আপনি কি উম্মতের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছেন? যদি কোন নারাজি থেকে থাকে, তবে আমি খেলাফত ত্যাগ করলাম। আপনারা যে কোন একজনকে খলিফা মনোনিত করুন। আলী (রা.) ও একই কথা বললেন-

لا تثريب يا خليفة رسول الله

অর্থঃ হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা! আমার পক্ষ থেকে আপনার ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই।

এ কথা বলে আলী (রা.) খলিফা আবু বকর (রা.)-এর হাতে বাই'আত জ্ঞাপন করলেন।

ইমাম আবু আলী নিশাপুরী বলেন, ইমাম মুসলিম ইমাম ইবনে খুযাইমার কাছে আবু বকর (রা.)-এর হাতে আলী (রা.)-এর বাই'আতের ঘটনাটি জানতে চেয়েছিলেন। যখন ইমাম ইবনে খুযাইমা ইমাম মুসলিমকে উপরোক্ত ঘটনাটির সত্যতা স্বীকার করলেন, তখন ইমাম মুসলিম অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, সুবাহানাল্লাহ! এই বর্ণনাটি কুরবানির উটের মতো মূল্যবান। তখন ইমাম ইবনে খুযাইমা বললেন, হ্যাঁ। বর্ণনাটি যেন মুদ্রার থলি! অর্থাৎ, এ মহামূল্যবান বর্ণনা দ্বারা আবু বকর (রা.) ও আলী (রা.)-এর মধ্যকার বিবাদের মিথ্যা কাহিনীর মূলোৎপাটন হয়ে গেছে।

ইমাম হাকিম একটি বর্ণনা এনেছেন, যেখানে দেখা যায় যে, আলী (রা.) ছয়মাস পর আবু বকর (রা.)-এর হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন। বর্ণনাটি যথার্থ। তবে আহলে সুন্নাতের গবেষক আলিমদের মতে, এটি ছিল আলী (রা.)-এর পক্ষ থেকে আবু বকর (রা.)-এর হাতে জ্ঞাপন করা দ্বিতীয় বাই'আত। কারণ, লোকেরা বলাবলি শুরু করেছিল যে, আলী (রা.) নিজে খলিফা হতে চেয়েছিলেন বিধায় তিনি আবু বকর (রা.)-এর হাতে বাই'আত জ্ঞাপন করেননি। এই কানাঘুষা শুনে খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আলী (রা.)-কে পুনরায় বাই'আত দিতে অনুরোধ করলেন, যেন বিষয়টি সমাধা হয়ে যায়। আলী (রা.) সন্তুষ্টচিত্তে আবু বকর (রা.)-এর হাতে দ্বিতীয়বার বাই'আত জ্ঞাপন করলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ৫ম খণ্ড, সাকীফা বনু সাঈদার ঘটনা)

শিয়াদের বিশ্বাস হল, আলী (রা.) আবু বকর (রা.)-এর ডাকে সাড়া দেননি। তখন উমর (রা.) খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-কে সাথে নিয়ে আলী (রা.)-এর ঘরে যান। তাঁরা সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে প্রহার করেন, তাঁর ঘর পুড়িয়ে দেন এবং টেনেহ্যাঁচড়ে আলী (রা.)-কে বের করে নিয়ে আসেন। ফাতিমা (রা.) তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। প্রহারের দরূণ তাঁর গর্ভপাত হয় এবং এ আঘাত নিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন! এরপর আলী (রা.) বাধ্য হয়ে বাই'আত দেন। এজন্য শিয়ারা সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে শহীদ বলে আখ্যায়িত করেন!

এমন লাগামহীন মিথ্যা গল্প বুনার আগে শিয়ারা একটি সহজ কথা অনুধাবন করতে পারেননা যে, তাদের বানোয়াট গল্পে সবচেয়ে বেশি অপমান হয় আলী (রা.) এবং আহলে বায়েতের অধিকার ও সম্মানের। কার শক্তি আছে আল্লাহর সিংহ আলী (রা.)-কে টেনেহ্যাঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসবে, যে আলী (রা.) একহাতে খায়বার দূর্গের দরজাকে ঢাল বানিয়ে খায়বার বিজয় করে এনেছিলেন? কিভাবে উমর (রা.) সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে আঘাত করতে পারেন, যে উমর (রা.) নিজেকে আহলে বায়েতের গোলাম বলে বেড়াতেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) যে ফাতিমা (রা.)-কে "কলিজার টুকরো" বলে ডাকতেন, তাঁকে এমন নির্মমভাবে প্রহার করলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা? এতকিছু হয়ে গেল, আর বনু হাশিমের একজন সদস্য কিংবা একজন সাহাবিও বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করলেন না? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারের প্রতি সদাচরণের যে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, সব সাহাবি একসাথে তা ভুলে গেলেন? রাসুলুল্লাহ (স.)-এর তেইশ বছরের তা'লিম-তারবিয়াত এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল? কথা বলার পূর্বে একবার তো আল্লাহর দিকে খেয়াল করা উচিৎ!

এ ঘটনাটি এতো জগন্য মিথ্যাচার যে, এর জবাব দেয়াও জ্ঞানের প্রতি অবিচার করার নামান্তর। আমরা কেবল এই ষড়যন্ত্রের উৎস অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ করব। এ ঘটনাটির মূল সূত্র হচ্ছে "আস-সাকীফাহ" নামক একটি গ্রন্থ, যেখানে প্রথমবার এই ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এটিই প্রথম শিয়া গ্রন্থ যাতে দাবী করা হয়েছিল যে, পবিত্র কুরআন বিকৃত হয়ে গেছে! এ গ্রন্থটির তথাকথিত রচয়িতা হচ্ছেন সুলায়েম ইবনে কায়েস আল-আমেরী নামক ব্যক্তি। তবে গ্রন্থটি সুলায়েম ইবনে কায়েস নিজে লেখেননি। তার তথাকথিত সাগরেদ আবান ইবনে আবি আইয়্যাশ গ্রন্থটি রচনা করে সুলায়েম ইবনে কায়েসের সূত্রে চালিয়ে দিয়েছেন। উক্ত গ্রন্থে সুলায়েম ইবনে কায়েস দাবী করেছেন, আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ঘরে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনাটি দেখেছি।

প্রসিদ্ধ শিয়া আলিমদের মধ্যে আল্লামা হিল্লী, আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আলী, আল্লামা মামেকানী প্রমুখ তাঁদের রিজাল বিষয়ক গ্রন্থসমূহে উক্ত ঘটনার "সূত্রধর" আবান ইবনে আবি আইয়্যাশকে অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এটিও বলেছেন যে, সুলায়েম ইবনে কায়েসের দিকে এ গ্রন্থটি সম্বোধিত করার দরূণ গ্রন্থটি দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ সুলায়েম ইবনে কায়েস "বর্ণনার জগতে" অপরিচিত ব্যক্তি।

আহলে সুন্নাতের ইমামদের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, ইমাম আলী ইবনুল মাদায়েনী, ইমাম ইয়াযিদ ইবনে হারূন, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী প্রমুখ ভুবনবিখ্যাত হাদিস বিশারদগণ আবান ইবনে আবি আইয়্যাশকে ليس بثقة (অনির্ভরযোগ্য), ضعيف (দুর্বল), منكر الحديث (হাদিস অস্বীকারকারী) এবং متروك (পরিত্যাজ্য) বলে নিন্দা করেছেন। কোন কোন মুহাদ্দিছ তাকে "লোক হিসেবে খারাপ না" বলে আখ্যায়িত করলেও পরে বলে দিয়েছেন যে, তার থেকে কোন বর্ণনা গ্রহন করা যাবেনা। শুয়াইব ইবনে হারবের সূত্রে বর্ণিত, ইমাম শো'বা ইবনে হাজ্জাজ বলেছেন-

لأن أشرب من بول حمارى أحب إلى من أن أقول حدثنى أبان

অর্থঃ আমার কাছে "আবান থেকে বর্ণিত" বলে কোন বর্ণনা করার চেয়ে গাধার মুত্র পান করা অধিক প্রিয়।

তবে আমরা একথাও অস্বীকার করছিনা যে, অনেক শিয়া উলামা উক্ত ঘটনাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন। তাঁরা বিভিন্ন মাহফিলে ঘটনাটি উল্লেখ করে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। জ্ঞানের গভিরতা ও যাচাই-বাছাই করার মানসিকতা না থাকায় সাধারণ শিয়ারা এ মিথ্যাচারকে সত্য বলে ধরে নেন এবং এখান থেকেই তাঁদের মনে সাহাবি-বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হয়। সাধারণ শিয়াদের উদ্দেশ্যে আমরা একটি কথাই বলতে পারি। হাফস ইবনে আসিম থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

كفي بالمرء كذبا ان يحدث بكل ما سمع

অর্থঃ কোন ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।

(সহীহ মুসলিম : মুকাদ্দিমা, ৫)

সাধারণ বিবেকবান মানুষও যে ঘটনাকে স্পষ্ট মিথ্যাচার বলবে, শিয়া আলিমগণ কেবল বিদ্বেষের জেরে এ জগন্য মিথ্যাটিকে সমাজে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। বস্তুত, শিয়ারা আর সেই দল নেই যাদেরকে আমরা شيعة علي বা আলী (রা.)-এর সমর্থক বলে জানতাম। মুখে না বললেও, তাঁরা এখন আলী (রা.) ও আহলে বায়েতের মানহাজ থেকে সরে এসে বনু উমাইয়ার অনুসারী হয়ে গেছেন। বনু উমাইয়ারা তাঁদের শাসনামলে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে আলী (রা.)-কে গালাগালি করতেন। শিয়ারাও এ পথ অনুসরণ করে সম্মানিত সাহাবিদেরকে গালাগালি করেন।

আমরা এ দাবী করছিনা যে, সাহাবিদের মধ্যে কোন মতপার্থক্যই ছিলনা। ছিল, এবং থাকাটা খুব স্বাভাবিক। চলার পথে দুজন মানুষের মধ্যে যদি দু'একটি মতভিন্নতা দেখা দেয়, তাতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে? আমরা এটিও স্বীকার করছি যে, আহলে বায়েতের সদস্যদের মনে খেলাফতের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল এবং থাকাটা স্বাভাবিক। উম্মতের খেদমত করতে চাওয়া তো কোন অন্যায় আকাঙ্ক্ষা নয়।

সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত একটি হাদিসে পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পূর্বে আব্বাস (রা.) আলী (রা.)-কে বলেছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে জেনে এসো যে, খেলাফত আহলে বায়েতের ভেতর থেকে হবে কি না। যদি হয় তাহলে ঠিক আছে। আর যদি না হয় তবে আমরা বিষয়টি জেনে নিলাম। কিন্তু আলী (রা.) বিচক্ষণতা বশত এমন জিজ্ঞাসা থেকে বিরত থেকেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) না করে দেন, তবে উম্মত আর কখনো আমাদের হাতে একত্র হবেনা। আলী (রা.) উম্মতের নেতৃত্বের বিষয়টি আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা উম্মতে মুহাম্মাদিকে ভ্রান্ততার উপর একমত করবেন না।

একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, আলী (রা.) প্রাথমিক পর্যায়ে আবু বকর (রা.)-এর হাতে বাই'আত দেননি। কারণ তিনি কিছুটা অভিমান করেছিলেন। এজন্য যে, খেলাফতের ব্যাপারটি তাঁর অংশগ্রহণ বা পরামর্শ ব্যতিরেকেই সমাধা হয়ে গিয়েছিল। যদি এমনটি হয়ে থাকে, তবে এর ব্যাখ্যা হল- রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সাকীফা বনু সাঈদার ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। ওদিকে আলী (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারের সদস্য। সুতরাং তখন তাঁর মনের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্য আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.) তৎক্ষণাৎ আলী (রা.)-কে এ বিষয়টিতে জড়িত করতে চাননি। তাছাড়া সাকীফা বনু সাঈদার বাই'আতটি ছিল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার একটি সদুপায় মাত্র। মূল বাই'আত মসজিদে নববীতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে আলী (রা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর হাত ধরে বলেছিলেন-

لا تثريب يا خليفة رسول الله

অর্থঃ হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা! আমার পক্ষ থেকে আপনার ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই।

অতপর তিনি বাই'আত দিয়েছিলেন। শুধু এই নয়। জ্ঞানের সিন্ধু আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার হাতেই বাই'আত দিয়েছিলেন এবং তাঁদের খেলাফতকালে বিচারক ও শুরা সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আলী (রা.)-এর এ অবস্থানকে ঢেকে রাখতে শিয়ারা "তাকিয়্যা" নামক একটি উদ্ভট আকীদার গোড়াপত্তন করেছেন। তাকিয়্যা হচ্ছে, আলী (রা.) ভেতরে ভেতরে তিন খলিফার বিরোধী ছিলেন এবং বাইরে নিজেকে তাঁদের সমর্থক হিসেবে দেখিয়েছেন! ঈমান কিংবা বিবেক, একটিও কি এমন উদ্ভট ধারণায় সায় দেয়?

আলী (রা.)-এর উপর তাকিয়্যা মতবাদটি আরোপ করা কতো বড় অবিচার, তা সহজেই বুঝা যায় মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুল-কিসসায় অভিযানের সময়কার একটি ঘটনা থেকে। ইমাম দারেকুত্বনী তাঁর সুনানে ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের সূত্রে বর্ণনা করেছেন-

عن ابن عمر قال : لما برز أبو بكر إلى ذي القصة واستوى على راحلته، أخذ علي بن أبي طالب بزمامها وقال : إلى أين يا خليفة رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ أقول لك ما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم أحد : شم سيفك ولا تفجعنا بنفسك، وارجع إلى المدينة، فوالله لئن فجعنا بك لا يكون للإسلام نظام أبدا فرجع

অর্থঃ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন খলিফা আবু বকর (রা.) যুল-কিসসায় গমন করার উদ্দেশ্যে বাহনে চড়লেন, তখন আলী (রা.) বাহনের লাগাম ধরে বললেন, হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমি আপনাকে সে কথাই বলব যে কথাটি রাসুলুল্লাহ (সা.) উহুদ যুদ্ধের দিন বলেছিলেন। সেটি হল- আপনাকে কেন তরবারি হাতে নিতে হবে? আপনার মৃত্যুর দ্বারা আপনি আমাদেরকে দুশ্চিন্তা ও বিপদের মধ্যে ফেলবেন না। আপনি মদীনায় ফিরে আসুন। আল্লাহর কসম, যদি আমরা আপনাকে হারিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে যাই, তবে পৃথিবীতে আর কখনো ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তখন আবু বকর (রা.) মদীনায় ফিরে আসলেন।

পরিশিষ্ট : উহুদ যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। ময়দানে নামতে দেননি। বলেছিলেন, আবু বকর! তোমার বিয়োগ আমরা মেনে নিতে পারবনা।

যদি আলী (রা.) আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতের বিরোধী হতেন এবং তাকিয়্যা করতেন, তবে তিনি কেন আবু বকর (রা.)-এর জীবন রক্ষায় এতো তৎপরতা দেখাতে যাবেন? কিংবা আলী (রা.) যদি পূর্ববর্তী খলিফাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকতেন, তবে তিনি তাঁর নিজের খেলাফতকালে সবকিছু খোলাসা করে দিতে পারতেন। তাহলেই তো আমরা প্রকৃত বিষয়টি জানতে পারতাম। ক্ষমতা যখন তাঁর হাতে ছিল, তখন তো আর তাকিয়্যা করার প্রয়োজন ছিলনা।

আমরা দৃঢ়চিত্তে দাবী করি, অন্তত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে আহলে বায়েতের উপর কোনরূপ অসদাচরণ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর জীবনদর্শন ছিল এরূপ, ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, আবু বকর (রা.) বলতেন-

ارقبوا محمدا صلى الله عليه وسلم في أهل بيته

অর্থঃ মুহাম্মদ (সা.)-এর ভালবাসা অর্জন করো তাঁর আহলে বায়েতের মাধ্যমে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৫০৯)

সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খলিফা হওয়ার পর প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি। মানবজাতির রাজনীতির ইতিহাসে এমন সাহসী স্বাগত বক্তৃতা আর ক'জন দিয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। ইমাম দারেকুত্বনী প্রখ্যাত তাবেয়ী উরওয়া ইবনে যুবায়েরের সূত্রে বক্তৃতাটি গ্রন্থিত করেছেন। বক্তৃতাটি ছিল এরূপ-

أيها الناس، فإني قد وليت عليكم ولست بخيركم، فإن أحسنت فأعينوني وإن أسأت فقوموني، الصدق أمانة والكذب خيانة، والضعيف منكم قوي عندي حتى أزيح علته إن شاء الله، والقوي فيكم ضعيف حتى آخذ الحق إن شاء الله، لا يدع قوم الجهاد في سبيل الله إلا ضربهم الله بالذل، ولا يشيع قوم قط الفاحشة إلا عمهم الله بالبلاء، أطيعوني ما أطعت الله ورسوله، فإذا عصيت الله ورسوله فلا طاعة لي عليكم، قوموا إلى صلاتكم يرحمكم الله

অর্থঃ হে লোকসকল! আমি আপনাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি। তবে আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। আমি যদি ভাল কাজ করি তবে আপনারা আমার অনুসরণ করবেন। আর যদি খারাপ কাজ করি তবে আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন। নিশ্চয়ই সততা হচ্ছে আমানত এবং মিথ্যা হচ্ছে খেয়ানত। আপনাদের মধ্যকার দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার অধিকার আদায় করে দিতে পারি, ইনশাআল্লাহ। প্রক্ষান্তরে, আপনাদের মধ্যকার শক্তিশালী ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে হকদারের অধিকার ফিরিয়ে আনতে পারি, ইনশাআল্লাহ। যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্চিত-অপমানিত করেন। যে জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বৃদ্ধি পায়, সে জাতির উপর আল্লাহ ব্যাপকভাবে বালা-মুসিবত নাযিল করেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করি, ততক্ষণ আপনারা আমার আনুগত্য করবেন। যদি আমি আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্য হই, তবে আপনারা আমার আনুগত্য করতে বাধ্য নন। এবার আপনারা নামাজের জন্য উঠে পড়ুন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।

(সীরাতুন নববীয়্যাহ : আল্লামা ইবনে হিশাম, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত)

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সারাটি জীবন দারিদ্রের মধ্যেই কাটিয়েছেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর দৃশ্যত স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ছিল মদীনার কিছু জমি, যা বনু নযীর থেকে লব্ধ হয়েছিল। এগুলোকে সাদাকাতুল মদীনা বলা হতো। আর ছিল খায়বারের জমি, যা তিনি গনিমতের অংশ হিসেবে পেয়েছিলেন। এছাড়া খায়বার থেকে প্রাপ্ত একটি বাগান ছিল, যার নাম ফাদাক। ফাদাক গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি ছিলনা। এটি ছিল ফাঈ। ইসলামি শরী'আতের পরিভাষায়, যুদ্ধ ব্যতীত লব্ধ সম্পত্তিকে ফাঈ বলা হয়। ফাঈ সাধারণত শত্রুর ফেলে যাওয়া জমি, কিংবা সন্ধিসূত্রে প্রাপ্ত জমি হয়ে থাকে।

ইসলামে গনিমত ও ফাঈ-য়ের বন্টন ও ব্যবহারিক বিধান ভিন্নতর। গনিমতের এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এবং আহলে বায়েতসহ গরিব, মিসকিনের জন্য নির্দিষ্ট। বাকি চার অংশ যোদ্ধাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়। প্রক্ষান্তরে ফাঈ কারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়না। ফাঈ-য়ের একাংশও আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের জন্য নির্দিষ্ট। তবে সম্পত্তি থাকবে রাষ্ট্রের অধীনে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় উপরোক্ত তিনটি জমি তাঁর হাতে ছিল। তিনি ফাঈ তথা ফাদাকের জমি থেকে তাঁর পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ দিতেন এবং বাকি অংশ রাষ্ট্রের কল্যাণে ব্যয় করতেন।

প্রসঙ্গতঃ আল্লাহর অংশ বলতে আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট অংশকে বুঝায়, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অধীনে থাকত।

আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায় আরেকটি বিতর্ক সদা উজ্জীবিত করে রাখেন। বিতর্কের মূলসূত্র হল একটি ঘটনা, যা আমরা ব্যাখ্যা করে প্রকৃত বিষয়টি জানার চেষ্টা করব। ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী বর্ণনা করেছেন প্রখ্যাত তাবেয়ী উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে। আয়েশা (রা.) বলেছেন-

أن فاطمة والعباس عليهما السلام أتيا أبا بكر يلتمسان ميراثهما من رسول الله صلى الله عليه وسلم وهما حينئذ يطلبان أرضيهما من فدك وسهمهما من خيبر فقال لهما أبو بكر سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول لا نورث ما تركنا صدقة إنما يأكل آل محمد من هذا المال قال أبو بكر والله لا أدع أمرا رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يصنعه فيه إلا صنعته قال فهجرته فاطمة فلم تكلمه حتى ماتت

অর্থঃ একবার ফাতিমা (রা.) এবং আব্বাস (রা.) তাঁদের উত্তরাধিকার চাইতে আবু বকর (রা.)-এর কাছে আসলেন। তাঁরা ফাদাকের জমি ও খায়বারের উত্তরাধিকার দাবী করলেন। আবু বকর (রা.) তাঁদেরকে বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন- "আমাদের (নবীদের) সম্পদের উত্তরাধিকার হয়না। আমরা যা ছেড়ে যাই তা সাদাকাহ।" এ সম্পদ থেকে মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারবর্গ ভোগ করবেন। এরপর আবু বকর (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে যেভাবে করতে দেখেছি সেভাবেই করব, কোন ব্যতিক্রম করবনা। বর্ণনাকারী বলেন, অতপর ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-কে ত্যাগ করলেন এবং মৃত্যু অবধি তাঁর সাথে কথা বলেননি।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ফারাইদ্ব, ৬৩৪৬)

অপর একটি সূত্রে, ইমাম যুহরী বর্ণনা করেছেন তাবেয়ী উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে। আয়েশা (রা.) বলেছেন-

أن فاطمة عليها السلام ابنة رسول الله صلى الله عليه وسلم سألت أبا بكر الصديق بعد وفاة رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يقسم لها ميراثها مما ترك رسول الله صلى الله عليه وسلم مما أفاء الله عليه فقال لها أبو بكر إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لا نورث ما تركنا صدقة فغضبت فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم فهجرت أبا بكر فلم تزل مهاجرته حتى توفيت وعاشت بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم ستة أشهر

অর্থঃ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর কন্যা ফাতিমা (আ.) আবু বকর (রা.)-এর কাছে উত্তরাধিকার বন্টনের দাবী করেন, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ফাঈ স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে পেছনে রেখে গেছেন। তখন আবু বকর (রা.) তাঁকে জানান যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- "আমাদের (নবীদের) সম্পদের উত্তরাধিকার হয়না। আমরা যা ছেড়ে যাই তা সাদাকাহ।" এতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর উপর অসন্তুষ্ট হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে কথা বলা ছেড়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ফাতিমা (রা.) ছয়মাস জীবিত ছিলেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফারদ্বিল খুমুস, ২৯২৬)

এ ঘটনাটি শিয়া আলিমগণ প্রায়ই উদ্বৃত্ব করেন এবং বলেন, আবু বকর (রা.) ফাতিমা (রা.)-কে অসন্তুষ্ট করেছিলেন। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করলে আমরা দেখতে পাই-

১. আবু বকর (রা.) নিজে থেকে কোন সিদ্ধান্ত দেননি। তিনি তাই বলেছিলেন, যা আল্লাহর নবী (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল আল্লাহর নবী (সা.)-এর হুকুম-আহকাম অক্ষরে অক্ষরে পালন করা।

২. ফাদাকের উত্তরাধিকার এমনিতেও সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে দেয়া যেতনা। ফাঈ-য়ের কোন ব্যক্তি মালিকানা হয়না। ইসলামি শরী'আহ অনুযায়ী, ফাঈ খলিফার অধীনে থাকে। এর থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে প্রথমত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারের ভরণপোষণ দেয়া হয়। এরপর বাকি অংশ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় হয়। তবে খায়বার ফাঈ ছিলনা; বরং গনিমত ছিল। গনিমতের এক পঞ্চমাংশ রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বায়েতের মালিকানাধীন হয়। সুতরাং রাসুল (সা.)-এর "নবীদের সম্পদের উত্তরাধিকার হয়না"- শীর্ষক হাদিস না থাকলে খায়বারের জমিতে ফাতিমা (রা.)-এর নিশ্চিত উত্তরাধিকার থাকত।

৩. খুব সম্ভব ফাতিমা (রা.) "নবীদের সম্পদের উত্তরাধিকার হয়না"- শীর্ষক হাদিসটি জানতেন না, তাই তিনি উত্তরাধিকার দাবী করেছিলেন। না জানাটা খুবই স্বাভাবিক। এরকম শতশত হাদিস রয়েছে যা শতশত সাহাবির জানা ছিলনা। হয়তো রাসুলুল্লাহ (সা.) কোন স্থানে একটি কথা বলেছেন, যেখানে কোন একজন সাহাবি অনুপস্থিত ছিলেন। কখনো প্রয়োজন পড়েনি বিধায় উক্ত হাদিসটি ঐ অনুপস্থিত সাহাবির শোনাও হয়নি। হাদিসের জগতে যাদের সামান্যতম জানাশোনা আছে তাঁরা বুঝতে পারবেন যে, এরকম হওয়া কতোটা স্বাভাবিক।

৪. ফাতিমা (রা.) খলিফার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বা কথাবলা ছেড়ে দিয়েছিলেন- এই অংশটিকে অনেক হাদিস বিশারদ মূল হাদিসের অংশ বলে মনে করেননা। তাঁদের মতে, ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী ঐ অংশটুকু যোগ করেছেন। কারণ, আমাদের উল্লেখিত প্রথম বর্ণনাটির শেষ অংশে উল্লেখ আছে-

قال فهجرته فاطمة فلم تكلمه حتى ماتت

অর্থঃ বর্ণনাকারী বলেন, অতপর ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-কে ত্যাগ করলেন এবং মৃত্যু অবধি তাঁর সাথে কথা বলেননি।

আরবি ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী قال (তিনি বললেন) শব্দটি পুরুষবাচক। এ শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে قالت (তিনি বললেন)। যদি কথাটি আয়েশা (রা.)-এর নিজের কথা হতো, তবে শব্দটি قالت তথা স্ত্রীবাচক হতো। এখানে قال দ্বারা কোন পুরুষ বর্ণনাকারীর দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আর, ইবনে শিহাব যুহরীর নামটি এজন্য আসে, কারণ হাদিস জগতে তিনি ادراج (ইদরাজ)-এর জন্য পরিচিত। ইদরাজ হচ্ছে, হাদিসের মূল কথার সাথে বর্ণনাকারীর নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রক্ষেপ করে দেয়া। হাদিস জগতে এটি দূষণীয়। অনেক উঁচুমানের এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় হাদিস বিশারদ হওয়া সত্ত্বেও ইমাম যুহরীর মধ্যে ইদরাজের অভ্যাস ছিল। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, তিনি হাদিসকে বিকৃত করার জন্য ইদরাজ করতেন। তিনি কেবল তাঁর শিষ্যদের অনুধাবনের জন্যই নিজের ব্যাখ্যা প্রক্ষেপ করতেন।

৫. যদি ধরে নেই যে, ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর উপর সত্যিই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে তাতেও দুজনের কাউকেই দোষারোপ করা যায়না। ফাতিমা (রা.) এমনিতেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিয়োগব্যথায় কাতর ছিলেন। সম্ভবত তিনি চাইছিলেন, উত্তরাধিকারের মাধ্যমে তাঁর বাবার পার্থিব স্মৃতিটুকু তিনি নিজের কাছে নিয়ে রাখবেন। এজন্য তিনি উত্তরাধিকার চাইতে এসেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আবু বকর (রা.)-এর মুখ থেকে "নবীদের সম্পদের উত্তরাধিকার হয়না"- শীর্ষক হাদিসটি শুনলেন, স্বভাবতই তাঁর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। হাদিসটি জানা না থাকায় তিনি খলিফার কাছে রাসুল (সা.)-এর উত্তরাধিকার চাইতে এসেছেন- এটি ভেবে হয়তো তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত এবং অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। আবার, প্রিয় বাবার স্মৃতিটুকু তাঁর হাতে আসলনা- এটি ভেবে হয়তো খানিকটা অভিমানী হয়ে পড়েছিলেন। এগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এসব অনুভূতি সাধারণ মানবিক অনুভূতি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, নবী-রাসুলদেরও মধ্যেও এসব অনুভূতি জাগ্রত হয়। মুসা (আ.) তাঁর ভাই হারূন (আ.)-এর হাতে বনি ইসরাইলের দায়িত্ব অর্পণ করে তুর পর্বতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন, বনি ইসরাইল শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তখন তিনি হারূন (আ.)-এর উপর অত্যন্ত রাগ করেছিলেন এবং তাঁকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। যদিও মুসা (আ.) ও হারূন (আ.) উভয়েই নবী ছিলেন। আবার নবী নূহ (আ.) যখন তাঁর অবিশ্বাসী পুত্রের জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করেছিলেন এবং এজন্য আল্লাহ তাঁকে তিরস্কার করেছিলেন, তখন নূহ (আ.) অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ভীতি, প্রীতি, বিরক্তি, অসন্তুষ্টি, অনুতপ্ততা, ভাললাগা- এসব মানবসত্ত্বার স্বাভাবিক অনুভূতি। কোন কোন পরিস্থিতিতে এসব অনুভূতির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

৬. ফাতিমা (রা.) ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত খলিফার সাথে কথা বলেননি- এ কথাটির মধ্যেও বড় একটি ফাঁক রয়েছে। ফাঁকটি হল- আবু বকর (রা.) তো ফাতিমা (রা.)-এর মুহরিম ছিলেন না। একজন পর্দানশীন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারী হিসেবে সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) বিনা প্রয়োজনে খলিফার মুখামুখি হতে যাবেন কেন? তাছাড়া সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) কখনো কোন রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন না যে, তিনি খলিফার সাথে নিয়মিত কথা বলবেন। সবচেয়ে বড় কথা, হাদিসের ভাষ্যে আমরা পেয়েছি যে, আবু বকর (রা.) খলিফা হওয়ার ছয়মাসের মাথায় সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেছিলেন। মাত্র ছয়মাসের মধ্যে কতোবার খলিফার সাথে ফাতিমা (রা.)-এর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল? বরং দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই তো ছিল অনেকগুণ বেশি।

৭. কিছু বর্ণনায় "ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত খলিফার সাথে কথা বলেননি"- কথাটি এভাবে বর্ণিত আছে-

فلم تكلمه في ذلك المال

অর্থঃ ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর সাথে এই সম্পত্তির বিষয়ে আর কোন কথা বলেননি।

শিয়াদের মধ্যকার একটি দল, যারা রাফেজি মতাদর্শী, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবু বকর (রা.)-এর উপর হীন অপবাদ আরোপ করতে উদ্যত হন। তাঁরা এ পর্যন্ত বলেন যে, যেভাবে আবু বকর (রা.) আলী (রা.)-কে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, সেভাবে তিনি সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন। আল্লাহ তাঁদেরকে হেদায়াত দান করুন। তাঁদের কথাটি বড় অবিচারপূর্ণ। আমরা বলি-

১. ফাদাক বা খায়বারের অংশবিশেষ এমন কোন লক্ষ-কোটি টাকার সম্পত্তি ছিলনা যে, আবু বকর (রা.) হিংসা বা লোভের বর্শবর্তী হয়ে সায়্যিদা ফাতিমা (রা.)-কে তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবেন। ফাদাক ছিল ছোটখাটো একটি বাগান, যেখানে সামান্য ক'টি খেজুর গাছ রোপিত ছিল।

২. আবু বকর (রা.) এবং তৎপরবর্তী খলিফাদের কেউই ফাদাককে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে নেননি। যেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাদাক থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে প্রথমে আহলে বায়েতের ভরণপোষণ দিতেন এবং বেঁচে যাওয়া অংশ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করতেন, খোলাফায়ে রাশিদীনের চার খলিফা এভাবেই ফাদাককে ব্যবহার করেছিলেন।

৩. যখন আলী (রা.) খলিফা নিযুক্ত হন, তখন তিনি ফাদাককে একইভাবে ব্যবহার করেছিলেন যেভাবে তাঁর পূর্ববর্তীরা করে গেছেন। যদি ফাদাক বা খায়বারের অংশবিশেষের উপর আহলে বায়েতের মালিকানা থাকত; তবে অন্তত আহলে বায়েতের সদস্য হিসেবে আলী (রা.) এসব জমিকে আহলে বায়েতের মালিকানাধীন করে দিতেন। তিনি কেন দেননি?

৪. খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে আলী (রা.) এবং আব্বাস (রা.) এসব জমির দায়িত্বশীল ছিলেন এবং খলিফার পক্ষ থেকে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। যদি আহলে বায়েতকে বঞ্চিত করাই উদ্দেশ্য হতো, তবে উমর (রা.) আহলে বায়েতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যকে কেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রেখে যাওয়া জমির দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেছিলেন?

৫. খোলাফায়ে রাশিদীন ফকির-দরবেশের বেশে জীবনযাপন করতেন, অথচ সাহাবিদেরকে বাইতুল মাল থেকে তাঁদের স্তর অনুযায়ী ভাতা দেয়া হতো। আহলে বায়েতের সদস্যবৃন্দ ৪০-৬০ হাজার দিরহাম পর্যন্ত বাৎসরিক ভাতা পেতেন। খলিফারা যদি এতো বড় অংকের ভাতা আহলে বায়েতকে দিতে পারেন, তাহলে মাত্র কয়েক হাজার দিরহাম মূল্যের ফাদাককে নিয়ে এতো জটিলতা করার কী দরকার ছিল? মূলত, খলিফারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর হুকুমই পালন করেছিলেন।

তার পরও যদি কারো সন্দেহ থেকে থাকে যে, আবু বকর (রা.)-এর উপর অসন্তুষ্ট থাকাবস্থায় সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, তবে একটি ঘটনার দ্বারাই তাঁদের সন্দেহ অপনোদন হয়ে যাবে। ইমাম বায়হাকী ইমাম শা'বি থেকে বর্ণনা করেছেন-

لما مرضت فاطمة رضي الله عنها أتاها أبو بكر الصديق رضي الله عنه فاستأذن عليها فقال علي رضي الله عنه يا فاطمة هذا أبو بكر يستأذن عليك فقالت أتحب أن آذن له، قال نعم، فأذنت له فدخل عليها يترضاها، وقال والله ما تركت الدار والمال والأهل والعشيرة إلا ابتغاء مرضاة الله ومرضاة رسوله ومرضاتكم أهل البيت ثم ترضاها حتى رضيت

অর্থঃ যখন ফাতিমা (রা.) অসুস্থ ছিলেন তখন আবু বকর (রা.) তাঁকে দেখতে তাঁর ঘরে গেলেন। তখন আলী (রা.) বললেন, ফাতিমা! আবু বকর এসেছেন। তিনি তোমার কাছে অনুমতি প্রার্থণা করছেন। ফাতিমা (রা.) স্বামী আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চাচ্ছেন আমি তাঁকে অনুমতি দেই? আলী (রা.) বললেন, হ্যাঁ। অতপর খলিফাকে গৃহপ্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করলেন এবং (উত্তরাধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করে) ফাতিমা (রা.)-কে খুশি করার চেষ্টা করলেন। একপর্যায়ে আবু বকর (রা.) বললেন- "আল্লাহর কসম! আমি আমার ঘর-বাড়ি, সম্পদ, পরিবার সবকিছু ত্যাগ করে এসেছি কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টির জন্য। এবং হে আহলে বায়েত, আপনাদের সন্তুষ্টির জন্য।" সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) খলিফার উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।

(সুনানে কুবরা : ইমাম বায়হাকি, ১১৭৯৮)

বস্তুত উত্তরাধিকার নিয়ে এক মুহূর্তের জন্য ফাতিমা (রা.)-এর মনে হয়তো সামান্য অভিমান তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়তম কন্যা এতো দুনিয়াদার ছিলেন না যে, একটুকরো জমির দাবী নিয়ে তিনি বসে থাকবেন। মূলত ফাদাকের মালিকানার দাবী আহলে বায়েত সেদিনই ত্যাগ করেছিলেন, যেদিন তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসটি শুনেছিলেন। কিন্তু শিয়ারা খলিফা আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-কে গালাগালি করার জন্য বিষয়টি এখনো জিইয়ে রেখেছেন। আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী "সীরাতুল মুস্তাফা" গ্রন্থে বলেছেন- শতশত বছর ধরে লাখো লাখো শিয়া যে ভূমিতে বসবাস করছেন, সেই ইরান খলিফা উমর (রা.)-ই বিজয় করে দিয়েছিলেন। তবুও কি তাঁদের ফাদাকের দাবী শেষ হয়না?

ইসলামের প্রথম খলিফা ছিলেন একেবারে শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহনকারী ব্যক্তি। সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফর শেষ করে এসে যেদিন শুনলেন আব্দুল মুত্তালিবের নাতী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছেন, সেদিনই তাঁর হাতে হাত রেখে দ্বীন কবুল করে ফেললেন। এরপর দীর্ঘ তেইশটি বছর সুখে-দুঃখে, বিজয়ে-পরীক্ষায়, গৃহের আভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডল থেকে নিয়ে জিহাদের কঠিন ময়দানে- যেখানেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.), সেখানেই বাহু আঁকড়ে ধরে ছিলেন আবু বকর ইবনে আবু কুহাফা (রা.)। আবু বকর (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াতের অনুগামী, নিপিড়ন সহ্য করার ভাগিদার, হিজরতের সঙ্গী, পরামর্শের আস্থাভাজন, যুদ্ধের সাথী, বিজয়ের সাক্ষী, নববী আদর্শ বাস্তবায়নের নিবেদিতপ্রাণ সহচর। আবু বকর (রা.)-এর উপর উম্মতে মুহাম্মাদির কতোটুকু ইহসান আছে জানিনা; তবে আবু বকর (রা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা উম্মতে মুহাম্মাদির উপর বড় ইহসান করেছেন- একথা শপথ করে বলতে পারি। আবু বকর (রা.)-এর মর্যাদা ও গুণাগুণ বর্ণনা করা কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আবু বকর (রা.)-এর পরিচয় পাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মোবারক বাণী থেকে, যার জন্য আবু বকর (রা.)-এর প্রতিটি নিঃশ্বাস সদা উপস্থিত ছিল। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

خطب رسول الله صلى الله عليه وسلم الناس وقال إن الله خير عبدا بين الدنيا وبين ما عنده فاختار ذلك العبد ما عند الله قال فبكى أبو بكر فعجبنا لبكائه أن يخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم عن عبد خير فكان رسول الله صلى الله عليه وسلم هو المخير وكان أبو بكر أعلمنا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن من أمن الناس علي في صحبته وماله أبا بكر ولو كنت متخذا خليلا غير ربي لاتخذت أبا بكر ولكن أخوة الإسلام ومودته لا يبقين في المسجد باب إلا سد إلا باب أبي بكر

অর্থঃ রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা সাহাবিদের সামনে খুতবা দানকালে বললেন, আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে পার্থিব ভোগবিলাস ও আল্লাহর নিকট রক্ষিত নিয়ামতরাজির মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহর ঐ বান্দা আল্লাহর নিকট রক্ষিত নিয়ামতরাজি বেছে নিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে আবু বকর (রা.) কেঁদে উঠলেন। আমরা তাঁর কান্না দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বান্দার সংবাদ দিচ্ছেন, যাকে এভাবে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। (তাতে কাঁদার কী আছে?)। পরে বুঝতে পারলাম যে, ঐ বান্দা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.)-ই ছিলেন। আবু বকর (রা.) ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ এবং সঙ্গ দিয়ে আমার উপর সবচেয়ে বেশি ইহসান করেছেন, তিনি হলেন আবু বকর। যদি আমি আমার প্রতিপালক ব্যতীত অন্য কাউকে আন্তরিক বন্ধুরূপে গ্রহন করতাম, তাহলে আবু বকরকেই করতাম। তবে তার সাথে আমার দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব এবং আন্তরিক ভালবাসা রয়েছে। মসজিদের দিকে আবু বকরের দরজা ব্যতীত অন্য কারো দরজা খুলা রাখা যাবেনা।

(সহীহ বুখারী, কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৫৪)

পরিশিষ্ট ১ : রাসুল (সা.)-এর কথার দ্বারা আবু বকর (রা.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, আল্লাহর নবী (সা.) পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। এজন্য তিনি কাঁদছিলেন।

পরিশিষ্ট ২ : তৎকালীন সময় সাহাবিরা মসজিদে নববীর আশেপাশে বসবাস করতেন এবং নিজ নিজ ঘরের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। উক্ত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কেবল আবু বকর (রা.)-এর ঘরের দিকে ফেরানো দরজা ব্যতীত অন্য সবার ব্যক্তিগত দরজা বন্ধ করা আদেশ দেন। তখন থেকে সবাই মসজিদের সার্বজনীন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর উম্মত নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাতে টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। আবু বকর (রা.) শক্তহাতে যাকাত অস্বীকারকারী, ইসলাম ত্যাগী মুরতাদ গোষ্ঠী ও নবুয়্যাতের মিথ্যা দাবীদার ভণ্ডদের ষড়যন্ত্র ধুলোয় মিশিয়ে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর খেলাফতকালে প্রথমবার পবিত্র কুরআন সংকলিত হয়েছিল, যদিও তা সুবিন্যস্ত ছিলনা। মাত্র ২ বছর চার মাসের শাসনামলে আল্লাহ আবু বকর (রা.)-এর হাতে উম্মতে মুহাম্মাদির প্রভূত কল্যাণ সাধন করেছিলেন।

১৩ হিজরির জুমাদুল উখরা মাসে খলিফা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি প্রবীণ সাহাবিদেরকে ডেকে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) সম্পর্কে পরামর্শ গ্রহন করলেন। এরপর বিশ্বস্ত সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে মানুষের নিকট থেকে উমর (রা.)-এর ব্যাপারে মতামত গ্রহন করার দায়িত্ব দিলেন। জনমত অনুকূলে থাকলেও স্বয়ং উমর (রা.) দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু উম্মতের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে আবু বকর (রা.) জোর করেই উমর (রা.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করলেন এবং নিজে তাঁর হাতে বাই'আত জ্ঞাপন করলেন। শিয়ারা এখানে তেমন কিছু ঢুকানোর সুযোগ পাননি। কারণ আলী (রা.) স্বেচ্ছায় উমর (রা.)-এর হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন।

ইন্তেকালের পূর্বে আবু বকর (রা.) তাঁর সম্পদ হিসেব করে দেখলেন, খলিফা থাকাকালীন তাঁর সম্পদে একজন চাকর এবং একটি উট যুক্ত হয়েছে, যা খলিফা হওয়ার পূর্বে ছিলনা। তিনি খলিফা উমর (রা.)-এর কাছে ঐগুলো পাঠিয়ে দিয়ে বললেন- এগুলো খলিফার সম্পদ। সুতরাং এখন থেকে আপনি এগুলোর মালিক। উমর (রা.) সশব্দে কেঁদে উঠে বললেন- হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা! আপনি পরবর্তীদের জন্য খেলাফতের দায়িত্বকে কঠিন করে তুললেন। আমরা কোনভাবেই আপনার কাছাকাছি যেতে পারবনা।

২২ জুমাদুল উখরা, ১৩ হিজরি, সোমবার। উম্মতে মুহাম্মাদিকে পরম মমতার ঋণে জড়িয়ে, ৬৩ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা, সিদ্দিকে আকবার সায়্যিদুনা আবু বকর আব্দুল্লাহ ইবনে আবু কুহাফা রাদ্বিআল্লাহু আনহু। ইন্তেকালের মুহূর্তে তাঁর মুখ থেকে বারবার একটি বাক্যই উচ্চারিত হচ্ছিল-

توفني مسلما والحقني بالصلحين

অর্থঃ আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং পূণ্যবানদের সাথে মিলিত করো।

(সুরা ইউসুফ : ১০১)

কন্যা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর ঘরে, রাসুলুল্লাহ (সা.) কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছিল আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে। পৃথিবীতে যারা বন্ধু ছিলেন, কবরদেশেও তাঁরা বন্ধু হয়ে রইলেন। ইনশাআল্লাহ, হাশরের ময়দানেও তাঁরা বন্ধু হয়ে থাকবেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত)

একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, আবু বকর (রা.) কেন উমর (রা.)-কেই খলিফা মনোনিত করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন? আমাদের কাছে মনে হয়, আবু বকর (রা.) কিছু হাদিসের বাহ্যিক অর্থের উপরই আমল করেছিলেন, যাতে আবু বকর (রা.)-এর পরে উমর (রা.)-কে মর্যাদা দেয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। সাহাবিদের বর্ণিত হাদিসসমূহে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা নিজেদের মধ্যে মর্যাদার স্তর নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আবু বকর (রা.), এরপর উমর (রা.)-কে গণনা করতেন। তাবেয়ী ইবনে আবি মুলাইকাহ বর্ণনা করেছেন-

سمعت عائشة وسئلت من كان رسول الله صلى الله عليه وسلم مستخلفا لو استخلفه قالت أبو بكر فقيل لها ثم من بعد أبي بكر قالت عمر ثم قيل لها من بعد عمر قالت أبو عبيدة بن الجراح ثم انتهت إلى هذا

অর্থঃ আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকে খলিফা মনোনিত করতেন তাহলে কাকে করতেন? তিনি বললেন, আবু বকর (রা.)-কে। তাঁকে বলা হল, এরপর কাকে করতেন? তিনি বললেন, উমর (রা.)-কে। তাঁকে বলা হল, এরপর কাকে করতেন? তিনি বললেন, আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ (রা.)-কে। এরপর তিনি থেমে গেলেন।

(সহীহ মুসলিম, কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৩৮৫)

তাবেয়ী নাফে' বর্ণনা করেছেন-

عن ابن عمر رضي الله عنهما قال كنا نخير بين الناس في زمن النبي صلى الله عليه وسلم فنخير أبا بكر ثم عمر بن الخطاب ثم عثمان بن عفانرضي الله عنهم

অর্থঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, আমরা নবী (সা.)-এর যুগে সাহাবিদের পারস্পারিক মর্যাদা নির্ণয় করতাম। আমরা সর্বাপেক্ষা মর্যাদা দিতাম আবু বকর (রা.)-কে, অতপর উমর (রা.)-কে, অতপর উসমান (রা.)-কে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৫৫)

আলী (রা.)-এর পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ বর্ণনা করেছেন-

قلت لأبي أي الناس خير بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم قال أبو بكر قلت ثم من قال ثم عمر وخشيت أن يقول عثمان قلت ثم أنت قال ما أنا إلا رجل من المسلمين

অর্থঃ আমি আমার পিতা আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর সবচেয়ে উত্তম মানুষ কে? তিনি বললেন, আবু বকর (রা.)। বললাম, এরপর কে? তিনি বললেন, উমর (রা.)। আমি আশঙ্কা করলাম, এরপর হয়তো তিনি উসমান (রা.)-এর নাম বলবেন। তাই আমি তাঁকে বললাম, এরপর তো আপনিই হবেন। তিনি বললেন, না। আমি তো সাধারণ মুসলমানদের একজন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৬৮)

বিবেকবান ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারবেন যে, উক্ত হাদিসে আলী (রা.)-এর মর্যাদায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। বরং "সাধারণ" কথাটি উচ্চারণ করার মাধ্যমে আলী (রা.) আমাদের চোখে তাঁর সত্ত্বাকে এক অসাধারণ মর্যাদার শিখরে নিয়ে গেছেন। এটিই ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গের বৈশিষ্ট্য। এজন্যই আহলে বায়েত উম্মতে মুহাম্মাদির সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র হয়ে আছেন।

তবে হাদিসসমূহের বাহ্যিক অর্থ থেকে বারবার আবু বকর (রা.)-এর পর উমর (রা.)-এর নামটিই ফুটে উঠেছে। সুতরাং, আমাদের বিশ্বাস, আবু বকর (রা.)-এর পর উমর (রা.)-ই ছিলেন খেলাফতে যোগ্য পাত্র।

আমরা যেহেতু কেবল আন্তঃমুসলিম বিতর্ক নিয়েই আলোচনা করছি, তাই উমর (রা.)-এর খেলাফতকাল থেকে আমাদেরকে রিক্তহস্তেই ফিরে আসতে হবে। কারণ আন্তঃমুসলিম বিতর্ক তো দুরের কথা; উমর (রা.)-এর শাসনব্যবস্থা নিয়ে কেউ টু শব্দটি করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি, আজো পারেনা। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকাল ছিল মুসলিম উম্মাহ'র প্রকৃত স্বর্ণযুগ।

রাগে গজগজ করতে করতে নাঙ্গা তরবারি হাতে তিনি এসেছিলেন আল্লাহর নবী (সা.)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। পবিত্র কুরআনের অমিয় বাণী তাঁর তরবারির মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদপার্শ্বে তরবারি ফেলে দিয়ে কালিমা শাহাদাত পাঠ করেছিলেন উমর। ইসলাম কবুল করেই সাহাবিদের কাফেলা নিয়ে বাইতুল্লাহ শরীফে গিয়ে নামাজ আদায় করে এসেছেন। মক্কাবাসী মুশরিকরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে, কিন্তু টু শব্দটি করার সাহস পায়নি। হিজরতের সময় তিনি দিনদুপুরে সবার সামনে দিয়ে মক্কা ত্যাগ করেছেন। মক্কাবাসী একচুল সামনে এগিয়ে আসেনি। সারাটি জীবন প্রিয়নবী (সা.)-এর দেহরক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিলেন। সত্যকে উচ্চকণ্ঠে সত্য বলেছেন, মিথ্যাকে নির্দিধায় মিথ্যা বলেছেন। অনেক কথা তিনি আগ বাড়িয়ে বলে ফেলেছিলেন। পরে তাঁর কথার সমর্থনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালেও তিনি ছিলেন খলিফার দক্ষিণবাহু। নানামুখী প্রতিকূলতা থেকে খলিফাকে সুরক্ষিত রাখাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। তরবারি তাঁর কোষবদ্ধ হয়নি কখনো। যেদিন নিজে খেলাফতের মসনদে আসীন হলেন, সেদিন হাত থেকে তরবারি ফেলে বেতের ছড়ি উঠিয়ে নিয়েছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে তরবারি তিনি মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, পুরো খেলাফতকালে আল্লাহ তাঁর হাতে পুনরায় সে তরবারি উঠাননি। সাড়ে ১০ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে তাঁকে কখনো সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়নি।

মসজিদে নববীতে খেজুরের চাটাইয়ের উপর বসে তর্জনী উঁচিয়ে ধরেছিলেন উমর (রা.)। চোখের পলকে অর্ধ পৃথিবী ইসলামের পতাকাতলে সমাবেত হয়ে গিয়েছিল। এমনি ছিলেন তিনি, খাত্তাবের বীরপুত্র, উমর ফারুক (রা.)। তাঁর ভয়ে দুষ্টুশক্তি সদা প্রকম্পিত থাকত। সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إيها يا ابن الخطاب والذي نفسي بيده ما لقيك الشيطان سالكا فجا قط إلا سلك فجا غير فجك

অর্থঃ হে খাত্তাবের পুত্র! কসম সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ। শয়তান যখন তোমাকে কোন রাস্তায় দেখতে পায়, তখন তোমার ভয়ে সে অন্য রাস্তা ধরে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৮০)

তাঁর শাসনামলে রোমান সম্রাজ্যের তিনভাগের দু'ভাগ এবং সমগ্র পারস্য সম্রাজ্য ইসলামের পতাকাতলে সন্নিবেশিত হয়েছিল। ইসলামের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে বিজয় হয়েছিল। আল্লাহর যমিনে আল্লাহর শরী'আহ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছিল। তাঁর হাত ধরেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মোবারক যাত্রা বৈশ্বিক সফলতার মুখ দেখেছিল। দীর্ঘ ১০ বছর ৬ মাসের খেলাফতকালে তিনি মুসলিম উম্মাহকে বহিঃস্থ এবং অন্তঃস্থ উভয় দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুসংহত সভ্যতার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সত্যিই, কেবল গর্ব করার উপাদান ব্যতীত উমর (রা.)-এর খেলাফত নিয়ে আর কিছুই বলার নেই।

উমর (রা.) ছিলেন সদা আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত এক ব্যক্তি। এজন্য মানুষ তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত থাকত। শক্ত গড়নের লম্বা দেহ ছিল তাঁর। তালি দেয়া জামা ও লুঙ্গী পরিধান করতেন, শক্ত খাবার খেতেন, রাতের বেলা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা দেখতেন, প্রয়োজনে নিজের কাঁধে আটার বস্তা উঠিয়ে নিতেন, গাধার পিঠে চড়তেন, ছড়ি দিয়ে অপরাধীর বিচার করতেন, কথা কম বলতেন। একমাত্র ভৃত্য আসলামকে সাথে নিয়ে জেরুজালেমে চুক্তিসাক্ষর করতে চলে গিয়েছিলেন। অর্ধেক পথ তিনি বাহনের পিঠে চড়েছেন, অর্ধেক পথ ভৃত্যকে বাহনের উপর উঠিয়ে নিজে পায়ে হেটেছেন। ভৃত্য বেচারা উটের পিঠে মরমে মরে যাচ্ছিল। এতো কোমল প্রাণটিও ন্যায়ের সাথে কোনরূপ আপোস করেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে সবচেয়ে শক্ত হলেন উমর।

প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর উপাধি ছিল- "খালিফাতু রাসুলিল্লাহ" বা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফা। এটি কেবল আবু বকর (রা.)-এর জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। উমর (রা.) খলিফা হওয়ার পর প্রথমদিকে তাঁকে "রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খলিফার খলিফা" বলে ডাকা হতো। পরে সাহাবিদের নিকট থেকে তিনি "আমিরুল মু'মিনীন" বা বিশ্বাসীদের নেতা উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর আংটিতে লেখা ছিল-

كفي بالموت واعظا ياعمر

অর্থঃ হে উমর! সতর্ককারী হিসেবে মৃত্যুই যথেষ্ট।

২৩ হিজরির যিলহাজ্জ মাস। ফজরের নামাজরত অবস্থায় মুগীরা ইবনে শো'বা (রা.)-এর অগ্নিপূজক গোলাম আবু লু'লু ফিরোজের হাতে ছুরিকাঘাতে আক্রান্ত হন খলিফা উমর (রা.)। উভয় পার্শ্বে বিষ মাখানো ছুরি দিয়ে ঘাতক ফিরোজ উমর (রা.)-এর বুকে, পিঠে এবং নাভির নিচে গুরুতর যখম করে। খলিফা বেহুশ হয়ে পড়ে যান। ঘাতক ফিরোজ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় এলোপাথাড়ি ছুরি চালিয়ে অন্তত ৭ জনকে হত্যা করে এবং ১৩-১৪ জনকে যখম করে। শেষপর্যন্ত পালিয়ে যেতে না পেরে সে নিজের বুকে ছুরি চালিয়ে আত্মহনন করে।

কোন কোন বর্ণনায় উমর (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডটি পারস্যের পরাজিত সেনাপতি হরমুজানের একটি ষড়যন্ত্র ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু লু'লুর ছুরিকাঘাতের মধ্যে নাভির নিচের আঘাতটি এতোই প্রাণঘাতী ছিল যে, খলিফার উদরের আবরক ঝিল্লি কেটে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। খলিফাকে খেজুরের শরবত এবং দুধ খাওয়ানো হল, তা তাঁর পেটের কাটা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইবনে আব্বাস (রা.) তখন খলিফার পাশে বসে বললেন, আমিরুল মু'মিনীন! আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেননা। আপনি ইসলামের হক আদায় করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং আবু বকর (রা.)-এর সাহচর্যের হকও আদায় করেছেন। উমর (রা.) জবাব দিলেন, ভাতিজা, আমি চিন্তিত কেবল তোমাদের জন্য।

এরপর খলিফা তাঁর পুত্রকে উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর নিকট প্রেরণ করলেন। বললেন, তুমি গিয়ে বলবে উমর ইবনে খাত্তাব রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আবু বকর (রা.)-এর পাশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছাপোষণ করেছেন। খবরদার! আমিরুল মু'মিনীন শব্দটি উচ্চারণ করবেনা।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর ঘরে গিয়ে দেখেন তিনি কাঁদছেন। উমর (রা.)-এর পক্ষ থেকে আরজি পেশ করলে আয়েশা (রা.) তাঁকে অনুমতি প্রদান করলেন।

২৬/২৭ যিলহাজ্জ, ২৩ হিজরি মুসলিম উম্মাহ'র সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসক আমিরুল মু'মিনীন সায়্যিদুনা উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিআল্লাহু আনহু শাহাদাতের সেহরা পরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। উমর (রা.) ছিলেন ইসলামের ঐক্য ও ফিতনার মধ্যবর্তী সীমান্তরেখা। তাঁর শাহাদতের মধ্য দিয়ে বড় বড় ফিতনাসমূহকে আবদ্ধকারী দরজাটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সাগরের ঢেউয়ের মতো নানাবিদ বিশৃঙ্খলা উম্মতের ঐক্যের দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৯৭; তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ২৩ হিজরির ঘটনাবলী; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, উমর (রা.)-এর খেলাফত)

উমর (রা.)-এর দেহ যখন খাটের রাখা হয়, সমস্ত সাহাবি বারেবারে এসে তাঁর জন্য দু'আ করে যাচ্ছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন-

إني لواقف في قوم فدعوا الله لعمر بن الخطاب وقد وضع على سريره إذا رجل من خلفي قد وضع مرفقه على منكبي يقول رحمك الله إن كنت لأرجو أن يجعلك الله مع صاحبيك لأني كثيرا ما كنت أسمع رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول كنت وأبو بكر وعمر وفعلت وأبو بكر وعمر وانطلقت وأبو بكر وعمر فإن كنت لأرجو أن يجعلك الله معهما فالتفت فإذا هو علي بن أبي طالب

অর্থঃ আমিও সে দলের সাথে ছিলাম, যারা উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর জন্য দু'আ করছিলেন। তখন তাঁর লাশটি খাটের উপর রাখা ছিল। এমন সময় এক লোক আমার পেছন থেকে তাঁর হাত আমার কাধের উপর রেখে উমর (রা.)-এর লাশের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আমি আশা করছি আল্লাহ আপনাকে আপনার দুই সঙ্গীর সাথেই রাখবেন। কারণ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অনেকবার বলতে শুনেছি- "আমি, আবু বকর ও উমর একসঙ্গে ছিলাম" "আমি, আবু বকর ও উমর এই কাজ করেছি" "আমি, আবু বকর ও উমর একসঙ্গে চলেছি"। আমি অবশ্যই আশা করি আল্লাহ আপনাকে তাঁদের দুজনের সাথেই রাখবেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৭৪)

ইন্তেকালের চারদিন পর রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং আবু বকর (রা.)-এর কবরের পাশেই উমর (রা.)-কে দাফন করা হল। নবী ও সিদ্দিকের পাশে পাহারাদার হয়ে শায়িত হলেন ফারুক। আজ যদি মানব সভ্যতার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের তালিকা তৈরি করি, নিঃসন্দেহে উমর (রা.) এ তালিকার শীর্ষস্থানে থাকবেন। এমনি ছিলেন তিনি, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, উম্মতে মুহাম্মাদির গর্ব আমিরুল মু'মিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)।

খেলাফত থেকে কারবালা - ৩

(একত্রিত এবং সংযোজিত)

ইন্তেকালের পূর্বে খলিফা উমর (রা.) আশারায়ে মুবাশশারার ছয়জন সাহাবির সমন্বয়ে একটি শুরা কমিটি গঠন করে তাঁদের মধ্য থেকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের নির্দেশ দিলেন।

উল্লেখ্য, العشرة المبشرون بالجنة অর্থ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) একই মজলিসে উপবিষ্ট থাকাকালীন দশজন সাহাবিকে নাম ধরে ধরে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছিলেন। ইসলামি পরিভাষায় এ দশজন সাহাবিকে العشرة المبشرون بالجنة বা আশারায়ে মুবাশশারাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁরা হলেন-

১. আবু বকর সিদ্দিক ইবনে আবি কুহাফা (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু তায়ীম

২. উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু আদী

৩. উসমান ইবনে আফফান (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু উমাইয়া

৪. আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু হাশিম

৫. ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু তায়ীম

৬. যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু আসাদ

৭. আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু যুহরা

৮. আবু উবায়দাহ আমির ইবনে জাররাহ (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু ফিহর

৯. সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু যুহরা

১০. সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.)

বংশঃ কুরাইশ, গোত্রঃ বনু আদী

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৬৮০)

আবু বকর (রা.), উমর (রা.) এবং আবু উবায়দাহ (রা.) ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.) নিজেকে সমস্ত রাষ্ট্রীয় পদ-পদবী থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি উমর (রা.)-এর চাচাতো ভাই ছিলেন বলে উমর (রা.) তাঁকে শুরা কমিটিতে সংযুক্ত করা করেননি। কারণ, উমর (রা.) তাঁর ধবধবে সাদা চরিত্রের উপর সামান্যতম স্বজনপ্রীতির আঁচড়ও বসাতে চাননি। বাকি ছয়জনের সমন্বয়ে শুরা কমিটি গঠিত হল। সহকারী হিসেবে থাকলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), আবু তালহা আনসারী (রা.) এবং মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.)। এছাড়াও উমর (রা.) ১৫ জন আনসার সাহাবিকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিদর্শক নিযুক্ত করে গেলেন।

বিশুদ্ধ সূত্রমতে, শুরা সদস্যবৃন্দ মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.)-এর ঘরে, মতান্তরে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর হুজরায় একত্রিত হলেন। ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) খলিফার ইন্তেকালের সময় মদীনায় উপস্থিত না থাকলেও পরদিন তিনি চলে আসেন। শুরার বৈঠকে যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) সর্বপ্রথম আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। অতপর সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। এরপর ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। সবশেষে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) নিজের নাম প্রত্যাহার করলেন এবং পূর্বেকার মতো এখানেও তিনি নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিলেন। প্রথমে তিনি শুরা সদস্যদেরকে তাঁদের প্রত্যেকের অবস্থান ও মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এরপর তিনি আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, যদি আমার পক্ষে আপনাকে আমির নিযুক্ত করা সম্ভব না হয়, তাহলে আপনি কাকে আমির হিসেবে চাইবেন? আলী (রা.) জবাব দিলেন, উসমানকে। এরপর তিনি উসমান (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, যদি আমার পক্ষে আপনাকে আমির নিযুক্ত করা সম্ভব না হয়, তাহলে আপনি কাকে আমির হিসেবে চাইবেন? উসমান (রা.) জবাব দিলেন, আলীকে। পরিস্থিতি প্রশংসনীয় দেখে নির্বাচন কমিশনার বললেন, এবার আমি জনমত যাচাইয়ে নামব। যদি জনমত যাচাইপূর্বক উম্মতের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে আমি একজনকে খলিফা নিযুক্ত করি, অপরজন কি তাঁকে মেনে নেবেন? উসমান (রা.) ও আলী (রা.) সমস্বরে বললেন, হ্যাঁ। আমরা মেনে নেব।

সর্বজনবিদিত সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) টানা তিনদিন সাহাবি ও তাবেয়ীদের ঘরে ঘরে গিয়ে উসমান (রা.) ও আলী (রা.)-এর ব্যাপারে মতামত গ্রহন করলেন, যেভাবে তিনি বিশ্বস্ততার সাথে উমর (রা.)-এর ব্যাপারে জনমত গ্রহন করেছিলেন। তিনদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চতুর্থ দিন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। তিনি উসমান (রা.) ও আলী (রা.)-কে মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.)-এর ঘরে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা দুজন উপস্থিত হলে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাঁদেরকে নিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন। তখন ছিল ফজরের সময়। মসজিদ লোকে লোকারণ্য। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) মিম্বরে দাঁড়ালেন এবং অনেক্ষণ দু'আ করলেন। এরপর তিনি উসমান (রা.) ও আলী (রা.)-কে কাছে ডাকলেন এবং বললেন, আপনারা কি আল্লাহর কিতাব, রাসুল (রা.)-এর সুন্নাত এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার সুন্নাত অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করার অঙ্গীকার করছেন? উসমান (রা.) হ্যাঁ বললেন। আলী (রা.) বললেন, আমি চেষ্টা করব। তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) উসমান (রা.)-এর হাত ধরে উপরে উত্তলন করলেন। বললেন, আল্লাহ তুমি সাক্ষী থেকো। আমার উপর যে খেলাফতের দায়িত্ব ছিল, আমি শুরা সদস্য ও সহকারীদের রায় এবং জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তা উসমান ইবনে আফফানের হাতে সোপর্দ করলাম।

এরপর লোকজন উসমান (রা.)-এর হাতে বাই'আত দিলেন। সর্বপ্রথম বাই'আত দিলেন আলী (রা.)। পরদিন বিকাল পর্যন্ত চলল বাই'আত গ্রহন। এভাবেই একটি যৌক্তিক, নিরপেক্ষ এবং প্রশংসনীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইসলামের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হলেন আমিরুল মু'মিনীন উসমান ইবনে আফফান (রা.)।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, উসমান (রা.)-এর খেলাফত; তারিখুল খোলাফা : ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী, উসমান (রা.)-এর খেলাফত)

শিয়া সম্প্রদায় উসমান (রা.)-কে ক্ষমতার জবরদখলকারী বলে নিন্দা করেন। কিন্তু পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জবরদখলের চিহ্নমাত্র পাওয়া যায়না।

উসমান ইবনে আফফান (রা.) ছিলেন مرحلة مبكرة তথা প্রারম্ভিক পর্যায়ের ইসলাম গ্রহনকারী সাহাবিদের অন্যতম। ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। খাদিজা (রা.)-এর পর ধন-সম্পদ দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের সর্বোচ্চ সাহায্যকারী ছিলেন উসমান (রা.)। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দ্বিতীয় কন্যা রুকাইয়া (রা.)-কে বিয়ে করেছিলেন। রুকাইয়া (রা.) মারা যাওয়ার পর রাসুল (সা.) তাঁর তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলছুম (রা.)-কে ও তাঁর কাছে বিবাহ দেন। নৈতিকতায় উসমান (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছায়াস্বরূপ, বৈশিষ্ট্যে আবু বকর (রা.)-এর সাদৃশ্য, দক্ষতায় উমর (রা.)-এর নিকটবর্তী। লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর ভূষণ। বিনয়-নম্রতায় তিনি ফেরেশতাদেরকেও হার মানাতেন। দানশীলতায় তিনি নিজেই নিজের উদাহরণ। তিনি বীরে রুমা নামক কূপ ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তাবুক যুদ্ধের সময়কার কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি সৈন্যদের রসদের যোগান দিয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে আবু বকর (রা.)-এর সাথে তাঁর গভির সখ্যতা ছিল। এক কথায় নবী, সিদ্দিক ও ফারুকের সুনিপুণ মিশ্রণ ঘটেছিল দুই নুরের অধিকারী উসমান (রা.)-এর জীবনে। আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন-

أن النبي صلى الله عليه وسلم صعد أحدا وأبو بكر وعمر وعثمان فرجف بهم فقال اثبت أحد فإنما عليك نبي وصديق وشهيدان

একদা নবী (সা.) আবু বকর, উমর ও উসমানকে সাথে নিয়ে উহুদ পাহাড়ে চড়লেন। উহুদ পাহাড় তখন কাঁপতে শুরু করল। নবী (সা.) পা মোবারক দ্বারা উহুদের গায়ে বাড়ি দিয়ে বললেন, শান্ত হও উহুদ! তোমার উপর একজন নবী, একজন সিদ্দিক এবং দুজন শহীদ আরোহণ করেছেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৭২)

উসমান (রা.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় সাড়ে ১২ বছর। তন্মধ্যে প্রথম ৬ বছর হুবহু উমর (রা.)-এর ন্যায় সুদৃঢ় ছিল। ধিরে ধিরে খারেজি মতাদর্শী কুচক্রী মহল উসমান (রা.)-এর নম্র স্বভাব ও সারল্যের সুযোগে তাঁর প্রতি নানাবিদ মিথ্যা-মিশ্রিত অভিযোগ উত্তাপন করে নও-মুসলিমদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলে। খলিফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ এবং খলিফা ও পরবর্তী আহলে সুন্নাতের ইমামদের পক্ষ থেকে এসবের জবাব সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হল-

১. উসমান (রা.) কুরআন শরীফ পুড়িয়ে ফেলেছেন।

জবাবঃ জবাব দেয়ার পূর্বে পবিত্র কুরআন সংকলনের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এতে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রথমবার পবিত্র কুরআন সংকলন করা হয়েছিল। উসমান (রা.) খলিফা হওয়ার পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান অঞ্চলে জিহাদে রত থাকা সাহাবি হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) খলিফার নিকট গভির উদ্বেগজনক একটি বার্তা নিয়ে আসলেন। বার্তাটি ছিল- লোকেরে নিজেদের ইচ্ছেমতো কুরআন পাঠ করতে শুরু করেছে এবং একে অন্যের সাথে কিরাতের ভিন্নতা নিয়ে ঝগড়া করছে। এর কারণ ছিল, আবু বকর (রা.)-এর সময়কার সংকলিত কুরআন সুবিন্যস্ত ছিলনা এবং তাতে লেখার ধরণও একিভুত ছিলনা। যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) "হায়রি খত" নামক লিপিতে কুরআন লিখেছিলেন, যাতে সাত হরফ ও ভিন্ন পাঠ বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া বিবিধ কারণে পাঠের বিকৃতি স্বাভাবিক ছিল। খলিফা উসমান (রা.) বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে পূর্ববর্তী সংকলক যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-কে পুনরায় একটি কমিটি গঠন করে কুরআন সংকলনের নির্দেশ দিলেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন- আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.), সাঈদ ইবনে আস (রা.) এবং আব্দুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশাম (রা.)। এরা সবাই হাফিজে কুরআন ছিলেন। নিজেদের হিফজকে প্রাথমিক উৎস ধরে তাঁরা আবু বকর (রা.)-এর সময়কার মাছহাফকে দ্বিতীয় উৎসরূপে সামনে রাখলেন। এর সাথে প্রতিটি আয়াতের জন্য আরো দুজন সাক্ষীর শর্তারোপ করলেন। অর্থাৎ একেকটি আয়াত সংযোজন করার জন্য কমিটির সদস্য এবং পুরাতন মাছহাফ ছাড়াও আরো দুজন সাহাবিকে সাক্ষ্য দিতে হতো যে, তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখ থেকে উক্ত আয়াত শুনেছেন। এরপর কমিটি সুরাসমূহকে পরপর সাজালেন এবং একটি হরফ ছাড়া বাকি হরফ বাদ দিলেন। অর্থাৎ এমন একটি বিশেষ লিখনি ব্যবহার করলেন, যাতে একই হরফে সাত/দশ কিরাত প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এ বিশেষ লিপির নাম দেয়া হল- রসমে খত। আল্লাহর অপার করুণায় সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর কিতাবের উপর দৃঢ়ভাবে ঐক্যমত পোষণ করলেন এবং এই "মাছহাফে উসমানি" বা উসমান (রা.)-কৃত মাছহাফকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর কালামের একমাত্র লিখিত সংস্করণরূপে গ্রহন করলেন। এরপর বিকৃতি ও মতবিরোধের আশঙ্কায় উসমান (রা.) সংকলক কমিটির বাদ দেয়া অংশ এবং সাহাবিদের নিকট থাকা ব্যক্তিগত-খণ্ডিত অংশগুলো একত্রিত করে আগুনে পুড়িয়ে দিলেন। ইসলামি শরী'আতে কোন কিছুকে অপব্যবহার ও বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া বৈধ। এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইসলামি আইনবিদদের ঐক্যমত রয়েছে। আলী (রা.) বলেছেন-

لأ تقولوا عثمان الأ خيرا فوالله ما فعل الذي فعل في المصاحف الأ عن ملأ منا

অর্থঃ তোমরা উসমান (রা.) সম্বন্ধে ভাল কথা ব্যতীত অন্য কিছু বলোনা। আল্লাহর কসম, তিনি যা করেছেন, আমাদের (সাহাবিদের) সাথে পরামর্শ করেই করেছেন।

(ফাতহুল বারী : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী; উলুমুল কুরআন : মাওলানা তক্বী উসমানী)

২. উসমান (রা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।

জবাবঃ এজন্য অংশগ্রহণ করেননি, কারণ তাঁর স্ত্রী সায়্যিদা রুকাইয়া বিনতে রাসুলিল্লাহ (রা.) অন্তিম শয্যাশায়ী ছিলেন। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (স.) উসমান (রা.)-কে স্ত্রীর পাশে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের থেকে ফিরে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) উসমান (রা.)-কে যুদ্ধলব্ধ গনিমতের একটি অংশ দিয়েছিলেন এবং তাঁকে বদরি সাহাবি বলে ঘোষণা করেছিলেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৯৫)

৩. উসমান (রা.) উহুদ যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।

জবাবঃ হ্যাঁ, উহুদ যুদ্ধের শেষভাগে যখন মুসলমানদের উপর চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন কতিপয় সাহাবি যুদ্ধের ভয়াবহতায় হতবিহ্বল হয়ে কিছুটা পিছপা হয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে-

إن الذين تولوا منكم يوم التقى الجمعان إنما استزلهم الشيطان ببعض ما كسبوا ولقد عفا الله عنهم إن الله غفور حليم

অর্থঃ তোমাদের মধ্যে কিছু লোক দুটি দলের লড়াইয়ের দিন পশ্চাদপসরণ করেছিল। শয়তান তাদের পাপের দরূণ তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল। তবে আল্লাহ তাদের পাপ মোছন করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম সহনশীল।

(আলে ইমরান : ১৫৫)

যখন আল্লাহ তাঁদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, তখন এ ব্যাপারে কথা বলা সরাসরি আল্লাহর হুকুমের বিপক্ষে অবস্থান করার নামান্তর।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৯৫)

৪. উসমান (রা.) বাই'আতে রিদ্বওয়ানে অংশগ্রহণ করেননি।

জবাবঃ এ অভিযোগটি অভিযোগকারীদের মূর্খতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বাই'আতে রিদ্বওয়ান সংঘটিতই হয়েছিল উসমান (রা.)-এর জন্য। হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সা.) উসমান (রা.)-কে কুরাইশদের সাথে আলোচনার জন্য মক্কায় প্রেরণ করেছিলেন। কুচক্রী মহল গুজব রটিয়ে দিয়েছিল যে, মক্কাবাসী উসমান (রা.)-কে বন্দী বা হত্যা করেছে। তখন হুদায়বিয়ায় উপস্থিত চৌদ্দশ সাহাবি একটি বৃক্ষের নিচে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে হাত রেখে উসমান-হত্যার প্রতিশোধ গ্রহন করার শপথ করেছিলেন। সুতরাং এ শপথে উসমান (রা.) কিভাবে অংশগ্রহণ করবেন? তিনি তো সেখানে ছিলেন না! তারপরও রাসুলুল্লাহ (স.) নিজের ডান হাতকে "উসমানের হাত" ঘোষণা দিয়ে, ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে উসমান (রা.)-এর পক্ষ থেকে বাই'আত দিয়েছিলেন। কারণ আল্লাহর নবী (সা.) তাঁর প্রিয়পাত্র উসমানকে এ বতকতময় বাই'আত থেকে বঞ্চিত করতে চাননি। উসমান (রা.)-এর জন্য এরচেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে?

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৯৫)

৫. উসমান (রা.) মদীনার কিছু এলাকায় পশুচারণ করতে নিষেধ করেছিলেন।

জবাবঃ খলিফা মদীনার কয়েকটি স্থানে ব্যক্তি মালিকানাধীন গবাদিপশু চরাতে ও পানি পান করাতে নিষেধ করেছিলেন। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বর্তমান মসজিদে গামামাহ এলাকা। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকে জিহাদ ও সাদাকায় ব্যবহৃত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পশু চরানোর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। উসমান (স.)-এর সময় পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এসব অধিগৃহীত ভূমি খলিফা তাঁর নিজের মালিকানাধীন পশুর জন্য গ্রহন করেননি; করেছিলেন রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য। তাছাড়া খলিফা নিজেই বলেছিলেন যে, তাঁর নিজের মাত্র দুটি পশু ছিল। একটি সফরের জন্য, অন্যটি জিহাদের জন্য।

৬. উসমান (রা.) হজের সময় মিনায় কসর করতেন না।

জবাবঃ খলিফা হজের সময় মিনায় যুহরের নামাজ দু'রাকাত কসরের পরিবর্তে পূর্ণ চার রাকাত আদায় করতেন। কারণ, বিবাহ সূত্রে, মতান্তরে জমি ক্রয় সূত্রে তিনি নিজেকে মক্কার মুকিম বা অধিবাসী ভাবতেন। আর মুকিম বা স্থানীয় অধিবাসীদের কসর আদায় করতে হয়না। তাছাড়া নও-মুসলিমদের নামাজ শিক্ষা দেয়ার জন্য কসর করা থেকে বিরত থেকে পূর্ণ চার রাকাত যুহর আদায় করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদ।

৭. উসমান (রা.) আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)-কে প্রহার করেছিলেন।

জবাবঃ উসমান (রা.) আম্মার (রা.)-কে প্রহার করেননি। মূলত, উসমান (রা.)-এর কতিপয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে আম্মার (রা.) ও কতিপয় সাহাবির মতপার্থক্য ছিল। আম্মার (সা.) সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে সাথে নিয়ে খলিফার সাথে কথা বলার জন্য তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা দ্বাররক্ষী মারফত খলিফার কাছে তাঁদের আগমনের বার্তা পাঠান। খলিফা তাঁদেরকে পরে আসতে বলেন। সা'দ (রা.) ফিরে আসলেও আম্মার (রা.) খলিফার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দ্বাররক্ষী আম্মার (রা.)-কে লাটি দিয়ে আঘাত করে বসে। খলিফা দৌড়ে এসে দ্বাররক্ষীর পক্ষ থেকে জবাবদিহি করেন। খলিফা বলেন, এটি আমার আদেশ কিংবা ইচ্ছায় হয়নি। এরপর খলিফা কিসাসের জন্য নিজের পিঠ এগিয়ে দিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, আম্মার (রা.) কিসাস বা প্রতিশোধ গ্রহন করেননি।

৮. উসমান (রা.) আবু যর গিফারী (রা.)-কে নির্বাসন দিয়েছেন।

জবাবঃ খলিফা আবু যর গিফারী (রা.)-কে নির্বাসন দেননি। আবু যর গিফারী (রা.)-এর জীবনদর্শন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন ছিল। তিনি পার্থিব ধন-সম্পদকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারতেন না এবং তিনি সম্পদ মজুদ করাকে হারাম মনে করতেন। তাছাড়া আবু যর গিফারী (রা.) সর্বদা একা একাই চলাফেরা করতেন। তিনি শহুরে জীবনে খুব অস্বস্তি বোধ করছিলেন বিধায় খলিফা তাঁকে গ্রামের দিকে গিয়ে বসবাস করতে বলেছিলেন। আবু যর গিফারী (রা.) তখন মদীনা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। যদিও আবু যর গিফারী (রা.) সম্পদ পছন্দ করতেন না, তবুও খলিফা তাঁর কাছে বাৎসরিক ভাতা প্রেরণ করতেন।

৯. উসমান (রা.) তাঁর চাচা হাকাম ইবনে আবিল আসকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

জবাবঃ এটি সত্য যে, খলিফা উসমান (রা.) তাঁর চাচা হাকাম ইবনে আবিল আসকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ ব্যক্তি খুবই ধুরন্ধর ছিলেন এবং মক্কায় অবস্থান করে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে পারেন বলে রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে তায়েফে নির্বাসন দিয়েছিলেন। সাথে তার পুত্র মারওয়ানকেও। উসমান (রা.) হাকামকে কেন নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, এ প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এটি খলিফার অধিকারভুক্ত ছিল। খলিফা হিসেবে তিনি এরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তাছাড়া, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাকামকে মক্কা থেকে নির্বাসিত করেছিলেন আর উসমান (রা.) তাকে মদীনায় ফিরিয়ে এনেছিলেন; মক্কায় নয়। তবে এটিও সত্য যে, এ সিদ্ধান্তকে অনেক সাহাবি মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা একে একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

১০. উসমান (রা.) তাঁর আত্মীয়দেরকে গনিমতের বড় অংশ দিয়ে দিতেন।

জবাবঃ উসমান (রা.) তাঁর আত্মীয় আব্দুল্লাহ ইবনে আবিস-সারাহকে মিশরের বিজিত অঞ্চল থেকে অর্জিত গনিমতের ৪% দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উসমান (রা.) সেটি করার অধিকার রাখতেন। কারণ আমর ইবনুল আস (রা.)-এর পর ইবনে আবিস-সারাহ মিশরের দ্বিতীয় বিজেতা ছিলেন। ইসলামি শরী'আহ অনুযায়ী অর্জিত গনিমতের ৪% খলিফার ভাগে যায়। উসমান (রা.) তাঁর নিজের অংশ সেনাপতিকে দিয়েছিলেন।

তাছাড়া উসমান (রা.) তাঁর আত্মীয় স্বজনকে, বিশেষত তাঁর চাচাতো ভাই ও সচিব মারওয়ানকে অনেক টাকাপয়সা দান করেছিলেন। তবে এসব তিনি তাঁর নিজের সম্পদ থেকে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে নয়।

১১. উসমান (রা.) স্বজনপ্রীতি করতেন।

জবাবঃ উসমান (রা.)-এর উপর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অভিযোগ। তিনি মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-কে সিরিয়ার গভর্নর পদে নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে আমিরকে বসরা এবং ওয়ালিদ ইবনে উকবাকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। মারওয়ান ইবনে হাকাম ছিলেন খলিফার সচিব। এরা সবাই খলিফার নিজের গোত্র বনু উমাইয়ার লোক ছিলেন।

প্রথম কথা হচ্ছে, মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-কে উসমান (রা.) সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেননি। বরং খলিফা উমর (রা.) মু'আবিয়া (রা.)-কে সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বনু উমাইয়া কিংবা কোন বিশেষ গোত্র থেকে, অথবা নিজের গোত্র থেকে গভর্নর এবং সচিব নিযুক্ত করা ইসলামি শরী'আতে হারাম নয়। তাহলে এতে খলিফার দোষ ছিল কোথায়?

তৃতীয় কথা হচ্ছে, আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-এর গোত্রদ্বয় যথাক্রমে বনু তায়ীম ও বনু আদী খুব ছোট দুটি গোত্র ছিল। তাই তাঁদের গোত্রদ্বয় থেকে সরকারি পদে নিয়োগ কম হওয়াই স্বাভাবিক। প্রক্ষান্তরে, উসমান (রা.) এবং আলী (রা.)-এর গোত্রদ্বয় যথাক্রমে বনু উমাইয়া ও বনু হাশিম ছিল বিশাল বড় দুটি গোত্র। তাছাড়া বনু উমাইয়ার লোকেরা স্বভাবগতভাবে ভাল রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দক্ষ ছিলেন। তাই উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে বনু উমাইয়া থেকে অনেক সরকারি নিয়োগ হয়েছিল। স্বজনপ্রীতির কারণে হয়নি; যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়েছিল। এমনকি রাসুলুল্লাহ (স.), আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-এর সময়েও বনু উমাইয়া থেকে অনেক সরকারি নিয়োগ হয়েছিল। তাছাড়া উসমান (রা.) কুরাইশদের অন্যান্য গোত্র, কুরাইশ বংশ ব্যতীত অন্য বংশের লোকজন এবং মদীনার আনসারদেরকে অনেক সরকারি পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সুতরাং স্বজনপ্রীতির অভিযোগটি একটি একপেশে এবং ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচার।

(ড. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-গাব্বান রচিত فتنة مقتل عثمان بن عفان অবলম্বনে)

এটি সত্য যে খলিফা উসমান (রা.)-এর অনেক নীতিমালা সাহাবিদের পছন্দনীয় ছিলনা এবং এজন্য কতিপয় প্রবীণ সাহাবি যেমন, ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.), সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), আবু যর গিফারী (রা.) প্রমুখ খলিফার নীতিমালার সমালোচনাও করেছিলেন। তাই বলে তাঁরা কেউই উসমান (রা.)-এর খেলাফতকে অস্বীকার করেননি। আর, ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়া মানবিক স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত।

উপরোল্লিখিত অভিযোগসমূহকে পুঁজি করে কুফা, মিশর ও সিরিয়া থেকে প্রায় হাজারখানেক বিদ্রোহী মদীনায় আসল এবং খলিফার কাছে তাদের অভিযোগপত্র পেশ করল। খলিফা এক এক করে তাদের সব অভিযোগের জবাব দিলেন এবং তারা শান্ত হয়ে দেশে ফিরে যেতে লাগল। উসমান (রা.) ইতোমধ্যে আলী (রা.)-কে একটি কমিটি দিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরণ করে উত্তেজনা প্রশমনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্ত ততক্ষণে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে।

খলিফার জবাব ও আশ্বাসে সন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহীরা যখন দেশে ফিরে যাচ্ছিল, প্রতিমধ্যে তারা একজন সন্দেহভাজন অশ্বারোহীকে আটক করল, যার কাছে পাওয়া গেল একটি রহস্যময় "চিঠি"। চিঠিতে মিশরের গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আবিস-সারাহ'র প্রতি নির্দেশ ছিল- এসব লোক (বিদ্রোহীরা) মিশরে পৌঁছামাত্র তাদেরকে হত্যা করা হোক।

এ চিঠি কে পাঠিয়েছিল তা নিয়ে তিনটি মতামত রয়েছে-

১. শিয়াদের বিশ্বাস, চিঠি স্বয়ং খলিফা উসমান (রা.) পাঠিয়েছিলেন। আহলে সুন্নাত এ মতকে সরাসরি নাকচ করে দেন। উসমান (রা.) এমন মানুষ ছিলেন না যে, চুপিসারে চিঠি পাঠিয়ে তিনি মানুষকে হত্যার নির্দেশ দেবেন। বরং তিনি মাত্রাতিরিক্ত দয়া প্রদর্শনের জন্য অনেকবার সাহাবিদের উষ্মার শিকার হয়েছিলেন।

২. সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী সূত্রমতে, এ চিঠি খলিফার চাচাতো ভাই এবং সচিব মারওয়ান ইবনে হাকাম পাঠিয়েছিলেন। কেন পাঠিয়েছিলেন, তা নিয়ে দুটি মতামত রয়েছে-

ক. হয়তো মারওয়ান চেয়েছিলেন, এর দ্বারা বিদ্রোহীদেরকে চিরতরে খতম করে দেয়া সম্ভব হবে।

খ. হয়তো মারওয়ান নিজে একজন ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন খেলাফত-কেন্দ্রিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখ্য, মারওয়ান একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং জীবনভর তার কর্মকাণ্ড খুবই সন্দেহজনক ছিল। তিনি পরবর্তীতে উমাইয়া রাজতন্ত্রের শাসক হয়েছিলেন। তার পরবর্তী উমাইয়া শাসকরা ছিলেন তারই বংশধর।

৩. সুন্নীদের আরেকটি মত হচ্ছে, বিদ্রোহীরা যখন শান্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তখন তাদের মধ্যকার কোন উগ্রপন্থী দল চিঠির নাটক সাজিয়েছিল। এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে, উক্ত চিঠির সাথে খলিফার আংটি পাওয়া গিয়েছিল। সাধারণত সরকারি চিঠিপত্রে খলিফার মোহর অঙ্কিত থাকত; আংটি নয়। ধারণা করা হয়, বিষয়টি জানা না থাকার কারণে বিদ্রোহীদের একটি দল কোনভাবে খলিফার আংটি চুরি করে চিঠির সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছিল, যেন সন্দেহ খলিফার উপর পতিত হয়। তবে এ মতটি খুব প্রসিদ্ধ নয়।

চিঠি হাতে বিদ্রোহীরা মদীনায় ফিরে এল। তখন হজের মৌসুম চলছিল বলে মদীনার লোকসংখ্যা ছিল খুব কম। বিদ্রোহীরা খলিফাকে চিঠি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করল। খলিফা আল্লাহর কসম করে বললেন, তিনি চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানেননা। ইসলামি শরী'আতে অভিযোগ উত্তাপনের হুকুম হচ্ছে-

البينة على المدعي واليمين على من أنكر

অর্থঃ বাদী তার অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ পেশ করবে, নয়তো বিবাদী নিজের নির্দোষিতার উপর শপথ করবে।

(জামিউল উলুম : ইমাম ইবনে আব্দিল বার)

উসমান (রা.) তাই করলেন। অনন্যোপায় হয়ে বিদ্রোহীরা তাঁর ঘর ঘেরাও করে বসে রইল। উসমান (রা.)-এর ঘর ছিল মসজিদে নববী এবং জান্নাতুল বাকীর মধ্যবর্তী স্থানে। অবরোধ প্রায় ৪০ দিন অব্যাহত ছিল। প্রথমদিকে খলিফা মসজিদে যেতে পারতেন। ধিরে ধিরে বিদ্রোহীরা খলিফাকে গৃহবন্দী করে দিল এবং সাক্ষাতপ্রার্থীদেরকেও আটকে দিল। এক সময় তাঁর ঘরে খাদ্য-পানীয় সরবরাহ বন্ধ করে দিল। সাহাবিরা ছাদ বেয়ে খলিফার ঘরে এসে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু খলিফা তাঁদের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তাঁর একটিই কথা ছিল- আমাকে কেন্দ্র করে মদীনা তাইয়্যিবায় কোন রক্তপাত হতে দেয়া যাবেনা। খলিফার এমন শীতিলতায় আলী (রা.) তাঁর উপর বিরক্ত হয়েছিলেন।

অবরোধকালীন সময় খলিফা বিদ্রোহীদেরকে বারবার নিজের অবস্থান, মর্যাদা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাবেয়ী ছুমামা ইবনে হাযন আল-কুশায়রী বর্ণনা করেন- অবরোধের একদিন খলিফা উসমান (রা.) ঘর থেকে মাথা বের করে বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে দুজনকে তাঁর ঘরের ভেতর যেতে বললেন। দুজন লোক ভেতরে গেলে খলিফা তাঁদেরকে বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও ইসলামের দোহাই দিয়ে বলছি। তোমরা কি জানো, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আসার পর বীরে রুমা ব্যতীত মদীনায় কোন মিঠাপানির কূপ ছিলনা? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, কে এই কূপটি ক্রয় করে এর পরিবর্তে জান্নাতকে বিনিময় হিসেবে নেবে? তখন আমি নিজের অর্থ দিয়ে বীরে রুমা কূপ ক্রয় করে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলাম। আর আজ তোমরা আমাকে পানি পান করতে বাধা দিচ্ছ। আমাকে সাগরের পানির মতো লোনা পানি পান করতে হচ্ছে! তোমরা কি জানো, মসজিদে নববীর জায়গাটি মুসল্লিদের জন্য খুব সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, কে জান্নাতের বিনিময়ে এ জায়গাটি ক্রয় করে দেবে? তখন আমি নিজের মূলধন দিয়ে মসজিদের বর্ধিত স্থানটি ক্রয় করে দিয়েছিলাম। আর আজ তোমরা আমাকে সেই মসজিদে দু'রাকাত নামাজ আদায় করতে বাধা দিচ্ছ! তোমরা কি জানো, আমি জাইশুল উসরার (তাবুক অভিযানকারী বাহিনী) রসদের যোগান দিয়েছিলাম? তোমরা কি জানো, মক্কার ছাবীর পাহাড়ের উপর রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর, উমর ও আমাকে নিয়ে উঠলেন। তখন পাহাড় কাঁপতে লাগল। রাসুলুল্লাহ (সা.) পা দিয়ে পাহাড়ে আঘাত করে বলেছিলেন, শান্ত হও ছাবীর! তোমার উপরে আছেন নবী, সিদ্দিক ও দুজন শহীদ। বিদ্রোহীরা প্রতিটি কথায় হ্যাঁ-বাচক সায় দিল। তখন উসমান (রা.) বললেন, আল্লাহু আকবার! এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে। কা'বার রবের কসম, আমি তো শহীদ।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭০৩)

মুহাম্মদ ইবনে আঈদ দামেস্কী আবু সাওরের সূত্রে বর্ণনা করেছেন- অবরোধকালীন সময় বিদ্রোহীরা উসমান (রা.)-এর বিপক্ষে নানা অপবাদ রটাতে শুরু করতে শুরু করল। এমনকি তারা খলিফার নৈতিক চরিত্রের উপরও আঙুল তুলল। তাদের কথা শুনে খলিফা বললেন, আমি কখনো এসব বলতাম না। কিন্তু যখন তোমরা আমার বিরুদ্ধে কথা বলছ, তাই আমি বলছি। শুনো, আমি ইসলামে চারজনের মধ্যে চতুর্থজন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে তাঁর কন্য বিবাহ দিয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরেকজন কন্যাকে আমার কাছে বিবাহ দেন। জাহেলি যুগেও আমি কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হইনি, চুরি করিনি। ইসলাম গ্রহনের পর থেকে আমি কোনদিন কাউকে কষ্ট দেইনি, কখনো লোভ-লালসা করিনি। প্রতি জুম'আর দিন আমি একজন গোলাম আযাদ করতাম। আল্লাহর কসম! যেদিন আমি আমার ডানহাত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র হাতে রেখে ইসলামের বাই'আত করেছিলাম, সেদিন থেকে এই ডানহাত দিয়ে আমি নিজের লজ্জাস্থান স্পর্শ করিনি।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, উসমান (রা.)-এর অবরোধের ঘটনা)

অবরোধকারী বিদ্রোহীদের সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকল। তাদের দাবী ছিল- খলিফাকে ইস্তফা দিতে হবে। সাথে আরো কিছু দাবী-দাওয়া থাকলেও মূলত তারা উসমান (রা.)-কে খলিফা হিসেবে সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু খলিফা ইস্তফা দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে এ ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলেন। আল্লাহর নবী (সা.) তাঁকে বলেছিলেন-

يا عثمان ان الله عز وجل عسي ان يلبسك قميصا فان ارادك المنافقون علي خلعه فلأ تخلعه حتي تلقاني

অর্থঃ হে উসমান! সম্ভবত আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরাবেন। যখন মুনাফিকরা এই জামা খুলে নিতে চাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জামা খুলে দেবেনা যতক্ষণ না আমার সাথে সাক্ষাৎ করো।

(ফাদ্বায়িলুস সাহাবা : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ৬৯৮)

যখন দেখা গেল বিদ্রোহীরা ভয়ংকর হয়ে উঠছে এবং খলিফাও প্রতিরোধের অনুমতি দিচ্ছেন না, তখন হারিস ইবনে নু'মান (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) ঘরের বাইরে প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করলেন। আলী (রা.) হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর হাতে খলিফার ঘরে চুপিসারে খাদ্য প্রেরণ করতে লাগলেন। খলিফা ইবনে যুবায়ের (রা.)-কে দাপ্তরিক দায়িত্ব এবং ইবনে আব্বাস (রা.)-কে হজের আমীর নিযুক্ত করলেন। অতপর আলী (রা.)-কে পরামর্শের জন্য ডেকে পাঠালেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা আলী (রা.)-কে ঘরে প্রবেশ করতে বাধা দিল। আলী (রা.) বাইরে থেকে তাঁর পাগড়ি ঘরের ভেতর ছুড়ে দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়ে গেলেন।

কা'ব ইবনে মালিক (রা.) ও যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে মদীনার আনসারগণ খলিফার পাহারায় বসলেন। কিন্তু খলিফার নির্দেশ ছিল- "যাদের উপর আমার দাবী আছে, তাদেরকে বলছি। তোমরা যার যার ঘরে ফিরে যাও। আমি কোন মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত হতে দেবনা।" অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে খলিফার দ্বারে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.), ইমাম হাসান (রা.) এবং ইমাম হোসাইন (রা.)। তাঁদের সাথে মারওয়ান ও ছিলেন।

প্রত্যেক প্রবীণ সাহাবি তাঁদের সন্তানদেরকে খলিফার দ্বাররক্ষায় প্রেরণ করলেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) এবং ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)। খলিফা আল্লাহর কসম দিয়ে তাঁদেরকে অস্ত্র চালাতে বারণ করলেন। এমনকি উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) গোপনে খলিফাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু খলিফা মুসলমানদের ছেড়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন।

১১ যিলহাজ্জ রাতে খলিফা স্বপ্নে দেখলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-কে সাথে নিয়ে তাঁর অপেক্ষা করছেন। আল্লাহর নবী (সা.) উসমান (রা.)-কে ডেকে বলছেন-

يا عثمان افطر عندنا

অর্থঃ হে উসমান! আমাদের সাথে এসে ইফতার করো।

উসমান (রা.)-এর ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং তিনি সেহরি খেয়ে রোজার নিয়ত করলেন। পরদিন খলিফা তাঁর প্রহরী ও দ্বাররক্ষী সাহাবিদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজেদের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সবার শেষে ইমাম হাসান (রা.) খলিফার ঘর ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এবং ইবনে যুবায়ের (রা.) যেতে চাচ্ছিলেন না। খলিফা তাঁদের দুজনকে একপ্রকার জোর করেই ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর গোসল করে, নতুন কাপড় পরিধান করে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে বসে পড়লেন।

প্রথমবার খলিফার দরজা রক্ষীহীন দেখে বিদ্রোহীরা ঘরে প্রবেশ করল। দুঃখজনক হলেও সত্য, খলিফা উসমান (রা.)-এর ঘরে প্রবেশ করা প্রথম ব্যক্তিটি ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র মুহাম্মদ। তিনি ভেতরে গিয়ে খলিফার দাড়ি ধরে অত্যন্ত কটু বাক্য প্রয়োগ করলেন। উসমান (রা.) বললেন, "ভাতিজা। আমার দাড়ি ছেড়ে দাও। তোমার বাবাও কখনো আমার দাড়িতে হাত দেননি। তিনি আমাকে খুব সম্মান করতেন।" মুহাম্মদ লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। তখন ভেতরে প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি শুরু চলছিল। বিদ্রোহীরা খলিফাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্চিত করতে শুরু করল। চিৎকার করে করে নানা অভিযোগ আরোপ করতে লাগল। কিন্তু খলিফা তখনো শান্ত ছিলেন। বিদ্রোহীদের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম খলিফার হাতে তরবারি দিয়ে আঘাত করল। আঘাতে তাঁর হাত কেটে গেল। তখন উসমান (রা.) বললেন, "তোমরা এমন একটি হাত কেটে ফেললে যে হাত সর্বপ্রথম ওহী লিপিবদ্ধ করেছিল।" তখন এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে খলিফার মুখে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এরপর আর আঘাত থামেনি। খলিফার স্ত্রী নায়লা হাত বাড়িয়ে তাঁকে রক্ষা করতে গেলে তরবারির আঘাতে নায়লার হাতের আঙুল কেটে গিয়েছিল। একপর্যায়ে কেউ একজন সরাসরি তরবারি চালালো খলিফার ঘাড়ের উপর। আঘাতটি এতো গুরুতর ছিল যে, ৮২ বছর বয়সী খলিফা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। রক্ত ছিটকে পড়ল সামনে রাখা কুরআন শরীফের আয়াতের উপর। আয়াতটি ছিল-

فسيكفيكهم الله وهو السميع العليم

অর্থঃ তাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

(সুরা বাকারা : ১৩৭)

১২ যিলহজ্জ ৩৫ হিজরি, শুক্রবার, মুসলিম উম্মাহ'র তৃতীয় খলিফা আমিরুল মু'মিনীন উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিআল্লাহু আনহু বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করলেন। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া কিছু লোকের নাম পরবর্তীতে উদ্ধার হয়েছিল। তারা হল- রুমান আল-ইয়ামেনি, জিবলা মিসরি, কিনানা ইবনে বুশর, সাওদান ইবনে হুমরান, ইবনে হাযিফ, আব্দুর রহমান ইবনে উদাইস, আল-বালাওয়ী প্রমুখ। খলিফার শাহাদতের পরপরই হত্যাকারীরা বিচ্ছিন হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীদের দ্বারা লাশ বিকৃতির আশঙ্কায় তিনদিন পর সাহাবিরা খলিফার দেহ একটি বাগানে দাফন করেন, যা তখন জান্নাতুল বাকীর অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। পরবর্তীতে কবরস্থান বৃদ্ধি করা হলে খলিফার কবরটি বাকীর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

(তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৩৫ হিজরির ঘটনাবলী ও উসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ড; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, উসমান (রা.)-এর শাহাদত)

খলিফা উসমান (রা.)-এর শাহাদতের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ'র আদর্শগত ঐক্যের যুগ চিরতরে শেষ হয়ে যায় এবং উম্মত এমন এক অন্তহীন ফিতনায় প্রবেশ করে, যে ফিতনা কিয়ামত পর্যন্ত ব্যাপ্তিত।

খলিফা উসমান (রা.)-এর শাহাদতের পরই হত্যাকারীরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সাহাবিরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বেশিরভাগ প্রবীণ সাহাবি নিজেদের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। লোকজন সর্বপ্রথম আলী (রা.)-এর কাছে গেল এবং তাঁকে উম্মতের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করল। কিন্তু আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করলেন। বললেন, "আমি পূর্ববর্তী খলিফাদের পরামর্শক ছিলাম, এখনো থাকব।" এরপর তাঁরা একে একে ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.), যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.), সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) প্রমুখের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে খেলাফতের দায়িত্ব নিতে বলল। কেউ রাজি হলেন না। অবশেষে সবাই জোটবদ্ধ হয়ে আলী (রা.)-এর নিকট আসলেন। একটি বর্ণনামতে, বিদ্রোহীদের একটি দল আলী (রা.)-কে খলিফা হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, বাড়ন্ত বিদ্রোহের ফলে মদীনা তাইয়্যিবার জনজীবন হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও লোকজনের অব্যাহত চাপের ফলে আলী (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। বললেন, "সবাই যদি আমার উপর ঐক্যমত পোষণ করেন, তবে কাল জনসম্মুখে বাই'আত গ্রহন করা হবে। বদ্ধ ঘরে কোন বাই'আত গ্রহন করা হবেনা।" পরদিন মসজিদে নববীতে বাই'আত গ্রহন করলেন মুসলিম উম্মাহ'র চতুর্থ খলিফা আবুল হাসান আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)। সর্বপ্রথম বাই'আত জ্ঞাপন করলেন ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.)। এরপর অন্যান্য প্রবীণ সাহাবি, মুহাজির ও আনসারগণ। এরপর সাধারণ মানুষ।

(তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৩৫ হিজরির ঘটনাবলী ও আলী (রা.)-এর খেলাফতের বাই'আত; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, আলী (রা.)-এর খেলাফত; তারিখুল খোলাফা : ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী, আলী (রা.)-এর বাই'আত)

দুঃখজনক হলেও সত্য, কতিপয় উচ্চপর্যায়ের সাহাবি ও তাবেয়ী আলী (রা.)-এর হাতে ততক্ষণ পর্যন্ত বাই'আত দিতে সম্মত হননি, যতক্ষণ না উসমান-হত্যার বিচার হবে। দিন যত অতিবাহিত হচ্ছিল, অসন্তুষ ততো দানা বাঁধছিল। বাই'আতের পর ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.) যথাক্রমে বসরা ও কুফার দায়িত্ব নিতে চাইলেন। যাতে তাঁরা সেখানে মুসলিম সেনাবাহিনী একত্র করে উসমান-হত্যার বিচার তরান্বিত করতে পারেন। কিন্তু আলী (রা.) তাঁদেরকে বললেন, "আপনারা আমার পাশে থাকুন। এখানেই আপনাদের প্রয়োজন বেশি।" বিদ্রোহীদের একটি দল আলী (রা.)-এর সেনাবাহিনীতেই আত্মগোপন করে রইল, যদিও তিনি তাদের উপস্থিতি পছন্দ করছিলেন না। কিন্তু তখন অবস্থাও এমন ছিলনা যে, খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করে সেনাবাহিনী থেকে তাড়িয়ে দেবেন। ওদিকে সবাই উসমান হত্যার বিচার চাচ্ছেন, কিন্তু বিচার কিভাবে হবে কেউই জানেন না। বিদ্রোহীরা সংখ্যায় এতো অধিক ছিল, ৭০০ থেকে শুরু করে হত্যার দিন পর্যন্ত তাদের সংখ্যা হাজারের উপরে চলে গিয়েছিল। হাজারো লোকের মধ্যে প্রকৃত হত্যাকারীরা সহজেই লুকিয়ে গিয়েছিল। খলিফা আলী (রা.)-এর হাতে তখন এতো বড় বাহিনীও ছিলনা যে, পুরো মুসলিম জাহানে "সার্চ-অপারেশন" নিক্ষেপ করে, প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের বিচার করবেন। ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.) বারবার খলিফার নিকট হত্যাকারীদের বিচার চাইতে লাগলেন। খলিফা বললেন, "আমি বিচারের বিপক্ষে নই। কিন্তু কিভাবে? আপনারা হত্যাকারীদের খুঁজে নিয়ে আসুন। আমি নিজ হাতে তাদেরকে হত্যা করব।" ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.) খলিফার জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁরা খলিফার অনুমতি নিয়ে উমরা করতে মক্কা মুকাররামায় চলে গেলেন। ওদিকে, মদীনা যখন অবরুদ্ধ; উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) তখন হজ পালনার্থে মক্কায় অবস্থান করছিলেন। ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.) মক্কায় গিয়ে আয়েশা (রা.)-এর সাথে পরামর্শ করলেন এবং সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে, উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদেরকে এভাবে ছেড়ে দেয়া যাবেনা।

মক্কা-মদীনার অবস্থা যখন এই, সিরিয়ায় তখন আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। উসমান (রা.)-এর শাহাদতের পর নু'মান ইবনে বশীর (রা.) খলিফার রক্তমাখা জামা এবং খলিফা-পত্নী নায়লার কর্তিত আঙুল নিয়ে সিরিয়ায় চলে যান। সিরিয়ার তৎকালীন গভর্নর ছিলেন উসমান (রা.)-এর চাচাতো ভাই মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)। তিনি দামেস্কের উমাওয়ী মসজিদে খলিফার রক্তমাখা জামা প্রদর্শন করেন। এতে লোকদের আবেগ ও উত্তেজনা চরম মাত্রায় উত্থিত হয়। মু'আবিয়া (রা.) খলিফা আলী (রা.)-এর হাতে ততক্ষণ পর্যন্ত বাই'আত দিতে অস্বীকৃতি জানান, যতক্ষণ না উসমান-হত্যার বিচার হয়।

এ সময় খলিফা আলী (রা.) এমন একটি অনাহূত সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন, যা উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলল। তিনি ইয়েমেন, বসরা, কুফা, মিশর এমনকি সিরিয়ার গভর্নর পরিবর্তন করে নতুন গভর্নর নিয়োগ দিলেন। খলিফার প্রধান পরামর্শক আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বারবার তাঁকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু খলিফা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।

আলী (রা.) কর্তৃক নিযুক্ত সিরিয়ার গভর্নর সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) সিরিয়ায় পৌঁছামাত্র সেখানকার দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী গভর্নর মু'আবিয়া (রা.) তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন। মু'আবিয়া (রা.)-এর এ আচরণ ছিল খেলাফতের আদর্শের সম্পুর্ণ বিপরীত। খলিফার প্রেরিত গভর্নরকে তাড়িয়ে দেয়ার অর্থ সরাসরি খেলাফতকে চ্যালেঞ্জ করা। এ সংবাদ আলী (রা.)-এর নিকট পৌঁছালে তিনি তৎক্ষণাৎ বিষয়টি সমাধানের উদ্দেশ্যে সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, আলী (রা.)-এর খেলাফত ও ৩৬ হিজরি সাল)

ওদিকে আয়েশা (রা.), ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.) মক্কা থেকে মদীনায় ফিরে আসার পরিবর্তে বসরায় চলে গেলেন। বসরা ছিল নতুন এবং নিরপেক্ষ একটি শহর। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, সেখানে বসবাসরত সাহাবি ও তাবেয়ীদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে বিচার তরান্বিত করতে খলিফাকে সাহায্য করবেন। বসরায় আসার পথে আয়েশা (রা.) একটি জায়গায় কুকুরের ডাক শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ জায়গাটির নাম কী? জবাব এলো, বসরার নিকটবর্তী হাউআব (حوأب) নামক এলাকা। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন- ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কোন একটি ঝামেলা বাধবে। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা তাঁর স্ত্রীদের দিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- তখন কী অবস্থা হবে যখন তোমাদের মধ্যে কেউ একজন হাউআব নামক এলাকায় কুকুরের ডাক শুনবে!

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৫২/৬)

আয়েশা (রা.) বুঝতে পারলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশৃঙ্খলার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি যাত্রা স্থগিত করতে চাইলে যুবায়ের (রা.) তাঁকে বললেন, চলুন, সম্ভবত আল্লাহ আপনার মাধ্যমে লোকদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করবেন।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৫২/৬)

ইমাম তাবারীর মতে, বসরায় আসামাত্র সাহাবাত্রয়ীর সাথে প্রায় ৩০ হাজার লোক যোগ দিলেন। শিয়ারা বলেন, আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এ বাহিনী নিয়ে আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আহলে সুন্নাত এ মতকে দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দিয়ে বলেন, আয়েশা (রা.)-এর এমন কোন পরিকল্পনা ছিলনা। তিনি কেবল খলিফাকে চাপ দিতে চাচ্ছিলেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, আয়েশা (রা.) ভেবেছিলেন, হয়তো তাঁর "মোবারক উপস্থিতি" সবাইকে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে উপনিত হতে সাহায্য করবে। আর যাই হোক, উম্মুল মু'মিনীনের কথাকে কেউ ফেলতে পারবেনা।

ওদিকে, ৩০ হাজার লোকের জমায়েত দেখে বসরার গভর্নর ঘাবড়ে গেলেন। তিনি খলিফার কাছে সংবাদ পাঠালেন। খলিফা তখন মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে বিরোধ নিরসনে সিরিয়া গমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ রাস্তা পরিবর্তন করে বসরায় আসলেন।

(তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৩৬ হিজরির ঘটনাবলী; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, জামাল যুদ্ধের সূচনা)

শহরের বাইরে অবস্থান করে আলী (রা.) তাঁর অন্যতম সেনাপতি তাবেয়ী আল-কা'কা' ইবনে আমরকে (القعقاع بن عمرو) শহরের ভেতরে প্রেরণ করলেন। সাথে গেলেন সাহাবি উসমান ইবনে হুনাইফ (রা.), ইমরান ইবনে হোছাইন (রা.), তাবেয়ী আবুল আসওয়াদ দুয়াইলি প্রমুখ। তাঁরা গিয়ে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মা আপনি কেন এতো লোক নিয়ে এখানে জমায়েত হয়েছেন? আয়েশা (রা.) জবাব দিলেন, আমরা উসমান-হত্যার বিচার চাই। আল-কা'কা' এসে খলিফাকে আয়েশা (রা.)-এর জবাব শুনালেন। খলিফা তাঁর যুক্তিসহ আল-কা'কা'কে আবার ভেতরে প্রেরণ করলেন। আয়েশা (রা.) তাঁর যুক্তিসহ আল-কা'কাকে আবার খলিফার কাছে প্রেরণ করলেন। এভাবে টানা তিনদিন আল-কা'কা'র অক্লান্ত ছোটাছুটি ও যুক্তিতর্কের পর সবাই একটি মীমাংসায় পৌঁছালেন। সিদ্ধান্ত হল- প্রথমে সব বিদ্রোহীদেরকে একঘরে করা হবে, যাদের অনেকেই তখনো খলিফার দলে লুকিয়ে ছিল। অতপর তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিচার করা হবে। আয়েশা (রা.) ভেবেছিলেন, তিনি এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আলী (রা.) ও মু'আবিয়া (রা.)-এর বাড়ন্ত বিরোধকেও শান্ত করতে পারবেন। কারণ তিনি জানতেন, যেকোন সময় মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে আলী (রা.)-এর যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।

সবাই যখন একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন, তখন নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত উসমান-হত্যাকারীরা মুসলিম উম্মাহ'র উপর আরেকটি ভয়াবহ আঘাত হানল। রাতের অন্ধকারে এক হাজার লোক একদিকে গিয়ে খলিফা আলী (রা.)-এর তাবুতে হামলা করল। আরো এক হাজার গিয়ে আয়েশা (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর তাবুতে হামলা করল। উভয় দল ভাবলেন, বিপক্ষ দল বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও আলী (রা.) ও আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) নিজেদের লোকজনকে আটকাতে পারলেন না। শেষ রাতের দিকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হল, যা পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ইতিহাসে এ যুদ্ধ يوم الجمل বা উষ্টীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। একপর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র উদ্ভাবিত হলেও যুদ্ধ থামানোর মতো অবস্থা তখন ছিলনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক মর্যাদাবান সাহাবিও এ যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। একসময় আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বাহিনী দুর্বল হয়ে গেলে আলী (রা.) তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজের সৈন্যদেরকে থামাতে সক্ষম হলেন। কিন্তু ততক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত ১০ হাজার মুসলমানের রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

একপর্যায়ে সামনে থেকে ছুটে আসা একটি তীর আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর হাওদা বহনকারী উষ্টীর পায়ে বিঁধে এবং তীব্র ঝাঁকুনির ফলে তাঁর হাওদা মাটিতে পড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে উভয় দল সৎবিত ফিরে পায়। বুঝতে পারে, সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। সাথেসাথেই যুদ্ধ বন্ধ হয়। খলিফা আয়েশা (রা.)-কে বসরা শহরে পাঠিয়ে দেন। ক'দিন পর তিনি আয়েশা (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি বুঝতে পারেন, আয়েশা (রা.) কাঁদছেন। খলিফা তাঁকে বলেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আয়েশা (রা.) জবাব দেন, আল্লাহ আপনাকেও ক্ষমা করুন। খলিফা নির্দেশ দেন, যে ব্যক্তি আয়েশা (রা.)-এর উপর যুদ্ধের দোষ চাপাবে, তাকে একশ দোররা মারা হবে। আলী (রা.) আয়েশা (রা.)-এর সৎভাই মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর এবং নিজপুত্র ইমাম হাসান (রা.)-কে সাথে দিয়ে একটি বিশাল নিরাপত্তা বহরে উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। যতদিন আয়েশা (রা.) বেঁচেছিলেন, ততদিন তিনি যুদ্ধের কথা স্মরণ করে অঝোরে কাঁদতেন। বলতেন, কেউ যেন কোন পক্ষকে নিন্দা না করে। আমার এবং আলী (রা.)-এর মধ্যে যা হয়েছে, মনে করো তা একজন নারীর সাথে তাঁর শশুরবাড়ির লোকদের মনোমালিন্য। নিশ্চয়ই আলী (রা.) সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, জামাল যুদ্ধ; আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, জামাল যুদ্ধের ঘটনা)

জামাল বা উষ্টীর যুদ্ধ এবং তৎসংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য আখ্যানসমূহ নিম্নরূপ-

১. যুদ্ধের মাঠে ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) লোকদেরকে থামাতে ব্যস্ত ছিলেন, যখন ছুটে আসা একটি তীর তাঁর উরুতে গুরুতর আঘাত হানে। এ আঘাতের ফলে সংঘটিত রক্তক্ষরণে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ত্বালহা সেই ব্যক্তি যিনি উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আঘাতের তীব্রতায় তাঁর শরীরের অর্ধাংশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

من سره أن ينظر إلى شهيد يمشي على وجه الأرض فلينظر إلى طلحة بن عبيد الله

অর্থঃ যে ব্যক্তি একজন শহীদকে পৃথিবীর বুকে হাটতে দেখতে চায়, সে যেন ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহকে দেখে।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৩৯; মিশকাতুল মাসাবিহ, ৬১২২)

২. যুবায়ের (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে আলী (রা.)-এর মুখামুখি হলে আলী (রা.) তাঁকে একটি হাদিস স্মরণ করিয়ে দিলেন, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের দুজনকে পরস্পরকে বিপক্ষে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। হাদিসটি স্মরণ হতেই যুবায়ের (রা.) দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। তাঁকে যেতে দেখে আমর ইবনে জুরমুয তাঁর পিছু নেয়। অনেকদুরে, একটি খোলা জায়গায় যুবায়ের (রা.) নামাজ পড়তে দাঁড়ালে ইবনে জুরমুয পেছন থেকে তাঁর গলায় ছুরি চালিয়ে দিল। নামাজরত অবস্থায় শাহাদত বরণ করলেন যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)। ঘাতক নিজে এসে আলী (রা.)-কে যুবায়ের-হত্যার সংবাদ দিল। ভাবল সে পুরস্কৃত হবে। আলী (রা.) বললেন, তাকে জাহান্নামের "সুসংবাদ" দাও। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ছাফিয়্যার পুত্র (যুবায়ের) হত্যাকারীকে জাহান্নামের "সুসংবাদ" দাও। যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খুব প্রিয় সাহাবি ছিলেন। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন-

إن لكل نبي حواريا وحواري الزبير

অর্থঃ প্রত্যেক নবীর একজন সহকারী থাকেন। আমার সহকারী যুবায়ের।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৪৫)

উষ্টীর যুদ্ধের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল ত্বালহা (রা.) ও যুবায়ের (রা.)-এর শাহাদত। কী চেয়েছিলেন তাঁরা, আর কী হয়ে গেল! মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে উসমান-হত্যার চারমাসের মাথায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ইসলামের সূচনালগ্নের দুই মহান সেবক- ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) এবং যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন-

طلحة والزبير جاراي في الجنة

অর্থঃ ত্বালহা ও যুবায়ের জান্নাতে আমার প্রতিবেশী।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৪১)

৩. যুদ্ধ চলাকালীন ইমাম হাসান (রা.) তাঁর পিতার খোঁজ নিতে তাবুতে গেলেন। গিয়ে দেখেন আলী (রা.) কাঁদছেন। তখন পিতা-পুত্রের মধ্যে নিম্নুক্ত কথোপকথন হয়েছিল-

قال علي رضي الله عنه لابنه الحسن يوم الجمل يا حسن ليت أباك مات من عشرين سنة قال فقال له الحسن : يا أبت قد كنت أنهاك عن هذا قال: يا بني لم أر الأمر يبلغ هذا

অর্থঃ আলী (রা.) উষ্টীর যুদ্ধের দিন হাসান (রা.)-কে বললেন, হে হাসান, তোমার পিতা যদি বিশ বছর আগেই মারা যেত! হাসান (রা.) তাঁকে বললেন, বাবা! আমি আপনাকে এসব করতে মানা করেছিলাম। আলী (রা.) বললেন, হে পুত্র, আমি ভাবতে পারিনি এসব এতোদুর পর্যন্ত পৌঁছাবে।

(মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ৩/৪২০)

৩. আবু রাফে' (রা.) বর্ণনা করেছেন-

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لعلي بن أبي طالب رضي الله تعالى عنه إنه سيكون بينك وبين عائشة أمرٌ قال أنا يا رسول الله؟ قال نعم قال فأنا أشقاهم يا رسول الله قال لا ولكن إذا كان ذلك فارددها إلى مأمنها

অর্থঃ একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে বললেন, একসময় তোমার ও আয়েশার মধ্যে একটি বিষয় ঘটবে। আলী (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার সাথে? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। আলী (রা.) বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমি হব উভয়ের মধ্যে নিকৃষ্ট। রাসুল (সা.) বললেন, না তা নয়। তবে যখন এরকম ঘটনা ঘটবে, তখন তুমি আয়েশাকে সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছিয়ে দিও।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৩৯৩/৬)

উপরোল্লিখিত বর্ণনাগুলো উষ্টীর যুদ্ধের আকস্মিকতা ও দুঃখজনক পরিনামকে স্পষ্ট করে দেয়। এ যুদ্ধের কারণ ও ফলাফলকে ব্যাখ্যা করলে আমরা নিম্নুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। যথা-

১. উসমান (রা.) ইন্তেকালের পূর্বে বলেছিলেন, আমার হত্যাকাণ্ড মুসলিম উম্মাহ'র রক্তঝরা দিনগুলোর সূচনা করবে। উষ্টীর যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করে দিয়েছিল।

২. একদিকে উসমান-হত্যাজনিত বিচার বিলম্বিত করার ফলে বিপুলসংখ্যক সাহাবির মনে অসন্তোষ জন্ম নিয়েছিল। এ অসন্তোষ থেকে তাঁরা খলিফার উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। অপরদিকে আলী (রা.) উভয়মুখী চাপের ফলে যথাপোযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারছিলেন না। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোর গভর্নর পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি খলিফার অবস্থানকে অন্যদের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। মোটকথা, উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থানে সঠিক ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক ছিল যে, দুটি সঠিক অবস্থানের মধ্যেও একটি সমন্বয়-রেখা টানা যাচ্ছিলনা।

৩. একপর্যায়ে যখন দু'দল একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, তখন কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র সমন্বয় প্রচেষ্টাকে চরমভাবে নস্যাৎ করে দেয়। নিশ্চিত বিজয়ের পরও আলী (রা.) এ যুদ্ধে কোন গনিমত ও যুদ্ধবন্দী গ্রহন করেননি। বরং তিনি আহতদের সেবাশুশ্রূষার ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, উষ্টীর যুদ্ধ "জিহাদ" ছিলনা। বরং এ যুদ্ধকে ভুল বুঝাবুঝির ফলস্রুতিতে সংঘটিত রাজনৈতিক দুর্ঘটনা বলতে আমাদের কোন দ্বিধা নেই। এজন্য আলী (রা.) ও আয়েশা (রা.) উভয়েই অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং একে অপরের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।

৪. দু'দলের কারো উদ্দেশ্য ছিলনা অন্যদলের রক্ত ঝরানোর। কিন্তু আপাতকালীন পরিস্থিতি এড়াতে কেউ সক্ষম ছিলেন না।

সবশেষে বলা যায়, উষ্টীর যুদ্ধ ছিল পূর্ববর্তী শৃঙ্খলা ও পরবর্তী বিশৃঙ্খলার মধ্যকার একটি সন্ধিক্ষণ এবং নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের সমাপ্তির সূচনা।

উষ্টীর যুদ্ধের পর ইতিহাস আরেকটি জটিল সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছিল। খলিফা আলী (রা.) সিরিয়ার গভর্নর মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে সৃষ্ট দ্বন্ধ নিরসনকল্পে সিরিয়ায় গমন করলেন। তখন ৩৬ হিজরি সন শেষ হওয়ার পথে। সিরিয়ার অদূরবর্তী সিফফিন নামক স্থানে অবস্থান করে আলী (রা.) মু'আবিয়া (রা.)-এর নিকট প্রতিনিধি পাঠিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) সব সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিলেন এবং বিচারের পূর্বে আলী (রা.)-এর হাতে বাই'আত দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। মু'আবিয়া (রা.)-এর অনুমান ছিল, উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীরা খলিফার দলে শামিল রয়েছে। এটি সত্য যে, কিছু বিদ্রোহী কৌশলে খলিফার দলে মিশে গিয়েছিল, তবু "হত্যাকারীরা সবাই আলীর দলে" এ কথাটি ভুল ছিল। দীর্ঘ দু'মাসের অবস্থানে অনেক সাহাবি পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করলেন। বিশেষত, উষ্টীর যুদ্ধে তাবেয়ী আল-কা'কা' ইবনে আমর যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, এখানে সাহাবি জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) সে ভূমিকাই পালন করলেন। উভয় দলের মাঝে ছোটাছুটি করে সমযোতার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সময়ে সময়ে অবস্থার আরো অবনতি হল। মু'আবিয়া (রা.) সমাধানের পথে বিন্দুমাত্র এগিয়ে আসলেন না। দীর্ঘ দু'মাস পর, আলী (রা.) ঘোষণা দিলেন- যথেষ্ট হয়েছে। এ বিদ্রোহ আর সহ্য করা হবেনা। এবার প্রস্তুত হোন।

৭ই সফর, ৩৭ হিজরি, বুধবার সকালে গভর্নর মু'আবিয়া (রা.)-এর বাহিনী সিফফিন প্রান্তরে খলিফা আলী (রা.)-এর বাহিনীর উপর হামলা করল। টানা ৫ দিন ধরে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আফসোস আর হাহাকার ব্যতীত এ যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা করার আর কিছুই নেই। খলিফা আলী (রা.)-এর সেনাপতি ছিলেন মালিক আল-আশতার নাখয়ী এবং মু'আবিয়া (রা.)-এর সেনাপতি ছিলেন হাবীব ইবনে মাসলামাহ। নামাজের সময় হলে যুদ্ধ বন্ধ থাকত এবং রাতের বেলায়ও। আলী (রা.)-এর দলে সৈন্য সংখ্যা ছিল একলক্ষ ২০ হাজার। তন্মধ্যে ৩০-৪০ হাজার সৈন্য প্রাণ দিলেন। মু'আবিয়া (রা.)-এর দলে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৬০-৭০ হাজার। তন্মধ্যে ২০-২৪ প্রাণ হারালেন। কোন সুত্রমতে, মু'আবিয়া (রা.)-এর সৈন্য সংখ্যা আরো বেশি ছিল এবং নিহতের সংখ্যাও আরো বেশি। কারো গবেষণা মতে, সিফফিনের যুদ্ধে ৭৪ হাজার মুসলিম প্রাণ হারিয়েছিলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, ইরাক ও শামবাসীর মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধ; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৩৭ হিজরির ঘটনাবলী ও আলী-মু'আবিয়ার যুদ্ধ)

আফসোস! সেই বদর থেকে নিয়ে সিফফিনের আগ পর্যন্ত অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হয়ে যত মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন, এক সিফফিনেই তার প্রায় তত মুসলমান প্রাণ হারালেন। তাও মুসলমানদের হাতে! ইতিহাসের এই নির্মম অধ্যায় আজো আমাদের মনে শত-সহস্র জিজ্ঞাসার ঢেউ তুলে যায়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এ যুদ্ধের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

لا تقوم الساعة حتى تقتتل فئتان عظيمتان يكون بينهما مقتلة عظيمة ودعواهما واحدة

অর্থঃ ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না দুটি বিশাল দলের মধ্যে একটি প্রকাণ্ড যুদ্ধ হবে, যদিও তাদের দাবী এক।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ফিতান, ৬৭০৪)

ইমাম ইবনে সীরিন বলেছেন, সিফফিনের যুদ্ধের সময় অন্তত ১০ হাজার সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ একশজন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ৩০ জন প্রবীণ সাহাবি। অন্যরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

যুদ্ধের চতুর্থ দিন আলী (রা.)-এর দক্ষিণবাহু, নব্বুই-উর্দ্ধ সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) শাহাদত বরণ করেন। আম্মার (রা.) ইসলামের প্রথম শহীদ দম্পতি সুমাইয়া-ইয়াসির (রা.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র। আবু জাহেল তাঁর সামনেই তাঁর মা-বাবা ও ভাইকে হত্যা করেছিল। বালক আম্মার নির্যাতন সইতে না পেরে মুশরিকদের দেব-দেবীর প্রশংসা করেন এবং প্রাণে বেঁচে যান। জ্ঞান ফিরলেই রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে দৌড়ে এসে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি বাধ্য হয়ে দেব-দেবীর প্রশংসা করে ফেলেছি, কিন্তু আমার অন্তর ঈমানের উপর ছিল। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা আয়াত অবতীর্ণ করেন-

من كفر بالله من بعد إيمانه إلا من أكره وقلبه مطمئن بالإيمان ولكن من شرح بالكفر صدرا فعليهم غضب من الله ولهم عذاب عظيم

অর্থঃ যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয়; তবে যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে, সে ব্যতীত... তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।

(সুরা নাহল : ১০৬, তাফসির তাবারী)

মসজিদে নববী তৈরি করার রাসুলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন-

ويح عمار تقتله الفئة الباغية يدعوهم إلى الجنة ويدعونه إلى النار

অর্থঃ আফসোস আম্মারের জন্য! তাকে বিদ্রোহীরা হত্যা করবে। সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে। তারা তাকে আহ্বান করবে জাহান্নামের দিকে।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুস সালাত, ৪৩৬)

আম্মার (রা.)-এর শাহাদতের পরপরই যুদ্ধ স্থিমিত হয়ে যায়। তাঁর শাহাদতের হাদিসটি সবার জানা ছিল। আলী (রা.) আম্মার (রা.)-এর দেহ কোলে তুলে নিয়ে হাদিসটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। সারা যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে গুঞ্জন শুরু হয়, মু'আবিয়ার দল বিদ্রোহী বলে প্রমাণিত হয়েছে। মু'আবিয়া (রা.)-এর এ কানে সংবাদ গেলে তিনি বলেন, আমরা নই; যারা আম্মারকে যুদ্ধে নিয়ে এসেছে তাঁরাই তাঁর হত্যার কারণ!

অনুমিতভাবেই পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি এ ব্যাখ্যাকে গ্রহন করেননি। আল্লামা ইবনে কাছীর বলেছেন- هذا تأويل بعيد

অর্থঃ এটি বহু-দূরবর্তী ব্যাখ্যা!

এমনকি মু'আবিয়া (রা.)-এর ব্যাখ্যা শুনে আলী (রা.) বলেছিলেন, তাহলে তো ধরে নিতে হবে, মুহাম্মদ (সা.) হামযা (রা.)-কে হত্যা করেছিলেন! কারণ তিনিই তাঁকে উহুদ যুদ্ধে নিয়ে এসেছিলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, ইরাক ও শামবাসীর মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধ; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৩৭ হিজরির ঘটনাবলী ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরের শাহাদত)

যুদ্ধক্ষেত্র যখন ইতস্তত তখন মু'আবিয়া (রা.)-এর দলের কিছু লোক বর্শার উপর কুরআন শরীফ গেঁথে উপরে তুলে ধরেন। তাদের কৌশলে কাজ দেয়। উভয় দল অস্ত্র ফেলে দিয়ে মীমাংসার সিদ্ধান্ত নেন। আলী (রা.) প্রথমে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর দলের কিছু উগ্র সদস্য, যারা কুররা নামে পরিচিত ছিল, এ সিদ্ধান্তে প্রচণ্ড বাধা প্রদান করল। পরে আলী (রা.)-এর পক্ষে আবু মুসা আল-আশ'আরী (রা.) এবং মু'আবিয়া (রা.)-এর পক্ষে আমর ইবনুল আস (রা.) সালিস নিযুক্ত হন। সালিসের নিমিত্তে কৃত সন্ধিপত্র লিখতে গিয়ে আরেকটি বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়। পরে আলী (রা.)-এর বদান্যতায় বিষয়টি সমাধা হয়েছিল।

সালিসের মূল সিদ্ধান্ত ছিল- যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং পুনরায় দু'দল যুদ্ধে জড়াবেনা। তাই হল। আলী (রা.) এবং মু'আবিয়া (রা.) আর কখনো যুদ্ধে জড়াননি। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) কখনো আলী (রা.)-এর হাতে খেলাফতের বাই'আত জ্ঞাপন করেননি। তবে যতদিন আলী (রা.) জীবিত ছিলেন ততদিন মু'আবিয়া (রা.) নিজেকে খলিফা দাবী করেননি, আলী (রা.)-কে অবৈধ খলিফাও বলেননি। তিনি তাঁর সিরিয়া নিয়েই শান্ত ছিলেন। আর ইতিহাস আলী (রা.)-এর উপর এরচেয়ে তিনগুণ বড় আরেকটি পরীক্ষা নিয়ে আপতিত হয়েছিল। এ পরীক্ষাটি ছিল الفتنة الخوارج বা খারেজি ফিতনা।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, সালিসের ঘটনা)

সিফফিনের যুদ্ধ উষ্টীর যুদ্ধের ন্যায় আকস্মিক কিংবা তৃতীয়পক্ষের ষড়যন্ত্রের ফলে সংঘটিত দুর্ঘটনা ছিলনা; বরং পুরোমাত্রায় একটি রাজনৈতিক সংঘাত ছিল- এ সত্যটি মেনে নিয়েই আমাদেরকে উভয় দলের অবস্থানগত পার্থক্য ব্যাখ্যা কর‍তে হবে। যথা-

১. এ যুদ্ধটি একটি রাজনৈতিক সংঘাত ছিল; আকীদা তথা বিশ্বাসগত বিরোধ নয়। সুতরাং এখানে হক-বাতিলের প্রশ্ন আসবেনা। প্রশ্ন আসবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগত যথার্থতার।

২. যে ক'টি কারণ সরাসরি এ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের উৎস ছিল বলে আমরা মনে করি, তা হল-

ক. খলিফা উসমান (রা.)-এর নির্মম শাহাদত। এ হত্যাকাণ্ডটি খেলাফতের সুদৃঢ় ও প্রশ্নাতীত অবস্থানকে শেকড়সহ নাড়িয়ে দিয়েছিল। কেবল সিফফিন নয়; তৎপরবর্তী প্রতিটি সংঘাতের অন্তত একটি উৎস উসমান-হত্যার সাথে জড়িয়ে ছিল।

খ. সাহাবিরা অনবরত উসমান-হত্যার বিচার দাবী করে আসছিলেন এবং তাঁদের দাবী শতভাগ যৌক্তিক ছিল। মুসলিম বিশ্বের খলিফাকে খুন করে খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, তা মেনে নেয়া যায়না। অপরদিকে পরিস্থিতি এতো অনুকূলে ছিলনা যে, আলী (রা.) উসমান-হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচার করা করবেন। একেতো হত্যার প্রারম্ভে সংঘটিত বিদ্রোহে হাজারখানেক লোক অংশ নিয়েছিল এবং হত্যার পরপরই তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। এদের মধ্য থেকে প্রকৃত অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করা নিতান্তই অসম্ভব ছিল। তাছাড়া বিদ্রোহীরা মিশর ও ইরাকে নিজেদেরকে যথেষ্ট শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আগুপিছু না ভেবে তৎক্ষণাৎ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ ছিল মুসলিম উম্মাহ'র জন্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনা। তাই আলী (রা.) খেলাফতকে গুছানোর জন্য কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নিরবতা সাহাবিদের মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল।

গ. বিদ্রোহীদের একাংশ কৌশলে খলিফা আলী (রা.)-এর দলে প্রবেশ করে বসেছিল। পরিস্থিতি ও সক্ষমতা অনুকূলে না থাকায় আলী (রা.) তাদেরকে খুঁজে বের করে তাড়িয়ে দিতে অসমর্থ ছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ আলী (রা.)-এর রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিলেন।

ঘ. খলিফা নির্বাচিত হয়েই গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোর গভর্নর পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি আলী (রা.)-এর জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ, বেশিরভাগ গভর্নর ছিলেন বনু উমাইয়া বংশোদ্ভূত। তাঁরা এ পরিবর্তনকে বহুপুরোনো হাশেমী-উমাইয়া গোত্রদ্বয়ের অন্তঃকলহের ফলাফল মনে করেছিলেন। খলিফার পরামর্শদাতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁকে এমনটি করতে মানা করেছিলেন। কিন্তু আলী (রা.) নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

খেলাফত থেকে কারবালা - ৪

(একত্রিত এবং সংযোজিত)

ঙ. অন্যান্য প্রদেশের গভর্নর পরিবর্তন ততটুকু সমস্যা সৃষ্টি করেনি, যতটুকু সমস্যা সৃষ্টি করেছিল সিরিয়ার গভর্নর পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর সময় থেকেই মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) ছিলেন সিরিয়ার গভর্নর। ভাল রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং সিরিয়ায় তাঁর প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। যখন আলী (রা.) সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.)-কে গভর্নর হিসেবে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, তখন মু'আবিয়া (রা.) তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মু'আবিয়া (রা.) উসমান-হত্যার বিচারের দাবীতে আলী (রা.)-এর হাতে বাই'আত পর্যন্ত দেননি। সিরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশকে খলিফার কর্তৃত্বের বাইরে রেখে খেলাফত পরিচালনা করা আলী (রা.)-এর জন্য অসম্ভব ছিল। তাই তিনি মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে বিরোধ নিরসনে সিফফিনে গমন করেছিলেন।

চ. সিফফিনে অবস্থান করে দীর্ঘ দু'মাস আলী (রা.) প্রতিনিধি পাঠিয়ে মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে বিবাদ মীমাংসার সর্বাত্মক এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরিয়াবাসী এতো আন্তরিক ছিলেন না। তাঁরা খলিফার প্রতিটি পদক্ষেপকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। এরপর আলী (রা.) অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

উপরোক্ত কারণসমূহ সিফফিনের যুদ্ধকে মাঠে নামিয়েছিল।

৩. খলিফা হিসেবে সিফফিনে আলী (রা.)-এর গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ শতভাগ যৌক্তিক ছিল। মু'আবিয়া (রা.) যে অবস্থান গ্রহন করেছিলেন, তা খলিফার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহের নামান্তর। যদি সিফফিনে সংঘটিত সংঘাতকে রাজনৈতিক অবস্থান ও সিদ্ধান্তগত ভুল বলে ধরে নেই, তবে সে ভুলটি আলী (রা.)-এর পক্ষ থেকে হয়নি। হয়েছিল সিরিয়াবাসীর পক্ষ থেকে।

৪. আম্মার (রা.)-এর শাহাদত সংক্রান্ত হাদিসে "সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করবে। তারা তাকে আহ্বান করবে জাহান্নামের দিকে"-এ কথাটির ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ "ফাতহুল বারী" কিতাবে বলেছেন, সিফফিন যুদ্ধে উভয় দলই নিজেদেরকে হক ভেবে ইজতিহাদ (চিন্তা-গবেষণা) করেছিলেন। আর ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ত্রুটি হওয়া কোন অপরাধ নয়। এখানে "জান্নাতের দিকে আহ্বান" দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জান্নাত প্রাপ্তির কারণের দিকে আহ্বান। আর, জান্নাত প্রাপ্তির কারণ হচ্ছে নেতার আনুগত্য। সিফফিনে আলী (রা.) বৈধ নেতা (খলিফা) ছিলেন এবং তাঁর আনুগত্য করা ওয়াজিব ছিল। আম্মার (রা.) বিপক্ষদলকে খলিফার আনুগত্যের দিকে আহ্বান করেছিলেন। অপরদিকে মু'আবিয়া (রা.)-এর দল যেহেতু নিজেদেরকে সঠিক বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাই তাঁরা আম্মার (রা.)-কে তাঁদের দিকেই আহ্বান করেছেন। অর্থাৎ উভয় দলই নিজেদেরকে সত্য মনে করে করেছিলেন বলেই নিজেদের কাছে উদ্ভাসিত ব্যাখ্যা গ্রহন করেছিলেন।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর ব্যাখ্যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদিসে উল্লেখিত يدعونه إلى النار তথা "জাহান্নামের দিকে আহ্বান করবে" দ্বারা يدعونه الي الكفر তথা "কুফরের দিকে আহ্বান করবে" উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা নেতার বিরূদ্ধাচরণ উদ্দেশ্য। আর যেহেতু মু'আবিয়া (রা.) নিজেকে সত্য ভেবে ইজতিহাদ করেছিলেন, সুতরাং ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ত্রুটি হওয়ার দরূন তাঁকে না-হক বা বাতিল বলা যায়না।

৫. মু'আবিয়া (রা.)-এর ব্যাপারে কোনরূপ কটুক্তি করা আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের আকীদা বহির্ভূত। কারণ তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে আমরা সমর্থন করতে পারিনা সত্য; কিন্তু তাঁর ঈমান, নিয়ত কিংবা ইসলামের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করার নামান্তর।

৬. আমরা আগেই উল্লেখ করে এসেছি যে, প্রত্যেক সাহাবি সমমর্যাদার নন। ইসলাম গ্রহন ও দ্বীনের পথে ত্যাগ-তিতিক্ষার তারতম্যের ফলে সাহাবিদের মধ্যে অবস্থানের তারতম্য ঘটে। মু'আবিয়া (রা.) মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। আর, আলী (রা.) প্রথম দু'জন মুসলমানের অন্যতম। মর্যাদার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আলী (রা.)-এর মর্যাদা আমাদের কাছে সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে এ কথাটিও জেনে রাখা প্রয়োজন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মু'আবিয়া (রা.)-এর জন্য দু'আ করেছিলেন-

اللهم اجعله هاديا مهديا

অর্থঃ আল্লাহ, তুমি তাকে সুপথপ্রাপ্ত এবং সুপথ-প্রদর্শক বানিয়ে দাও।

(মিশকাতুল মাসাবীহ : কিতাবুল মানাকিব ওয়াল-ফাদ্বায়িল, ৬২৪৪)

তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) মু'আবিয়া (রা.)-কে ওহী-লেখক নিযুক্ত করেছিলেন। যদিও তিনি (সা.) জানতেন যে, একদিন সিফফিন সংঘটিত হবে। তিনি (সা.) এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন। যদি মু'আবিয়া (রা.)-এর নিয়তের উপর সন্দেহ থাকত, তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) কি তাঁকে ওহী-লেখকের মতো সংবেদনশীল দায়িত্বে নিয়োজিত করতেন? তাতে কি আল্লাহর কালামের অকাট্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ত না? সুতরাং ইজতিহাদি ভুলের জন্য মু'আবিয়া (রা.) দোষী সাব্যস্ত হননা।

৭. যারা মু'আবিয়া (রা.)-এর উপর কুফরের অপবাদ দেন, তাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, দুটি মুসলিম দল একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তাঁরা কাফির হয়ে যায়না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে-

وإن طائفتان من المؤمنين اقتتلوا فأصلحوا بينهما فإن بغت إحداهما على الأخرى فقاتلوا التي تبغي حتى تفيء إلى أمر الله فإن فاءت فأصلحوا بينهما بالعدل وأقسطوا إن الله يحب المقسطين إنما المؤمنون إخوة فأصلحوا بين أخويكم واتقوا الله لعلكم ترحمون

অর্থঃ যদি মু'মিনদের দুটি দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। মু'মিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।

(সুরা হুজুরাত : ৯-১০)

এ আয়াত আমাদেরকে দুটি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনিত করে।

১. খলিফা আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারণে মু'আবিয়া (রা.) কাফির হয়ে যাননি।

২. আমিরুল মু'মিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ছিলেন উক্ত আয়াতের ব্যবহারিক তাফসির (Practical Exegeses)। তিনি সিফফিনে হুবহু তাই করেছিলেন, যা আল্লাহর আয়াত তাঁকে নির্দেশ করেছিল।

আমাদের গবেষণায় আমরা উপরোক্ত ফলাফলে উপনিত হয়েছি। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

আলী (রা.)-এর দলভুক্ত কুররা (অধিক তিলাওয়াতকারী) সম্প্রদায় খলিফাকে সালিসে যাওয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, সালিসের সিদ্ধান্ত সরাসরি মু'আবিয়া (রা.)-এর বিপক্ষে যাবে। কিন্তু দুমাতুল জান্দাল নামক স্থানে অনুষ্ঠিত সালিসের সিদ্ধান্ত যখন অনেকটাই মু'আবিয়া (রা.)-এর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, তখন এ মীমাংসায় নাখুশ হয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহব আর-রাসিবীর নেতৃত্বে ৬ হাজার লোক খলিফা আলী (রা.)-এর দল ত্যাগ করে হারুরা নামক অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। ইতিহাসে তারা খারেজি ও হারুরী নামে পরিচিত। তবে তারা নিজেদেরকে شراء বা বিক্রিত (Sold out) বলে পরিচয় দেন। তাদের বিশ্বাস, তারা আল্লাহর হুকুম ও সন্তুষ্টির কাছে নিজেদের জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছেন।

(কিতাবুল খাওয়ারিজ : হাইছাম ইবনে আদী)

খারেজিরা নিম্নুক্ত আয়াতকে নিজেদের দিকে সম্বন্ধিত করেন-

ومن الناس من يشري نفسه ابتغاء مرضاة الله والله رءوف بالعباد

অর্থঃ কিছু মানুষ আছে এমন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে বিক্রি করে দেয়। আর আল্লাহ তাঁর (এসব) বান্দাদের প্রতি মেহেরবান।

(সুরা বাকারা : ২০৭)

কার্যকরীভাবে খারেজি ফিতনা সিফফিন যুদ্ধের সালিসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এর বীজ প্রোথিত হয়েছিল অনেক আগে। যুদ্ধ বা মীমাংসার ফলস্রুতিতে নয়; খারেজিরা পৃথিবীতে তাদের বীজ ছড়িয়েছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শানে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করার মাধ্যমে।

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হুনায়েন যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন গনিমত বন্টন করছিলেন, তখন যুল-খুয়াইসারা তামিমী নামক দক্ষিণ আরবের এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ায় এবং আল্লাহর নবী (সা.)-এর দিকে আঙুল তুলে বলে-

يا محمد اعدل

অর্থঃ হে মুহাম্মদ! বন্টনে ন্যায়পরায়ণ হও।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন-

ويلك ومن يعدل إذا لم أكن أعدل

অর্থঃ ধ্বংস হও! আমি ন্যায়পরায়ণ না হলে, কে ন্যায়পরায়ণ হবে? তৎক্ষণাৎ উমর (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই মুনাফিকের ঘাড় নামিয়ে দেয়ার হুকুম দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন- তাকে যেতে দাও। আমি চাইনা মানুষ বলাবলি করুক, মুহাম্মদ (সা.) নিজের লোককে হত্যা করেছেন। যুল-খুয়াইসারা পেছন মোড়ে চলে যেতে লাগল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখিয়ে বললেন-

إن هذا وأصحابه يقرءون القرآن لا يجاوز حناجرهم يمرقون منه كما يمرق السهم من الرمية

অর্থঃ সে এবং তার অনুসারীরা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু কুরআন তাদের গণ্ডদেশের নিচে প্রবিষ্ট হবেনা। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুয যাকাত, ১০৬৩)

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

دعه فإن له أصحابا يحقر أحدكم صلاته مع صلاتهم وصيامه مع صيامهم يقرءون القرآن لا يجاوز تراقيهم يمرقون من الدين كما يمرق السهم من الرمية

অর্থঃ তাকে যেতে দাও। তার অনুসারীদের নামাজের কাছে তোমরা (সাহাবিরা) তোমাদের নামাজকে কম মনে করবে। তাদের রোজার কাছে তোমাদের রোজাকে কম মনে করবে। তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের গণ্ডদেশের নিচে প্রবিষ্ট হবেনা। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর শিকার ছিড়ে বেরিয়ে যায়।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল মানাকিব, ৩৪১৪)

এটিই ছিল খারেজি ফিতনার সূচনা। সাহাবিদের ভাষ্যনুযায়ী যুল-খুয়াইসারা তামিমী ছিল মাথা মুণ্ডিত, ঘন দাড়ি বিশিষ্ট এবং পায়ের গোছার উপর কাপড় পরিহিত। তার চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছিল উগ্রপন্থা। একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এ লোকটি ইসলামের প্রথম নার্সিসিস্ট বা আত্মশ্লাঘায় বিমোহিত ব্যক্তি ছিল। তার বাহ্যিক পরহেজগারিতা তাকে এ বোধ দিয়েছিল যে, সে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকেও অধিক ন্যায়পরায়ণ। খারেজিদের আচার-আচারণ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যে ক'টি ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, প্রতিটিতে তাদের বাহ্যিক পরহেজগারিতা, সংযমের আতিশয্য ও ইবাদতের প্রাচুর্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সেই সাথে বলা হয়েছে, তারা ইসলামকে ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে। যুল-খুয়াইসারার চিন্তাধারা ও আচরণের প্রতিটি সুক্ষ উপাদান ছিল ইসলামি আইন ও শিষ্টাচারের সরাসরি বিপরীত। এজন্য খারেজি ফিতনা বুঝতে হলে প্রথমে যুল-খুয়াইসারার চিন্তাধারাকে তলিয়ে দেখা আবশ্যক। যুল-খুয়াইসারার কথার পেছনে তার পুরো মনোভাব স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছিল। তার আচরণের ত্রুটিসমূহ নিম্নরূপ-

১. সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নাম ধরে সম্বোধন করেছিল। ইসলামি শিষ্টাচারে এটি কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। কোন মুসলমানের অধিকার নেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মধ্যম পুরুষ (Second person) হিসেবে নাম ধরে সম্বোধন করার। এমনকি আত্মীয়তার নাম ধরেও না। আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন-

لأ تجعلوا دعاء الرسول بينكم كدعاء بعضكم بعضا

অর্থঃ রাসুলকে আহ্বান করাকে তোমাদের একে অপরকে আহ্বান করার মতো গণ্য করোনা।

(সুরা নুর : ৬৩)

সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করার সময় বলতেন-

فداك ابي وامي يا رسول الله

অর্থঃ আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক, ইয়া রাসুলাল্লাহ!

এরপর যা প্রশ্ন করার তা করতেন।

২. যুল-খুয়াইসারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ন্যায়পরায়ণ হতে বলেছিল। আর স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর রাসুল (রা.)-এর চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়েছেন-

انك لعلي خلق عظيم

অর্থঃ অবশ্যই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।

(সুরা কলম : ৪)

৩. এক বর্ণনায় রয়েছে, যুল-খুয়াইসারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেছিল-

اتق الله

অর্থঃ আল্লাহকে ভয় করুন।

এটিও চরম ধৃষ্টতা। যিনি আমাদেরকে তাকওয়ার নাম-পরিচয় শিখিয়েছেন, তাঁকেই যুল-খুয়াইসারা তাকওয়া বা পরহেজগারিতা অবলম্বন করতে বলছে! এটি কুফরের সমতূল্য অপরাধ।

৪. সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে পেছন মোড়ে চলে গিয়েছিল। এটিও ইসলামি শিষ্টাচারের বিপরীত। সাহাবায়ে কেরাম কখনোও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে পেছন ফিরে উঠাবসা, চলাফেরা করতেন না।

৫. সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বন্টনে আপত্তি তুলেছিল। ওদিকে কুরআন আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে-

ما آتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا

অর্থঃ রাসুল যা দেন তা গ্রহন করো, আর যা নিষেধ করেন তা পরিত্যাগ করো।

(সুরা হাশর : ৭)

৬. যুল-খুয়াইসারা ভেবেছিল, সে তাকওয়া ও ন্যায়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে অগ্রগামী। এজন্য সে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং আপত্তি আরোপ করেছিল। ওদিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন-

يا ايها الذين امنوا لأ تقدموا بين يدي الله ورسوله

অর্থঃ মু'মিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের সামনে অগ্রণী হয়োনা।

(সুরা হুজুরাত : ১)

ধর্মীয় বিষয় তো দুরের কথা; পার্থিব বিষয়েও কোন ঈমানদারের জন্য বৈধ নয় যে, সে কোন ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে অগ্রণী হবে। মোটকথা, যুল-খুয়াইসারা যদিও খারেজি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা নয়; কিন্তু তার চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করেই খারেজি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহব আর-রাসিবীর নেতৃত্বে খারেজিরা যখন আলী (রা.)-এর দল ত্যাগ করে হারুরা এলাকায় চলে গিয়েছিল, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) খলিফা আলী (রা.)-কে বললেন, আমাকে একবার গিয়ে এদের সাথে কথা বলার অনুমতি দিন। খলিফা তাঁকে মানা করলেন। বললেন, তারা তোমার ক্ষতি করতে পারে। ইবনে আব্বাস (রা.) খলিফাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালেন। বললেন, আমি কেবল কথা বলতে যাচ্ছি। কোন সমস্যা হবেনা। অগত্যা আলী (রা.) তাঁকে অনুমতি দিলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

ইতিহাস আমাদেরকে জানায়, বনু হাশিম গোত্র "শিয়াবে আবু তালিব" নামক গিরিখাদে অবরুদ্ধ থাকাকালীন একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তঃসত্ত্বা চাচী লুবাবা হেটে যাচ্ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ডাক দিয়ে বললেন, "উম্মুল ফযল! তোমার পেটের সন্তান জন্ম নিলে আমার কাছে নিয়ে এসো।" হিজরতের তিন বছর পূর্বে শিয়াবে আবু তালিবে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ও লুবাবা বিনতে হারিসের ঘরে জন্ম নিলেন এক ছেলেসন্তান। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তাঁকে নিয়ে আসা হলে তিনি (সা.) একটু খেজুর চিবিয়ে শিশুর মুখে দিলেন এবং তাঁর জন্য দু'আ করলেন। সেদিনের সেই শিশুই হচ্ছেন উম্মতের পণ্ডিত, কুরআনের অনুবাদক, কুরআন-ব্যাখ্যার পথপ্রদর্শক, জ্ঞানের সিন্ধু, মুসলমানদের আইনজ্ঞ সায়্যিদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম স্ত্রী মায়মুনা বিনতে হারিস (রা.) ছিলেন ইবনে আব্বাসের খালা। তিনি প্রায় রাতে খালার ঘরে চলে যেতেন। উদ্দেশ্য, রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে কিভাবে ইবাদত করেন তা দেখবেন এবং শিখবেন। একরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাথরুম থেকে এসে দেখেন, সামনে ওজুর পানি রাখা। জিজ্ঞেস করলেন, কে রেখেছে? জানানো হল, আব্দুল্লাহ রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন রেখেছ? তিনি জবাব দিলেন, আমি দেখি আপনি বাথরুম থেকে এসেই ওজুর পানি খুঁজেন। তাই আজ পানি এনে রেখেছি, যেন খুঁজতে না হয়। আল্লাহর নবী (সা.) যারপরনাই খুশি হলেন এবং ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বুকে জড়িয়ে ধরে দু'আ করলেন। ইমাম ইকরিমা বর্ণনা করেছেন-

عن ابن عباس قال ضمني رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال اللهم علمه الكتاب

অর্থঃ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, আল্লাহ! তাকে কুরআন শিখিয়ে দাও।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ইলম, ৭৫)

আরেকটি সূত্রে, দু'আটি ছিল এরূপ-

اللهم فقهه في الدين وعلمه التأويل

অর্থঃ হে আল্লাহ! তাকে দ্বীনের গভির জ্ঞান দান করো এবং কুরআনের ব্যাখ্যা শিখিয়ে দাও।

(মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ৩/৫৩৪)

আল্লাহর নবী (সা.)-এর দু'আ এমনভাবে কবুল হয়েছিল যে, আজ পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মাদির হৃদয়জুড়ে কুরআনের ব্যাখ্যা মানেই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)।

হারুরায় যাওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর সবচেয়ে সুন্দর জুব্বাটি পরিধান করলেন এবং দুপুরের দিকে হারুরায় উপস্থিত হলেন। যেহেত তিনি ইবনে আব্বাস, অতএব তাঁর প্রতিটি কাজে মেধার ঝলক থাকতেই হবে! ভাল কাপড় পরলেন, কারণ বিতর্কে নিজেকে উত্তমরূপে উপস্থাপন করাও একধরণের কৌশল। একজন ছন্নছাড়া মানুষের চেয়ে একজন পরিপাটি মানুষ অনেক বেশি গ্রহনযোগ্য। দুপুরকে বেছে নিলেন, কারণ এসময় মানুষ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং খারেজিরা উত্তেজিত হলেও দুপুরের গরমে তাদের এতো তেজ থাকবেনা যে হাতাহাতির পর্যায়ে নেমে আসে। তিনি গিয়ে দেখলেন, ভর দুপুরেও খারেজিদের তাবু থেকে মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় তিলাওয়াতের শব্দ আসছে। স্মরণে আসল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী- "তাদের ইবাদতের কাছে তোমরা তোমাদের ইবাদতকে কম মনে করবে।" ইবনে আব্বাস (রা.) দেখলেন, খারেজিদের মাথা মুণ্ডিত এবং গায়ে ভেড়ার ছাল দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পোষাক। তাদের কাছে এগুলোই তাকওয়ার চিহ্ন। তাঁকে দেখে তারা বলল- রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাইকে স্বাগতম। আপনি এতো ভাল কাপড় পরেছেন কেন?

ইবনে আব্বাস (রা.) জবাব দিলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এরচেয়ে ভাল কাপড় পরতে দেখেছি। আপনারা কি জানেননা, আল্লাহ বলেছেন-

قل من حرم زينة الله التي أخرج لعباده و الطيبات من الرزق

অর্থঃ বলুন, আল্লাহ যে সাজসরঞ্জাম এবং পরিত্র খাদ্য তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, কে এগুলো হারাম করল?

(সুরা আরাফ : ৩২)

তারা জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন এসেছেন? তিনি বললেন, তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি। আমি এসেছি মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের মধ্য থেকে। তাঁদের সামনে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। তাঁরা কুরআনকে ভালভাবে বুঝতে সক্ষম। কিন্তু এখানে তাঁদের একজনকেও দেখছিনা।

তখন কিছু খারেজি বলল, তাঁর সাথে কথা বলোনা। তিনি একজন কুরাইশ। আর, কুরআনে কুরাইশদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-

بل هم قوم خصمون

অর্থঃ বস্তুত তারা খুব ঝগড়াপ্রবণ জাতি।

(সুরা যুখরুফ : ৫৮)

উল্লেখ্য, এটিই খারেজিদের বৈশিষ্ট্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তারা মুশরিক ও আহলে কিতাবের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ আয়াত মুসলমানদের জন্য ব্যবহার করবে। এখানেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মুশরিক কুরাইশদের সম্পর্কে আল্লাহ যা বলেছেন, খারেজিরা এটি সম্বন্ধিত করেছে একজন সাহাবির দিকে!

ইবনে আব্বাস (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কেন খলিফা আলী (রা.)-এত দল ত্যাগ করেছেন? তারা বলল- তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের তিনটি অভিযোগ রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, বলুন কী অভিযোগ। তারা বলল-

১. আলী (রা.) মানুষের রায় (সিফফিনের সালিস) মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন-

ان الحكم الأ لله

অর্থঃ হুকুম কেবল আল্লাহর।

(সুরা ইউসুফ : ৪০)

২. আলী (রা.) দুটি যুদ্ধ করলেন। যদি তাঁর বিপক্ষদল কাফির হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কেন যুদ্ধবন্দী গ্রহন করেননি? আর যদি তাঁরা মুসলিম হয়, তাহলে কেন যুদ্ধ করেছেন?

৩. আলী (রা.) কেন সালিসের সন্ধিপত্রে নিজের নামে আমিরুল মু'মিনীন লেখেননি? যদি তিনি আমিরুল মু'মিনীন না হন; তাহলে তো তিনি আমিরুল কাফিরীন!

ইবনে আব্বাস (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু? তারা বলল, না এগুলোই। তিনি বললেন, যদি আমি কুরআন-সুন্নাহ থেকে তোমাদের অভিযোগের জবাব দেই, তাহলে কি তোমরা ফিরে আসবে? তারা বলল- হ্যাঁ অবশ্যই।

ইবনে আব্বাস (রা.) শুরু করলেন, প্রথমে তোমরা বলেছ, আল্লাহ ছাড়া কাউকে সালিস মানা যাবেনা। এদিকে আল্লাহ নিজেই সালিস নির্ধারণের হুকুম দিয়েছেন। ইহরাম অবস্থায় শিকারের ক্ষেত্রে বলেছেন-

يا أيها الذين آمنوا لا تقتلوا الصيد وأنتم حرم ومن قتله منكم متعمدا فجزاء مثل ما قتل من النعم يحكم به ذوا عدل منكم

অর্থঃ মুমিনগণ! তোমরা ইহরাম অবস্থায় শিকার করো না। যে ইচ্ছাকৃত শিকার করবে, তার উপর শিকার করা জন্তুর সমান কাফফারা ওয়াজিব হবে। দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এর ফয়সালা করবে।

(সুরা মায়িদা : ৯৫)

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বেলায় বলেছেন-

وإن خفتم شقاق بينهما فابعثوا حكما من أهله وحكما من أهلها إن يريدا إصلاحا يوفق الله بينهما

অর্থঃ যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা করো, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রী পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা মীমাংসা চাইলে আল্লাহ তাদেরকে এক করে দেবেন।

(সুরা নিসা : ৩৫)

এবার বলো, যদি সালিস হারাম হতো, তবে খোদ আল্লাহ সালিসের নির্দেশ দিতেন? বলো, একটি জন্তুর প্রাণের চেয়ে হাজারো মুসলমানের প্রাণের মূল্য কি বেশি নয়? একটি সংসার বাঁচানোর চেয়ে মুসলিম উম্মাহ'র ভ্রাতৃত্ব রক্ষা কি অধিক জরুরি নয়? যদি ঐসব বিষয়ে মানুষের সালিস বৈধ হয়ে থাকে, তবে এখানে কেন অবৈধ হবে? খারেজিরা মাথা চুলকাতে লাগল। ইবনে আব্বাস (রা.) আগে বাড়লেন। দ্বিতীয়ত বলেছ, আলী (রা.) কেন যুদ্ধবন্দী তথা "মিলকে ইয়ামিন" গ্রহন করেননি? বলো, তোমাদের কার সাহস আছে যে, তোমাদের মা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে মিলকে ইয়ামিন হিসেবে গ্রহন করবে? কারণ মিলকে ইয়ামিনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। যদি এ ধরণের চিন্তাও তোমাদের মনে এসে থাকে, তবে তোমরা ঈমানহারা হয়েছ। কারণ তিনি নবীর স্ত্রী, তিনি মু'মিনদের মা। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

النبي أولى بالمؤمنين من أنفسهم وأزواجه أمهاتهم

অর্থঃ নবী মু'মিনদের জন্য তাদের প্রাণাধিক প্রিয় এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা।

(সুরা আহযাব : ৬)

আর যদি ভাবো, বিপক্ষদল মুসলিম হলে আলী (রা.) কিভাবে যুদ্ধ করলেন, তবে আল্লাহ বলছেন-

وإن طائفتان من المؤمنين اقتتلوا فأصلحوا بينهما

অর্থঃ যদি মু'মিনদের দুটি দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।

(সুরা হুজুরাত : ৯)

সুতরাং মু'মিনরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেই তাঁরা কাফির হয়ে যায়না। খারেজিরা হা করে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) আগে বাড়লেন। তৃতীয়ত বলেছ, আলী (রা.) কেন আমিরুল মু'মিনীন কেটে ফেলেছিলেন? তোমরা কি জানোনা, হুদায়বিয়ার সন্ধিতে খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.) "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" কেটে "মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ" লিখতে বলেছিলেন? তিনি (সা.) বলেছিলেন, আল্লাহ জানেন আমি তাঁর রাসুল। এবার বলো, যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) কাফিরদের সাথে সন্ধি করার জন্য আল্লাহর দেয়া খেতাব ত্যাগ করতে পারেন, তবে মুসলিমদের মধ্যে সন্ধি করার জন্য আলী (রা.) মানুষের দেয়া খেতাব ত্যাগ করতে পারেন না? আলী কি নবী থেকে শ্রেষ্ঠ? ততক্ষণে খারেজিদের মুখের রঙ পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এতো কুরআন পড়েও এগুলো তাদের মাথায় আসেনি! হুবহু যেভাবে বলেছিলেন আল্লাহর নবী (সা.)- "তারা কুরআন পড়বে কিন্তু কুরআন তাদের গলার নিচে প্রবেশ করবেনা।"

(মুসান্নাফ : ইমাম আব্দুর রাযযাক, ১৮৬৭৮; সুনানে কুবরা : ইমাম নাসায়ী, ৮৫২২; মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ২৭০৩)

ইতিহাস বলে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হারুরায় গিয়েছিলেন একা। যখন তিনি ফিরে আসলেন, তখন তাঁর সাথে এক তৃতীয়াংশের বেশি খারেজি হারুরা ত্যাগ করে মুসলমানদের জামা'আতে ফিরে আসল। এজন্যই তিনি ইবনে আব্বাস, মুসলিম উম্মাহ'র গর্ব।

খলিফা আলী (রা.) যখন আবু মুসা আল-আশ'আরী (রা.)-কে সালিসের জন্য দুমাতুল জান্দালে প্রেরণ করেছিলেন, তখন থেকেই খারেজিরা মাত্রাতিরিক্ত উৎপাত শুরু করেছিল। একপর্যায়ে তারা কুফার গ্রান্ড মসজিদে আসল এবং খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি কালিমা পড়ে আবার মুসলমান হোন। কারণ মানুষের রায় মেনে নিয়ে আপনি কাফির হয়ে গেছেন! আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-

ان الحكم الأ لله

অর্থঃ হুকুম কেবল আল্লাহর জন্য।

(সুরা ইউসুফ : ৪০)

আলী (রা.) তাদেরক কথা শুনে বললেন-

كلمة حق اريد بها باطل

অর্থঃ কথাটি সত্য। কিন্তু এর দ্বারা তারা যা উদ্দেশ্য করছে, তা ভ্রান্ত।

খারেজিরা বলল, আমরা কেবল কুরআনের রায় মানবো। আলী (রা.) একটি মাছহাফ নিয়ে আসতে বললেন। মাছহাফ তাদের সামনে রেখে বললেন, হে কুরআন, কথা বলো! উপস্থিতি লোকেরা বলল, আপনি একি করছেন? মাছহাফ কিভাবে কথা বলবে? আলী (রা.) বললেন, এরা যা বলছে, তার অর্থ তো এটিই দাঁড়ায়!

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, খারেজি ফিতনার উদ্ভব ও খারেজিদের কুফা ত্যাগ)

খলিফার দলের অনেকেই খারেজিদেরকে কাফির ঘোষণা করার জন্য খলিফাকে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আলী (রা.) বারবার একটিই কথা বললেন, যা তিনি জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে বিপক্ষদল সম্বন্ধে বলে এসেছিলেন। খলিফা বললেন-

اخوننا بغوا علينا

অর্থঃ এরা আমাদের ভাই। আমাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেছে।

(মুসান্নাফ : ইমাম ইবনে আবি শাইবাহ, ৫৬২৪)

আলী (রা.) খারেজিদেরকে মুসলিম এলাকায় বসবাসের সুযোগ দিয়েছিলেন, একই মসজিদে নামাজের অনুমতি দিয়েছিলেন, ফাঈ থেকে প্রাপ্য অংশও তাদেরকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা খলিফার বদান্যতাকে দুর্বলতা ভেবে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব আর-রাসিবীকে নিজেদের খলিফা ঘোষণা করে বিভিন্ন এলাকা থেকে সদস্য সংগ্রহ করল। এরপর অর্থ সংগ্রহে লুঠতরাজ করতে শুরু করল। তাদের স্লোগান ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। নও-মুসলিমরা যখন শুনত "আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবেনা" তখন ভাবত, এরচেয়ে উত্তম কথা আর কী হতে পারে? দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকায় নির্বোধ লোকরা খারেজিদের সাথে যোগ দিত। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন-

سيكون في أمتي اختلاف وفرقة، قوم يحسنون القيل ويسيئون الفعل

অর্থঃ আমার উম্মতের মধ্যে মতপার্থক্য ও দলাদলির সৃষ্টি হবে। একটি দল এমন হবে, যারা কথার দিক থেকে অতি উত্তম এবং কাজের দিক থেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।

(মিশকাতুল মাসাবীহ : কিতাবুদ দিয়াত, ৩৫৪৩)

একবার খারেজিরা একটি কাফেলা আক্রমণ করল, যাতে সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব (রা.) ছিলেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে তারা তাঁকে বলল, আমাদেরকে হাদিস শুনিয়ে যান। তিনি তাদেরকে একটি হাদিস শুনালেন, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি দল কর্তৃক ফিতনা ছড়ানোর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। খারেজিরা ভাবল তিনি তাদেরকে ইঙ্গিত করে হাদিসটি বলেছেন। তারা আব্দুল্লাহ (রা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আবু বকর ও উমর সম্বন্ধে তোমার মতামত কী? তিনি বললেন, অতি উত্তম। তারা বলল, উসমান? তিনি বললেন, অতি উত্তম। তারা জিজ্ঞেস করল, আলী? তিনি বললেন, তিনি আমিরুল মু'মিনীন। তোমাদের চেয়ে জ্ঞান ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অনেক অগ্রগামী। খারেজিরা আব্দুল্লাহ (রা.)-কে বন্দী করে তাদের ঢেরায় নিয়ে গেল। প্রতিমধ্যে তাদের একজন একটি খেজুর পড়ে থাকতে দেখে উঠিয়ে মুখে দিল। বাকিরা চিৎকার করে উঠল- "আল্লাহকে ভয় করো। তুমি কি মালিকের অনুমতি নিয়েছ?"

আরো কিছুদুর যাওয়ার পর আরেকজন একটি শূকর দেখে সেটিকে হত্যা করে ফেলল। বাকিরা আবারো চিৎকার দিল- "আল্লাহকে ভয় করো। তুমি এর মালিক নও।"

আব্দুল্লাহ (রা.) অবাক হয়ে বললেন, তোমরা যদি এতো মুত্তাকী হয়ে থাকো তবে আমার সাথে এই আচরণ করছ কেন? খারেজিরা আব্দুল্লাহ (রা.)-এর কথাকে ধৃষ্টতা মনে করল এবং তাঁকে জনসম্মুখে জবাই করে হত্যা করল। সাথে থাকা তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেট ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল। মা-বাচ্চা কেউই বাঁচল না।

মুসলিম বিশ্ব ক্রোধে ফুঁসে উঠল। এ কেমন নিষ্ঠুরতা! খলিফা বার্তা পাঠালেন, তোমরা আব্দুল্লাহ'র হত্যাকারীদের ধরে দাও। আমরা তোমাদের পুরো দলের উপর আক্রমণ করব না। তারা জবাব দিল, আমরা সবাই হত্যাকারী! যা করার করতে পারেন!

(মুসান্নাফ : ইমাম ইবনে আবি শাইবাহ; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, খারেজিদের কুফা ত্যাগ ও আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ)

খলিফা আলী (রা.) খারেজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং মুহাররাম, ৩৯ হিজরিতে খারেজিদের ঘাটি নাহরাওয়ানে রওয়ানা দিলেন। দুঃখ হয় আলী (রা.)-এর জন্য। এমন একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশে তিনি খলিফার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন তাঁকে নিজের লোকদের বিরুদ্ধেই একটির পর একটি যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল। অথচ তিনি কতো সহজ-সরল মহৎপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যেদিন হেরাগুহা থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, আলী, আমি আল্লাহর নবী। আলী (রা.) সাথেসাথেই বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর নবী।

বদর যুদ্ধের দু'মাস পর আলী (রা.) আল্লাহর নবী (সা.)-এর কাছে এসে ইতস্তত করে বলেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার প্রতি আপনার ইহসানের সীমা নেই। আজ আরেকটি ইহসান চাইতে এসেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) আগেই থেকেই জানতেন। জিবরাইল (আ.) এসে সংবাদটি দিয়ে গেছেন। তিনি দৌড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে আদরের খুকি ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আলী তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে? তোমার কি মত? ফাতিমা (রা.) লজ্জায় চুপ করে রইলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) চুপ থাকাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বাইরে এসে বললেন, আলী, মোহরানার ব্যবস্থা করো। বিয়ের পর ফাতিমা (রা.) যেদিন প্রথমবার আলী (রা.)-এর ঘরে যাচ্ছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর আদরের মেয়েকে নিজের উষ্টীর পিঠে বসিয়ে দিয়েছিলেন। সালমান ফারসি (রা.) উটের রশি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের দু'ধারে মুহাজির ও আনসার সাহাবিরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে এ মোবারক বন্ধনকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন।

সংসার জীবনে যখন ফাতিমা (রা.)-এর সাথে মনোমালিন্য হতো, আলী (রা.) তখন চুপ করে এসে মসজিদে নববীর মাটিতে শুয়ে থাকতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এসে ডাক দিতেন, ওহে মাটির পিতা! আলী (রা.) উঠে দাঁড়ালে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাঁর শরীরের মাটি ঝেড়ে দিতেন। এমন ভালবাসায় পরিপূর্ণ ছিল আলী (রা.)-এর জীবন।

নাহরাওয়ানে পৌঁছে আলী (রা.) একটি Buffer State নির্ধারণ করলেন। বললেন, যারা এখানে চলে আসবে তারা মুক্ত। অর্ধেক খারেজি অস্ত্র ফেলে নিরপেক্ষ স্থানে চলে আসল। তখনো লোকজন আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমিরুল মু'মিনীন! খারেজিরা কি মুশরিক? আলী (রা.) জবাব দিলেন, না। শিরক থেকে বাঁচার জন্যই তো তারা আলাদা হয়ে গেছে। তারা আমাদেরকে মুশরিক মনে করে। লোকেরা আবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি তারা মুনাফিক? আলী (রা.) বললেন, না। মুনাফিকদের ইবাদত খুব কম থাকে। এদের ইবাদত অনেক বেশি। আবার প্রশ্ন আসল, তাহলে তারা কী? আলী (রা.) আবার সেই বদান্যতার বাক্য উচ্চারণ করলেন-

اخوننا بغوا علينا

অর্থঃ এরা আমাদের ভাই। আমাদের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেছে।

রাসিবীর নেতৃত্বে অবশিষ্ট খারেজিরা খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলো। শেরে খোদা আলী (রা.) ও জুলফিকার হাতে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। এরপরের অধ্যায়টি খারেজিদের পতনের উপাখ্যান। নাহরাওয়ান খলিফা আলী (রা.)-কে একটি প্রশ্নাতীত বিজয়ের সারথি করে রাখল। খারেজিদের ৭-৮ জন নেতা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। বাকিরা এখানেই প্রাণের আহুতি দিয়ে জাহান্নামের পথ ধরল।

(কিতাবুল খাওয়ারিজ : আল্লামা হাইছাম ইবনে আদী; আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, আলী (রা.)-এর অভিযান)

এরপর থেকে প্রথাগত হারুরী খারেজিরা আর বৃহৎ পরিসরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। উমাইয়া-আব্বাসি শাসনামলে যেসব খারেজি বিদ্রোহ হয়েছিল, সবই ছিল হারুরী খারেজিদের ভগ্নাংশ।

খারেজিদের কিছু বৈশিষ্ট্যঃ

১. তারা গোনাহগার মুসলমানকে কাফির এবং নিজেরা ব্যতীত বাকি মুসলিম উম্মাহকে পথভ্রষ্ট ও হত্যাযোগ্য মনে করে।

২. তারা কুরআনুল কারীমকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করে এবং এক উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ আয়াত সম্পুর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করে। তাদের ব্যাখ্যা এতো উদ্ভট এবং অবাস্তব যে, অন্য পক্ষে এর ধারেকাছে যাওয়াও সম্ভব নয়।

৩. তাদের বাহ্যিক ধর্মপরায়ণতা চোখে পড়ার মতো। তাকওয়ার চিহ্নস্বরূপ তারা নিজেদেরকে পার্থিব নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করে রাখে।

৫. নিজেদের দ্বীনি জ্ঞান শূন্যের কোটায় থাকলেও তারা উম্মতের আলিমদেরকে পথভ্রষ্ট ভাবে। যেভাবে, যুল-খুয়াইসারা ভেবেছিল সে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে অধিক মুত্তাকী ও ন্যায়পরায়ণ।

৬. তারা অস্বাভাবিক দ্রুততায় নিজেদের চিন্তাধারা পাল্টে ফেলে। খারেজিরাই আলী (রা.)-কে চাপ দিয়েছিল মীমাংসায় যাওয়ার জন্য। যখন মীমাংসা তাদের মনমতো হলনা, তখন আবার বিপক্ষে চলে গেল।

৭. খারেজিদের মধ্যে বেশিদিন ঐক্য থাকেনা। কারণ প্রত্যেকে ভাবে, কেবল তার হাতেই রয়েছে ইসলাম ও কুরআনের মালিকানা। উমাইয়া-আব্বাসি যুগে খারেজিদের অন্তত ২৫-৩০টি উপদল ছিল। প্রত্যেকে একে অন্যকে কাফির ভাবত।

৮. প্রথাগত খারেজিদের মধ্যে কেবল একটি উপদলই বর্তমানে রয়ে গেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ইবাদ্বের (عبد الله بن الأباض) প্রতিষ্ঠিত ইবাদ্বী সম্প্রদায়, যাদেরকে সবচেয়ে "সভ্য" খারেজি বলে গণ্য করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।

৯. সমসাময়িক জঙ্গিদেরকে উলামায়ে কেরাম নব্য-খারেজি বলে গণ্য করেন। দৃষ্টিভঙ্গি, নির্বুদ্ধিতা ও বর্বরতায় এরা হুবহু প্রথাগত খারেজিদের উচ্ছিষ্ট।

খারেজি মতবাদ এবং তাদের চিন্তাধারায় পুষ্ট লোক উম্মতের মধ্যে তখনো ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। থাকবে তাদের উত্তম কথার আড়ালে লুকানো নিকৃষ্ট কর্ম। থাকবে পরহেজগারিতার পর্দায় ঢাকা বিবেকহীন বর্বরতা। থাকবে নিজেদের ইচ্ছেমতো আল্লাহর কিতাবকে ব্যাখ্যা করে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার হীন পায়তারা। তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে এবং তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হাদিসে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

سيخرج في آخر الزمان قوم أحداث الأسنان سفهاء الأحلام يقولون من خير قول البرية يقرءون القرآن لا يجاوز حناجرهم يمرقون من الدين كما يمرق السهم من الرمية فإذا لقيتموهم فاقتلوهم فإن في قتلهم أجرا لمن قتلهم عند الله يوم القيامة

অর্থঃ শেষ যামানায় আমার উম্মতের মধ্যে একদল লোক আসবে, যারা বয়সে তরুণ এবং বোধশক্তিতে দূর্বল। তারা কথা বলবে, যেন সৃষ্টির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কথা বলছে। তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের গণ্ডদেশের নিচে প্রবিষ্ট হবেনা। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে তীর শিকার ছিড়ে বেরিয়ে যায়। তোমরা যখন তাদের সাথে মিলিত হবে, তখন লড়াই করবে। কারণ এদের সাথে লড়াইয়ের জন্য আল্লাহ কিয়ামত দিবসে বিনিময় দেবেন।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুয যাকাত, ১০৬৬)

নাহরাওয়ান থেকে খারেজিদের পলাতক নেতারা হজের সময় মক্কা মুকাররামায় গিয়ে কা'বা শরীফের পাশে বসে সিদ্ধান্ত নিল, তারা আলী (রা.), মু'আবিয়া (রা.) এবং আমর ইবনুল আস (রা.)-কে হত্যা করবে। এ থেকেই তাদের চরিত্র এবং আদবের ধারণা পাওয়া যায়। হাতীমে কা'বার ছায়াতলে তিনজন কুখ্যাত খারেজি ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত প্রথম "আত্মঘাতী" মিশনের শপথ নিল। আত্মঘাতী এজন্য, তারা জানত যে তাদের জীবিত ফিরে আসা দূরহ হবে। ঐ তিন ব্যক্তি ছিল-

আল-বারক হাজ্জাজ ইবনে আব্দুল্লাহ তামিমী, মু'আবিয়া (রা.)-কে হত্যার জন্য।

আমর ইবনে বাকরা তামিমী, আমর ইবনুল আস (রা.)-কে হত্যার জন্য।

আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম, আলী (রা.)-কে হত্যা জন্য।

ইতিহাস আমাদেরকে জানায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর এক ব্যক্তি মদীনায় আগমন করে মু'আজ ইবনে জাবাল (রা.)-এর কাছে কুরআন শরীফ পড়া শিখেছিল। ভাল ক্বারী বলে খলিফা উমর (রা.) তাকে মিশরে কুরআন-শিক্ষক নিযুক্ত করলেন। পরহেজগার বলে পরিচিত এ ব্যক্তি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধে খলিফা আলী (রা.)-এর পক্ষে ছিল। দুমাতুল জান্দালের সালিসের পর যখন রাসিবীর হাত ধরে কয়েক হাজার লোক আলী (রা.)-এর দল ত্যাগ করব বেরিয়ে যায়, তন্মধ্যে ঐ কুরআন-শিক্ষকও ছিল। ৩৯ হিজরির যিলহজ্জ মাসে কা'বা শরীফের হাতীমে বসে ঐ কুরআন-শিক্ষক আমিরুল মু'মিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে হত্যা করার শপথ নিল! হ্যাঁ, এই ক্বারী সাহেবের নাম আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম! সাহাবিরা এই লোকটিকে তাবেয়ী বলে গণ্য করতেন। ছাত্ররা ক্বারী বলে সম্মান করত। সমাজে সে মুত্তাকী বলে পরিচিত ছিল। আর সে কিনা আমিরুল মু'মিনীন আলী (রা.)-কে হত্যা করার শপথ নিয়েছিল! বিশ্বাসভঙ্গের এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে?

৪০ হিজরির রামাদ্বান মাসের নির্ধারিত দিন ফজরের সময় দামেস্কের উমাওয়ী মসজিদে আল-বারক হাজ্জাজ তামিমী মু'আবিয়া (রা.)-কে আক্রমণ করল। মু'আবিয়া (রা.)-এর দেহরক্ষীরা সতর্ক ছিল বিধায় সামান্য একটি আঘাত ব্যতীত তাঁর গুরুতর কিছু হয়নি। মিশরের গভর্নর আমর ইবনে আস (রা.) সেদিন অসুস্থ ছিলেন বলে তাঁর জায়গায় অন্য একজনকে ফজরের নামাজে ইমামতি করতে পাঠালেন। আমর ইবনে বাকরা তামিমী এই ইমামকে আমর ইবনে আস (রা.) ভেবে আক্রমণ করল এবং হত্যা করল। কুফার গ্রান্ড মসজিদে আলী (রা.) যখন ফজরের নামাজের তাহরিমা বাঁধছেন, তখন মুসল্লিদের সারি থেকে আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম লাফিয়ে সামনে আসল এবং চিৎকার দিয়ে বলল-

الحكم لله، لأ لك ولأ لأصحابك

অর্থঃ হুকুম কেবল আল্লাহর। না তোমার, না তোমার সাথীদের।

উপস্থিত মুসল্লিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই বিষমিশ্রিত ছোরা দিয়ে ইবনে মুলজিম খলিফার বুকে এবং কাঁধে পরপর কয়েকটি প্রাণঘাতী আঘাত করল। খলিফা সাথেসাথে মাটিতে পড়ে গেলেন।

ইবনে মুলজিমকে বন্দী করা হল। খলিফাকে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসকরা বললেন, এ আঘাত সারানো অসম্ভব। আলী (রা.) ইবনে মুলজিম সম্পর্কে বললেন, আমি মারা গেলে তার থেকে কিসাস গ্রহন করবে, নইলে না। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও দৃঢ়ভাবে ৪ বছর ৯ মাসের সফল খেলাফত সম্পন্ন করে, ৪০ হিজরির ২১ রামাদ্বান, ৬৩ বছর বয়সে শাহাদতের চিহ্ন বুকে নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানালেন "নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত" খেলাফতের শেষ খলিফা, আল্লাহর সিংহ, আমিরুল মু'মিনীন সায়্যিদুনা আবুল হাসান আলী ইবনে আবি তালিব রাদ্বিআল্লাহু আনহু। ইমাম হাসান (রা.) পিতার জানাযা পড়ালেন এবং খলিফাকে কুফায় দাফন করা হল।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, আলী (রা.)-এর শাহাদত; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, আলী (রা.)-এর শাহাদত)

হাসান (রা.) যখন ইবনে মুলজিমের সামনে গেলেন, তখন সে করজোড়ে বলল, আমি আলী ও মু'আবিয়াকে হত্যার শপথ নিয়েছিলাম। একজনকে করেছি, আরেকজন বাকি আছে। আমাকে যেতে দিন। কাজ শেষ করেই আমি নিজেকে আপনার হাতে সোপর্দ করব! হাসান (রা.) বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। এই লোক কি আদৌ মানসিকভাবে সুস্থ? সে ভাবছে, আন্তঃবিরোধ থাকার দরূণ হাসান (রা.) তাকে মু'আবিয়া (রা.)-কে হত্যার জন্য পাঠাবেন! হাসান (রা.) জবাব দিলেন, এর আগে আমি তোমাকে জাহান্নামে পাঠাব। কিসাস অনুযায়ী ইবনে মুলজিমকে হত্যা করা হল।

আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আলী (রা.)-এর মাঝে কথা হচ্ছিল, যা আলী (রা.) নিজ মুখে শুনিয়েছেন-

قال علي قال لي رسول الله من أشقى الأولين قلت عاقر الناقة قال صدقت فمن أشقى الآخرين قلت لا علم لي يا رسول الله قال قاتلك وفي رواية الذي يضربك على هذه وأشار بيده على يافوخه

অর্থঃ আলী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, পূর্ববর্তীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি কে? আমি বললাম, নবী সালেহ (আ.)-এর উষ্টী হত্যাকারীরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সত্য বলেছ। পরবর্তীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কে? আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার জানা নেই। তিনি (সা.) বললেন, যে তোমাকে হত্যা করবে। অপর বর্ণনা রয়েছে, যে তোমাকে এখানে আঘাত করবে। এ কথা বলার সময় তিনি তাঁর বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

(ফাদ্বায়িলুস সাহাবা : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ২/৫৬৬; আল-ইসতিয়াব : ইমাম ইবনে আব্দিল বার, ৩/৫৯-৬০)

মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে লোকেরা আলী (রা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের খলিফা নির্ধারণ করে যাবেননা? আলী (রা.) বললেন, না। আমি তোমাদেরকে সেভাবেই ছেড়ে যাব যেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আমরা কি আপনার পর হাসানের হাতে বাই'আত দেব? আলী (রা.) বললেন, আমি নির্দেশও দিচ্ছিনা, নিষেধও করছিনা।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৭ম খণ্ড, আলী (রা.)-এর শাহাদত)

আলী (রা.)-এর শাহাদতের পর কুফাবাসী ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর হাতে বাই'আত জ্ঞাপন করল। সাথেসাথেই সিরিয়ার গভর্নর মু'আবিয়া (রা.) নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলেন। যা হবার তাই হল। দু'দলে আবার যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। যদিও হাসান (রা.) যুদ্ধে যেতে অনিহা প্রকাশ করেছিলেন, তবু জনগণের চাপে তাঁকে এগুতে হল। হাসান (রা.)-এর বাহিনী ছিল চোখে পড়ার মতো। মনে হচ্ছিল, সারা মুসলিম বিশ্ব তাঁর সাথে যোগ দিয়েছে। মাদায়েন যাওয়ার পর সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে হাসান (রা.) যুদ্ধ এড়ানোর পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং মু'আবিয়া (রা.)-এর কাছে সমযোতার বার্তা পাঠান। বিনিময়ে মু'আবিয়া (রা.) তাঁর কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়ে বললেন, আপনার পছন্দমতো শর্ত বলে দিন। অর্থাৎ মু'আবিয়া (রা.) পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আমি খেলাফত ছাড়ব না। সুতরাং আপনি খেলাফত ত্যাগ করার বিনিময়ে আপনার শর্ত বলে দিন। হাসান (রা.) শর্ত দিলেন- আলী (রা.)-কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা যাবেনা এবং আহলে বায়েতকে বাইতুল মাল থেকে সেভাবে ভাতা দিতে হবে, যেভাবে পূর্বের খলিফারা দিতেন। মু'আবিয়া (রা.) রাজি হলেন। ইমাম হাসান (রা.)-এর একক ত্যাগ, বদান্যতা ও সুবুদ্ধির কল্যাণে মুসলিম উম্মাহ অকল্পনীয় রক্তপাত থেকে রক্ষা পেল।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর খেলাফত; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, হাসান ও মু'আবিয়ার সন্ধি)

যদিও এ মীমাংসা অনেকের মনঃপুত হয়নি, তবু এটি বড় বরকতময় মীমাংসা ছিল। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) এ মীমাংসার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। আবু বাকরাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন খুতবা দেয়ার সময় শিশু হাসান মসজিদে প্রবেশ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন-

ابني هذا سيد ولعل الله أن يصلح به بين فئتين من المسلمين

অর্থঃ আমার এই বাচ্চা একজন নেতা। সম্ভবত আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুটি বৃহৎ দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ফিতান, ৬৬৯২)

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন- এ হাদিসে হাসান (রা.)-এর মর্যাদা ফুটে উঠেছে। তিনি নিজের দুর্বলতা বা চাহিদার জন্য খেলাফত ত্যাগ করেননি। করেছেন কেবল মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, দ্বীন ও উম্মাহকে সুসংহত করার জন্য। (ফাতহুল বারী)

সমযোতার ফলাফলস্বরূপ বৈধভাবে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার ছয়মাসের মাথায়, ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.) খেলাফতের মসনদ ত্যাগ করলেন। একইসাথে মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) ইসলামের ইতিহাসের প্রথম "রাজা" হিসেবে রাজতন্ত্রের মসনদে অধিষ্ঠিত হলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর এবং মারওয়ান ইবনে হাকামের বংশধারায় ৮৯ বছর পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মাদিকে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল।

ইসলামের সোনালী যুগ তথা খোলাফায়ে রাশিদীনের খেলাফতকালে সংঘটিত আন্তঃমুসলিম বিবাদ ও বিতর্কসমূহ উল্লেখ ও ব্যাখ্যাপূর্বক আমরা নিম্নুক্ত সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছি-

১. রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে প্রত্যক্ষ বাক্যের দ্বারা কোন সাহাবিকে উত্তরাধিকারী বা খলিফা মনোনিত করে যাননি। বরং উম্মতে মুহাম্মাদি নিজেদের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ক্রমানুসারে চারজন মহান ব্যক্তিত্বের হাতে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা উম্মতের কল্যাণ চেয়েছেন বলেই উম্মত উক্ত চারজনের উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

২. একটি গোষ্ঠীর দ্বারা খোলাফায়ে রাশিদীনের মধ্যে দুঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য যত কাহিনী ফাঁদা হয়েছে তার সবই অতিরঞ্জিত। বিশেষত, পূর্ববর্তী তিন খলিফার সাথে আলী (রা.)-এর দুঃসম্পর্কের যে কাহিনীসমূহ বর্ণনা করা হয়, তা সত্য থেকে বহুদূরে। খলিফাদের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা কতো গভির ছিল তা বুঝা যায় আলী (রা.) ও পূর্ববর্তী তিন খলিফার পরিবারের মধ্যে সংঘটিত আন্তঃবিবাহের দ্বারা। পূর্ববর্তী তিন খলিফাই আলী (রা.)-এর পরিবার থেকে বিবাহ নিয়েছেন এবং দিয়েছেন। খলিফাদের পর তাঁদের বংশধররাও আহলে বায়েতের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.), উমর ফারুক (রা.) ও উসমান (রা.) আহলে বায়েতের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করাকে দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর এবং সম্মানজনক মনে করতেন। আবু বকর (রা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর বিধবা স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস (রা.)-কে আলী (রা.) বিবাহ করেছিলেন। আলী (রা.) তাঁর কন্যা উম্মে কুলছুমকে উমর (রা.)-এর কাছে বিবাহ দিয়েছিলেন। উসমান (রা.) তাঁর ছেলেকে আলী (রা.)-এর পরিবারে বিবাহ দিয়েছিলেন। তাছাড়া আলী (রা.) এর পুত্রদের মধ্যে একজনের নাম ছিল আবু বকর, আরেকজনের নাম উসমান। সম্পর্ক যদি খারাপ হতো, তাহলে কি এসব সম্ভব ছিল? তাছাড়া চার খলিফাই একে অন্যের মর্যাদা খুব উৎসাহ সহকারে বর্ণনা করতেন। আমরা হাদিসে তার অগনিত উদাহরণ পেয়ে থাকি। খারাপ সম্পর্ক হলে কি এসব সম্ভব ছিল?

৩. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কখনো আকীদা তথা বিশ্বাসগত বিরোধ ছিলনা। যা কিছু পরিলক্ষিত হয়, সবই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগত বিরোধ। প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, প্রত্যেকের খেয়ালখুশি ভিন্ন। সুতরাং পার্থিব বিষয়ে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। ভুলে গেলে চলবেনা যে, সাহাবায়ে কেরাম ঈমান-আমল-আখলাকের সবক নিয়েছেন সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহচর্যে বসে। সুতরাং, পার্থিব ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যার যাই দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক, সাহাবায়ে কেরাম এবং আহলে বায়েত সবসময় আমাদের জন্য সত্য ও ন্যায়ের মানদণ্ড। তাঁরা সেই আয়না, যা দিয়ে আমরা নুরে মুহাম্মাদি (সা.) অবলোকন করি।

৪. ইসলামের ইতিহাস রচিত হয়েছে পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে। একই বিষয়কে সুন্নীরা একভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, শিয়ারা আরেকভাবে, উগ্রপন্থী খারেজি মতাদর্শীরা আরেকভাবে, আবার পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্টরা আরেকভাবে। সুতরাং কুরআন-হাদিসকে আমরা যেভাবে গ্রহন করি; ইতিহাসকে সেভাবে গ্রহন করার সুযোগ নেই। আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা'আতের মতামত ও যুক্তি এবং নিজেদের গবেষণাপ্রসূত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছি। তার মানে এই নয় যে, আমরা শিয়া কিংবা অন্য কোন মতাদর্শী ভাই-বোনদের সাথে বিতর্ক করতে বসেছি। না, আমরা কেবলই নিজেদের সূত্রসমূহ জানতে চেয়েছি। সহস্র বছর ধরে উম্মতের মধ্যে যে বিতর্কগুলো চলে আসছে, আমরা দুটি যুক্তি দিয়েই এগুলোকে রফাদফা করে ফেলব- এরকম ভাবনা নেহায়েত বোকামি। আমরা সে চেষ্টাও করছিনা।

৫. সালাফে সালেহীন তথা উম্মতের উত্তম প্রজন্মসমূহ কখনো সাহাবিদের মধ্যকার বিরোধ ও রাজনৈতিক সংঘাত (জামাল, সিফফিন) বিষয়ে কাউকে দোষারোপ করেননি। উদাহরণস্বরূপ-

আহলে সুন্নাতের হাদিস ও তাসাউফের অগ্রদূত ইমাম হাসান বসরীকে সাহাবিদের মধ্যকার যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন-

قتال شهده أصحاب محمد صلي الله عليه وسلم وغبنا، وعلموا وجهلنا، واجتمعوا فاتبعنا، واختلفوا فوقفنا

অর্থঃ এটি এমন এক যুদ্ধ ছিল যেখানে মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিরা উপস্থিত ছিলেন এবং আমরা অনুপস্থিত ছিলাম। তাঁরা সেসময়কার অবস্থা জানতেন এবং আমরা জানিনা। সুতরাং তাঁরা যে বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, আমরাও তাতে ঐক্যমত পোষণ করি। আর তাঁদের মধ্যে যে বিষয়ে বিতর্ক-বিরোধ হয়েছে, আমরা সেসব বিষয়ে চুপ থাকি।

(তাফসিরে আহকামিল কুরআন : ইমাম কুরতুবী)

আহলে সুন্নাতের রাজনীতির "ইমাম" খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয সাহাবিদের মধ্যকার বিবাদের ব্যাপারে বলেছেন-

تلك دماء طهّر الله يدي منها أفلا أُطهر منها لساني؟

অর্থঃ সেসব রক্ত থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে পবিত্র রেখেছেন। সুতরাং আমরা কি এসব উচ্চারণ করা থেকে নিজেদের জিহ্বাকে পবিত্র রাখবনা?

(তাবাকাত : ইমাম ইবনে সা'দ)

আহলে সুন্নাতের হাদিস ও আকীদার প্রতিকৃত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে মু'আবিয়া (রা.) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন-

ما أقول فيهم إلاّ الحسنى

অর্থঃ আমি তাঁদের সম্পর্কে ভাল ব্যতীত অন্য কিছু বলিনা।

(মানাক্বিবে ইমাম আহমদ : হাফিজ ইবনুল জাওযী)

সুতরাং আমাদের মতাদর্শ খুবই পরিষ্কার। তা হল-

قد جعل الله لكل شي قدرا

অর্থঃ আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ ঠিক করে রেখেছেন।

(সুরা তালাক : ৩)

সুতরাং যখন যা হওয়ার কথা, তা হয়েছে এবং হবে। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয়নি, হতেও পারেনা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সর্বজ্ঞাত।

সাফীনা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-

الخلافة في أمتي ثلاثون سنة ثم ملك بعد ذلك

অর্থঃ আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশ বছর খেলাফত থাকবে। এরপর আসবে রাজতন্ত্র।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২২২৬)

অপর একটি সূত্রে, সাফীনা (রা.) উক্ত ত্রিশ বছরকে ভাগ করেছেন এভাবে-

فخذ سنتين أبو بكر وعشرا عمر واثنتي عشرة عثمان وستا علي رحمهم الله

অর্থঃ মনে করো, আবু বকরের দুই বছর, উমরের দশ বছর, উসমানের বার বছর এবং আলীর ছয় বছর।

সাফীনা (রা.) হয়তো অনুমান-নির্ভর হিসেব করেছেন। কারণ তাঁর হিসেব পুরোপুরি সঠিক নয়। শারহে তাহাভীতে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-

كانت خلافة أبي بكر الصديق سنتين وثلاثة أشهر وخلافة عمر عشر سنين ونصفاً وخلافة عثمان اثنتي عشرة سنة وخلافة علي أربع سنين وتسعة أشهر

অর্থঃ আবু বকর সিদ্দিকে (রা.)-এর খেলাফতকাল ২ বছর তিনমাস, উমর (রা.)-এর সাড়ে ১০ বছর, উসমান (রা.)-এর ১২ বছর এবং আলী (রা.)-এর ৪ বছর নয়মাস।

রাসুলুল্লাহ (স.) ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সেদিন, অর্থাৎ আবু বকরে (রা.)-এর বাই'আত (রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি) থেকে আলী (রা.)-এর শাহাদত (রামাদ্বান, ৪০ হিজরি) পর্যন্ত হিসেব করলে দেখা যায়, চার খলিফার সম্মিলিত খেলাফতকাল ছিল ২৯ বছর ছয়মাস। তাহলে হাদিসে বর্ণিত ৩০ বছরের বাকি ছয়মাস কোথায়? এ প্রশ্নের জবাবে আহলে সুন্নাতের আলিমগণ বলেছেন-

خلافة الحسن ستة أشهر وأول ملوك المسلمين معاوية رضي الله عنه وهو خير ملوك المسلمين

অর্থঃ হাসান (রা.)-এর খেলাফত ছয় মাস। আর মুসলমানদের প্রথম রাজা হচ্ছেন মু'আবিয়া (রা.) এবং তিনি মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন।

(শারহে তাহাভী : ইবনে আবিল 'ইয)

আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এ ছয়মাসকে মু'আবিয়া (রা.)-এর শাসনে গণ্য করেছিল বলে খোদ হাদিসের রাবী সাফীনা (রা.) প্রতিবাদ করে বলেছেন, "কেন মু'আবিয়ার শাসনে গণ্য হবে? বরং এ ছয়মাস গণ্য হবে হাসানের খেলাফতে। বৈধ খলিফা হিসেবে তখন ৪০-৪২ হাজার লোক তাঁর হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন।"

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর খেলাফত)

ইতিহাস বলে, ৪০ হিজরির রামাদ্বান মাসে হাসান (রা.) খলিফা হন। যখন তিনি খেলাফত ত্যাগ করেন তখন ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাস চলছিল। এবার হিসেব করে দেখা যায়, ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল থেকে ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল পর্যন্ত কাটায় কাটায় ৩০ বছর হয়। ইলমে নববীর কি অকাট্য সত্যতা!

আমাদের মতে, হাদিসে উল্লেখিত ত্রিশ বছরের খেলাফতকাল পূর্ণ হয় হাসান (রা.)-এর খেলাফতের মধ্য দিয়ে। মু'আবিয়া (রা.)-এর ২০ বছর শাসনের মধ্যে প্রথম ছয়মাস এমন বিশেষ কিছু ছিলনা যে, এ ছয়মাসকে আলাদা করে "নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত"-এর ভেতর গণ্য করতে হবে।

ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেছেন-

فنفذ الوعد الصادق في قوله صلى الله عليه وسلم الخلافة في أمتي ثلاثون سنة ثم تعود ملكاً فكانت لأبي بكر وعمر وعثمان وعلي وللحسن منها ثمانية أشهر لا تزيد ولا تنقص يوماً فسبحان المحيط لا رب غيره

অর্থঃ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথা সত্যে পৌঁছেছে, যেভাবে তিনি বলেছিলেন, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশ বছর খেলাফত থাকবে। অতপর তা রাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করবে। এখানে আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রা.) এবং হাসান (রা.)-এর ছয়মাস অন্তর্ভুক্ত। একদিন বেশিও নয়, কমও নয়। কত পবিত্র পরিবেষ্টনকারী (আল্লাহ), যিনি ছাড়া কোন রব নেই।

(তাফসিরে আহকামিল কুরআন : ইমাম ইবনুল আরাবী)

আল্লামা কাযী আয়াদ্ব বলেছেন-

لم يكن في ثلاثين سنة إلا الخلفاء الراشدون الأربعة والأشهر التي بويع فيها الحسن بن علي

অর্থঃ ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়না, খোলাফায়ে রাশিদীনের চার খলিফা এবং সেই মাসগুলো ব্যতীত যে সময় লোকেরা হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন।

(শারহে সহীহ মুসলিম : ইমাম নববী)

ইমাম শা'রানীর খলিফা, খ্যাতিমান সুফি ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ আল-মুনাওয়ী বলেছেন-

فلما بويع له بعد أبيه وصار هو الإمام الحق مدة ستة أشهر تكملة للثلاثين سنة التي أخبر المصطفى صلى الله عليه وسلم إنها مدة الخلافة وبعدها يكون ملكاً عضوضاً

অর্থঃ তাঁর (হাসানের) পিতার পর যখন তাঁর হাতে বাই'আত দেয়া হয়। তিনি ছয়মাসের জন্য যথাপোযুক্ত নেতা হন, সেই ত্রিশ বছর পূর্ণ করার জন্য, যে সম্পর্কে মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) সংবাদ দিয়েছিলেন। এটি (ছয়মাস) ছিল খেলাফত। এরপর আসে কঠোর রাজতন্ত্র।

(ফায়যুল কাদীর : আল্লামা মুহাম্মদ আল-মুনাওয়ী)

আল্লামা মানাওয়ীর উক্তির জের ধরে প্রশ্ন আসে- কঠোর রাজতন্ত্র কথাটি কোথা থেকে আসল? বস্তুত হাদিসে এ শব্দটি উল্লেখিত আছে। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

تكون النبوة فيكم ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها الله إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، فتكون ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها الله إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون ملكا عاضا، فتكون ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها الله إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون ملكا جبرية، فتكون ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، ثم سكت

অর্থঃ যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তোমাদের মধ্যে নবুয়্যাত থাকবে। এরপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত থাকবে। এরপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, কঠোর (দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা) রাজতন্ত্র থাকবে। এরপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন, বলপূর্বক (উৎপীড়ক) রাজতন্ত্র থাকবে। এরপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর আবার নববী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আসবে। এরপর রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৪/২৭৩)

এখানে নবুয়্যাত বলতে নবুয়্যাতে সায়্যিদুল মুরসালিন (সা.), নববী আদর্শের খেলাফত বলতে খোলাফায়ে রাশিদীনের ত্রিশ বছর এবং সবশেষে আবার নববী আদর্শের খেলাফত বলতে ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী (আ.)-এর খেলাফতকে বুঝানো হয়েছে। এ পর্যন্ত কোন মতভেদ নেই। মতভেদ মাঝের দুটিকে নিয়ে- কঠোর ও বলপূর্বক (উৎপীড়ক) রাজতন্ত্র কোনগুলো? নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব। বহুজন বহুমত দিয়েছেন। সমসাময়িক গবেষকদের মতে, উমাইয়া-আব্বাসি-মামলুক-উসমানীয় তথা মুসলমানদের নিজস্ব রাজত্বসমূহকে কঠোর রাজতন্ত্র এবং পরবর্তীতে (বর্তমানে) মুসলিম উম্মাহ যখন বিধর্মী শক্তির তল্পিবাহক হবে, সেটিকে বলপূর্বক (উৎপীড়ক) রাজতন্ত্র বুঝানো হয়েছে। আমাদের নিকট এ মতামতটি অনেকাংশে গ্রহনযোগ্য এজন্য যে, কঠোর (عاضا) শব্দটি এতোটা খারাপ নয়। উমাইয়া-আব্বাসিরা আর যাই হোক, অন্তত মুসলমানদের মধ্য থেকে ছিল। কিছু জগন্য শাসক ক্ষমতায় আসলেও তাঁদের রাজতন্ত্রে মুসলমানদের বিকাশ ও উন্নতি সাধিত হয়েছিল। অন্তত, বর্তমান সময়ে উম্মাহ'র অবস্থা বিবেচনা করলে তৎকালীন রাজতন্ত্রকে স্বর্ণযুগ বলতেও দ্বিধা হয়না। সুতরাং খোলাফায়ে রাশিদীনের নখের বরাবর না হলেও, উমাইয়া-আব্বাসি-উসমানী শাসন এক অর্থে মুসলমানদের জন্য রহমত ছিল। এ মতের সমর্থনে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

أول هذا الأمر نبوة ورحمة، ثم يكون خلافة ورحمة، ثم يكون ملكًا ورحمة

অর্থঃ এ ক্ষেত্রে প্রথমে নবুয়্যাত ও রহমত। এরপর আসবে খেলাফত ও রহমত। এরপর আসবে রাজত্ব ও রহমত।

এরপর রাসুল (সা.) খারাপ সময়ের কথা বলেছেন।

(মু'জামুল কাবীর : ইমাম তাবরানী, ১১১৩৮)

প্রশ্ন আসে, তাহলে হাসান (রা.) ও মু'আবিয়া (রা.)-এর প্রকৃত অবস্থান কী? তারা কি খোলাফায়ে রাশিদীনের অন্তর্ভুক্ত? হলে কেন? আর না হলে কেন নয়?

রাজনৈতিক বিচারে, হাসান (রা.) ছিলেন বৈধ খলিফা। মুসলিম উম্মাহ'র বিশাল একটি অংশ পরামর্শের ভিত্তিতেই তাঁর হাতে বাই'আত জ্ঞাপন করেছিল। কিন্তু হাসান (রা.) যেভাবে খেলাফত ত্যাগ করেছিলেন, তা ছিল খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বিপরীত। যদিও, নিঃসন্দেহে হাসান (রা.)-এর খেলাফত গ্রহন ও খেলাফত-ত্যাগ দুটিই অত্যন্ত বরকতময় ছিল। তাই বলা যায়, হাসান (রা.)-এর খেলাফত ছিল নববী মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিল শুরা এবং বাই'আত দিয়েছিলেন লাখো মুসলমান। তাঁর খেলাফতকে অন্তর্ভুক্ত না করলে খেলাফতের ত্রিশ বছর পূর্ণই হয়না। তবে প্রচলিত অর্থে যেহেতু চার খলিফাকেই "খোলাফায়ে রাশিদীন" বিবেচনা করা হয় এবং যেহেতু হাসান (রা.) নিজেই তাঁর খেলাফত ত্যাগ করেছিলেন, তাই হাসান (রা.)-এর নামটি খোলাফায়ে রাশিদীনের প্রথাগত গণনায় আসেনা।

অপরদিকে মু'আবিয়া (রা.) এবং পরবর্তী উমাইয়া-আব্বাসি শাসনকে খেলাফত নামে ডাকা করা হলেও তাঁরা খোলাফায়ে রাশিদীনের অন্তর্ভুক্ত নন, যদিও তন্মধ্যে উমর ইবনে আব্দুল আযীযের মতো খলিফা ছিলেন। প্রথমত, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী খেলাফত ত্রিশ বছর ছিল। এরপর রাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কিছু রাজনৈতিক কারণেও উমাইয়া-আব্বাসি শাসনকে খেলাফত বলা যায়না। কারণসমূহ নিম্নরূপ-

১. খেলাফত নিজে চেয়ে নেয়া যায়না। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) প্রায় জোর করেই হাসান (রা.)-এর নিকট থেকে খেলাফত নিয়েছিলেন, যখন হাসান (রা.) ছিলেন মুসলিম উম্মাহ'র বৈধ খলিফা।

২. নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা দেয়া খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত বহির্ভূত। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) নিজেকে খলিফা ঘোষণা দিয়েই হাসান (রা.)-এর সাথে যুদ্ধে এসেছিলেন।

৩. খেলাফতের মনোনয়ন ও প্রশাসনিক কর্ম সম্পাদিত হয় শুরা তথা পরামর্শ-সভার ভিত্তিতে। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) নিজে নিজেই খলিফা হয়েছিলেন। তাঁর খেলাফতের পরবর্তী কর্মসমূহও শুরাভিত্তিক ছিলনা।

৪. যদিও বংশ পরম্পরায় খেলাফত পরিচালিত হওয়া কিংবা কাউকে পরবর্তী খলিফা মনোনিত করা ইসলামি শরী'আতে অবৈধ নয়। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে "ক্রাউন প্রিন্স" মনোনিত করে, "রাজকীয় নির্দেশের মাধ্যমে" তার জন্য বাই'আত গ্রহন করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। যদিও তখন অনেক মুসলমান ইয়াযিদের জন্য বাই'আত দিয়েছিলেন, কিন্তু শাসকের চাপে বাই'আত দেয়াকে অন্তত "বাই'আতে খেলাফত" বলে দাবী করা যায়না। মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইয়াযিদের পক্ষে বাই'আত নেয়ার সময় সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) এ বাই'আতকে রোম-পারস্যের আদলে রাজতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তবে নিজে থেকে খলিফা হওয়া, খেলাফত শুরাভিত্তিক না হওয়া কিংবা ইয়াযিদকে মনোনিত করা- এসব সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মু'আবিয়া (রা.)-এর ঈমান, নিয়ত ও যোগ্যতার উপর প্রশ্ন তুলেনা। মু'আবিয়া (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন শাসক এবং ইতিহাসের একমাত্র রাজা, যিনি ছিলেন সাহাবি। তাঁর শাসনামলে মুসলিম উম্মাহ'র প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়েছিল। খলিফা উমর (রা.) এবং উসমান (রা.)-এর বিজয় অভিযানকে তিনিই আবার গতি দিয়েছিলেন। তিনি আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কাছ থেকে নসিহত গ্রহন করতেন, আহলে বায়েতকে সম্মান করতেন। তিনি সাহাবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, সাহাবিরাও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তবে একথাও সত্য যে, তাঁর শাসনামলে সংঘটিত কিছু বিষয় আজো আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়। শ্রদ্ধাবশত আমরা এসব উচ্চারণ করা থেকে বিরত রইলাম। খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয ক্ষমতায় এসে এধরণের হীন কাজ বন্ধ করেছিলেন। সুতরাং আমরা বলি, মু'আবিয়া (রা.) ছিলেন একজন সাহাবি ও দক্ষ শাসক। কিন্তু তিনি খলিফা নন। ইনশাআল্লাহ, এটিই মধ্যমপন্থা।

খেলাফত থেকে কারবালা - ৫

(একত্রিত এবং সংযোজিত)

৩য় হিজরির রামাদ্বান মাসে আলী-ফাতিমা (রা.) দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান জন্ম নিলেন। ভালাবাসায় অভিভূত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) নাতির নাম রাখলেন হাসান।

(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ইমাম যাহবী)

হাসান তাঁর পুরো জীবন জুড়ে যতটা না আলী-ফাতিমা (রা.)-এর সন্তান ছিলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সন্তান। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়িয়েছেন, হাসান জায়নামাজে বসা। রুকু দিচ্ছেন, তো হাসান নানার কাপড় বেয়ে উঠতে ব্যস্ত। সেজদা দিচ্ছেন, তো হাসান নানার কাঁধে ঘোড়া চড়ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেজদা দীর্ঘ করলেন। নামাজ শেষে বললেন, হাসান আমার কাঁধের উপর চড়ে বসেছিল। তার স্বাদ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে চাদর পরে বেরিয়েছেন। বাইরে এসে চাদর ঝাড়া দিতে টুপটাপ করে ঝরে পড়লেন হাসান-হোসাইন! এভাবেই কেটে গিয়েছিল বাল্যকাল।

সীরাত-সুরতে হাসান (রা.) ছিলেন নানার উপমা। আনাস (রা.) বলেছেন-

لم يكن احد اشبه بالنبي صلي الله عليه وسلم من الحسن بن علي

অর্থঃ হাসান ইবনে আলীর চেয়ে নবী (সা.) সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কেউ ছিলনা।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৫৪২)

ফাতিমা (রা.) ছেলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন- ওহ বাবা! এ তো আলীর ছেলে নয়। এ তো তার নানার ছেলে! খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন-

هذان ابناي وابنا ابنتي اللهم اني احبهما فاحبهما واحب من يحبهما

অর্থঃ এ দুটি আমার বাচ্চা এবং আমার কন্যার বাচ্চা। হে আল্লাহ! আমি এদেরকে ভালবাসি, তুমিও এদেরকে ভালবাস। যে এদেরকে ভালবাসে, তাকেও তুমি ভালবাসো।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৩১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নাতিদ্বয়কে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। বারা ইবনে আজিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি হাসানকে রাসুল (সা.) কাঁধের উপর দেখেছি। তিনি (সা.) বলছিলেন-

اللهم إني أحبه فأحبه

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালবাসি। তুমিও তাকে ভালবাসো।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪২২)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসানকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। লোকজন হাসানকে বলত, কত উত্তম হাসানের বাহন! রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, কত উত্তম আমার কাঁধের আরোহী!

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর খেলাফত)

একটু সময় নাতিদ্বয় চোখের আড়াল হলেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠত। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বাজার থেকে এসে ফাতিমা (রা.)-এর ঘরের আঙ্গিনায় গেলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ডাক দিলেন- ও আমার বাচ্চারা! ও আমার বাচ্চারা! কেউ বাইরে আসছেনা দেখে তিনি আঙ্গিনায় বসে পড়লেন। একটু পর হাসান বেরিয়ে আসলে রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে পরপর তিনবার বললেন-

إني أحبه وأحب من يحبه

অর্থঃ আমি একে ভালবাসি। আর যে তাকে ভালবাসে, আমি তাকেও ভালবাসি।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ২৪২১)

আনাস (রা.) বলেছেন-

كان يقول لفاطمة ادعي لي ابني فيشمهما ويضمهما اليه

অর্থঃ রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাতিমা (রা.)-কে বলতেন, আমার বাচ্চাদেরকে ডাকো। অতপর তিনি তাঁদেরকে নাক দিয়ে শুকতেন এবং বুকে চেপে ধরতেন।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৭২)

সাহাবায়ে কেরামের চোখে হাসান (রা.)-এর অনুপম মর্যাদা ছিল। একবার আবু বকর (রা.) আলী (রা.)-এর সাথে হেটে যাচ্ছিলেন। প্রতিমধ্যে হাসান (রা.)-কে দেখে আবু বকর (রা.) তাঁকে কাঁধে নিয়ে বললেন-

بأبي شبيه بالنبي ليس شبيه بعلي وعلي يضحك

অর্থঃ ওহ বাবা! এ তো নবীর সাদৃশ্য। আলীর সাদৃশ্য নয়! রাবী বলেন, এ কথা শুনে আলী (রা.) হাসলেন।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৫৪০)

উমর (রা.) বাইতুল মাল থেকে হাসান (রা.)-কে বদরি সাহাবিদের সমান, ৫ হাজার দিরহাম ভাতা দিতেন। যদিও বদর যুদ্ধের সময় হাসান (রা.)-এর জন্মই হয়নি। উসমান (রা.) খারেজিদের দ্বারা গৃহবন্দী থাকাকালীন হাসান (রা.) গলায় খোলা তরবারি ঝুলিয়ে খলিফার পাহারায় রত ছিলেন। উসমান (রা.)-এর মনে আশঙ্কা লেগেই থাকত, "না জানি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে হাসানের কিছু হয়ে যায়।" শাহাদতের দিন তিনি জোর করে হাসান (রা.)-কে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও মূল আক্রমণের আগে হাতাহাতির দরূণ হাসান (রা.) গুরুতর আহত হয়েছিলেন। আলী (রা.) হাসান-হোসাইনকে খুব সম্মান করতেন। তিনি বলতেন, এ দুজন আমার নবীর সন্তান। একদা আলী (রা.) হাসান (রা.)-কে বললেন, তুমি বক্তৃতা দাও, আমি শুনব। হাসান (রা.) জবাব দিলেন, বাবা! আপনার সামনে আমার লজ্জা লাগে। আলী (রা.) আড়ালে চলে গিয়ে বললেন, নাও সরে গেলাম, এবার বলো। হাসান (রা.) তখন অত্যন্ত সারগর্ভ একটি বক্তৃতা দিলেন। হাসান-হোসাইন (রা.) যখন বাহনে চড়তেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বরকতের জন্য বাহনের লাগাম ধরে রাখতেন। আল্লামা ইবনে কাছীর বর্ণনা করেছেন, হাসান-হোসাইন (রা.) যখন বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করতেন, সাহাবিরা তখন মায়াভরা চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন, আবু হুরায়রা (রা.) হাসান (রা.)-কে বলতেন, বাবা তোমার সে স্থানটি দেখাও যেখানে আমার নবী (সা.) চুমু দিতেন। হাসান (রা.) জামা উপরে উঠাতেন। আবু হুরায়রা হাসান (রা.)-এর পেটে চুমু দিতেন।

হাসান (রা.) অধিক যিকর করতেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। মানুষ তাঁকে হাদিয়া-তুহফা দিত। তিনি যা গ্রহন করতেন, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দান করে দিতেন। একবার এক হাবশি গোলামকে দেখলেন, সে নিজে এক লুকমা খাবার খাচ্ছে আর পাশে থাকা কুকুরের মুখে এক লুকমা দিচ্ছে। এ বদান্যতা দেখে তিনি ঐ গোলামের মালিকের কাছে গিয়ে গোলামকে ক্রয় করে, তাকে আযাদ করে দিলেন। মু'আবিয়া (রা.) প্রতিবছর হাসান (রা.)-এর জন্য ভাতা ও উপঢৌকন পাঠাতেন। ইমাম বুখারী বলেছেন, হাসান (রা.) পায়ে হেটে হজে যেতেন। তিনি অন্তত ২০ বার হজ করেছেন।

হাসান (রা.) অধিক তালাক প্রদান করতেন। আলী (রা.) বলেছিলেন, তোমরা হাসানের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেনা। সে অধিক তালাক প্রদানকারী। লোকেরা জবাব দিয়েছিল, আল্লাহর কসম, আমরা একদিনের জন্যও তাঁর কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি। আমরা আহলে বায়েতের সাথে আত্মীয়তা করতে চাই।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর ওফাত)

মানুষ হাসান (রা.)-এর সাথে আত্মীয়তা করাকে বরকতময় মনে করত। যেভাবে পূর্ববর্তী খলিফাগণ আলী (রা.)-এর পরিবারে বিয়ে দেয়া-নেয়াকে বরকতময় মনে করতেন। আমাদের বিশ্বাস, আহলে বায়েতের সাথে আত্মীয়তা করার জন্য মানুষের নিদারুণ আগ্রহই ছিল হাসান (রা.)-এর অধিক বিয়ে ও তালাকের একমাত্র কারণ। তাছাড়া তৎকালীন যুগে অধিক বিবাহ খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল।

একদা হাসান (রা.) স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর কপালে قل هو الله احد লেখা। স্বপ্নটি শুনে প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব বললেন-

ان كان رأي هذه الرؤيا فقل ما بقي من اجله

অর্থঃ যদি তিনি এ স্বপ্ন দেখেন তাহলে বুঝতে হবে তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসছে।

প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, হাসান (রা.)-কে বিষপান করানো হয়েছিল। কিছু ঐতিহাসিক এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। হাসান (রা.) তাঁর চিকিৎসককে বলেছিলেন, আমাকে তিনবার বিষপান করানো হয়েছে। দু'বার বেঁচে গেছি, এবার আর পারবনা। হোসাইন (রা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে আপনাকে বিষপান করিয়েছে? হাসান (রা.) বললেন, তুমি কি তাকে হত্যা করবে? ছেড়ে দাও! আমি ধারণার বর্শবর্তী হয়ে কারো রক্ত ঝরাতে চাইনা। আমরা সবাই একদিন আল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়াব।

হাসান (রা.)-কে বিষপান করানোর কারণ হিসেবে কেউ বলেছেন, তাঁর জনৈকা স্ত্রী ভেবেছিলেন হাসান (রা.) তাকে তালাক দেবেন। তাই তিনি তাঁকে বিষপান করিয়ে দেন। একটি মত এমন রয়েছে যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে তাঁর ঐ স্ত্রীকে প্ররোচনা দেয়া হয়েছিল।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর ওফাত)

একটি তথ্যমতে, হাসান (রা.)-এর জনৈকা স্ত্রী জা'দাহ বিনতে আশ'আছ তাঁকে বিষপান করিয়েছিলেন।

(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ইমাম যাহবী)

কোন মতটি বিশুদ্ধ, আল্লাহই ভাল জানেন। বিষের প্রকোপে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে ৪৯ হিজরির ৫ই রবিউল আউয়াল ৪৬-৪৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আদরের নাতি, ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু। আয়েশা (রা.)-এর অনুমতিক্রমে তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাফন করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু মদীনার গভর্নর মারওয়ান ও উমাইয়া আমির-উমরাগণ হিংসাবশত প্রচণ্ড বাধা সৃষ্টি করে। এতে হোসাইন (রা.) প্রচণ্ড রেগে যান। সাহাবি সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), ইবনে উমর (রা.), আবু হুরায়রা (রা.), জাবির (রা.) প্রমুখ হোসাইন (রা.)-কে শান্ত করেন। অবশেষে জান্নাতুল বাকীতে ফাতিমা (রা.)-এর কবরের পাশেই সমাহিত হন জান্নাতি পুরুষদের শিরতাজ ইমাম হাসান আল-মুজতাবা (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-

الحسن والحسين سيدا شباب اهل الجنة

অর্থঃ হাসান ও হোসাইন জান্নাতি যুবকদের সর্দার।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৬৮)

আবু হুরায়রা (রা.) মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেন- হে লোক সকল! আজ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কাঁদো, তোমরা কাঁদো। মদীনা তাইয়্যিবার অলিগলি তখন কান্নার ধ্বনিতে ছেয়ে গিয়েছিল।

মু'আবিয়া (রা.)-এর শাসনামলের মধ্যবর্তী সময়ে মুগিরা ইবনে শো'বা (রা.) তাঁকে পরামর্শ দিলেন, আপনি আপনার উত্তরাধিকারী মনোনিত করে যান। প্রবীণ সাহাবিরা ইন্তেকাল করেছেন। এখন যারা আছে বেশিরভাগই নতুন মুসলমান, যারা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহন করেছে। এবার যদি কোন বংশ বা গোত্র শক্তহাতে শাসনের ভার না নে, তাহলে উম্মতের মধ্যে আবারো রক্তপাত হবে। মু'আবিয়া (রা.) বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন। খেলাফতকে কেন্দ্র করে কি পরিমান রক্তপাত হয়েছে, তা তিনি ভালভাবেই দেখেছেন। কিছুদিন ভেবেচিন্তে তিনি তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে শাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনিত করলেন।

মু'আবিয়া (রা.)-এর অন্যতম স্ত্রী মাইসুন বিনতে বাহদালের ঘরে ২৬ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান। ইয়াযিদ তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মু'আবিয়া (রা.) মাইসুনকে তালাক দিয়েছিলেন বিধায় ইয়াযিদের জন্ম হয় তার নানাবাড়িতে। কিছুদিন পর তিনি পিতার কাছে চলে আসেন। শিক্ষিত, চতুর এবং রাজকীয় বালখিল্যতায় গড়ে উঠা এক প্রিন্স হিসেবে ইয়াযিদের জীবন আর দশটি মুসলমানের চেয়ে আরাম-আয়েশ ও প্রতিপত্তির দিকে ঝুঁকানো ছিল। আল্লামা ইবনে কাছীর ইমাম তাবরানীর বরাত দিয়ে বলেছেন, প্রথম জীবনে ইয়াযিদ মদ্যপান ও সংগীতের দিকে ঝুঁকানো ছিলেন। এজন্য তিনি পিতার দ্বারা বারবার তিরস্কৃত হতেন। তিনি সময়মত নামাজ আদায় করতেন না; প্রায়ই কাযা করতেন। মু'আবিয়া (রা.) তাকে ভালবাসতেন বলেই বারবার ডেকে ভাল হওয়ার উপদেশ দিতেন। কিন্তু ইয়াযিদ সুকৌশলে পিতাকে শান্ত করে দিতেন। ইয়াযিদ ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী। স্বার্থ আদায় করার যাবতীয় সাতপাঁচ তার জানা ছিল। তার চতুরতার একটি নমুনা হচ্ছে- একবার মু'আবিয়া (রা.) তাঁর জনৈক পুত্র আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার কাছে কী চাও। আব্দুল্লাহ বললেন, আমি একটি কুকুর ও একটি সুন্দর গাধা চাই। মু'আবিয়া (রা.) বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি নিজেই একটি গাধা! এরপর তিনি ইয়াযিদকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চাও। ইয়াযিদ তৎক্ষণাৎ সেজদায় পতিত হয়ে বললেন, আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি আপনাকে আমিরুল মু'মিনীন হিসেবে আমাদের মাঝে জীবিত রেখেছেন। এরচেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে? তবে আমি চাই আপনি আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান। মু'আবিয়া (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে? ইয়াযিদ বললেন, আমি হাদিসে পেয়েছি, যে ব্যক্তি উম্মতের কাজ পরিচালনা করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। বাবা, আমাকে উম্মতের দায়িত্ব পরিচালনা করার সুযোগ দিন। বলাই বাহুল্য, মু'আবিয়া (রা.) অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার জীবনকথা; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার শাসন)

আল্লামা শামসুদ্দীন দামেস্কী ইয়াযিদকে পাশা-খেলোয়াড়, বন্য প্রাণী শিকারী, নামাজ ত্যাগী, মদ্যপানের দিকে ঝুঁকানো বলে অবিহিত করেছেন। তাছাড়া বানর নিয়ে খেলা করা ইয়াযিদের আজীবন অভ্যাস ছিল।

আমরা মনে করি, মু'আবিয়া (রা.) যে কতিপয় কারণে ইয়াযিদকে মনোনিত করেছিলেন তা ছিল-

১. মু'আবিয়া (রা.) জানতেন, তিনি উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে না গেলে আবারো রক্তপাত হবে। ইতোপূর্বের রক্তপাত তিনি দেখেছেন এবং এসবে অংশগ্রহণও করেছেন।

২. আল্লামা ইবনে খালদুন "আল-মুকাদ্দিমা" গ্রন্থে বলেছেন, মু'আবিয়া (রা.)-এর খেলাফতকালে ইয়াযিদের আসল চরিত্র প্রকাশিত হয়নি, যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে। ইয়াযিদ সবসময় পিতাকে খুশি করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৩. সবচেয়ে বড় কথা, মু'আবিয়া (রা.) জানতেন, বনু উমাইয়া গোত্রের লোকেরা কখনো তাদের বাইরে, বিশেষত বনু হাশিম থেকে কাউকে খলিফা মেনে নেবেনা। ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকে কুরাইশ বংশের প্রধান গোত্রদ্বয় বনু হাশিম ও বনু উমাইয়ার মধ্যে চরম দ্বন্ধ বিরাজমান ছিল। ইসলাম আসলেও ঐ আরব্য গোত্রপ্রীতি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। উসমান (রা.)-এর শাহাদত, আলী (রা.)-এর খেলাফত এবং সিফফিনের যুদ্ধ এই দ্বন্ধে হাওয়া দিয়েছিল। বনু উমাইয়ারা মনে করত, উসমান (রা.)-এর শাহাদতের মধ্য দিয়ে তারা যে ক্ষমতা হারিয়েছিল, মু'আবিয়া (রা.)-এর হাত ধরে পুনরায় সে ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। সুতরাং এবার তারা ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেনা। এই দ্বন্ধের তিক্ততা বিবেচনা করেই মু'আবিয়া (রা.) তাঁর পুত্রকে মনোনিত করে যান।

মু'আবিয়া (রা.) একজন সাহাবি এবং উম্মতের কল্যাণকামী শাসক ছিলেন। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক ইজতিহাদকে আমরা সমর্থন করতে পারিনা। তখন কয়েকজন প্রখ্যাত সাহাবি জীবিত ছিলেন। তাছাড়া, খেলাফত যখন মুসলমানদের, তখন পছন্দও মুসলমানদের হওয়া উচিৎ। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) নিজে থেকেই উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছিলেন। রাজনীতির হিসাব-নিকাশ যাই হোক; নৈতিকতা বলে যে, ইয়াযিদ থেকে হাজারগুন উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব তখন জীবিত ছিলেন এবং তাঁদেরকে মনোনিত করাই ছিল কল্যাণের দাবী। যোগ্যতমকে রেখে স্বল্প যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে মনোনিত করা যদিও রাজতন্ত্রের নীতি বহির্ভূত নয়; তবুও ইয়াযিদের মতো প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্রের ব্যক্তিকে "রাজা" মানতেও আমাদের দ্বিধা হয়।

যখন মু'আবিয়া (রা.) ইয়াযিদের পক্ষে বাই'আত গ্রহনের নির্দেশ দেন, তখন পাঁচজন সাহাবির অবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য, যারা খলিফা হওয়ার ক্ষেত্রে ইয়াযিদ থেকে অনেক যোগ্য ছিলেন।

১. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)। তিনি ছিলেন আবিদ, মুহাদ্দিছ, ফকীহ ও সুন্নতে নববীর জলাধার। উহুদ পরবর্তী যুদ্ধসমূহে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো রাজনীতির মঞ্চে আসেননি। উম্মতের মধ্যে পুনরায় রক্তপাত রোধ করতে তিনি ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল- যদি ইয়াযিদের মধ্যে কল্যাণ থাকে তাহলে ভাল। আর যদি অকল্যাণ থাকে তবে আমরা ধৈর্যধারণ করব এবং বিচারের ভার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেব।

২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। আহলে বায়েতের এ প্রবীণ সদস্য ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদির জ্ঞানের খনি। তবে তিনিও ইবনে উমরে (রা.)-এত মতো অরাজনৈতিক ছিলেন বিধায় মু'আবিয়া (রা.)-এর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর মতামত ছিল- ইয়াযিদকে নির্বাচিত করা খারাপ কাজ হচ্ছে। তবে তা ততটা খারাপ নয়, যতটা খারাপ হবে আবার খেলাফত-কেন্দ্রিক বিরোধের জেরে উম্মতের মধ্যে রক্তপাত ঘটানো। তিনি এবং ইবনে উমর (রা.) ইয়াযিদকে যোগ্য বলে বাই'আত দেননি; কেবল উম্মতের মধ্যে বিরোধ নিরসনের স্বার্থেই মেনে নিয়েছিলেন।

৩. আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.)। তিনি এ বাই'আতকে রোম-পারস্যের আদলে রাজতন্ত্র বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

৪. আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.)। তিনি অত্যন্ত রাজনীতি-সচেতন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ইজতিহাদ ছিল- ইয়াযিদ কোনভাবেই খলিফা হওয়ার যোগ্য নয়। সুতরাং তিনি বাই'আত জ্ঞাপন করেননি।

৫. হোসাইন ইবনে আলী (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চোখের মণি হোসাইন (রা.) হুবহু ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর মতো চিন্তা করেছিলেন এবং ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দেয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন।

মু'আবিয়া (রা.) তাঁদের কাউকেই কোন জোরজুলুম করেননি। তাছাড়া তখন কেবল "ক্রাউন প্রিন্স" হিসেবেই বাই'আত নেয়া হচ্ছিল; খলিফা হিসেবে নয়। মু'আবিয়া (রা.)-এর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আল্লামা ইবনে খালদুন বলেছেন-

عهد معاوية إلى يزيد خوفاً من افتراق الكلمة

অর্থঃ খেলাফত-কেন্দ্রিক বিভাজনের ভয়েই মু'আবিয়া (রা.) ইয়াযিদকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন।

(আল-মুকাদ্দিমা : আল্লামা ইবনে খালদুন)

৬০ হিজরির রজব মাসে মু'আবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন। যে উসমান-হত্যার বিচার নিয়ে মু'আবিয়া (রা.) আমিরুল মু'মিনীন আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, জীবনভর খলিফার হাতে বাই'আত পর্যন্ত দেননি; তাঁর নিজের ২০ বছরের দীর্ঘ শাসনামলেও ঐ বিচারটি কিন্তু সম্পন্ন হয়নি। ইমাম হাসান (রা.)-এর সাথে চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, আলী (রা.)-কে গালাগালি করা হবেনা। কিন্তু উমাইয়া রাজতন্ত্রের ৮ম খলিফা সায়্যিদুনা উমর ইবনে আব্দুল আযীযের শাসনামল ব্যতীত পুরো উমাইয়া শাসনামলে মিম্বরের উপর আলী (রা.) এবং তাঁর প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদেরকে গালাগালি ও লা'নত করা হতো। দুঃখজনক হলেও, এসব সত্য।

পিতার ইন্তেকালের পর ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। ইন্তেকালের পূর্বে মু'আবিয়া (রা.) ইয়াযিদকে সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বায়েতের সাথে খারাপ আচরণ না করার নসিহত করে যান। কিন্তু ইয়াযিদ পিতার নসিহত রাখেননি। পরবর্তী বছরগুলোতে ইয়াযিদ মুসলিম উম্মাহকে একের পর এক দুঃখ, ব্যর্থতা ও নিগ্রহের পসরা উপহার দিয়ে যান। তার আমলে উম্মতের মুহাম্মাদির ন্যুনতম কল্যাণ সাধিত হয়নি। বরং যেসব অবর্ণনীয় কষাঘাত তিনি উম্মতের উপর করেছিলেন, তার বিবরণ দিতে গিয়ে হাফিয ইবনুল জাওযী বলেছেন-

ما رأيكم في رجل حكم ثلاث سنين : قتل في الأولى الحسين بن علي، وفي الثانية أرعب المدينة وأباحها لجيشه، وفي السنة الثالثة ضرب بيت الله بالمنجنيق

অর্থঃ এ ব্যক্তির শাসন সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা, যার শাসনের প্রথম বছরে হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বছরে মদীনায় ত্রাস সৃষ্টি করা করেছে এবং তার সেনাদলের জন্য মদীনাকে হালাল করে দিয়েছে। তৃতীয় বছর বাইতুল্লাহ শরীফে আগুনের গোলা দিয়ে আক্রমণ করেছে।

(তাযকিরাতুল খাওয়াছ : হাফিজ ইবনুল জাওযী)

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন-

حفظت من رسول الله صلى الله عليه وسلم وعاءين فأما أحدهما فبثثته وأما الآخر فلو بثثته قطع هذا البلعوم

অর্থঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে দুটি (জ্ঞানের) পেয়ালা সংরক্ষণ করেছি। একটি তোমাদের কাছে বর্ণনা করি। আরেকটি যদি বর্ণনা করি তাহলে আমার গর্দান আলাদা হয়ে যাবে!

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ইলম, ১২০)

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন- আলিমগণ বলেছেন, এখানে আবু হুরায়রা পথভ্রষ্ট শাসকদের নাম, অবস্থা ও সময়ের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু স্পষ্টভাবে বলেননি। আবু হুরায়রা (রা.) বলতেন-

اللهم اني اعوذبك من رأس الستين وامارة الصبيان

অর্থঃ "আল্লাহ! আমি ৬০ হিজরি সন এবং বালকদের শাসন থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি।" ৬০ হিজরিতে মু'আবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন এবং ইয়াযিদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আল্লাহ আবু হুরায়রা (রা.)-এর দু'আ কবুল করেছিলেন। ইয়াযিদ ক্ষমতায় আসার পূর্বে, ৫৯ হিজরিতে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। (ফাতহুল বারী)

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর মতের সমর্থনে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস পাওয়া যায়। আমর ইবনে সাঈদ ইবনে ইয়াহয়া তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, মু'আবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে মসজিদে নববীতে মদীনার গভর্নর মারওয়ানের সামনে বসে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন-

سمعت الصادق المصدوق يقول هلكة أمتي على يدي غلمة من قريش فقال مروان لعنة الله عليهم غلمة فقال أبو هريرة لو شئت أن أقول بني فلان وبني فلان لفعلت

অর্থঃ আমি "মহাসত্যবাদী এবং সত্যবাদী হিসেবে স্বীকৃত" নবী (সা.) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, কুরাইশ বংশের কতিপয় বালকের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে। এ কথা শুনে মারওয়ান বললেন, এসব বালকদের উপর আল্লাহর লা'নত পতিত হোক। অতপর আবু হুরায়রা বললেন, যদি আমি বলতে ইচ্ছা করি যে, এরা হচ্ছে অমুক গোত্রের এবং অমুকের ছেলে, তাহলে আমি (তাদের নাম-পরিচয়) বলতে সক্ষম।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল ফিতান, ৬৬৪৯)

আমাদের ধারণা, রাসুলুল্লাহ (সা.) উমাইয়া ও আব্বাসি রাজতন্ত্রের কিছু কমবয়সী শাসকের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। কারণ ইসলামের ইতিহাসে এ দুটি রাজতন্ত্র ছিল কুরাইশ বংশোদ্ভূত। এরপরের মুসলিম রাজতন্ত্রসমূহ যেমন- মামলুক, সেলজুক, ফাতেমি, সাফাভী, আইয়ুবী, উসমানী, মোঘল কোনটিই কুরাইশ বংশদ্ভূত ছিলনা। যদিও ফাতেমিরা নিজেদেরকে বনু হাশিম বলে দাবী করত; কিন্তু ইতিহাস তাদের বক্তব্যে একমত পোষণ করেনা।

উল্লেখ্য, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া ছিলেন অনেকটাই বালক-বয়সী। তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছরের সামান্য বেশি। বনু উমাইয়ার ৮৯ বছরের শাসনামলে ইয়াযিদ থেকে কমবয়সী একজন শাসকই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ইয়াযিদের পুত্র মু'আবিয়া ইবনে ইয়াযিদ, যাকে ২য় মু'আবিয়া বলা হয়। ২য় মু'আবিয়া জন্মগতভাবে অসুস্থ ছিলেন। ২০-২১ বছর বয়সে ক্ষমতায় আরোহণ করে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি; যা তার পিতা ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার শাসনামলে হয়েছিল। এটি আমাদের ধারণা। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

৬০ হিজরির রজব মাসে ক্ষমতায় এসে ইয়াযিদ মদীনার গভর্নর আল-ওয়ালীদ ইবনে উতবার কাছে নির্দেশ দেন- "যেভাবেই হোক হোসাইন ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে বাই'আত দিতে বাধ্য করো।" ইবনে উমর (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) আগেই বাই'আত দিয়েছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করেছেন। উপরোক্ত দুজন এখনো বাকি আছেন। গভর্নর আল-ওয়ালীদ হোসাইন (রা.)-কে ডেকে বাই'আত দেয়ার কথা জানান। হোসাইন (রা.) বলেন, আমাকে কিছুদিন সময় দিন। সে রাতেই তিনি মদীনা থেকে মক্কার দিকে পা বাড়ান। মদীনার ক্ষমতাচ্যুত গভর্নর মারওয়ান হোসাইন (রা.)-কে বন্দী করতে চাইলেও তৎকালীন গভর্নর আল-ওয়ালীদ মারওয়ানের পরামর্শ গ্রাহ্য করেননি।

মক্কায় যাওয়ার পথে হোসাইন (রা.) ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর সাথে মিলিত হন। উভয়েই মক্কায় যাচ্ছিলেন। মক্কায় ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর ভাল প্রভাব ছিল বিধায় তাঁরা দুজন মক্কাকে তুলনামূলক নিরাপদ ভাবেন। ওদিকে ইবনে উমর (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) মু'আবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুসংবাদ শুনে মক্কা থেকে মদীনায় আসার পথে হোসাইন (রা.) ও ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর সাথে সাক্ষাত হয়। ইয়াযিদ ক্ষমতা গ্রহন করেছেন শুনে এ দুই প্রবীণ সাহাবি হোসাইন (রা.) ও ইবনে যুবায়ের (রা.)-কে শান্ত ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ হওয়ার দরূণ ইবনে উমর (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) জানতেন যে, মু'আবিয়া (রা.)-এর সময়কার পরিস্থিতি যা ছিল এখন তা বহাল থাকবেনা। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।

মক্কায় পরবর্তী তিনমাস হোসাইন (রা.)-এর কাছে ইরাকের কুফা প্রদেশের লোকেরা অনবরত চিঠি ও প্রতিনিধিদল পাঠাতে থাকে। তাদের একটিই কথা- "আমরা ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দেবনা। আপনি আসুন, আমরা আপনার হাতে বাই'আত দেব।" হোসাইন (রা.) প্রথমে বিষয়টিকে আমলে নিতে চাননি। কিন্তু কুফাবাসীর নিদারুণ আগ্রহ দেখে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হোসাইন (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে সামান্য ক'জন সহকারীসহ কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকীল কুফায় পৌঁছে অভিভূত হয়ে যান। কুফায় হোসাইন নামের জয়জয়কার! ৩০-৩৫ হাজার কুফাবাসীর পক্ষ থেকে ১২ হাজার বাছাইকৃত গণ্যমান্য ব্যক্তি মুসলিমের হাতে বাই'আত দেন। আনন্দের আতিশয্যে মুসলিম হোসাইন (রা.)-এর কাছে চিঠি পাঠান- "মঞ্চ তৈরি, আপনি আসুন।" তখন ৬০ হিজরির যিলক্বদ মাস চলছিল।

ওদিকে ইয়াযিদের কানে এ সংবাদ পৌঁছামাত্র তিনি বসরার তৎকালীন গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে কুফার দায়িত্ব নেয়ার নির্দেশ দেন। ইবনে যিয়াদ ছোট একটি দল সাথে নিয়ে মুখের উপর কাপড় বেঁধে কুফায় প্রবেশ করে। মানুষ তাকে হোসাইন (রা.) ভেবে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। ধূর্ত ইবনে যিয়াদ চুপ থেকে পরিস্থিতি আঁচ করতে চেষ্টা করে। হঠাৎ তার দলের এক ব্যক্তি বলে উঠে- ইনি হোসাইন নন; তোমাদের নতুন গভর্নর ইবনে যিয়াদ। প্রথমবার কুফাবাসী পরিবর্তনের হাওয়া আঁচ করতে পারে। কুফায় পৌঁছে ইবনে যিয়াদ ক্ষমতাসীন গভর্নর নু'মান ইবনে বশীরের হাতে ইস্তফানামা ধরিয়ে দিয়ে নিজ হাতে গভর্নরের দায়িত্ব তুলে নেয়। মুসলিম ইবনে আকীল নিজেকে আড়াল করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছিলেন। ইবনে যিয়াদ মুসলিমকে খুঁজে বের করার জন্য এক ব্যক্তিকে ব্যবসায়ীয় পোশাক পরিয়ে শহরে নামিয়ে দেয় এবং বলে, তুমি সবার দ্বারেদ্বারে গিয়ে মুসলিমকে খুঁজবে এবং বলবে যে, তোমার কাছে সিরিয়ার শিয়াদের পাঠানো অর্থ রয়েছে যা তুমি কেবল মুসলিমের হাতেই দেবে।

আমরা এখানে শিয়া বলতে সে দলকে বুঝাচ্ছি যারা রাজনৈতিকভাবে আলী (রা.) ও আহলে বায়েতের পক্ষে ছিলেন। তখনো প্রচলিত আকীদাভিত্তিক শিয়া মতাদর্শের জন্ম হয়নি। ঐ আলীর দলের সাথে আহলে সুন্নাতের ন্যুনতম বিরোধ তো নেই-ই; বরং আহলে সুন্নাত নিজেদেরকে আলী (রা.)-এর গর্বিত সমর্থক বলে বিশ্বাস করে।

ব্যবসায়ীরূপী গোয়েন্দা খুঁজে বের করল, হানি ইবনে উরওয়া নামক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ইয়াযিদের পক্ষের লোক বলে পরিচয় দিতেন, তিনিই মুসলিমের আশ্রয়দাতা এবং প্রধান সহযোগী। ইবনে যিয়াদ হানিকে ডেকে এনে বন্দী করল। ওদিকে মুসলিম ইবনে আকীল দেখলেন, আর লুকিয়ে থাকার কোন মানে হয়না। তিনি কুফাবাসীর কাছে গোপন কোড-ওয়ার্ড প্রেরণ করলেন। শিয়াদের গোপন যুদ্ধের কোড-ওয়ার্ড ছিল يا منصور امت (হে সাহায্যপ্রাপ্ত, মৃত্যু ঘটাও)।

৩০-৩৫ হাজার কুফাবাসীর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার লোক যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসল! তবুও খারাপ না। মুসলিম ইবনে আকীল গভর্নর ইবনে যিয়াদের প্রাসাদ অবরোধ করলেন। ইবনে যিয়াদ ভয় পেয়ে গেল। তার সাথে মাত্র ক'জন সৈন্য। বাধ্য হয়ে ইবনে যিয়াদ নতুন অংক কষল। বাইরে লোক পাঠিয়ে দেখে নিল, কোন কোন গোত্রের লোকেরা মুসলিমের সাথে আছে। অতপর সেসব গোত্রের ভীতু লোকদেরকে ঘুষের লোভ ও হত্যার ভয় দেখিয়ে সরে যেতে বলল। এমনকি তাদের বাবা-মাকে ডেকে ছেলেদেরকে সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দিল।

ধিরে ধিরে একেকটি গোত্র পিছু হটতে শুরু করল। সকাল থেকে শুরু হওয়া অবরোধ যখন সন্ধ্যায় পৌঁছাল, তখন ৪ হাজার কুফাবাসীর মধ্যে বাকি রইল মাত্র ৭০ জন! মাগরিবের নামাজ শেষে মুসলিম পেছনে ফিরে দেখেন, অবশিষ্ট আছে মাত্র ৩০ জন! অন্ধকার নামতেই দেখা গেল, বাকি আছে মাত্র ১০ জন! বাধ্য হয়ে তিনি অবরোধ তুলে নিয়ে কিন্দা এলাকায় চলে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল, নতুন করে লোক জমা করবেন। কিন্দায় পৌঁছে যখন পেছনে তাকালেন, দেখলেন পেছনদিক জনমানবশূন্য! একজন মানুষও তাঁর সাথে নেই। একটুখানি ঘুষের লোভ, আর ওমনি কুফাবাসী হাওয়া! রাতের ঘোর অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে মুসলিম ইবনে আকীল নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিঃসঙ্গ, প্রতারিত, প্রত্যাখ্যাত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, কপর্দকশূন্য। মাথার উপর কোন ছাদ নেই, মুখে দেয়ার এতটুকু খাবার নেই, তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। দাওয়াত দিয়ে এনে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করল কুফাবাসী? প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি একটি দরজায় কড়া নাড়লেন। এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসলে তিনি একটু পানি চাইলেন। বললেন- মা, আমি হোসাইনের ভাই মুসলিম ইবনে আকীল। আমাকে আশ্রয় দেবেন? দয়াপরবশ হয়ে বৃদ্ধা তাঁকে আশ্রয় দিলেন। পরদিন বৃদ্ধার ছেলে তাঁকে দেখে ফেলল এবং মায়ের অনুরোধ সত্ত্বেও ইবনে যিয়াদের কাছে সংবাদ দিয়ে দিল। আব্দুর রহমান ইবনে আশ'আছের নেতৃত্বে একটি বাহিনী বৃদ্ধার ঘর ঘেরাও করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার হুমকি দিল। বৃদ্ধার ঘর বাঁচাতে মুসলিম বেরিয়ে আসলেন। এর পরের ঘটনা অবর্ণনীয়! আঘাতে আঘাতে তাঁকে প্রায় বেহুশ করে ফেলা হয়েছিল। তিনি একটু পানি খেতে চাইছিলেন। একফোঁটা পানিও তাঁকে দেয়া হয়নি। তিনি ইবনে আশ'আছকে বললেন, তোমরা আমাকে মেরে ফেল। কিন্তু একটি কাজ করে দাও। হোসাইনের কাছে বার্তা পাঠিয়ে দাও যে- মুসলিম বন্দী হয়েছেন, সম্ভবত তাকে মেরে ফেলা হবে। তুমি যেখানেই থাকো, মক্কায় ফিরে যাও। কুফাবাসী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা কখনো তোমাকে সাহায্য করবেনা।

হোসাইন (রা.)-এর কথা ভেবে মুসলিম ইবনে আকীল হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। ইবনে আশ'আছ বলল, আমি কথা দিচ্ছি, বার্তা পাঠিয়ে দেব।

ইবনে যিয়াদ মুসলিমকে হত্যার আদেশ দিল। ৯ই যিলহজ্জ, আরাফার দিন উঁচু ভবনের ছাদ থেকে নিচে ফেলে বিভৎস কায়দায় শহীদ করা হল আহলে বায়েতের সদস্য, আলী (রা.)-এর ভাতিজা, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, ইসলামের ইতিহাসের Unsung Hero মুসলিম ইবনে আকীল (রা.)-কে। মৃত্যুকালে কালিমা শাহাদাতের সাথে সাথে একটি কথাই তিনি বলে যাচ্ছিলেন- আল্লাহ! তুমি কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী থেকো!

এরপর হানি ইবনে উরওয়া এবং অন্য সহকারীদেরকে শহরের মধ্যখানে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হল। ওদিকে এই ঘটনার একদিন আগেই, ৮ই যিলহজ্জ মক্কা ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কুফার দিকে রওয়ানা হয়েছেন ইমাম হোসাইন (রা.)। মুসলিম ইবনে আকীলের শেষ চিঠি তখনো তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়নি।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইমাম হোসাইনের বৃত্তান্ত, খেলাফতের দাবীতে মক্কাত্যাগ; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হোসাইনের কাছে কুফাবাসীর চিঠি ও মুসলিম ইবনে আকীলকে প্রেরণ)

ইমাম হোসাইন (রা.) কুফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সাহাবিরা তাঁকে বারণ করলেন।

ইমাম তাউসের সুত্রে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বারবার তাঁকে বারণ করলেন। বললেন, সামর্থ থাকলে আমি তোমাকে ঘাড় ধরে আটকাতাম। তুমি কুফাবাসীর উপর বিশ্বাস করোনা। তুমি দেখনি, তারা তোমার পিতা ও ভাইয়ের সাথে কী আচরণ করেছিল? প্রসঙ্গত, আলী (রা.) বিপক্ষদলের দ্বারা যতটা আক্রান্ত হয়েছেন; ততটাই বিব্রত হয়েছেন নিজের দলের লোকদের দ্বারা। একেতো খারেজিরা তাঁর দল ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। তার উপর কিছু লোক তাঁকে কেন্দ্র করে অতিরঞ্জন করতে শুরু করেছিল। বিশেষত, আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে কেন্দ্র করে নানাবিদ কুফরি মতবাদ প্রচার করেছিল। আলী (রা.) ইবনে সাবার কিছু সহকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও তারা তাদের মতবাদ ত্যাগ করেনি। আলী (রা.) বলেছিলেন, আমিও তাদের উপর বিরক্ত, তারাও আমার উপর বিরক্ত।

হোসাইন (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জবাব দিলেন, আপনি আমার সুহৃদ। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি মক্কায় অবস্থান করে এ পবিত্র মাটিকে রক্তাক্ত করতে চাইনা।

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) তাঁকে বারণ করলে হোসাইন (রা.) তাঁকে জবাব দিলেন- ইবনে যুবায়ের, আমি মক্কায় রক্তপাত হতে দেবনা।

ইমাম শা'বির সূত্রে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) দ্রুত মদীনা থেকে মক্কায় চলে এলেন এবং হোসাইন (রা.)-কে থামাতে চেষ্টা করলেন। বললেন, হোসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদিস শুনাব, যা ইতোপূর্বে কাউকে বলিনি। হাদিসটি হল-

إن جبريل أتى النبي فخيره بين الدنيا والآخرة فاختار الآخرة ولم يرد الدنيا، وإنك بضعة من رسول الله والله ما يليها أحد منكم أبدا؛ وما صرفها الله عنكم إلا للذي هو خير لكم

অর্থঃ একদা জিবরাইল রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে ইখতিয়ার দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আখেরাতকে বেছে নিলেন। আর, তুমি রাসুলের অংশ। আল্লাহ তোমাদের থেকে দুনিয়াকে সরিয়ে নিয়েছেন, আখেরাতের কল্যাণের জন্য।

হোসাইন (রা.) তাঁকেও একই জবাব দিলেন।

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বললেন- তুমি কুফাবাসীকে বিশ্বাস করোনা। তাদের না আছে দৃঢ় সংকল্প, না আছে নিয়তের শুদ্ধতা। তুমি হাসানের মতো চুপ করে থাকো। হোসাইন (রা.) জবাব দিলেন, আল্লাহ হাসানকে তাঁর মীমাংসার জন্য প্রতিদান দেবেন। আর আমাকে আমার নিয়তের জন্য।

জাবির (রা.) তাঁকে বারণ করলেন। সৎভাই মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ হোসাইন (রা.)-কে থামাতে চাইলেন। বললেন, অন্তত পরিবার নিয়ে যেওনা। কিন্তু হোসাইন (রা.) সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর প্রমুখ প্রবীণ সাহাবিরা কেঁদে কেঁদে বললেন, যাও হোসাইন! তোমাকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করলাম।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইমাম হোসাইনের ইরাক গমনের প্রেক্ষাপট; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হোসাইনের কুফা গমন)

কেন ইমাম হোসাইন (রা.) কুফায় যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন? খলিফা বা শাসক ইয়াযিদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? আমাদের কাছে প্রশ্নগুলোর জবাব হচ্ছে নিম্নরূপ-

১. উল্লেখিত সাহাবায়ে কেরাম হোসাইন (রা.) থেকে বয়সে বড় ছিলেন। তাঁরা দেখেছেন, কুফাবাসী আলী (রা.)-এর জন্য কতবড় মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মু'আবিয়া (রা.)-এর সাথে মীমাংসার পর তারা কিভাবে হাসান (রা.)-কে ত্যাজ্য করেছিল। প্রক্ষান্তরে, হোসাইন (রা.) মাত্র দুই-আড়াই বছর কুফায় ছিলেন এবং তখন তিনি বয়সে নবীন ছিলেন। তাঁর পবিত্র হৃদয়ে এ কল্পনাও আসেনি যে, কুফাবাসী এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে!

২. হোসাইন (রা.) ইয়াযিদের হাতে জোরপূর্বক বাই'আত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যেভাবে মু'আবিয়া (রা.) ইয়াযিদের পক্ষে বাই'আতে গ্রহন করেছিলেন, তা কোনভাবেই খেলাফতের বাই'আত হতে পারেনা। বড়জোর তা ছিল রাজতন্ত্রের বাই'আত। মুসলিম উম্মাহ'র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসক উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) খেলাফতের বাই'আত বিষয়ে একটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, উমর (রা.) বলেছেন-

من بايع رجلا عن غير مشورة من المسلمين فلا يبايع هو

অর্থঃ যে কেউ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত বাই'আত করবে, তার অনুসরণ করা যাবেনা।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল হুদুদ, ৬৪৪২)

উল্লেখ্য, ইয়াযিদের মনোনয়ন মুসলমানদের পরামর্শে হয়নি। মু'আবিয়া (রা.) নিজেই ইয়াযিদকে মনোনিত করে সবাইকে বাই'আত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং ইয়াযিদের জন্য গৃহীত বাই'আতটি "বাই'আতে খেলাফত" হতে পারেনা। যেসব সাহাবি ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন, তাঁরা বিবাদ এড়ানোর জন্যই দিয়েছিলেন। আমাদের মতে, মু'আবিয়া (রা.) ইয়াযিদকে মনোনিত করার ক্ষেত্রে নিজের ইজতিহাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন, ইবনে আব্বাস (রা.) ও ইবনে উমর (রা.) ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ইজতিহাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন, ইবনে যুবায়ের (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াযিদের হাতে বাই'আত না দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ইজতিহাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রত্যেকের ইজতিহাদ তথা চিন্তা-গবেষণা ও সিদ্ধান্ত নিজেদের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ছিল। তবে হোসাইন (রা.) এটিও জানতেন, ইয়াযিদ তাঁকে ছেড়ে দেবেননা। তাই তিনি মক্কা মুকাররামাকে রক্তপাত থেকে বাঁচানোর জন্য মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বারবার বলেছিলেন-

والله لأن أقتل خارجًا منها أحب إلي من أن أقتل داخلًا منها بشبر

অর্থঃ আল্লাহর কসম, মক্কার ভেতরে সামান্যতম রক্তপাতের চেয়ে আমার কাছে মক্কার বাইরে নিহত হওয়া অধিক প্রিয়।

(তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হোসাইনের কুফা গমন)

৩. হোসাইন (রা.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, তিনি শাসনযন্ত্রের কৃত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেছিলেন-

إني أستخير الله وأنظر ما يكون

অর্থঃ আমি ইস্তেখারা করেছি। এবার দেখি কী হয়।

(তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হোসাইনের কুফা গমন)

আমাদের কথা হল, কেবল একটি বিচারকে কেন্দ্র করে আমিরুল মু'মিনীন আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরও যখন আমরা মু'আবিয়া (রা.)-কে Benefit of Good Intention তথা "উত্তম নিয়তের আনুকূল্য" দিয়ে থাকি, যদি তাঁর উত্তম নিয়তের দিকে তাকিয়ে তাঁর সমালোচনা করা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখি; তাহলে ইয়াযিদের মতো শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কেন দোষী সাব্যস্ত করব? এটি তো স্ববিরোধী নীতি হয়ে যায়!

কোন সাহাবির সমালোচনা করা কোনভাবেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা সাহাবির সমালোচনা করাকে আহলে সুন্নাতের আকীদা বহির্ভূত বলে বিশ্বাস করি। আমরা কেবল এটুকু বুঝাতে চাচ্ছি যে, ইমাম হোসাইন কেন ইয়াযিদের শাসনামলেই প্রতিবাদ করতে গেলেন? কেন তিনি মু'আবিয়া (রা.)-এর খেলাফতকালে প্রতিবাদ করেননি? নিশ্চয়ই এর কোন কারণ ছিল। আমাদের মতে সে কারণটি হল- ইমাম হাসান (রা.)-এর সাথে সন্ধি করার মধ্য দিয়ে মু'আবিয়া (রা.) মুসলিম উম্মাহ'র শাসনের যে বৈধতা পেয়েছিলেন, ইয়াযিদের হাতে সে বৈধতা ছিলনা। ইয়াযিদের বাই'আতটি গ্রহন করা হয়েছিল একপ্রকার জোরপূর্বক। আর আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, জোরপূর্বক বাই'আতকে বাই'আত বলে গণ্য করা হয়না। আব্বাসি শাসক আবু জা'ফর মনসুর যখন সবাইকে তাঁর হাতে বাই'আত দেয়ার জন্য জোরাজুরি করছিলেন, তখন একই কথা বলেছিলেন আহলে সুন্নাতের চার ইমামের অন্যতম, ইমাম মালিক। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল-

ليس بمستقرح طلأق

অর্থঃ জোরপূর্বক তালাক প্রদানে বাধ্য করা হলে সে তালাক গ্রহনযোগ্য হবেনা।

এ কথার দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন যে, বিবাহ-তালাক তথা ইসলামে যে সকল বিষয়কে "আকদ" বা চুক্তি বলে পরিগণিত করা হয়, সেসব বিষয় জোরপূর্বক সম্পাদন করা বা করানো যায়না। যেহেতু "বাই'আতে খেলাফত" একধরণের আকদ বা চুক্তি, যা মুসলমানরা খলিফার সাথে সম্পাদন করেন, সুতরাং সেটিও জোরপূর্বক গ্রহন করা যাবেনা।

এজন্য আব্বাসি শাসকরা ইমাম মালিককে প্রহার করেছিলেন, জনসম্মুখে লাঞ্চিত করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বাকি তিন ইমামের মতো ইমাম মালিকও ছিলেন দৃঢ়চেতা, সৎসাহসী ব্যক্তি। তিনি তাঁর ফতোয়া থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি।

৪. কেউ কেউ এ যুক্তি প্রদান করেন যে, ইবনে উমর (রা.) ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত বাই'আত বলবৎ রেখেছিলেন। তাতে ইয়াযিদের বাই'আত বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়। আমাদের কথা হল, যদি ইবনে উমর (রা.)-এর বাই'আত দেয়ার দ্বারা ইয়াযিদের খেলাফতের যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে ইয়াযিদ কেন ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইবনে যুবায়ের (রা.)-কে বাই'আত দিতে বাধ্য করার আদেশ দিয়েছিলেন? বাধ্য করে তো খেলাফতের বাই'আত হয়না। সা'দ ইবনে উবাদা (রা.) আমৃত্যু আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর হাতে খেলাফতের বাই'আত জ্ঞাপন করেননি। কিন্তু খলিফাদ্বয় সা'দ ইবনে উবাদা (রা.)-কে বিন্দুমাত্র জোরাজুরি করেননি। আমাদের মতে, ইয়াযিদ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীতই খলিফা হয়েছিলেন বলেই তৎকালীন প্রধান সাহাবিদের, বিশেষত আহলে বায়েতের স্বীকৃতি তার জন্য এতো জরুরি ছিল।

৫. ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াযিদকে উৎখাত করার জন্য বের হননি। বরং খেলাফতের নামে প্রচলিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বের হয়েছিলেন। যদি এ বের হওয়া অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে আব্বাসি শাসক আবু জা'ফর মনসুরের বিরুদ্ধে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের প্রতিবাদ এবং শাসক আল-মামুন ও মুসতা'সিম বিল্লাহ'র বিরুদ্ধে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের প্রতিবাদকেও অন্যায় বলে ধরে নিতে হবে। বস্তুত কোন কিছুকে অন্যায় মনে করলে এর প্রতিবাদ করা মুসলমানের কর্তব্য। ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াযিদের বাই'আতকে নীতিবিবর্জিত বলে মনে করেছিলেন বলেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যদি তাঁর উদ্দেশ্য থেকে থাকত, তবে তিনি এর আগেও বের হতে পারতেন।

৬. ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কুফাযাত্রার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, তিনি এ বিষয়ে আদিষ্ট ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার উম্মুল মু'মিনীন উম্মে সালামা (রা.)-এর ঘরে রাসুলুল্লাহ (সা.) উপবিষ্ট ছিলেন। তখন হোসাইন (রা.) নানার কাঁধে ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর নিকট একজন ফেরেশতা আসলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি তাঁকে ভালবাসেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ। তখন ফেরেশতা বললেন-

فإن أمتك تقتله وإن شئت أريتك المكان الذي يقتل فيه، فضرب بيده فأراه ترابا أحمر، فأخذت أم سلمة ذلك التراب فصرته في طرف ثوبها

অর্থঃ নিশ্চয়ই আপনার উম্মত তাঁকে হত্যা করবে। আপনি চাইলে আমি সে স্থানের মাটি দেখাতে পারি, যেখানে হোসাইন শহীদ হবেন। ফেরেশতা হাত দ্বারা বাড়ি দিয়ে কিছু লাল মাটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখালেন। উম্মে সালামা (রা.) এ মাটিগুলো নিয়ে কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রাখলেন।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ৩/২৪২)

এক বর্ণনায় রয়েছে, উম্মে সালামা (রা.) বলেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) খুব পেরেশান হয়ে একমুষ্টি মাটি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই মাটিগুলো কী? তিনি বললেন-

أخبرني جبريل أن هذا يقتل بأرض العراق للحسين، قلت له يا جبريل أرني تربة الأرض التي يقتل بها فهذه تربتها

অর্থঃ জিবরাইল আমাকে জানালেন, হোসাইন ইরাকের মাটিতে শহীদ হবে। আমি বললাম, জিবরাইল, আমাকে তার হত্যাস্থলের মাটি দেখাও। এগুলো সেই মাটি।

(মুসতাদরাক : ইমাম হাকিম, ৪/৩৯৮)

সুতরাং এরপর আর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মক্কাত্যাগ ও ইয়াযিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে خروج বা বিদ্রোহ বলার সুযোগ নেই। বিদ্রোহ তখনি হতো, যদি ইয়াযিদের বাই'আতটি খেলাফতের সুন্নাত অনুসারে গৃহীত বাই'আত হতো এবং হোসাইন (রা.) একবার বাই'আত দেয়ার পর তা ভেঙ্গে ইয়াযিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। কিন্তু না ইয়াযিদের বাই'আত খেলাফতের সুন্নাত অনুযায়ী গৃহীত বাই'আত ছিল, না ইমাম হোসাইন (রা.) কখনো ইয়াযিদের হাতে বাই'আত দিয়েছিলেন। বরং ইমাম হোসাইন (রা.) বাই'আত জ্ঞাপন করা থেকে বিরত থেকে ইয়াযিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সুতরাং তাঁর মক্কাত্যাগকে আমরা قيام বা দৃঢ়চিত্তে দণ্ডায়মান হওয়া এবং পদক্ষেপ নেয়া বলতে পারি। সাহাবিরা হোসাইন (রা.)-কে ভালবাসতেন বলেই তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁকে আটকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দিনশেষে সেটিই হবে, যা আল্লাহর তাকদীরে রেখেছেন। আবার তাকদীরের দোহাই দিয়ে অপরাধীকে মুক্তি দেয়া যায়না। এটি ইসলামের সুন্নাত নয়। আমরা আমাদের যুক্তি পেশ করলাম। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

হোসাইন (রা.) ৮ই যিলহজ্জ আহলে বায়তের সদস্যবৃন্দসহ মক্কা ত্যাগ করলেন। তখনো তিনি ইবনে যিয়াদের আগমন ও মুসলিমের হত্যা সম্বন্ধে সম্পুর্ণ অনবগত। কুফার নিকটবর্তী হয়ে তিনি শহরে দূত পাঠালেন। ইবনে যিয়াদ দূতকে হত্যা করল। প্রথম দূত ফিরে আসছেনা দেখে তিনি আবার দূত পাঠালেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকেও হত্যা করল। কিন্তু দ্বিতীয় দূত মৃত্যুর পূর্বে চিৎকার দিয়ে বলে গেলেন- কুফাবাসী, হোসাইন (রা.) আসছেন। তোমরা প্রস্তুতি নাও। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক কুফাবাসী ছিল নিরব-নিথর!

সর্বপ্রথম ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে হুর ইবনে ইয়াযিদ কিছু সৈন্য নিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পথ রুদ্ধ করল। তখন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে মুসলিমের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাল। সাথেসাথে তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু তখন আর পেছনে ফেরার প্রশ্নই আসেনা। বেরিয়ে যখন এসেছেন, বাকিটুকু আল্লাহর হাতে। ইমাম হোসাইন (রা.) ভীতু ছিলেন না। ভীতু হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসতেন না। তিনি বীর নবীর নাতি, বীর পিতার বীরপুত্র। তাঁর শরীরে প্রবাহিত সেই রক্ত, যা বদর-উহুদ-খন্দকে জুলফিকার হাতে ইসলামের দ্বাররক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিঃসন্দেহে ইমাম হোসাইন (রা.) আত্মহত্যার পণ করে আসেননি। তিনি তখনো বিশ্বাস করতেন যে, কুফাবাসী তাঁর সাথে থাকবে। আর যদি না থাকে তবে যা হবে, দেখা যাবে। তাছাড়া তাঁর সাথে মুসলিম ইবনে আকীলের সন্তানরাও রয়েছেন। তাঁরা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে যাবেননা। ইমাম হোসাইন (রা.) সঙ্গীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "যারা চলে যেতে চাও, যেতে পারো।" প্রতিমধ্যে যে কিছু মানুষ তাঁর কাফেলায় যোগ দিয়েছিল, তারা সরে পড়ল। কেবল বাকি রইলেন, যারা হোসাইন (রা.)-এর সাথে মক্কা থেকে এসেছেন। নারী-পুরুষ-শিশু সমেত শ'খানেক মানুষ।

হোসাইন (রা.)-এর মক্কা ত্যাগ করার সংবাদ পেয়ে ইবনে যিয়াদ ইয়াযিদের কাছে অতিরিক্ত বাহিনী চাইল। ইয়াযিদ উমর ইবনে সা'দের নেতৃত্বে ৪ হাজার সৈন্যের একটি ব্যাটেলিয়ন প্রেরণ করলেন, যারা মূলত তুরস্কের দাইলাম অঞ্চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নির্দেশমতো উমর ইবনে সা'দ হোসাইন (রা.)-এর কাফেলাকে কুফার নিকটবর্তী একটি প্রান্তরে রুখে দিল। ইমাম হোসাইন (রা.) আশেপাশের লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই প্রান্তরের নাম কী? জবাব আসল- কারবালা! দিনটি ছিল ৬১ হিজরির ৩ মুহাররাম।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, শিয়াদের মিথ্যাবর্জিত নির্ভর‍যোগ্য ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম হোসাইনের কুফা গমন)

দূতদের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) তিলাওয়াত করলেন-

فمنهم من قضي نحبه ومنهم من ينتظر

অর্থঃ তাদের কতিপয় মৃত্যুবরণ বরণ করেছে এবং কতিপয় অপেক্ষায় আছে।

(সুরা আহযাব : ২৩)

উমর ইবনে সা'দ জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন এসেছেন? হোসাইন (রা.) জবাব দিলেন, কুফাবাসী আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যদি তারা আমাকে না চায়, তবে আমি ফিরে যাব। ইবনে যিয়াদের কাছে বার্তা পাঠানো হল। উগ্র-দাম্ভিক ইবনে যিয়াদ জবাব দিল, হোসাইনকে অবশ্যই আমার কাছে এসে "আমার হাতে" ইয়াযিদের পক্ষে বাই'আত দিতে হবে।

হোসাইন (রা.) এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে ইবনে যিয়াদকে তিনটি পছন্দ দিলেন-

১. হয় আমাকে মক্কায় ফিরে যেতে দাও।

২. নয়তো আমাকে সরাসরি ইয়াযিদের কাছে নিয়ে যাও। আমি যা কথা বলার, তার সাথে বলব।

৩. নয়তো আমাকে সীমান্তে পাঠিয়ে দাও। আমি সেখানে বসবাস করব, জিহাদে অংশ নেব।

[আমার মন বিশ্বাস করতে চায়না যে, ইমাম এরকম কোনো প্রস্তাব আদৌ দিয়েছিলেন। আল্লাহু আ'লাম]

উমর ইবনে সা'দ নিজে ইবনে যিয়াদের কাছে বার্তা নিয়ে গেল। ইবনে যিয়াদ একই জবাব দিল- "হয় আমার হাতে বাই'আত, নয়তো হত্যা।" এও নির্দেশ দিল, আহলে বায়েতের উপর পানি বন্ধ করে দেয়া হোক। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, একপাশ দিয়ে প্রশস্ত ফোরাত বয়ে যাচ্ছে; অপরপাশে পানির তৃষ্ণায় ছটফট করছেন আহলে বায়েতের শিশুরা! উমর ইবনে সা'দ কিছুটা নরম পড়ে গেছে দেখে ইবনে যিয়াদ আরেকটি ট্রুপ পাঠালো, যার নেতৃত্বে ছিল শিমর ইবনে যুল-জাওশান। শিমর সেই কুখ্যাত রক্তপিপাসু, যে আহলে বায়েতের উপর আক্রমণের দায়িত্ব নিয়েছিল। সময় গড়িয়ে তখন ৯ মুহাররাম চলে এসেছে। এ সময় ইবনে সা'দের বাহিনী থেকে হুর ইবনে ইয়াযিদের নেতৃত্বে কিছু লোক ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দলে চলে আসলেন। তাঁদের কথা ছিল- আমরা মুসলিম বিশ্বের সেনাবাহিনী। ইয়াযিদকে খুশি করার জন্য আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তানদের উপর তরবারি উঠাবনা। এতো কিছু হয়ে গেল, ৩ থেকে ৯ মুহাররাম চলে আসল; একজন কুফাবাসীও ইমামের সহযোগিতায় এগিয়ে এলোনা। বিশ্বাসঘাতকতার এরচেয়ে বড় উপমা আর কী হতে পারে?

৯ মুহাররাম দিবাগত রাত। কারবালার মরুপ্রান্তরে আহলে বায়েতের শেষ রাত। ইমাম হোসাইন (রা.) আবারো তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, এরা কেবল আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। আমি নির্দেশ দিচ্ছি, তোমরা আমার আহলে বায়েতকে সাথে নিয়ে চলে যাও। তাঁদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে তোমরা যারযার মতো চলে যেও। তোমাদের নিয়ত ও ত্যাগ আল্লাহ দেখেছেন। তোমাদের উপর আমার আর কোন দাবী নেই। জবাব আসল- হোসাইন! আপনি আমাদের ভাই নন, চাচা নন, বন্ধু নন; আপনি আমাদের অস্তিত্ব! আপনি না থাকলে আমরা থেকেও নেই। আমরা আপনাকে ফেলে যাবনা। তর্ক চলতেই থাকল। হোসাইন (রা.) সবাইকে ফেরত পাঠাবেন, কিন্তু কেউ তাঁকে ছেড়ে যাবেনা। শেষপর্যন্ত সাঈদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফী তর্কের ইতি টানলেন। বললেন-

والله لا نخليك حتى يعلم الله أنا قد حفظنا غيبة رسول الله فيك، والله لو علمت أني أقتل دونك ألف قتلة، وأن الله يدفع بذلك القتل عنك وعن أنفس هؤلاء الفتية من أهل بيتك، لأحببت ذلك، وإنما هي قتلة واحدة

অর্থঃ আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ছেড়ে যাবনা যতক্ষণ না আল্লাহ দেখবেন যে, আহলে বায়েতকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথাকে হেফাজত করেছি। আল্লাহর কসম! যদি জানতাম যে, আমাকে হাজারবার হত্যা করার বিনিময়ে আপনার এবং আহলে বায়েতের প্রাণ রক্ষা পাবে, তবে আমি তাই আশা করতাম। কিন্তু হায়! আমি যে কেবল একবারই জীবন দিতে পারব!

রাত নামল। আযরাহ ইবনে কায়েসের নেতৃত্বে অশ্বারোহী বাহিনী আহলে বায়েতের কাফেলাকে ঘিরে হামলার অপেক্ষায় রত। উমর ও শিমর যুদ্ধের ছক আঁকছে। ওদিকের দৃশ্য ছিল বড় ভিন্ন। ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা গলায় পরে, আল্লাহর সামনে তাহরিমা বেধে দাঁড়িয়েছেন আহলে বায়েতের কাফেলা। যেন কুরআনের আয়াত কথা বলছে-

يا ايها الذين أمنوا استعينوا بالصبر والصلاة، ان الله مع الصابرين

অর্থঃ মু'মিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থণা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।

(সুরা বাকারা : ১৫৩)

১০ মুহাররামের ভোর হল। ফজরের পর ইমাম হোসাইন (রা.) গোসল করে, প্রচুর সুগন্ধি গায়ে মাখলেন। এরপর মহিলাদের তাবুতে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত পুত্র আলী যাইনুল আবেদীন (রা.)-এর মাথায় হাত রাখলেন। আলী বলেন, আমার গলায় কান্নার ঝড় দলা পাকিয়ে আটকে গেল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। হোসাইন (রা.) বোন যায়নাব বিনতে আলী (রা.)-কে পরিবারের দায়িত্ব সপে দিলেন। যায়নাব বললেন, ভাই! নানাও নেই, মা-বাবাও চলে গেছেন, বড়ভাই হাসানও বিদায় নিয়েছেন। এবার তুমিও চলে গেলে আলে-মুহাম্মদ (সা.) যে একেবারে ইয়াতিম হয়ে যাবে! হোসাইন (রা.) বোনকে ধৈর্যধারণ করার আবেদন জানিয়ে, কিশোরী কন্যা ফাতিমা ও সুকাইনাকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে আসলেন।

ইয়াযিদের প্রেরিত ৪ হাজার সৈন্যের রণসজ্জিত উমাইয়া বাহিনী দাঁড়িয়েছে কারবালার একপ্রান্তে। মূল ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্বে উমর ইবনে সা'দ। বিশেষ ট্রুপ শিমর ইবনে যুল-জাওশানের অধীনে। অশ্বারোহী উইংয়ের দায়িত্বে আযরাহ ইবনে কায়েস। পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার শাবীছ ইবনে রিবঈ।

আরেকপাশে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে ভালবেসে শাহাদতের দ্বারপ্রান্তে বীরের বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছেন কিছু মানুষ। সেনাবাহিনী বলতে যা বুঝায় তার বিন্দুমাত্র লক্ষণ তাঁদের মধ্যে নেই। তাঁরা যুদ্ধ করার জন্য আসেনও নি। গণনায় তাঁরা মাত্র ৭২ জন পুরুষ। তন্মধ্যে ৩২ জন অশ্বারোহী, ৪০ জন পদাতিক। মূল সেনাপতি হোসাইন (রা.)-এর সৎভাই আব্বাস ইবনে আলী। ডানপ্রান্তের নেতৃত্বে যুহায়ের ইবনে কায়িন এবং বামদিকের কমান্ডার হাবীব ইবনে মুতাহহার।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াযিদি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণটি নিম্নরূপ-

قال بعد حمد الله والثناء عليه : أيها الناس إن قبلتم مني وأنصفتموني كنتم بذلك أسعد، ولم يكن لكم عليّ سبيل، وإن لم تقبلوا مني فاجمعوا امركم وشركاءكم ثم لأ يكن امركم عليكم غمة ثم اقضوا الي ولأ تنظرون ان وليي الله الذي نزل الكتاب وهو يتولي الصالحين

راجعوا أنفسكم وحاسبوها هل يصلح لكم قتال مثلي وأنا ابن بنت نبيكم، وليس على وجه الأرض ابن بنت نبي غيري؟ وعلي أبي وجعفر ذو الجناحين عمي وحمزة سيد الشهداء عم أبي؟ وقال لي رسول الله هذان سيدا شباب أهل الجنة، فإن صدقتموني بما أقول فهو الحق، فوالله ما تعمدت كذبةً منذ علمت أن الله يمقت عليّ الكذب، وإلا فاسألوا أصحاب رسول الله عن ذلك جابر بن عبد الله وأبا سعيد وسهل بن سعد وزيد بن أرقم وأنس بن مالك يخبرونكم بذلك، ويحكم! أما تتقون الله؟ أما في هذا حاجز لكم عن سفك دمي؟

ثم قال : أيها الناس ذروني أرجع إلى مأمني من الأرض. أخبروني أتطلبوني بقتيل لكم قتلته أو مال لكم أكلته أو بقصاصة من جراحه؟

قال : فنادى يا شبيث بن ربعي، يا حجار بن أبجر، يا قيس بن الأشعث، يا زيد بن الحارث، ألم تكتبوا إليّ أنه قد أينعت الثمار واخضر الجناب، فأقدم علينا فإنك إنما تقدم على جند مجندة؟ فقالوا له : لم نفعل فقال : سبحان الله! والله لقد فعلتم، ثم قال: يا أيها الناس: إذ قد كرهتموني فدعوني أنصرف عنكم. فقال له قيس بن الأشعث: ألا تنزل على حكم بني عمك فإنهم لن يؤذوك، ولا ترى منهم إلا ما تحب؟ فقال له الحسين: أنت أخو أخيك، أتريد أن تطلبك بنو هاشم بأكثر من دم مسلم بن عقيل؟ لا والله لا أعطيهم بيدي إعطاء الذليل، ولا أقر لهم إقرار العبيد

অর্থঃ ইমাম হোসাইন (রা.) আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণার পর বললেন, হে লোকসকল! যদি তোমরা আমার কথা গ্রহন করো এবং আমার সাথে ইনসাফ করো তবে এর দ্বারা তোমরা অধিক সৌভাগ্যবান হবে। আর, তাতে তোমরা আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বৈধতা পাবেনা। আর যদি গ্রহন না করো, তাহলে- (কুরআনের আয়াত)

"তাহলে তোমরা তোমাদের শরিকদেরকে সাথে নিয়ে তোমাদের কর্তব্য স্থির করে নাও। পরে যাতে কর্তব্য সম্বন্ধে তোমাদের কোন সংশয় না থাকে। আমার প্রতি তোমাদের কর্ম নিষ্পন্ন করে ফেল এবং আমাকে কোন অবকাশ দিওনা। আল্লাহ আমার অভিভাবক, যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আর, তিনি সৎকর্মপরায়নদের অভিভাবকত্ব করেন।"

এবার তোমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে ভেবে দেখ যে, আমার মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কি তোমাদের উচিৎ হবে? আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর দৌহিত্র। এখন কি পৃথিবীর বুকে আমি ছাড়া আর কোন নবী-দৌহিত্র আছেন? আলী (রা.) আমার পিতা, দু'ডানাবিশিষ্ট জা'ফর (রা.) আমার চাচা, সর্বশ্রেষ্ঠ শহীদ হামযা (রা.) আমার পিতার চাচা। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার (ও আমার ভাইয়ের) জন্য বলেছেন- "এরা দুজন জান্নাতি যুবকদের সর্দার।" তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস করে থাকো, তাহলে জেনে রেখো এটাই সত্য। আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি জেনেছি যে, আল্লাহ আমার জন্য মিথ্যাকে অপছন্দ করেন, তখন থেকে আমি কোনদিন মিথ্যা বলিনি। আর যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.), আবু সাঈদ খুদরী (রা.), সাহল ইবনে সা'দ (রা.), যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.), আনাস ইবনে মালিক (রা.)-কে জিজ্ঞেস করো। তাঁরা তোমাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করবেন। কী ব্যাপার তোমাদের? তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করোনা? আমি যা বললাম, সেগুলো কি আমার রক্ত প্রবাহিত করার অন্তরায় হিসেবে কোন মূল্য রাখেনা?

অতপর তিনি বললেন, হে লোকসকল! আমার পথ ছেড়ে দাও। আমি আমার নিরাপদ ভূখণ্ডে ফিরে যাই। আমাকে বলো, তোমরা কি তোমাদের কোন নিহত ব্যক্তির প্রতিদানস্বরূপ আমাকে হত্যা করতে চাও, যাকে আমি হত্যা করেছি? কিংবা তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার কারণে? কিংবা কোন গুরুতর আঘাতের প্রতিদানস্বরূপ?

অতপর হোসাইন (রা.) চিৎকার দিয়ে বললেন, হে শাবীছ ইবনে রিবঈ! হে হাজ্জার ইবনে আবজার! হে কায়েস ইবনে আশ'আছ! হে যায়েদ ইবনে হারিস! তোমরা কি আমাকে পত্র লেখনি যে, ফল পেকে গেছে। এবার আপনি আগমন করুন। আপনি আসলেই দেখবেন যে, আপনি একটু সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর নিকট আগমন করেছেন। লেখনি তোমরা? তারা বলল, না। আমরা তা করিনি। ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, সুবাহানাল্লাহ! আল্লাহর কসম, তোমরা এমনটি করেছ।

অতপর ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, হে লোকসকল! তোমরা যখন আমাকে অপছন্দ করছ, তাহলে আমার পথ ছেড়ে দাও। আমি তোমাদের থেকে চলে যাব। তখন কায়স ইবনে আশ'আছ বলল, আপনি কি আপনার পিতৃব্য-পুত্রের সিদ্ধান্তে আত্মসমর্পণ করবেন না? তারা আপনাকে কোন কষ্ট দেবেনা। আপনি তাদের থেকে অপ্রিয় কিছু পাবেন না। ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, তুমি তোমার ভাইয়ের মতো! তুমি কি চাও যে, বনু হাশিম মুসলিম ইবনে আকীলের রক্তের বিনিময়ের চেয়ে বেশি কিছু দাবী করুক? না, আল্লাহর কসম! আমি অপদস্থ হয়ে তাদের হাতে হাত রাখবনা এবং ক্রীতদাসের ন্যায় তাদের আনুগত্য স্বীকার করবনা।

পরিশিষ্ট ১ : কায়েস ইবনে আশ'আছ "পিতৃব্য-পুত্র" (চাচাতো ভাই) দ্বারা ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়াকে বুঝিয়েছে। বংশধারা উপরের দিকে উত্থিত হলে একপর্যায়ে ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইয়াযিদের বংশ পরস্পর মিলিত হয়।

পরিশিষ্ট ২ : বক্তৃতা চলাকালীন কিছু কথোপকথনও হয়েছিল। আমরা কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এসব পরিহার করেছি।

হোসাইন (রা.)-এর বক্তৃতা শেষ হতেই বিপক্ষদল আক্রমণ করল। উইং কমান্ডার যুহায়ের ও হাবীব সৈন্যদেরকে নিয়ে ময়দানে নামলেন। দিন গড়াতে লাগল। কারবালার বালুবেলায় রক্তের নদী বইতে শুরু হল। গ্রীষ্মের খরতাপে আকাশে খৈ ফুঁটছিল। কিন্তু গলা ভেজানোর এতটুকু পানিও ছিলনা। যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে একে একে শাহাদত বরণ করলেন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে থাকা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ৭ জন সাহাবি মুসলিম, হাবীব, আব্দুল্লাহ, আনাস ইবনে হারিস, বারীর, যুহায়ের ও হাজ্জাজ রিদ্বওয়ানুল্লাহি আলাইহিম। উইং কমান্ডার যুহায়ের ইবনে কায়িন এবং হাবীব ইবনে মুতাহহার, এরপর নাফে ইবনে হেলাল এবং ইবনে আবি শাকীব দোর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। শহীদদের স্মরণে ইমাম হোসাইন (রা.) দু'আ করলেন-

جزاكم الله خيرًا عن أهل بيت نبيك

অর্থঃ তোমাদের নবী (সা.)-এর পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

আহলে বায়েতের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ময়দানে গেলেন হোসাইন (রা.)-এর বড় ছেলে আলী আকবর। তরবারি উঁচিয়ে বললেন-

أنا علي بن حسين بن علي - نحن ورب البيت أولى بالنبي

অর্থঃ আমি আলী ইবনে হোসাইন ইবনে আলী।

বাইতুল্লাহ'র প্রভুর শপথ, আমরাই নবীর নিকটবর্তী।

কথার ঝলকেই তরবারির দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছিল! দীর্ঘ সময় একা লড়াই করে, ইয়াযিদ বাহিনীর এক অংশকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে শাহাদত বরণ করলেন আলী আকবর ইবনে হোসাইন।

এরপর সেনাপতি আব্বাস ইবনে আলী ময়দানে নামলেন। রচিত হল আরেকটি বীরত্বগাঁথা। কিন্তু একা আর কতক্ষন? ছুটন্ত তীর আর নেজার অবিরাম আঘাতে শাহাদত বরণ করলেন কারবালার সেনাপতি আব্বাস ইবনে আলী। যুহরের পর আক্রমণ তরান্বিত হল। ইয়াযিদি সৈন্যরা ধিরে ধিরে এগিয়ে এল ইমামের দিকে। শুরু হল ইমাম হোসাইন (রা.)-কে রক্ষা করার প্রতিযোগিতা। সঙ্গীরা ঢাল হয়ে হোসাইন (রা.)-কে ঘিরে রাখলেন, যেভাবে উহুদের দিন সাহাবিরা ঘিরে রেখেছিলেন রাসুলুল্লাহ (স.)-কে। একে একে ময়দানে গেলেন আহলে বায়েতের সদস্যবৃন্দ। ওদিকে হোসাইন (রা.)-এর কাছে আসতে লাগল পরিবার-পরিজনের শাহাদতের অবিরাম সংবাদ। ইমাম হোসাইন (রা.) ছাড়াও আহলে বায়েতের সদস্যদের মধ্যে কারবালায় শহীদ হয়েছিলেন নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ-

১. আব্বাস ইবনে আলী

২. জা'ফর ইবনে আলী

৩. আব্দুল্লাহ ইবনে আলী

৪. মুহাম্মদ ইবনে আলী

৫. আবু বকর ইবনে আলী

৬. উসমান ইবনে আলী

৭. জা'ফর ইবনে আকীল

৮. আব্দুল্লাহ ইবনে আকীল

৯. আবু বকর ইবনে হাসান

১০. আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান

১১. কাসিম ইবনে হাসান

১২. আলী আকবর ইবনে হোসাইন

১৩. আলী আছগর ইবনে হোসাইন

১৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম

১৫. মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম

১৬. মুহাম্মদ ইবনে আবু সাঈদ

১৭. আউন ইবনে আব্দুল্লাহ

১৮. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ

একসময় অবস্থা এমন হল যে, অসুস্থ আলী যাইনুল আবেদীন, দু'একজন খাদিম এবং ইমাম হোসাইন (রা.) ব্যতীত আর কোন পুরুষ জীবিত রইলেন না। সৈন্যরা ইমামকে ঘিরে ধরল। পশ্চিমাকাশের সূর্য তখন বিকেলের রঙ হারাচ্ছিল। ইমামের পরনে ছিল বীরের বর্ম, হাতে পিতার জুলফিকার, বুকে দুর্মদ তেজ, হৃদয়গহিনে প্রিয় নানার সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষা আর কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। কার সাহস আছে সামনে এসে দাঁড়াবে? দীর্ঘক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। সৈন্যরা এগিয়ে এসেও আঘাত করার সাহস যোগাতে পারলনা।

প্রত্যক্ষদর্শী ও উপস্থিত মহিলাদের বর্ণনামতে, একসময় শিমর ইবনে যুল-জাওশান ৮-১০ জনের একটি ট্রুপ নিয়ে ইমামের দিকে এগিয়ে এলো। মালিক ইবনে বশীর নামক ব্যক্তি সর্বপ্রথম আঘাত হানল ইমামের মাথায়। আঘাতের তীব্রতায় মাথা থেকে টুপি পড়ে গেল। রক্ত মুছতে মুছতে মাটি থেকে টুপি উঠিয়ে আবার মাথায় দিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। হাসীন ইবনে তামীম আঘাত হানল ইমামের চোয়ালে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসল। এরপর আর আঘাত থামেনি। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে আসতে লাগল তীর আর নেজা। ক্লান্ত-অবসন্ন ইমাম ঘোড়ার উপর থেকে ছিটকে পড়লেন মাটিতে। শরীরে তখন ৩০-৪০টি তীর আর নেজা গেঁথে আছে। দেহ জুড়ে তরবারির শতটি আঘাত। শিমরের নির্দেশে সিনান ইবনে আনাস ছুরি দিয়ে ইমামের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলল। দ্বীন ও খেলাফতের পবিত্রতা রক্ষা করতে ইনসাফের তারাজু উচ্চহাতে তুলে ধরে শাহাদত বরণ করলেন ইমাম আবু আব্দিল্লাহ হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে দিয়ে নানার আদর-সোহাগের ঋণ শোধ করলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। পশ্চিমাকাশে ডুবন্ত সূর্যের লালিমা যখন আকাশজুড়ে লাল রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, কারবালা প্রান্তরে তখন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শির মোবারক দেহ থেকে আলাদা হয়ে পড়ে রইল। ইনি সেই হোসাইন, যাকে কাঁধে তুলে মদীনার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। উম্মতকে জানিয়ে দিতেন-

حسين مني وانا من حسين

অর্থঃ হোসাইন আমার থেকে, আমি হোসাইন থেকে।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৭৫)

১০ মুহাররাম কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধের খুঁটিনাটি নিয়ে ইতিহাসবিদের মধ্যে নানা তর্কবিতর্ক রয়েছে। এজন্য আমরা বিস্তারিত বর্ণনা পরিহার করেছি এবং আমাদের নিকট গ্রহনযোগ্য তথ্যসম্ভারকে ক্রমানুসারে সাজিয়ে উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছি। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, শিয়াদের মিথ্যাবর্জিত নির্ভর‍যোগ্য ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৬১ হিজরির ঘটনা ও ইমাম হোসাইনের শাহাদত; আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ইমাম হোসাইনের শাহাদত)

খেলাফত থেকে কারবালা - ৬ (সমাপ্ত)

(একত্রিত এবং সংযোজিত)

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের সাথেসাথেই তাঁর মৃত্যুসংবাদ মক্কা-মদীনায় পৌঁছে গেল, যদিও মক্কা ও মদীনা কারবালা থেকে তৎকালীন সময় প্রায় ৩ সপ্তাহের দূরত্বে ছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল, কারণ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রিয় নাতির শাহাদতের সংবাদ মক্কা-মদীনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নিকট। মদীনায় উম্মুল মু'মিনীন উম্মে সালামা (রা.)-এর নিকট। আম্মার ইবনে আবি আম্মার থেকে বর্ণিত, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন-

رأيت رسول الله في المنام نصف النهار أشعث أغبر معه قارورة فيها دم، فقلت بأبي وأمي يا رسول الله، ما هذا؟ قال هذا دم الحسين وأصحابه لم أزل ألتقطه منذ اليوم

অর্থঃ আমি দুপুরবেলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর চুলগুলো অবিন্যস্ত, চেহারা ধুলোমলিন। তাঁর হাতে এক শিশি রক্ত। জিজ্ঞেস করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার বাবা-মা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনার হাতে কী? তিনি (সা.) বললেন- এগুলো হোসাইন ও তার সাথীদের রক্ত। আমি আজই এগুলো সংগ্রহ করেছি।

(মুসনাদ : ইমাম আহমদ ১/২৪২, ২৮৩)

ইবনে আবিদ-দুনিয়ার সূত্রমতে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বললেন-

أتعلم ما صنعت أمتي من بعدي؟ قتلوا الحسين وهذا دمه ودم أصحابه أرفعهما إلى الله

অর্থঃ জানো, আমার পরে আমার উম্মত কী করেছে? তারা হোসাইনকে হত্যা করেছে। এগুলো তার ও তার সাথীদের রক্ত। আমি এগুলোকে হাশরের দিন আল্লাহর সামনে তুলে ধরব।

ইবনে আব্বাস (রা.) তড়িগড়ি করে ঘুম থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে বললেন- ইন্না লিল্লাহিল ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। হোসাইন শহীদ হয়েছেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ)

মদীনায় ছিলেন উম্মুল মু'মিনীন উম্মে সালামা (রা.)। বর্ণনাকারী সালমা বলেন, আমি উম্মে সালামার ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি খুব কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন-

رأيت رسول الله وعلى رأسه ولحيته التراب فقلت ما لك يا رسول الله؟ قال شهدت قتل الحسين آنفا

অর্থঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর মাথা ও দাড়িতে ধুলাবালি লেগে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার কী হয়েছে? তিনি (সা.) বললেন- এইমাত্র দেখে আসলাম হোসাইনকে হত্যা করা হয়েছে।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৭১)

এরপর উম্মে সালামা চিৎকার দিয়ে বললেন- আল্লাহ! যারা এসব করেছে তাদের ঘর-বাড়ি ও কবরে তুমি আগুন লাগিয়ে দাও। এই বলে তিনি বেহুশ হয়ে গেলেন।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ)

প্রসিদ্ধ সূত্রমতে, উমর ইবনে সা'দ ও শিমর ইবনে যুল-জাওশানের বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর শহীদ সঙ্গীদের দেহ ফোরাত নদীর তীরে দাফন করে দিয়েছিল। এরপর ইমামের শির মোবারক ও আহলে বায়েতের নারীদেরকে বন্দী করে কুফায় নিয়ে যাওয়া হয়। হীন চরিত্রের নিষ্ঠুর ব্যক্তি ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইন (রা.) সম্বন্ধে নানা কটুক্তি করতঃ তাঁর শির মোবারকে ছড়ি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে থাকে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) তখন কুফায় ছিলেন এবং বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করতে অন্যদের সাথে তিনিও কুফার গভর্নর হাউজে আসলেন। ইবনে যিয়াদের বর্বর আচরন দেখে বয়সের ভারে ন্যুব্জ আনাস (রা.) চিৎকার করে বলেন-

أما إنه كان أشبههما بالنبي صلى الله عليه وسلم

সাবধান ইবনে যিয়াদ! হোসাইন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাদৃশ্য।

(জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৭৭৮)

আরো বললেন-

لقد رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقبل موضع قضيبك من فيه

অর্থঃ আল্লাহর কসম! তুমি যেখানে ছড়ি দিয়ে খোঁচাচ্ছ, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সে জায়গায় চুমু দিতে দেখেছি।

(আল-মু'জামুল কাবীর : ইমাম তাবরানী, ২৮৭৮)

ইবনে যিয়াদ আনাস (রা.)-কে কঠোরভাবে তিরস্কার করল। যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কর্তিত শির দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন এবং ইবনে যিয়াদকে বদদু'আ করলেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকেও তিরস্কার করল। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে আকীফ জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে ইবনে যিয়াদকে ভর্ৎসনা করলেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করল।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সূত্রমতে, ইবনে যিয়াদ আহলে বায়েতের নারীদের সাথে চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল। সে ইমামের জীবিত পুত্র আলী যাইনুল আবেদীনকে বলল, তুমি এখনো জীবিত কেন? তিনি জবাব দিলেন-

الله يتوفي الأنفس حين موتها

অর্থঃ মৃত্যুর সময় হলেই আল্লাহ মানুষের রূহ কবয করেন।

(সুরা আলে ইমরান : ১৪৫)

ইবনে যিয়াদ তাঁকে হত্যা করতে চাইল। শেষপর্যন্ত সে সাহস করেনি। কিন্তু শারীরিকভাবে চরম লাঞ্চিত করতে বাদ দেয়নি। পরকালীন শাস্তি তো এখনো আমাদের চোখের আড়ালে; তবে বনু উমাইয়ার সন্তুষ্টির কাছে ঈমান বিক্রি করে দেয়া এ কুখ্যাত ইবনে যিয়াদ ইহকালীন জীবনেও চরমভাবে লাঞ্চিত হয়েছিল। ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেছেন, শিয়া নেতা মুখতার সাকাফী ইবনে যিয়াদকে হত্যা করে তার কর্তৃক মস্তক যখন কুফার মসজিদে এনে রেখেছিলেন, তখন একটি সাপ এসে পরপর তিনবার তার মাথার ফুঁটো দিয়ে ঢুকে নাক দিয়ে বের হয়েছিল।

এরপর কুফা থেকে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শির ও আহলে বায়েতের নারীদেরকে পাঠানো হল রাজধানী দামেস্কে। সেখানে কী হয়েছিল, তা নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য রয়েছে। সুন্নী সূত্রে এ বিষয়ে অল্পকিছু তথ্য রয়েছে। বাকি সবই শিয়া সূত্রে প্রাপ্ত। সুন্নীরা এসময়ের কিছু ঘটনা শিয়াদের সুত্রে বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে কেউ যাচাই বাছাই করেছেন, যেমন আল্লামা ইবনে কাছীর। কেউ করেননি, যেমন ইমাম ইবনে জারীর তাবারী। ইবনে কাছীর তাঁর বিদায়াহ'তে সূত্রবিহীন বর্ণনা করেছেন যে, ইয়াযিদের কাছে ইমামের শির মোবারক পৌঁছালে ইয়াযিদ হত্যাকারীদেরকে তিরস্কার করেছিলেন। আবার বিদায়াহ গ্রন্থেই ইমাম মুজাহিদের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইয়াযিদ কবিতা পড়েছিলেন- "আমরা তোমাদের দ্বিগুণ সম্মানি ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে বদর যুদ্ধের দ্বিগুণ প্রতিশোধ গ্রহন করলাম।"

শিয়া ঐতিহাসিক আবু মিখনাফের সূত্রে সুন্নী ঐতিহাসিকরা ইয়াযিদ কর্তৃক আহলে বায়েতের সাথে চরম বেয়াদবি প্রদর্শনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ইয়াযিদ ইমামের শির মোবারকে ছড়ি দিয়ে আঘাত করেছেন। তার দরবারে উপস্থিত এক ব্যবসায়ী অজ্ঞতাবশত ইমামকন্যা ফাতিমাকে দাসীরূপে কিনতে চাইলে ইয়াযিদ বলেছিলেন- আমি বিক্রি করতে পারি, আমার ক্ষমতা আছে। এছাড়া সায়্যিদা যায়নাব বিনতে আলী, আলী যাইনুল আবেদীন ও ইমামকন্যা সুকাইনার সাথেও ইয়াযিদের কটু বাক্যালাপ হয়েছিল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা এসব সূত্রের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারিনি বিধায় বিস্তারিত বর্ণনা পরিহার করলাম। আমরা এসব ঘটনার সত্যতা অস্বীকারও করছিনা, আবার নিশ্চিতভাবে সত্য বলেও ঘোষণা করছিনা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা অধিক জ্ঞাত এবং তিনি চুড়ান্ত বিচারক।

এরপর ইমামের শির ও আহলে বায়েতের কাফেলাকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শির মোবারক জান্নাতুল বাকীতে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছিল।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইমাম হোসাইনের কবর ও শির মোবারক)

আমরা অনেকে জানিনা যে, ইমাম হোসাইন (রা.) চমৎকার কবিতা লিখতেন। তাঁর একটি কবিতা নিম্নরূপ-

اغن عن المخلوق بالخالق - تسد علي الكاذب والصادق

واستدرق الرحمن من فضله - فليس غير الله من الرازق

হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের পরপরই মক্কা ও মদীনাবাসী ইয়াযিদের বাই'আত ভেঙ্গে দিলেন। তাঁরা বললেন-

قدمنا من عند رجل ليس له دين يشرب الخمر

অর্থঃ আমাদের উপর এমন এক লোক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে যার দ্বীন নেই এবং সে মদ্যপ।

তবে ইবনে উমর (রা.) এবং আহলে বায়েতের জীবিত সদস্যরা এক্ষেত্রে কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। মদীনাবাসী উমাইয়া বংশীয় সাবেক গভর্নর মারওয়ান ইবনে হাকাম এবং বনু উমাইয়ার লোকদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করে রাখলেন। ইয়াযিদ তখন কারবালার মূলহোতা, কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে মদীনা তাইয়্যিবায় আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বিচিত্র কারণে ইবনে যিয়াদ তা নাকচ করে দিল। অগত্যা মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে ১০-১৫ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য প্রেরিত হল। ৬৩ হিজরির যিলহজ্জ মাসে মদীনার অদূরবর্তী হাররা নামক স্থানে ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে আহলে মদীনার যুদ্ধ সংঘটিত হল। লোকবলের অভাবে মদীনাবাসী নিদারুণ পরাজয় বরণ করলেন। এরপর ইয়াযিদের নির্দেশানুযায়ী আল্লাহর নবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় শহর মদীনাকে তিনদিনের জন্য হালাল বা উন্মুক্ত করে দেয়া হল, যে মদীনাকে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) হারাম তথা পবিত্র ঘোষণা করেছিলেন। ইমাম যুহরী ও ইমাম আল-মাদায়েনীর সূত্রে আল্লামা ইবনে কাছীর বলেছেন, টানা তিনদিন ধরে মদীনায় গণহত্যা চালানো হল। কমবেশি ১০ হাজার মদীনাবাসীকে হত্যা করা হল, যার মধ্যে অন্তত ৭০০ জন সাহাবি ছিলেন। বৃদ্ধ-অন্ধ সাহাবি আবু সাঈদ খুদরী (রা.)-এর দাড়ি টেনে ছিড়ে ফেলেছিল ইয়াযিদের সৈন্যরা। অকল্পনীয় বিভৎস আচরণ করা হল মদীনার নারীদের সাথে। হাজারের অধিক নারী শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হয়েছিলেন! লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচারের কোন সীমা রইলনা। তিনদিন ধরে ইয়াযিদের সৈন্যরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাওদ্বা মোবারকে ঘোড়া ও খচ্চর বেঁধে রাখল। তাবেয়ী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেছেন, টানা তিনদিন মসজিদে নববীতে আযান-ইকামাত হয়নি। ইয়াযিদের ক্ষমতালিপ্সা ও পাপাচারিতার ফলস্রুতিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বুক দিয়ে আগলে রাখা মোবারক শহর মদীনা মুনাওয়ারাকে চুড়ান্তরূপে অপদস্থ করা হয়েছিল।

মদীনা সেই শহর, যাকে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন "পবিত্র" নামে অবিহিত করেছেন। জাবির ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

إن الله سمى المدينة طابة

অর্থঃ আল্লাহ মদীনার নাম দিয়েছেন "পবিত্র"।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুল হাজ্জ, ১৩৮৫)

মদীনা সেই শহর, যাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রকার ফিতনা-ফাসাদ থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

المدينة حرم من كذا إلى كذا لا يقطع شجرها ولا يحدث فيها حدث من أحدث حدثا فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين

অর্থঃ মদীনা "এখান থেকে এখান পর্যন্ত" হারাম (পবিত্র)। মদীনার বৃক্ষ নিধন করোনা এবং এখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করোনা। যে মদীনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, তার উপর আল্লাহর লা'নত, ফেরেশতাগণ ও সমগ্র মানবজাতির লা'নত।

(সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুল মাদীনা, ১৭৬৮)

মদীনাবাসীর মর্যাদা অন্যান্য শহরের লোকদের মর্যাদার অনুরূপ নয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

من أراد أهل المدينة بسوء أذابه الله كما يذوب الملح في الماء

অর্থঃ যে ব্যক্তি মদীনাবাসীর সাথে খারাপ আচরণের চিন্তাও করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে এমনভাবে গলিয়ে দেবেন যেভাবে লবন পানিতে গলে যায়।

(সহীহ মুসলিম : কিতাবুল হাজ্জ, ১৩৮৬)

মদীনা সেই শহর, যা সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিয়ামতের পূর্বে এই মদীনাই হবে ঈমানের শেষ আশ্রয়স্থল। আর সেই মদীনা ও আহলে মদীনার জান-মাল-ইজ্জতকে ভূলুণ্ঠিত করল ইয়াযিদ বাহিনী! ইসলামের ভেতরে বসে ইসলামকে এমনভাবে আঘাত করার নজির আর একটিও নেই।

মক্কা মুকাররামায় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) নিজের স্বাধীন খেলাফত ঘোষণা করলেন। ৬৪ হিজরিতে মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বাধীন ইয়াযিদ বাহিনী তাঁকে আক্রমণ করল। তিনি মক্কাবাসীকে সাথে নিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করলেন। একপর্যায়ে ইয়াযিদের সৈন্যরা লোহার কামান (মিনজানিক) দ্বারা কা'বা শরীফে পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষেপ করল। ঐতিহাসিক আল্লামা ওয়াকিদীর ভাষ্যমতে, পাথরের প্রচণ্ড আঘাত ও আগুনের ঝলসানিতে কা'বার দেয়াল গিলাফসহ পোড়ে গিয়েছিল। এই যুদ্ধেই বনু উমাইয়ার তল্পিবাহক আরেক রক্তপিপাসুর অভিষেক হয়েছিল। তার নাম- হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ।

বাইতুল্লাহ শরীফে যখন আগুন জ্বলছিল, তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ৩৬ বছর বয়সে পৃথিবী ত্যাগ করলেন ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া। মৃত্যুসংবাদ আসামাত্র তার সৈন্যরা মক্কা থেকে পিছু হটলো। ৬৪ হিজরির ১৪ রবিউল আউয়াল ইয়াযিদের মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্ত হল উম্মতে মুহাম্মাদির উপর সাড়ে ৩ বছরের এক কালো অধ্যায়।

(আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ৬৩ ও ৬৪ হিজরির ঘটনা, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার জীবনকথা ও মৃত্যু; তারিখুর রুসুল ওয়াল-মুলুক : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ৬৩ ও ৬৪ হিজরির ঘটনা, কা'বায় পাথর নিক্ষেপ ও ইয়াযিদের মৃত্যু; আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৬৩ ও ৬৪ হিজরির ঘটনা)

৬০ হিজরির রজব থেকে ৬৪ হিজরির রবিউল আউয়াল, সাড়ে তিন বছর সময় মুসলিম উম্মাহ'র শাসন কর্তৃত্ব ছিল ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার হাতে। তার শাসনামলে সংঘটিত তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক হিসেবে তার দায়দায়িত্ব এবং ব্যক্তি হিসেবে তার অবস্থান মূল্যায়ন করা আমাদের নিকট তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত ঘটনাত্রয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াযিদের অবস্থান পর্যালোচনা করব।

প্রথমত, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত ও আহলে বায়েতের সাথে ইয়াযিদের ব্যবহার প্রসঙ্গে। আমাদের গবেষণায় আমরা এ ফলাফলে উপনিত হয়েছি যে, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হত্যার প্রত্যক্ষ আদেশদাতা নন। ইতিহাসের সূত্রসমূহ ব্যাখ্যা করলে একথা প্রতিয়মান হয় যে, কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইন (রা.)-এর হত্যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। আমাদের যুক্তিসমূহ নিম্নরূপ-

১. কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাফেলাকে আটকে দেয়া হয়েছিল ৩ মুহাররাম। তাঁকে শহীদ করা হয়েছিল ১০ মুহাররাম। কারবালা থেকে দামেস্কের দূরত্ব আকাশপথে ৭২৭ এবং সড়কপথে ৮২৬ কিলোমিটার। দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেও কারবালা কিংবা কুফা থেকে দামেস্কে পৌঁছাতে কমপক্ষে দেড়-দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। আবার ফিরে আসতেও আরো দেড়-দুই সপ্তাহ। সুতরাং এটি প্রায় অসম্ভব যে, ৩-৯ মুহাররামের ভেতর বার্তাবাহক দামেস্কে ইয়াযিদের কাছে গিয়ে ইমাম-হত্যার আদেশ নিয়ে কুফায় ইবনে যিয়াদের কাছে ফিরে এসেছিল।

২. ইমাম হোসাইন (রা.) ইবনে যিয়াদকে যে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে একটি ছিল- তাঁকে যেন সরাসরি ইয়াযিদের কাছে যেতে দেয়া হয়। অর্থাৎ, কোন কথা থাকলে সেটি হবে ইয়াযিদের সাথে; ইবনে যিয়াদের সাথে নয়। ধারণা করা যায়, হোসাইন (রা.) জানতেন যে ইয়াযিদ আর যাই করুন; অন্তত তাঁকে হত্যা করার দুঃসাহস দেখাবেন না।

৩. ইয়াযিদ নৈতিকভাবে স্খলিত হলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে চতুর ছিলেন। তিনি জানতেন যে, হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করা হলে তার শাসন হুমকির মুখে পড়বে এবং তাই হয়েছিল। পরবর্তী হাররার যুদ্ধ এবং মক্কা আক্রমণ সরাসরি কারবালার বিয়োগান্তক হত্যাকাণ্ডের ফলাফল। সুতরাং ইয়াযিদের মতো ক্ষমতালিপ্সু শাসক কেন জেনেশুনে তার ক্ষমতাকে হুমকির মুখে পতিত করবেন?

৪. আমাদের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদরা তাঁদের কিতাবসমূহে ন্যুনতম দু'তিনটি বর্ণনা এরকম এনেছেন যে, ইয়াযিদ ইমাম হোসাইন (রা.)-এর হত্যাকারীদেরকে তিরস্কার করেছিলেন, যদিও কোন শাস্তি দেননি। এসব বর্ণনার আলোকে অনুমিত হয় যে, ইয়াযিদ ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করার নির্দেশ দেননি।

উপরোক্ত যুক্তিসমূহ উল্লেখ করে আমরা ইয়াযিদকে ইমাম-হত্যার সমস্ত দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিচ্ছিনা। আমরা মনে করি, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া ইমাম হোসাইন (রা.)-এর হত্যার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে বেরিয়েছেন- এ সংবাদ পেয়েই ইবনে যিয়াদ ইয়াযিদের নিকট সৈন্য তলব করেছিল। তখন ইয়াযিদ উমর ইবনে সা'দের নেতৃত্বে ৪ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। এ বাহিনীর উপর ইমাম হোসাইন (রা.)-কে জোরপূর্বক আটকানোর নির্দেশ ছিল। যদি হত্যা করার নির্দেশ থাকত, তবে ৩-৯ মুহাররাম পর্যন্ত টানা সাতদিন উমর ইবনে সা'দের সাথে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কথোপকথন অনুষ্ঠিত হতোনা। যখন ইমাম হোসাইন (রা.) ইবনে যিয়াদের হাতে বাই'আত দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন, তখন নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ন্যায়বোধকে ভূলুণ্ঠিত করে ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। ইবনে যিয়াদের প্রত্যক্ষ আদেশে উমর ইবনে সা'দের নেতৃত্বাধীন বাহিনী, বিশেষত শিমর ইবনে যুল-জাওশানের বিশেষায়িত ট্রুপ মানব ইতিহাসের জগন্যতম হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করেছিল। এজন্য আমরা ধারণা করছি যে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ছিল কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ।

দ্বিতীয়ত, আহলে বায়েতের সাথে ইয়াযিদের যে কতিপয় দুর্ব্যবহারের ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় পেয়ে থাকি, প্রায় সবগুলোই শিয়া ঐতিহাসিক আবু মিখনাফের সূত্রে বর্ণিত। এই আবু মিখনাফ প্রাথমিক যুগের সুন্নী ইতিহাসে "বড় সূত্র" হিসেবে গণ্য হলেও, আহলে সুন্নাতের গবেষক আলিমদের নিকট তিনি "অতিরঞ্জিত কাহিনী রচয়িতা" বলে পরিচিত। আমরা বলি, যদি ইয়াযিদ আহলে বায়েতের সাথে দুর্ব্যবহার করে থাকেন, তবে জেনে রাখা উচিৎ যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা অত্যাচারের শাস্তি প্রদানে অত্যন্ত কঠোর। আর যদি সেরকম কিছু না ঘটে থাকে, তবে আমরা এ ব্যাপারে নিজেদের জিহ্বাকে সংযত রাখি এবং বিচারের ভার আহকামুল হাকিমীন আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেই।

দ্বিতীয় বিষয় ছিল, হাররার যুদ্ধের পর মদীনা শহর ও মদীনাবাসীর প্রতি দুর্ব্যবহার প্রসঙ্গে। হাদিস ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া মদীনা তাইয়্যিবায় হামলা করার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন। জ্ঞান কিংবা বিবেক, কোনটিই এ কথা সমর্থন করেনা যে, শাসক ইয়াযিদের সরাসরি নির্দেশ ব্যতীত রাজধানী দামেস্ক থেকে ১০-১৫ হাজার সৈন্য মদীনায় আগমন করেছিল এবং মদীনাবাসীর সাথে এমন অবর্ণনীয় নারকীয় আচরণ করেছিল। ইতিহাসের বিশুদ্ধ সূত্রমতে, ইয়াযিদ প্রথমে কারবালার মূলহোতা উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে মদীনা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইবনে যিয়াদ সাহস করেনি। পরে ইয়াযিদের প্রেরিত মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বাধীন বাহিনী মদীনা ও আহলে মদীনাকে চরমভাবে লাঞ্চিত ও হত্যা করেছিল। আল্লামা ইবনে কাছীর তাঁর বিদায়াহ'তে উল্লেখ করেছেন, ইয়াযিদ মদীনা তাইয়্যিবাকে তিনদিনের জন্য হালাল তথা উন্মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। বিগত অধ্যায়ে আমরা বিশুদ্ধ সনদে প্রাপ্ত হাদিসসমূহ উল্লেখ করেছি, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনা শহর ও আহলে মদীনার সাথে খারাপ আচরণকারীর উপর লা'নত ও কঠিন আযাব পতিত হওয়ার কথা ইরশাদ করেছেন। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে ইয়াযিদ লা'নত পাওয়ার যোগ্য।

তৃতীয় বিষয় ছিল, মক্কায় আক্রমণ এবং কা'বা শরীফে পাথর ও অগ্নিগোলক নিক্ষেপ। সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হাজ্জ অধ্যায়ে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। তবে কা'বা শরীফে পাথর ও অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করার নির্দেশ ইয়াযিদের পক্ষ থেকে ছিল কি না, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের গবেষণামতে, ইয়াযিদ এমন কোন নির্দেশ দেননি। ইমাম যাহবী, ইমাম সুয়ুতী, আল্লামা ইবনে কাছীর (একটি বর্ণনামতে) এবং ড. আলী সাল্লাবী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বলেছেন যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে কা'বা শরীফকে অপমান করার কোন নির্দেশ ছিলনা। এমনকি ইয়াযিদের সৈন্যরা কা'বা শরীফ ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে পাথর ও অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করেনি। বরং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) কা'বা শরীফের পাশে তাঁর বাহিনীসহ অবস্থান করছিলেন বিধায় তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পাথর ও অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এমনকি, দু'একটি সুত্রে পাওয়া যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর বাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নিক্ষেপিত পাথর ও অগ্নিগোলক কা'বা শরীফের ক্ষয়ক্ষতির কারণ ছিল। আমাদের কাছে এ মতটি নির্ভরযোগ্য মনে হয়না। কারণ, ইবনে যুবায়ের (রা.)-এর বাহিনী ছিল কা'বা শরীফের খুব নিকটে। তাঁরা কিভাবে কামান দাগা করে কা'বা শরীফে পাথর ও অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করবেন? নিক্ষেপ করতে হলে তো দুর থেকে করতে হবে!

তবে ইয়াযিদ মক্কা মুকাররামায় আক্রমণ করার প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা, এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। মদীনা আক্রমণকারী বাহিনীর কমান্ডার মুসলিম ইবনে উকবা-ই প্রথমদিকে মক্কা আক্রমণের নেতৃত্বে ছিল। তার মৃত্যুর পর আরেক ব্যক্তি কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিল। উক্ত আক্রমণের প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা হিসেবেও ইয়াযিদের উপর সীমাহীন পাপাচারিতা ও লা'নতের কারণ সাব্যস্ত হয়।

অনেকেই حديث قسطنطينية (কন্সটান্টিনোপোলের হাদিস) নামক একটি হাদিস দ্বারা ইয়াযিদকে "ক্ষমাপ্রাপ্ত" বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, উক্ত হাদিসে রোমান সম্রাজ্যে অভিযানকারী প্রথম সেনাদলকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষমার সুসংবাদ দিয়েছেন। ইয়াযিদ যেহেতু কন্সটান্টিনোপোল অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তাই অনেক আলিম তাকে ক্ষমার নিশ্চয়তা লাভকারী বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু হাদিসের ভাষ্য ও ইতিহাসের তথ্যানুসারে এখানে কিছু ফাঁক বা বিচ্যুতি রয়ে যায়। প্রথমে উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করা প্রয়োজন। উম্মে হারাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

أول جيش من أمتي يغزون مدينة قيصر مغفور لهم

অর্থঃ আমার উম্মতের প্রথম দল, যারা সিজারের শহরে (রোমান সম্রাজ্য) অভিযান করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল জিহাদ ওয়াস-সিয়ার, ২৭৬৬)

উক্ত হাদিস এবং প্রথম রোমান সম্রাজ্য অভিযানের প্রেক্ষিতে ইয়াযিদকে নিশ্চিতভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত বলে অবিহিত করা আমাদের কাছে যথার্থ বলে মনে হয়না। কারণ-

১. হাদিসের মূলভাষ্যে قسطنطينية (কন্সটান্টিনোপোল) শব্দটির কোন উল্লেখ নেই। হাদিসের ব্যাখ্যায় কতিপয় উলামা কন্সটান্টিনোপোলকে সিজারের শহর বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) উক্ত হাদিসে কন্সটান্টিনোপোলের নাম উচ্চারণ করেননি। প্রসঙ্গত, বর্তমান ইস্তাম্বুলের পূর্বনাম ছিল কন্সটান্টিনোপোল।

তাছাড়া কতিপয় আলিম বলেছেন, তৎকালীন সময় সিজারের শহর ছিল বর্তমান সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হোমস শহর। অতএব ক্ষমার সুসংবাদ হোমস অভিযানকারী দলের প্রতি সম্বন্ধিত হবে। উল্লেখ্য, উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) হোমস বিজয় করেছিলেন।

২. রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রোমান সম্রাজ্যে অভিযানকারী প্রথম দল ক্ষমাপ্রাপ্ত। প্রথম দল রোমান সম্রাজ্যে অভিযান করেছিল ৪২ হিজরি সনে। ইয়াযিদ যে দলে ছিলেন সে দল ৪৯-৫০ হিজরি সনে অভিযানে গিয়েছিল। আল্লামা ইবনুল আসীর বলেছেন-

دخلت سنة اثنتين وأربعين - في هذه السنة غزا المسلمون اللان وغزوا الروم

অর্থঃ ৪২ হিজরি প্রবেশ করল। এ বছর মুসলমান ও রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল।

(আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৪২ হিজরির ঘটনা)

ইবনুল আসীরের ভাষ্যমতে, এরপর আরো কয়েকটি মুসলিম দল রোমান সম্রাজ্যে অভিযান করেছিল। এরপর ইবনুল আসীর বলেছেন-

ثم دخلت سنة تسع وأربعين... في هذه السنة، وقيل سنة خمسين، سير معاوية جيشا كثيفا إلى بلاد الروم للغزاة وجعل عليهم سفيان بن عوف وأمر ابنه يزيد بالغزاة معهم

অর্থঃ অতপর ৪৯ হিজরি প্রবেশ করল। এ বছর, কেউ কেউ বলেন ৫০ হিজরিতে মু'আবিয়া (রা.) সুফিয়ান ইবনে আউফের নেতৃত্বে একটি বিশাল দল রোমান সম্রাজ্য অভিযানে প্রেরণ করলেন এবং তাঁর ছেলে ইয়াযিদকেও যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

(আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৪৯ হিজরির ঘটনা)

সুতরাং, ইয়াযিদ প্রথম দলে ছিলেন না। আর যদি প্রথম দলে না থাকেন, তাহলে তিনি কিভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক ঘোষিত ক্ষমার সুসংবাদপ্রাপ্ত হবেন?

৩. যদি ব্যাখ্যাকারদের ভাষ্য অনুযায়ী কন্সটান্টিনোপোল অভিযানকে উক্ত হাদিসের সাথে সংযুক্ত করা হয়, অথবা মুসনাদে আহমদের একটি হাদিসে কন্সটান্টিনোপোল অভিযানের কথা বলা হয়েছে সেটিকে, তাহলে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, কন্সটান্টিনোপোলে পরিচালিত প্রথম অভিযানেও ইয়াযিদ ছিলেন না। ইবনুল আসীর ৪৩ হিজরির অভিযানের ব্যাপারে বলেন-

ثم دخلت سنة ثلاث وأربعين - في هذه السنة غزا بسر بن أبي أرطاة الروم وشتا بأرضهم حتى بلغ القسطنطينية

অর্থঃ অতপর ৪৩ হিজরি প্রবেশ করল। এ বছর বুসর ইবনে আবি আরতার নেতৃত্বাধীন (মুসলিম) বাহিনী রোমান সম্রাজ্যে অভিযান করে এবং কন্সটান্টিনোপোল পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

(আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৪৩ হিজরির ঘটনা)

উপরোল্লিখিত ঐতিহাসিক বর্ণনার সত্যতা নিশ্চিত হয় বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত দুটি হাদিসের মাধ্যমে।

ক. সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ অধ্যায়ে তাবেয়ী আবু ইমরান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমরা আব্দুর রহমান ইবনে খালিদের নেতৃত্ব কন্সটান্টিনোপোল শহরে যুদ্ধে রত ছিলাম, যখন আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) আমাদেরকে একটি আয়াতের তাফসির বর্ণনা করেছিলেন। আয়াতটি হল-

وأنفقوا في سبيل الله ولا تلقوا بأيديكم إلى التهلكة

অতপর তিনি কন্সটান্টিনোপোলে একের পর এক অভিযানে অংশগ্রহণ করতেই থাকেন। একসময় সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁকে কন্সটান্টিনোপোলে দাফন করা হয়।

উল্লেখ্য, এ অভিযানে ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া উপস্থিত ছিলেন না। কোন একটি সূত্রেও তার উপস্থিতির কথাটি উল্লেখ নেই। তাছাড়া তখন তার বয়সও খুব কম ছিল।

খ. সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) কন্সটান্টিনোপোলে সংঘটিত একটি অভিযানে ইন্তেকাল করেন, যে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া। অতপর তাঁকে কন্সটান্টিনোপোলে দাফন করা হয়। এ ঘটনাটি ইমাম যাহবী "সিয়ারু আ'লামিন নুবালা" গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোন অভিযানটি প্রথমে সংঘটিত হয়েছিল? সুনানে আবু দাউদে উল্লেখিত হাদিস, যেখানে আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) তাঁর সাথীদেরকে আয়াতের তাফসির বলেছিলেন এবং যে দলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে খালিদ, সে অভিযানটি প্রথমে সংঘটিত হয়েছিল? নাকি সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত হাদিস, যেখানে আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) ইন্তেকাল করেছেন এবং যে দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া, সে অভিযানটি প্রথমে সংঘটিত হয়েছিল?

খুব সহজ উত্তর। অবশ্যই সুনানে আবু দাউদে উল্লেখিত অভিযানটি প্রথমে সংঘটিত হয়েছিল (যেখানে ইয়াযিদ ছিলেন না)। কারণ এ অভিযানে আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) জীবিত ছিলেন এবং হাদিসের ভাষ্যমতে, এরপর তিনি আরো বহু অভিযানে একের পর এক অংশগ্রহণ করেছিলেন। সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত অভিযানে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইয়াযিদের নেতৃত্বাধীন অভিযান কন্সটান্টিনোপোলে মুসলমানদের প্রথম অভিযান ছিলনা। এমনকি সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত অভিযানটিও কন্সটান্টিনোপোলে মুসলমানদের প্রথম অভিযান ছিলনা। এটি ২য়, মতান্তরে ৩য় অভিযান ছিল। সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত ইয়াযিদের নেতৃত্বাধীন অভিযানটি ছিল ৭ম, মতান্তরে ৮ম অভিযান। আর, ক্ষমার সুসংবাদ ছিল প্রথম অভিযানকারী দলের উপর। তাহলে ৭ম, মতান্তরে ৮ম অভিযানে অংশগ্রহণ করে ইয়াযিদ কিভাবে ক্ষমার সুসংবাদের দাবীদার হন?

৪. ইয়াযিদ ৪৯-৫০ হিজরিতে যে অভিযানে কন্সটান্টিনোপোল গিয়েছিলেন, সেখানেও তিনি স্বেচ্ছায় যাননি। ইবনুল আসীর ৪৯-৫০ হিজরির অভিযান সম্বন্ধে বলেন-

وأمر ابنه يزيد بالغزاة معهم، فتثاقل واعتل، فأمسك عنه أبوه، فأصاب الناس في غزاتهم جوع ومرض شديد، فأنشأ يزيد يقول... فبلغ معاوية شعره فأقسم عليه ليلحقن بسفيان إلى أرض الروم ليصيبه ما أصاب الناس

অর্থঃ এবং মু'আবিয়া (রা.) তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে এ দলের সাথে যেতে বললেন। ইয়াযিদ অসুস্থতার ভান করে বসে রইলেন। তাই তার পিতাও তার থেকে বিরত রইলেন। ওদিকে রোম সম্রাজ্যে অভিযানরত সেনাদলকে দুর্ভিক্ষ ও কঠিন রোগে পেয়ে বসল। এ সংবাদ পৌঁছালে ইয়াযিদ বললেন...(একটি কবিতা পড়েছিলেন)। যখন মু'আবিয়ার কাছে তার কবিতা পৌঁছাল, তখন তিনি কসম দিয়ে ইয়াযিদকে রোম অভিযানে প্রেরণ করলেন। যেন মুসলিম সেনাদল সেখানে যে কষ্ট করছেন, তাকেও সে কষ্টের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়।

(আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৪৯ হিজরির ঘটনা)

এটি ছিল ইয়াযিদের প্রথম অভিযান। এরপর ৫৪ হিজরিতে সংঘটিত অভিযানের নেতৃত্বেও ইয়াযিদ ছিলেন। সেই অভিযানে আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) ইন্তেকাল করেছিলেন।

৫. উক্ত হাদিসে উল্লেখিত "ক্ষমার সুসংবাদ" দ্বারা কোন ব্যক্তি জান্নাতের নিশ্চিত অধিকার লাভ করেননা। জান্নাতের নিশ্চিত দাবীদার আশারায়ে মুবাশশারাহ, আসহাবে বদর, বাই'আতে রিদ্বওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবিগণ, নির্দিষ্ট করে নাম উল্লেখ করা কিছু সাহাবি এবং বৃহত্তর অর্থে সমস্ত সাহাবিগণ। এছাড়া পরবর্তী প্রজন্মসমূহের ক্ষেত্রে যখন এরকম কোন হাদিস পাওয়া যায়, সেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) কোন একটি কাজের জন্য কোন ব্যক্তির প্রতি আগাম জান্নাত বা মাগফিরাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, এমতাবস্থায় এসব সুসংবাদকে মাগফিরাত বা জান্নাত প্রাপ্তির "অন্যতম কারণ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, গুরুত্বারূপ করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) অসংখ্যবার তৎকালীন এবং পরবর্তীতে আগত উম্মতকে এরকম সুসংবাদ দান করেছেন। আল্লামা ড. তাহির উল-কাদরী বলেছেন, হাদিস গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়, ১৬২০ বার বিভিন্ন হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলকে এরকম ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। যেমন একটি হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি এটি জেনে মারা গেল যে "আল্লাহ এক" সে জান্নাতে যাবে। আরেকটি হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি ফজর ও আছরের নামাজ আদায় করে সে জান্নাতে যাবে। এরকম আরো অনেক রেওয়ায়াত বিদ্যমান। এর মানে এই নয় যে, ঐ ব্যক্তির জীবনের আরো কোন কাজই ধর্তব্য হবেনা। উলামায়ে কেরাম বলেন, এসব সুসংবাদের অর্থ হল, আর কোন পাপাচারিতায় লিপ্ত না হয়ে মৃত্যুবরণ করলে উক্ত সুসংবাদটি জান্নাতের নিশ্চয়তা দেয়।

যদি সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত ক্ষমাপ্রাপ্তির হাদিস অনুযায়ী ইয়াযিদ ক্ষমার সুসংবাদপ্রাপ্ত হয়েও থাকেন, তবু তিনি তার পরবর্তী কৃতকর্মের দরূণ নিজেকে এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন যে, আমরা তাকে "নিশ্চিতভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত" বলতে পারিনা। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

ইয়াযিদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের ভেতরেই তিনটি মতামত বিদ্যমান।

১. ইয়াযিদ ছিলেন মুসলমানদের আমীর, জনপ্রিয় শাসক, উত্তম ব্যক্তিত্ব এবং তার মধ্যে ভাল-মন্দ উভয়ই ছিল।

২. ইয়াযিদ ইসলামের সীমানা থেকে বাইরে, অর্থাৎ সরাসরি কাফির এবং লা'নতপ্রাপ্ত।

৩. ইয়াযিদ একজন ফাসিক এবং তার কৃতকর্মের জন্য তিনি লা'নতের যোগ্য।

প্রথমত, যারা ইয়াযিদকে আমিরুল মু'মিনীন এবং ভাল মানুষ বলে গণ্য করেন, তাদের মাত্রাতিরিক্ত বনু উমাইয়া-প্রীতিই তাদেরকে এমন অবিচারপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া এমন "আমীর", যার বাই'আত গ্রহন করা হয়েছিল মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে এবং একপ্রকার জোর করেই। ওদিকে আমিরুল মু'মিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ফতোয়া দিয়েছেন-

من بايع رجلا عن غير مشورة من المسلمين فلا يبايع هو

অর্থঃ যে কেউ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত বাই'আত করবে, তার অনুসরণ করা যাবেনা।

(সহীহ বুখারী : কিতাবুল হুদুদ, ৬৪৪২)

সুতরাং ইয়াযিদ কোনভাবেই আমিরুল মু'মিনীন হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। তার উপর তিনি এমনসব কর্ম করেছেন এবং করিয়েছেন, যা সরাসরি আল্লাহর নবী (সা.)-কে সরাসরি কষ্ট দেয়ার নামান্তর। ইমাম যাহবী "সিয়ারু আ'লামিন নুবালা" গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীযের সামনে ইয়াযিদকে আমিরুল মু'মিনীন বলে আখ্যায়িত করায় উমর ইবনে আব্দুল আযীয তাকে বিশটি বেত্রাঘাত করার আদেশ দিয়েছিলেন।

ব্যক্তি হিসেবে ইয়াযিদ কতো ভাল মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ একটি কথার দ্বারাই পাওয়া যায়। তা হল- আহলে সুন্নাতের একটি হাদিসের কিতাবে ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়া থেকে একটি বর্ণনাও গ্রহন করা হয়নি। উম্মতে মুহাম্মাদির সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ ইয়াযিদ থেকে কোন বর্ণনা গ্রহন না করার মধ্য দিয়ে ইয়াযিদের ভালমানুষীর পরিচয় উন্মুচিত করে দিয়েছেন। খলিফা আবু বকর (রা.), উমর (রা.) এবং আলী (রা.)-এর সন্তানদের থেকে সুন্নী হাদিসের কিতাবসমূহে অগনিত সংখ্যক বর্ণনা গ্রহন করা হয়েছে। খলিফা উসমান (রা.)-এর পুত্র আবান ইবনে উসমান সীরাত শাস্ত্রের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান সংকলক। কিন্তু মু'আবিয়া (রা.) ২০ বছর উম্মতের নেতৃত্বে থাকার পরও তার পুত্র থেকে কোন একজন মুহাদ্দিছ একটি হাদিসও গ্রহন করেননি। যদি ইয়াযিদের চরিত্র প্রশংসনীয় হতো, তবে মু'আবিয়া (রা.)-এর পুত্র হিসেবে ইয়াযিদ থেকে দু'একটি হাদিস/বর্ণনা তো গ্রহন করা যেত? হাফিয ইবনুল জাওযী "আর-রাদ্দু আলাল মুতা'আসসিবিল আনীদ" গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে ইয়াযিদ থেকে হাদিস গ্রহন করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইয়াযিদ থেকে কোন বর্ণনা গ্রহন করা যাবেনা। যখন উম্মতে মুহাম্মাদির সকল মুহাদ্দিছ তাবেয়ীদের যুগে বসবাস করা একজন ব্যক্তির অগ্রহনযোগ্যতার উপর এভাবে ঐক্যমত পোষণ করেন, তখন ঐ ব্যক্তি কেমন ভালমানুষ তা সহজেই অনুমেয়।

দ্বিতীয়ত, যারা ইয়াযিদকে সরাসরি কাফির বলেন, তাঁদের মতটি আহলে সুন্নাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত নয়। যদিও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলসহ আহলে সুন্নাতের কিছু ইমাম এ মত পোষণ করেছেন। বস্তুত, ইসলাম থেকে সে ব্যক্তিই বহিষ্কৃত বলে গণ্য হয়, যে ঘোষণা দিয়ে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালতকে অস্বীকার করে দ্বীন থেকে বেরিয়ে যায়। ইতিহাস বলে, ইয়াযিদ এমনটি করেননি। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াত এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদিস থেকে কুফর ও কাফিরের যে দর্শন আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়, তাতে বুঝা যায় যে, কুফরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মে পতিত হলেই কোন মুসলিম ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়না। সুতরাং কোন "আহলে কিবলা" ব্যক্তিকে তার বড় থেকে বড় পাপের জন্যও সরাসরি কাফির বলে ফতোয়া দেয়াতে কিছুটা ঝুঁকি তো থেকেই যায়।

তৃতীয়ত, আহলে সুন্নাতের বেশিরভাগ ইমামের মতে, ইয়াযিদ ব্যক্তি-চরিত্রের দিক থেকে ফাসিক তথা পাপাচারী এবং তার কৃতকর্মের জন্য লা'নত তথা অভিসম্পাত পাওয়ার যোগ্য। তবে যেহেতু কাউকে লা'নত করার মধ্যে কোন উপকার নেই, তাই আহলে সুন্নাত ইয়াযিদকে নাম ধরে লা'নত করেননা।

আহলে সুন্নাতের ইমাম চতুষ্টয়ের অন্যতম ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদিস বিশারদ ইমাম কাদ্বী আবু ইয়ালা ও হাফিজ ইবনুল জাওযী, তাফসির বিশারদ আল্লামা মাহমুদ আলূসী, আকীদা বিশেষজ্ঞ আল্লামা তাফতাযানী, খ্যাতিমান পণ্ডিত আল্লামা শাওকানী প্রমুখ ইয়াযিদকে লা'নতের যোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা মাহমুদ আলূসী "তাফসিরে রূহুল মা'আনী" গ্রন্থে সুরা মুহাম্মদের তাফসিরে বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ইয়াযিদকে লা'নতের যোগ্য বলে আখ্যায়িত করার প্রমাণস্বরূপ সুরা মুহাম্মদের একটি আয়াত উল্লেখ করেছেন। আয়াতটি হল-

فهل عسيتم إن توليتم أن تفسدوا في الأرض وتقطعوا أرحامكم أولئك الذين لعنهم الله

অর্থঃ ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের উপরই আল্লাহর লা'নত।

(সুরা মুহাম্মদ : ২২-২৩)

আল্লামা মুহাম্মদ আল-মুনাওয়ী "ফায়যুল কাদীর" গ্রন্থে আল্লামা তাফতাযানীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আল্লামা তাফতাযানী বলেছেন-

لا أشك في إسلامه بل في إيمانه فلعنة الله عليه وعلى أنصاره وأعوانه

অর্থঃ আমরা তার (ইয়াযিদের) ইসলামের উপর সন্দেহ পোষণ করিনা; কিন্তু তার ঈমানের উপর সন্দেহ পোষণ করি। তার উপর আল্লাহর লা'নত, এবং তার সহকারী ও সহযোগীদের উপরও।

তবে আহলে সুন্নাত ইয়াযিদের নামে সরাসরি ملعون (লা'নতপ্রাপ্ত) শব্দটি ব্যবহার করেননা। কারণ হাদিস বিশারদ ইমাম ইবনে হাজার হাইছামী বলেছেন, কাউকে নাম ধরে গালি দেয়ার মধ্যে কোন উপকার নেই এবং তা জায়েযও নয়। রিজালশাস্ত্র বিশারদ ইমাম যাহবী বলেছেন, আমরা ইয়াযিদকে গালি দেইনা (তাতে কোন উপকার নেই) এবং আমরা তাকে ভালও বাসিনা। হাফিজ ইবনুল জাওযী "আর-রাদ্দু আলাল মুতা'আসসিবিল আনীদ" গ্রন্থে সালেহ ইবনে আহমদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি তাঁর পিতা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের নিকট "ইয়াযিদকে ভালবাসা" সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে ইমাম আহমদ জবাব দিয়েছিলেন, কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি ইয়াযিদকে ভালবাসতে পারে? অতপর সালেহ ইবনে আহমদ "ইয়াযিদকে লা'নত করা" সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে ইমাম আহমদ জবাব দিলেন, তুমি কখনো তোমার পিতাকে কাউকে নাম ধরে লা'নত করতে দেখেছ? আল্লামা হাফিজ উদ্দীন হানাফি বলেছেন, ইয়াযিদের উপর লা'নত করা বৈধ, তবে করা শুভনীয় নয়। এটি ইমাম আবু হানিফারও মতামত।

উপরোক্ত তিনটি অবস্থানের মধ্যে আমাদের নিকট তৃতীয় মতকেই অধিক নির্ভরযোগ্য মনে হয়। আর, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা'আলা সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

(১. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ : আল্লামা ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, ইয়াযিদ ইবনে মু'আবিয়ার শাসন, জীবনকথা ও মৃত্যু

২. আল-কামিল ফিত-তারিখ : আল্লামা ইবনুল আসীর, ৬৪ হিজরির ঘটনা

৩. سير اعلأم النبلأء : ইমাম যাহবী

৪. الرد علي المتعصب العنيد المانع من ذم يزيد : হাফিজ ইবনুল জাওযী

৫. نيل الأوطار : আল্লামা শাওকানী

৬. تفسير الروح المعاني : আল্লামা মাহমুদ আলূসী

৭. شرح العقائد النسفية : আল্লামা সা'দউদ্দীন তাফতাযানী)

উপরোল্লিখিত কয়েকটি তথ্য ও মতামতের সাথে আমি একমত নই। তবুও হাদিস, সীরাত ও ইতিহাসের পাতা তুলে দিলাম। সম্মানিত পাঠক নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মা'আসসালাম।।