ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

জেন্ডার, লিঙ্গ-পরিচয় ও পরিবর্তনঃ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

নতুন শিক্ষানীতিতে সপ্তম শ্রেণীর একটি বইয়ে দুই প্রকার লিঙ্গের সাথে পরিচয় করানো হয়েছে। একটি জৈবিক লিঙ্গ, অপরটিকে সামাজিক লিঙ্গ বলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি পড়ে অনেকেই বুঝবেন না যে, এর পেছনে কী লুকিয়ে আছে।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
জেন্ডার, লিঙ্গ-পরিচয় ও পরিবর্তনঃ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

নতুন শিক্ষানীতিতে সপ্তম শ্রেণীর একটি বইয়ে দুই প্রকার লিঙ্গের সাথে পরিচয় করানো হয়েছে। একটি জৈবিক লিঙ্গ, অপরটিকে সামাজিক লিঙ্গ বলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি পড়ে অনেকেই বুঝবেন না যে, এর পেছনে কী লুকিয়ে আছে।

মাদরাসা বা স্কুলে আমাদেরকে যা শেখানো হয়, আমরা বিশ্বাস করে তা শিখি। বয়স ও যোগ্যতা কম থাকায় পাল্টা প্রশ্ন বা দ্বিমত পোষণ করতে পারি না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বই ও শিক্ষকের সাথে দ্বিমত পোষণ, পাল্টা প্রশ্ন ও নতুন অন্বেষণ করতে পারি। মাদরাসা, এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজে আমার মূল অধ্যয়নের বিষয় ছিল ইসলাম। সাথে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয়। তবে পড়ার ধরণ ছিল অভিন্ন। উভয় জায়গায় আমি ইসলামের ভেতরে থেকে, অর্থাৎ ইসলামকে সত্য জেনেই অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু ইউরোপে এই সুযোগ নেই। তারা ইসলামকে কেবল একটি সামাজিক শক্তি ও ঘটনা (Societal Force and Phenomenon) হিসেবে বিচার করে। তাই ইসলাম কী বলল, তা রেখে এখানে আমাকে মুসলিম চিন্তা, রিলিজিয়াস প্লুরালিজম, মুসলিম ডায়াস্পোরা, ইউরোপীয় ট্রেডিশন, এরিয়া স্টাডিজ, জেন্ডার স্টাডিজ, মিস্টিসিজম, পার্সিয়ান লিটারেচার, পোস্ট কলোনিয়াল যুগ, ট্রমা স্টাডিজ, এনথ্রোপলজি ইত্যাদি পড়তে হয় এবং এসব তত্ত্ব দিয়ে ইসলামকে বিচার করতে হয়। অনেক কিছু আমি শিখি। আবার অনেক তত্ত্ব আছে, যা মানতে পারি না। যুক্তিতর্ক ও সমালোচনা করি। আমার পূর্ববর্তী শিক্ষা এই ভিত গড়ে দিয়েছে। এবার ১২ বা ১৩ বছরের একটি বাচ্চার সামনে যদি এসব তুলে ধরা হয়, সে কিন্তু সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেবে। কারণ তার সেই বয়স ও যোগ্যতা তৈরি হয়নি।

ফিরে যাই ওপরের আলোচনায়। ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে Sex ও Gender, বাংলাতে দুটিকেই লিঙ্গ বলা হয়। এক সময় এগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও এখন ভিন্ন অর্থে হয়। তাই বাংলা ভাষায় Sex-কে বলা হয় জৈবিক লিঙ্গ এবং Gender-কে বলা হয় সামাজিক লিঙ্গ।

ইসলামের বিধান হচ্ছে, স্রষ্টা যাকে যে লিঙ্গ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তার লিঙ্গ-পরিচয় হবে সেই লিঙ্গ অনুসারে৷ পুংলিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে পুরুষ, স্ত্রীলিঙ্গ হলে নারী। পুরুষের অভিব্যক্তি– চালচলন, কথাবার্তা ও পোশাক হবে পুরুষালি এবং নারীর অভিব্যক্তি হবে মেয়েলি বা নারীর মতো। রাসূলুল্লাহ ﷺ লা‘নত করেছেন সেই পুরুষের ওপর, যে নারীর বেশভূষা ধারণ করে ও সেই নারীর ওপর, যে পুরুষের বেশভূষা ধারণ করে (সহীহ বুখারী, ৫৮৮৫)। আবার পুরুষের শারীরিক আকর্ষণ হবে বিপরীত লিঙ্গ তথা নারীর প্রতি এবং নারীর আকর্ষণ হবে তার বিপরীত লিঙ্গ তথা পুরুষের প্রতি। সমকামিতা ইসলামে গুরুতর অপরাধ। কুরআনে এটিকে ফাহিশাহ ও ফিসক বলা হয়েছে। রাসূল ﷺ বলেছেন, সমকামিতায় লিপ্ত উভয় ব্যক্তিকে হত্যা করো (আবু দাউদ, ৪৪৬২)।

আজ বলা হচ্ছে, জন্মের সময় ব্যক্তি যে লিঙ্গ নিয়ে আসে, সেটি কেবল তার Sex বা জৈবিক লিঙ্গ। এটি তার লিঙ্গ-পরিচয় নয়। লিঙ্গ-পরিচয় ‘সমাজ’ ঠিক করে দেয়। এর নাম Gender বা সামাজিক লিঙ্গ। চাইলে এই পরিচয় পরিবর্তন করা যায়। পুংলিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও কেউ নিজেকে নারী, আবার স্ত্রীলিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও নিজেকে পুরুষ পরিচয় দিতে পারে। পুরুষ বা নারী হওয়া ইচ্ছার ওপর; লিঙ্গের ওপর নয়। ব্যক্তির চালচলন, কথাবার্তা ও পোষাক পুরুষ নাকি নারীর মতো হবে, সেটিও তার ইচ্ছা। ব্যক্তি কি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হবে, নাকি সমলিঙ্গের প্রতি, নাকি উভয়ের প্রতি, সেটিও তার ইচ্ছা। চাইলে জৈবিক লিঙ্গ পরিবর্তন করে কেউ পুরুষ থেকে নারী অথবা নারী থেকে পুরুষ হতে পারবে। এটি নাকি মানবাধিকার!

তৃতীয় আরেকটি বৈধ লিঙ্গ আছে। সারা বিশ্বে মাত্র ১.৭ শতাংশ মানুষ জন্মগতভাবে লিঙ্গ সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যাদেরকে Intersex বা হিজড়া বলা হয়। এদের ব্যাপারে ইসলামের সংক্ষিপ্ত, তবে স্পষ্ট বিধান আছে। এদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা মোটেও উচিত নয়।

তবে রাস্তাঘাটে যে বিপুল পরিমাণ হিজড়া আমরা দেখি, বেশিরভাগই লিঙ্গ সমস্যা নিয়ে জন্মায়নি। এরা অপারেশনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে। এদেরকে Transgender বলা হয়। ‘আধুনিক’ মতানুযায়ী, এরাও বৈধ লিঙ্গ! এখানেই শেষ নয়। আজকাল নতুন নতুন লিঙ্গ-পরিচয় বের হচ্ছে। LGBTQ+ নামে তাদের আন্দোলন আছে। L দ্বারা নারী সমকামী, G দ্বারা পুরুষ সমকামী, B দ্বারা উভকামী, T দ্বারা লিঙ্গ পরিবর্তনকারী, Q দ্বারা বুঝানো হয় যারা এখনও ঠিক করতে পারেনি, পুরুষ নাকি নারী হবে। এরপর + (প্লাস) মানে আরও আছে। একদিন গুণে দেখি আরও প্রায় আড়াইশ লিঙ্গ-পরিচয় বের করে ফেলেছে! মনে পড়ে, ইবলিস চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল-
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ
“আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, মিথ্যা আশ্বাস দেব; তাদেরকে আদেশ দেব, ফলে তারা পশুর কান ছিদ্র করবে (একটি শিরকি প্রথা) এবং অবশ্যই তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।” (সুরা নিসা, ১১৯)

ভাবছেন, মুসলিম দেশে এসব নেই? পাকিস্তান ২০১৮-তে ট্রান্সজেন্ডার আইন করেছে, যেখানে নারী ও পুরুষকে ইচ্ছামত লিঙ্গ-পরিচয় বেছে নেয়া ও লিঙ্গ পরিবর্তন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ভেবে দেখুন, সপ্তম শ্রেণীতে জৈবিক ও সামাজিক নামে দুটি আলাদা লিঙ্গ-পরিচয় পড়ানো হচ্ছে কেন? তাতে ছোটকালেই যেন শিখে যায়, জৈবিক লিঙ্গ যাই হোক, আমি নারী নাকি পুরুষ হব, সেটি আমার ইচ্ছা। কোন পোশাক পরব, কীভাবে চলব, কী অভিব্যক্তি হবে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হব, সমলিঙ্গের প্রতি, নাকি উভয়ের প্রতি, সবই আমার ইচ্ছা।

শিক্ষানীতির কী হবে আমি জানি না। আলিম-উলামা কেবল ফাতওয়া দিয়ে দায় সারবেন, নাকি যৌক্তিক পাল্টা বয়ান দেবেন, তাও জানি না। তবে একটি অনুরোধ করতে চাই। আপনার সন্তান, ছোট ভাই-বোন স্কুল বা মাদরাসা থেকে আসার পর জিজ্ঞেস করবেন, কী শিখল। ভুল শিখে আসলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিন, যেন গোড়াতেই ভুল ভেঙ্গে যায়। তার আগে নিজে শিখুন। ইসলামের আকাঈদ ও বিধিবিধান সম্পর্কে জানুন। অন্যের সাহায্য নিন। নয়তো পস্তাতে হবে। আপনি কি চান, আপনার সন্তান আধা পুরুষ, আধা নারী, লিঙ্গ পরিবর্তনকারী, সমকামী, বেহায়া নাস্তিক হয়ে যাক? এই সাদাকাহ জারিয়াহ আপনি রেখে যেতে চান?