কারবালা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হিজরি বর্ষ শেষ হয় নবী ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর কুরবানীর স্মৃতি নিয়ে, আবার শুরু হয় ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের স্মৃতি নিয়ে। নবী ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে শেষপর্যন্ত পুত্র কুরবানী দিতে হয়নি। কিন্তু আমাদের নবী ﷺ-কে দিতে হয়েছিল। চাচা হামযা থেকে শুরু করে নাতি হুসাইনকে আল্লাহর রাস্তায় নযরানা পেশ করে আমাদের নবী ﷺ উম্মাতকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এ দ্বীন ত্যাগ ও কুরবানীর দ্বীন। এখানে চকচকে পোশাক আর সুগন্ধি মাখা তকতকে চেহারার চাইতে উহুদের ময়দানে পড়ে থাকা হামযা রা. এর কাঁটাছেড়া রক্তাক্ত কলিজাবিহীন দেহটিই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।
হিজরি বর্ষ শেষ হয় নবী ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর কুরবানীর স্মৃতি নিয়ে, আবার শুরু হয় ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর শাহাদাতের স্মৃতি নিয়ে। নবী ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে শেষপর্যন্ত পুত্র কুরবানী দিতে হয়নি। কিন্তু আমাদের নবী ﷺ-কে দিতে হয়েছিল। চাচা হামযা থেকে শুরু করে নাতি হুসাইনকে আল্লাহর রাস্তায় নযরানা পেশ করে আমাদের নবী ﷺ উম্মাতকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এ দ্বীন ত্যাগ ও কুরবানীর দ্বীন। এখানে চকচকে পোশাক আর সুগন্ধি মাখা তকতকে চেহারার চাইতে উহুদের ময়দানে পড়ে থাকা হামযা রা. এর কাঁটাছেড়া রক্তাক্ত কলিজাবিহীন দেহটিই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।
আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেছেন, আমরা রাসূল ﷺ এর সাথে পথ চলছি, তখন তাঁর জুতা ছিড়ে গেল। তিনি আলীকে তাঁর জুতা ঠিক করতে দিলেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি আছে, যে কুরআনের তা'বীলের জন্য কিতাল করবে, যেভাবে আমি কুরআনের তানযীলের জন্য কিতাল করছি (অর্থাৎ রাসূল ﷺ কিতাল করেছেন কুরআনকে 'আল্লাহর কিতাব' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ানোর জন্য, আর ওই ব্যক্তি কিতাল করবেন কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য)। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ওই ব্যক্তি কে? রাসূল ﷺ বললেন, যে আমার জুতা ঠিক করছে [মুসনাদে আহমাদ, ১১৭৭৩]। কুরআনের জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাহাত্ম্যপূর্ণ কিতাল ছিল বদর যুদ্ধ, যেখানে আলী রা. শরীক ছিলেন। আর কুরআনের জন্য আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু-এর কিতাল ছিল খারিজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ, যেখানে তাঁর সাথে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দুআ উপস্থিত ছিল।
পিতার আদর্শ অনুসরণ করেছেন ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম। তবে তাঁর যুদ্ধটি একটু ভিন্ন ছিল। পিতার শাহাদাতের পর হিজায, ইয়ামেন, ইরাক, খোরাসানসহ বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ তাঁর হাতে খিলাফাতের বাইআত দিয়েছিল। তবুও কেবল উম্মাতের মধ্যে রক্তপাত রোধ করার স্বার্থে তিনি খিলাফাত ত্যাগ করেছেন। রাসূল ﷺ তাঁর ব্যাপারে বলেছেন-
إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ وَلَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“নিশ্চয়ই আমার এ বাচ্চা নেতা। সম্ভবত আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুটি বড় দলের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করাবেন।” [সহীহ বুখারী, ২৭০৪]
একই সিলসিলা ধরে এসেছে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম-এর কুরবানী। নাসিবীরা বলে, কারবালা কোনো দ্বীনি মাসয়ালা নয়। আরে কারবালা-ই তো দ্বীনি মাসয়ালা। তবে সেটি বুঝার আগে 'দ্বীন' বুঝতে হবে। দ্বীন মানে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে মানব জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, রাজনৈতিক সব দিক বিদ্যমান। ইসলাম একটি দ্বীন, যা মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও ক্ষেত্রের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিপূর্ণ আনুগত্য নিশ্চিত করতে চায়। রাসূল ﷺ আল্লাহর দ্বীন তথা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিতাল করেছেন এবং সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
এই পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার ওপর প্রথম ধাক্কা লেগেছে, যখন নুবুয়াতের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাত ভেঙ্গে বনু উমাইয়ার 'দাঁত দিয়ে কেটে খাওয়া' রাজতন্ত্র শুরু হয়েছে। মুসলমানদের পছন্দ-অপছন্দ তোয়াক্কা না করে খিলাফাতকে বংশানুক্রমে পরিচালনা করা হয়েছে এবং ক্ষমতার জোরে শাসকের হাতে বাইআত নেয়া হয়েছে [সহীহ বুখারী, ৪৮২৭; ফাতহুল বারী, খ. ৮, পৃ. ৫৭৬-৫৭৭]। রাসূল ﷺ বলেছেন-
أَوَّلُ مَنْ يُبَدِّلُ سُنَّتِي رَجُلٌ مِنْ بَنِي أُمَيَّةَ
“সর্বপ্রথম আমার সুন্নাতকে পরিবর্তন করবে বনু উমাইয়ার এক ব্যক্তি।” [মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবা, ৩৫৮৭৭]
সালাফি মাসলাকের প্রসিদ্ধ আলিম শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী এ হাদীসের সনদকে 'হাসান' বলেছেন, এবং বলেছেন-
ولعل المراد بالحديث تغيير نظام اختيار الخليفة وجعله وراثة والله أعلم
“সুন্নাতকে পরিবর্তন করবে- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে, খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে সেটিকে বংশীয় (পিতার পর পুত্র) বানিয়ে দেবে। আল্লাহই ভালো জানেন।” [সিলসিলা আহাদীসুস সাহীহাহ, খ. ৪, পৃ. ৩৩০]
অতএব ইয়াযিদ বদকার, বেনামাজি নাকি মদখোর সেটি আমাদের মূল ঝগড়া নয়। মূল ঝগড়া হচ্ছে, যেভাবে ইয়াযিদকে ক্ষমতায় বসিয়ে তার পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে, তা রাসূল ﷺ এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বিপরীত। যে ব্যক্তি মুসলমানদের পছন্দ ও পরামর্শ ব্যতিরেকে জোরপূর্বক মুসলমানদের ওপর চেপে বসবে, সে ফেরেশতা হলেও পরিত্যাজ্য। এ উম্মাতকে নিজেদের নেতা বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল ﷺ। উম্মাতের হাত থেকে এ অধিকার কেড়ে নেয়াই ছিল সুন্নাতের প্রথম পরিবর্তন। ইমাম আবু আবদিল্লাহ হুসাইন আলাইহিস সালাম সেই পরিবর্তনের প্রতিবাদ করেছেন। যদি তিনি ইয়াযিদের হাতে বাইআত দিয়ে দিতেন, তাহলে বাতিলের সামনে হকের কালিমা নিচু হয়ে যেত। নবী-পরিবার নানাজানের পতাকাকে নিচু হতে দেননি। ইসলামের পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার মধ্যে যখন পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন নবী-পরিবার রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং কারবালা সেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রাজসাক্ষী হয়ে আছে। তবে হুসাইন কেবল কারবালায় শহীদ হননি। যখনই কেউ ইয়াযিদের সমর্থনে একটি বাক্য ব্যয় করে, তখন হুসাইনের ওপর আরেকটি তীর ছোড়া হয়। আর হুসাইনি মানহাজের অনুসারীরা দ্বীনের পরিপূর্ণতা ও আহলে বাইতের মাহাব্বাতকে সেভাবেই আগলে রাখে, যেভাবে রেখেছিলেন হুসাইন আলাইহিস সালামের সঙ্গী সাঈদ ইবন আবদুল্লাহ। ৯ই মুহাররাম রাতে তিনি বলেছিলেন-
وَاللَّهِ لَا نُخَلِّيكَ حَتَّى يَعْلَمَ اللَّهُ أَنَّا قَدْ حَفِظْنَا غَيْبَةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيكَ وَاللَّهِ لَوْ عَلِمْتُ أَنِّي أُقْتَلُ دُونَكَ أَلْفَ قَتْلَةٍ وَأَنَّ اللَّهَ يَدْفَعُ بِذَلِكَ الْقَتْلَ عَنْكَ وَعَنْ أَنْفُسِ هَؤُلَاءِ الْفِتْيَةِ مِنْ أَهْلِ بَيْتِكَ لَأَحْبَبْتُ ذَلِكَ فَكَيْفَ وَإِنَّمَا هِيَ قَتْلَةٌ وَاحِدَةٌ
“আল্লাহর কসম, আমরা ততক্ষণ আপনাকে ছেড়ে যাব না যতক্ষণ না আল্লাহ দেখে নেন যে, আমরা আহলে বাইতকে রক্ষার ব্যাপারে রাসূল ﷺ এর ওসিয়ত পালন করেছি। আমাকে হাজারবার হত্যা করার বিনিময়ে যদি আপনার এবং আহলে বাইতের প্রাণ বাঁচানো যেত, আমি খুশি মনে তা-ই করতাম। কিন্তু (হে হুসাইন), আমি তো কেবল একবারই প্রাণ দিতে পারব।” [বিদায়াহ, খ. ১১, পৃ. ৫৩০]
বি.দ্রঃ আহলে বাইতের নামের সাথে 'আলাইহিস সালাম' ব্যবহার করা মুহাদ্দিসীনের আদর্শ। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ প্রমুখ হাদীসের ইমামগণ নিজ নিজ কিতাবে আহলে বাইতের নামের সাথে প্রায় জায়গায় আলাইহিস সালাম লিখেছেন। তাই আমি এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছি, যেন এ ব্যাপারে মানুষের সন্দেহ দূর হয়।
* হাদীস ও অন্যান্য সূত্রের নম্বর মাকতাবাতুশ শামিলা অনুসারে
-Marjan Ahmed Chy