ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

আল-কুরআনের রত্নরাজি

রোজা (الصوم) একমাত্র ইবাদত, যার প্রতিটি খুঁটিনাটি নির্দেশ পবিত্র কুরআনের একই জায়গায় দিয়ে দেয়া হয়েছে। সুরা বাকারার ২৩ নং রুকু, আরও স্পষ্ট করে বললে ১৮৩-১৮৭ নং আয়াতে রোজা সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা বিদ্যমান।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
আল-কুরআনের রত্নরাজি

রোজা (الصوم) একমাত্র ইবাদত, যার প্রতিটি খুঁটিনাটি নির্দেশ পবিত্র কুরআনের একই জায়গায় দিয়ে দেয়া হয়েছে। সুরা বাকারার ২৩ নং রুকু, আরও স্পষ্ট করে বললে ১৮৩-১৮৭ নং আয়াতে রোজা সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা বিদ্যমান। পবিত্র কুরআনের আর কোথাও রোজার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়নি।

রোজা সম্পর্কে কথা বলার সময় আমরা রোজা সংক্রান্ত আয়াতের অবস্থান সম্পর্কে বেখবর থেকে যাই। কিন্তু পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতের অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর কালাম পূর্বাপর প্রাসঙ্গিক। একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা মিলে একটি, দুটি বা তিনটি প্রসঙ্গে আলোচনা সমাপ্ত করে৷ মাঝখান থেকে আয়াত তুলে আনলে হুকুম তো ঠিক থাকে; কিন্তু অনেক সময় প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট হয়ে যায়।

রোজার আয়াত এসেছে কেবল সুরা বাকারায়। সুরা বাকারা মাদানী সুরা। হিজরতের পরপরই এ সুরার অবতরণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ ১০ বছরে সুরাটির অবতরণ সমাপ্ত হয়। মোটাদাগে সুরা বাকারার আলোচ্য বিষয় ২টি। একটি হলো, পূর্ববর্তী মুসলিম উম্মাহকে (বনী ইসরাইল) এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া, যে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে কতো বড় বড় নিয়ামতরাজি (নবী-রাসুল, কিতাব, বাদশাহী, খাদ্যদ্রব্য, নিরাপত্তা, বিজয়) পেয়েছিল এবং সেগুলোকে কীভাবে হেলায় নষ্ট করেছিল। সুরা বাকারার প্রথম অংশে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় হলো, নাফরমানির কারণে পূর্ববর্তী উম্মাহকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে সরিয়ে ওই জায়গায় আল্লাহ এবার নতুন উম্মাহকে নিয়ে আসছেন। সুরা বাকারার মধ্যভাগ ও শেষদিকে এই নতুন উম্মাহ'র (উম্মতে মু্হাম্মাদি) অভিষেক ও উদঘাটন হয়েছে৷

এ দুটি প্রসঙ্গের প্রায় মধ্যখানে এসেছে রোজার নির্দেশ। কেন?

রামাদ্বান বা রোজা সম্পর্কে কথা আগানোর পূর্বে সুরা বাকারার গঠন ও প্রসঙ্গ সম্পর্কে একটু কথা বলে নেয়া উচিৎ (যেহেতু রোজার নির্দেশ এসেছে সুরা বাকারায়)৷ তাতে বৃহৎ চিত্রটি বুঝতে সুবিধা হবে।

সুরা বাকারা প্রথম মাদানী সুরা। তবে এর সম্পূর্ণ অবতরণে সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুরো মাদানী সময়জুড়ে সুরা বাকারা অবতীর্ণ হয়েছিল।

বাকারার প্রথম দুই রুকুতে (২০ আয়াতে) মুমিন, কাফির ও মুনাফিকদের বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ৩য় রুকুতে রয়েছে পুরো মাক্কী দাওয়াতের সারমর্ম। অর্থাৎ বিগত ১৩ বছর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় যে দাওয়াত দিয়ে এসেছেন, ৩য় রুকুতে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪র্থ রুকুতে রয়েছে আদম সৃষ্টি ও পৃথিবীতে আল্লাহর খেলাফত। এরপর শুরু হয়েছে বনী ইসরাইলের (পূর্ববর্তী মুসলিম উম্মাহ) কথা। প্রথমে বনী ইসরাইলকে রিসালাতে মুহাম্মাদির দিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। পরে তাদের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, কীভাবে তারা আল্লাহর এতো বড় বড় নিয়ামত হাতে পেয়ে সেগুলো হেলায় নষ্ট করেছিল।

এর পরপরই এসেছে এমন ২টি নির্দেশ/প্রজ্ঞাপন, যার দ্বারা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তাআলা প্রায় ২ হাজার বছর থেকে বিদ্যমান, “মনোনীত উম্মাহ” হিসেবে খ্যাত বনী ইসরাইলকে ওই আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এবং প্রথমবারের মতো বনী ইসমাঈল (ইসমাঈলের বংশধর) থেকে একটি উম্মাহ মনোনীত করেছেন। ওই ২টি প্রজ্ঞাপন ছিল-

১. কিতাব (কুরআন)। উম্মাহ হওয়ার মূল উপসর্গ বা হাতিয়ার হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কিতাব৷ আর, এ রামাদ্বান মাসেই আল্লাহর কিতাব কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীর আসমানে অবতীর্ণ হয়েছিল, যে কুরআন উম্মতে মুহাম্মাদিকে “মনোনীত উম্মাহ” বানিয়েছিল। তাই রামাদ্বান মাসের রোজা হচ্ছে মনোনীত উম্মাহ'র আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার উদযাপন। অর্থাৎ, কিতাব দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ যে আমাদেরকে একটি উম্মাহ হিসেবে মনোনীত করেছেন, এক মাসের রোজা হচ্ছে সে মনোনয়নের শুকরিয়া জ্ঞাপন করার মাধ্যম, যেন আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। আল্লাহ বলেছেন-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَان فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

২য়টি ছিল কিবলাহ পরিবর্তন। এটিও সমপরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ।

আগের পর্বে বলেছিলাম, কিতাব অবতরণ ও কিবলাহ পরিবর্তনের প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে আল্লাহ পূর্ববর্তী মুসলিম উম্মাহ বনী ইসরাইলকে স্বীয় আসন থেকে সরিয়ে নতুন মুসলিম উম্মাহ উম্মতে মুহাম্মাদিকে উক্ত আসনে সমাসীন করেছেন।

মূলত, কিবলাহ একটি উম্মাহ'র আধ্যাত্মিক রাজধানীর সমতূল্য৷ বনী ইসরাইলের গর্ব ছিল যে, সব নবী-রাসূলদের কিবলাহ হচ্ছে তাঁদের তীর্থভূমি জেরুজালেম৷ অনুমিতভাবে, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রথম কিবলাহও ছিল জেরুজালেমের দিকে। মক্কায় অবস্থানকালীন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবিরা বাইতুল্লাহ শরীফের সামনে এমনভাবে নামাজে দাঁড়াতেন, যেন বাইতুল্লাহ (মাসজিদুল হারাম) এবং বাইতুল মুকাদ্দাস (মাসজিদুল আকসা) একইসাথে সামনে থাকে। কিন্তু মদীনায় হিজরতের পর সে সুযোগ বাকি রইলনা। কারণ মদীনা তায়্যিবাহ থেকে মক্কা শরীফ একদিকে, জেরুজালেম আরেকদিকে। বাধ্য হয়েই মুসলমানরা বাইতুল্লাহ'র দিকে পেছন ফিরে নামাজ আদায় করতেন। সাহাবিরা তো বটেই, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হৃদয়েও বাসনা জাগতো, “আমাদের কিবলাহ যেন আল্লাহর ঘরের দিকে ফিরে যায়”! কিন্তু মনোবাসনা একদিকে, আর আল্লাহর আদেশ আরেকদিকে। তাই বাধ্য হয়েই জেরুজালেমের দিকে ফিরে সেজদা করতে হতো। মুসলমানদের এ বাধ্যবাধকতা ছিল ইহুদিদের চোখের মণি। অর্থাৎ তারা গর্ব করতো যে, দিনশেষে মুহাম্মদকে আমাদের কিবলাহ'র দিকেই ফিরতে হয়!

বিরামহীন আল্লাহর কালাম (কুরআন) অবতীর্ণ হওয়া এবং ইসলামের রাজনৈতিক বলয় ও শক্তিবৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে আশাহত হতে থাকা ইহুদিদের যা কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা বাকি ছিল, তাতেও পুকুর পরিমাণ পানি ঢেলে অবতীর্ণ হলো কিবলাহ পরিবর্তনের সেই মহিমান্বিত প্রজ্ঞাপন-

قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ

(সুরা বাকারা : ১৪৪)

নতুন কিবলাহ মানেই তো নতুন উম্মাহ। প্রথমবারের মতো বনী ইসরাইল/ইহুদিরা বুঝতে পারল যে, নবুয়্যাতের সম্মানটুকু বনী ইসরাইলের হাত থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছে।

কিন্তু নবুয়্যাতকে কেন বনী ইসরাইলের ঘর থেকে সরিয়ে বনী ইসমাঈলের ঘরে নিয়ে আসা হলো? কেনইবা বনী ইসরাইল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে চিনতে পারার পরও এতোটা বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল?

১৩ বছরের দাওয়াতে মক্কায় মোটে দেড়শ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কাবাসী ছিল উম্মী। সাক্ষরতার হার ছিল নিতান্তই কম। হাজার-দেড় হাজার বছর থেকে মক্কাভূমিতে কোনো নবী-রাসুলের আগমন ঘটেনি, কিতাব অবতীর্ণ হয়নি। তাই দেখা যায়, যদিও পুরো কুরআনের প্রায় দুই-তৃতিয়াংশ মক্কায় (হিজরতের পূর্বে) অবতীর্ণ হয়েছিল, তথাপি এতে কোনো শরঈ হুকুম-আহকাম ছিলনা। পুরো মাক্কী কুরআনজুড়ে ছিল আল্লাহর পরিচয়, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ ঈমানের মৌলিক বিষয়াদি। মাক্কী সুরাগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলোর আয়াত সংক্ষিপ্ত এবং অতি উচ্চমাণের সাহিত্যিক উৎকর্ষ সম্বলিত। কারণ, মক্কাবাসীর অহংকার ছিল ছন্দময় কথাসাহিত্য।

মদীনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মনে একটি নতুন আশার সঞ্চার হলো। মদীনায় ৩টি ইহুদি গোত্রের বসবাস ছিল, যারা আহলে কিতাব। এদের কিতাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যাপারে স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। তাই আহলে কিতাব হয়তো ইসলামের দাওয়াত কবুল করবে। কিন্তু কপট ইহুদিরা ইসলামের দাওয়াতকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করলো।

আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিস্টান) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নবী হিসেবে চিনতে পারেনি- এমনটি দাবী করা নিতান্তই ভুল হবে। কারণ আল্লাহ বলে দিয়েছেন-

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ

যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাঁকে (নবীকে) এমনভাবে চেনে, যেভাবে তাদের নিজেদের সন্তানাদিকে চেনে। [সুরা বাকারা : ১৪৬]

সুতরাং চিনতে পেরেও এরা সত্য গোপন করেছিল। কিন্তু কেন? কারণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনী ইসরাইলের মধ্য থেকে আসেননি। তিনি এসেছেন বনী ইসমাঈলের মধ্য থেকে।

প্রসঙ্গত, ইবরাহিম আ. এর দুই পুত্র (ইসমাইল ও ইসহাক) দুই জায়গায় আবাদ হয়েছিলেন। ইসমাঈল আ. মক্কায়, ইসহাক আ. জেরুজালেমে। ইহুদি এবং তৎকালীন বেশিরভাগ খ্রিস্টান ইসহাক আ. এর বংশধর। ইসহাক আ. এর পুত্র ইয়াকুব আ. এর নাম ছিল ইসরাইল। তাঁর ১২জন পুত্র থেকে যে ১২টি গোত্র বেরিয়েছিল, তারাই পরবর্তীতে মুসা আ. এর হাত ধরে বনী ইসরাইল তথা ইহুদি জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এই বনী ইসরাইলের মধ্য থেকেই পৃথিবীতে এসেছিলেন ঈসা ইবনে মারইয়াম আ.। তাই ইহুদি-খ্রিস্টানরা ইসহাক আ. এর বংশ নিয়ে বড়াই করে। তারা (আজও) ইসমাঈল আ. কে নবী স্বীকার করা তো দুরের কথা, তাঁকে বৈধ সন্তান বলেও স্বীকার করেনা। তাই ইসমাঈল আ. এর বংশ থেকে শেষনবী (এবং শ্রেষ্ঠনবী) এসেছেন, এটি মেনে নেয়া তাদের জন্য কঠিন ছিল। বংশীয় অহমিকাকে ধরে রাখতে গিয়ে বনী ইসরাইল খোদায়ী সত্যকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

কিন্তু আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা সুরা বাকারায় তাদের কলসি ভেঙ্গে দিয়েছেন। কিভাবে?

গত পর্বে বলেছিলাম, বনী ইসরাইল ইসমাঈল আ. কে “বৈধ” বলে স্বীকার করেনা। তাদের মতে ইবরাহিম আ. এর “আসল পুত্র” কেবল ইসহাক আ.। [তারা এও মনে করে যে, ইবরাহিম আ. আল্লাহর আদেশে পুত্র ইসহাক আ. কে যবেহ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। আপাতত আমরা এ আলোচনায় যাচ্ছিনা]।

আল্লাহ তাদের অন্তরের গোমর ফাঁস করে দিলেন। জানিয়ে দিলেন ইসমাঈল আ. এর প্রকৃত অবস্থান। ইয়াকুব আ. এর সাথে তাঁর ১২ পুত্রের কথোপকথন পবিত্র কুরআনে এভাবে এসেছে-

أَمْ كُنتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِن بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَٰهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ

তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন তিনি তার সন্তানদেরকে বললেন, আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বললো, আমরা আপনার উপাস্যের এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহিম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের ইবাদত করব। তিনি একক উপাস্য। আর আমরা তাঁর আজ্ঞাবহ। [সুরা বাকারা : ১৩৩]

লক্ষ্য করুন, ইয়াকুব আ. এর ১২ পুত্র (যারা প্রকৃত/মূল বনী ইসরাইল) স্বয়ং ইসমাঈল আ. কে তাঁদের পিতৃপুরুষ বলে দাবী করছেন৷ নিজেদের দাদা ইসহাক আ. এর নামের পূর্বে দাদার ভাই ইসমাঈল আ. এর নাম উচ্চারণ করেছেন। তাহলে ৪ হাজার বছর পর বনী ইসরাইলের কী এমন রক্ত গরম হয়ে গেল যে, তারা ইসমাঈল আ. কে তাদের পিতৃপুরুষের তালিকা থেকেই মুছে দিলো? আর, এই ভিত্তিহীন অহমিকার ফলে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালোভাবে চেনার পরও তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করলো? মূলত, তারা জেনেশুনে মিথ্যাচার করেছিল।

এই বনী ইসরাইলকে আল্লাহ কী দেননি? ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সম্মান-সম্পদ-স্বাধীনতা দিয়েছেন। চলার পথে মেঘের ছায়া দিয়েছেন, ক্ষুধা পেলে মান্না-সালওয়া পাঠিয়েছেন, তৃষ্ণা পেলে একটি পাথর থেকে ১২টি সুপেয় পানির ঝর্ণা বহিয়েছেন। মুসা আ. থেকে শুরু করে ঈসা আ. পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪শ বছর বিরামহীন নবুয়্যাতের সিলসিলা অটুট রেখেছেন। তাওরাত, যাবুর, ইনজিলের মতো কিতাব দিয়েছেন। তালুত, দাউদ, সুলাইমান আ. এর মতো বাদশা দিয়েছেন। লোকমান হাকিমের মতো গুণী ব্যক্তি দিয়েছেন৷ বারবার ওয়াদা ভঙ্গ করার পরও ক্ষমা করেছেন, শত্রুর ওপর বিজয় দিয়েছেন, পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু বনী ইসরাইল আল্লাহর নিয়ামতের কী প্রতিদান দিয়েছিল? যখন ঈসা আ. আসলেন, তখন তারা তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলো। নিজেদের সাধ্যানুযায়ী হত্যা করার চেষ্টা করলো। যখন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন হলো, তখনও তারা তাঁর প্রাণের শত্রু হয়ে ওঠল! বনী ইসরাইলের ওপর যে অবমাননা-অসহায়ত্ব (الذِّلَّةُ وَالمَسْكَنَةُ) এসেছিল, এগুলো কি তাদের কৃতকর্মের ফলাফল নয়?

সুরা বাকারার প্রথম অংশ (প্রথম ৪ রুকু) এবং দ্বিতীয় অংশের (পরের ১৪ রুকু) আলোচ্য বিষয় সংক্ষেপে আলাপ করলাম। শেষ অংশে (শেষ ২২ রুকু) উম্মতে মুহাম্মাদির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।

সুরা বাকারার শেষাংশ আলোচনা করার পূর্বে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যা ভুলবশত ছুটে গিয়েছিল। কিবলাহ পরিবর্তনের ঠিক আগে আগে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে একটি বুনিয়াদি ধাক্কা দিয়েছিলেন। ধাক্কাটি ছিল ইবরাহিম আ. এর ব্যাপারে। বনী ইসরাইল নিজেদেরকে ইবরাহিমী দীনের অনুসারী বলে প্রচার করতো৷ আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা ইবরাহিম আ. এর জীবনের একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ কাজ উল্লেখ করে ইবরাহিম আ. কে উম্মতে মুহাম্মাদির সাথে সম্পৃক্ত করে দিলেন। ১৫ নং রুকুতে আল্লাহ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যে ঘরের দিকে উম্মতে মুহাম্মাদির কিবলাহ ফিরতে যাচ্ছে, সে ঘরটি (কা'বা) তাঁদের পিতা ইবরাহিমের হাতেই তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়। ইবরাহিম আ. এ ঘরটি তৈরি করে মজুরীস্বরূপ যে দুআ করেছিলেন, সে দুআটিও করেছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদি (وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ) এবং এ উম্মতের নবীর (وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ) জন্য৷ সুতরাং ইবরাহিম আ. এর সাথে যে তথাকথিত সম্পর্কের সুতোটি বনী ইসরাইল ধরে রেখেছিল, আল্লাহ তাও কেটে দিলেন।

মদীনায় একটি মুসলিম উম্মাহ'র গঠন এবং সুরা বাকারার অবতরণ একইসাথে হয়েছে৷ হিজরতের পরপরই, যখন মদীনা তায়্যিবাহ ইসলামি আদর্শকে বুকে ধারণ করে একটি শক্তিতে পরিণত হচ্ছিল, ঠিক তখনই খোদায়ী পথ-নির্দেশিকাস্বরূপ অবতীর্ণ হচ্ছিল সুরা বাকারা। বিশেষত বাকারার শেষ অর্ধেক, যেখানে উম্মতে মুহাম্মাদির ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷

সুরা বাকারার ১৯ নং রুকু যেভাবে শুরু হয়েছে, তা দেখেই বুঝা যায় যে, এখান থেকে আলোচ্য বিষয় নতুন মোড় নিচ্ছে৷ বলা হয়েছেঃ “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামাজ এবং ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থণা করো।”

বুঝাই যাচ্ছে যে, মাক্কী জীবনে দীনের দাওয়াতের যে নমুনা ছিল, মাদানী জীবনে তা পরিবর্তন হচ্ছে। মক্কায় নির্দেশ ছিল, “টিকে থাকো এবং সয়ে যাও।” মদীনায় নির্দেশ হচ্ছে, “দীন কায়েম করে দেখাও।” তাই দীন কায়েমের পথে যে কঠিন পরীক্ষা এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আসবে, সেসবে উত্তির্ণ হওয়ার জন্য নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থণা করো।

পরের আলোচনা উম্মতে মুহাম্মাদিকে ঘিরেই এগিয়ে গেছে। যেহেতু বাকারা মাদানী সুরা, তাই তাতে হালাল-হারাম, খাদ্যদ্রব্য, দিন-পঞ্জিকা, কিসাস-তাযির, রোজা, বিবাহ-তালাক সংক্রান্ত প্রচুর শরঈ নির্দেশনা এসেছে৷ তবে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে যে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে, তা হলো, الإنفاق في سبيل الله তথা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ খরচ করা।

সুরা বাকারার শেষাংশে, যেখানে মূলত উম্মতে মুহাম্মাদিকে দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে, সেখানে বনী ইসরাইলের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে৷ ৩২ এবং ৩৩ নং রুকুতে উল্লেখিত ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হচ্ছে এরকম-

মুসা আ. যখন ৬ লক্ষ বনী ইসরাইলকে নিয়ে মিশর থেকে হিজরত করে জেরুজালেমে আসলেন, ততদিনে সেখানে দুর্ধর্ষ আমালিকা সম্প্রদায় দখল করে বসে আছে, যারা ছিল অবিশ্বাসী এবং অত্যাচারী। মুসা আ. বনী ইসরাইলকে আমালিকার বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ বনী ইসরাইল জিহাদ করতে রাজি হলোনা। অগত্যা শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে নির্বাসনে প্রেরণ করলেন। দীর্ঘ ৪০ বছর তারা মরুভূমিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালো। এ সময়টিতে মুসা আ. এবং হারূন আ. পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পরবর্তী নবী ইউশা ইবনে নূন আ. বনী ইসরাইলকে নিয়ে আবার রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। তবে তেমন কোনো ফলাফল আসলোনা। ওই ৪০ বছরে বনী ইসরাইলের ঘরে অনেক নতুন শিশুর জন্ম হলো। এরা যখন ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠল, তখন পূর্বপুরুষের ভুল বুঝতে পারলো৷ তারা তখনকার নবী শামুয়েল আ. এর কাছে তাদের জন্য একজন সেনাপতি নিযুক্ত করে দেয়ার আবেদন করলো, যার নেতৃত্বে তারা আমালিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। শামুয়েল আ. তালুতকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। অভ্যাস অনুযায়ী বনী ইসরাইল প্রথমে তালুতকে সেনাপতি মানতে রাজি হলোনা। পরে উপায়ান্তর না দেখে তারা তালুতের নেতৃত্বে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো।

রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের অবতারণা হলো। মহাশক্তিধর আমালিকাদের বিপক্ষে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বিজয় দান করলেন৷

বনী ইসরাইলের পক্ষে যারা যুদ্ধে এসেছিলেন, তন্মধ্যে দাউদ নামক এক তরুণ কামার/কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। যদিও তিনি নিয়মিত যোদ্ধা/পালোয়ান নন, তবুও জোশের মাথায় ওই যুদ্ধে হাজির হয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময় দাউদ তাঁর নিজের তৈরি গুলতি দিয়ে একটি পাথর ছুড়েছিলেন আমালিকা সেনাপতি জালুতের চোখ বরাবর। ওই পাথর জালুতের চোখ ভেদ করে মগজে আঘাত হানে। তাতেই জালুতের খেল খতম হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই দাউদ বনী ইসরাইলের নবী এবং প্রভাবশালী বাদশা হয়েছিলেন। আলাইহিস সালাম।

আল্লাহ কেন হঠাৎ করেই একটি যুদ্ধের কথা উল্লেখ করলেন? তাও এমন আলোচনার মধ্যখানে, যেখানে উম্মতে মুহাম্মাদিকে পথ-নির্দেশ করা হচ্ছিল? ওই যুদ্ধ বা যোদ্ধাদের সাথে মদীনায় উপস্থিত মুসলমানদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

আমার মনে হয়, সুরা বাকারার ৩২ ও ৩৩ নং রুকুতে উল্লেখিত বনী ইসরাইলের সাথে আমালিকা সম্প্রদায়ের যুদ্ধের বর্ণনাটি ছিল বদর যুদ্ধের প্রতি এক ধরণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, আল্লাহু আ'লাম। কারণ ১৯ থেকে নিয়ে ৪০ নং রুকু পর্যন্ত বাকারার পুরো শেষাংশ যেখানে উম্মতে মুহাম্মাদিকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেখানে হঠাৎ করে ২ হাজার বছর আগের একটি যুদ্ধের কথা কোনোভাবেই উল্লেখ করা হতোনা, যদি এর সাথে তৎকালীন মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক না থাকতো। সুরা বাকারার বড় একটি অংশ অবতীর্ণ হয়েছে হিজরতের প্রথম ২ বছরে। সুরাটিতে পূর্ববর্তী উম্মাহ'র পদস্খলন এবং নতুন উম্মাহ'র গঠন সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে রয়েছে অসংখ্য শরঈ নির্দেশ, যা একটি নতুন জাতি/সভ্যতা গঠন করতে সাহায্য করে। এতোসব তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করার পরও একটি অভিজ্ঞতা উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য বাকি থেকেই গেল। সেটি হচ্ছে “অস্ত্রহাতে যুদ্ধ”। যদিও যুদ্ধের প্রথম অনুমতি অবতীর্ণ হয়েছে সুরা হজ্জের ৩৯ নং আয়াতে, তথাপি সুরা বাকারায় আল্লাহ একটি উদাহরণ দেয়ার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে চাচ্ছেন। আল্লাহু আ'লাম।

শেষদিকে এসে ওই কথাটির পুনরাবৃত্তি করতে চাই, যা প্রথমদিকে বলে এসেছিলাম। সুরা বাকারা এমন একটি সুরা, যা জাযিরাতুল আরবে একটি নতুন একত্ববাদী উম্মাহ গঠন করেছে। সুরা বাকারা পূর্ববর্তী উম্মাহ বনী ইসরাইলের ভুল-ভ্রান্তি উল্লেখপূর্বক উম্মতে মুহাম্মাদিকে সত্যের আয়না দেখিয়েছে। তাই এটি ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরামের খুব প্রিয় সুরা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রায়ই এ সুরাটি তিলাওয়াত করতেন।

শেষ করার পূর্বে সুরা বাকারার অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করতে চাই।

১. কিবলাহ পরিবর্তন সংক্রান্ত আয়াত : ১৪৪

২. আল্লাহর সৃষ্টি সংক্রান্ত আয়াত : ১৬৪

৩. সাওয়াব বা পূণ্যের হকিকত সংক্রান্ত আয়াত : ১৭৭

৪. রামাদ্বান, কুরআন ও রোজার নির্দেশ সংক্রান্ত আয়াত : ১৮৩-১৮৭

৫. নবী-রাসুল ও আসমানি কিতাব প্রেরণ করার হকিকত সংক্রান্ত আয়াত : ২১৩

৬. আয়াতুল কুরসি : ২৫৫

৭. আয়াতুদ দাঈন বা পারস্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত আয়াত : ২৮২

৮. সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত : ২৮৫-২৮৬

উপরোল্লিখিত কয়েক পর্বের লেখনিতে সংক্ষেপে সুরা বাকারার প্রসঙ্গ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। হক আদায় করতে পেরেছি, এমনটি কোনোভাবেই দাবী করছিনা। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলার, যিনি সব জ্ঞানীদের ওপর মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়৷

সুরা বাকারা সমাপ্ত।

সুরা আনফাল মাদানী সুরা। ২য় হিজরির শেষদিকে, বদর যুদ্ধের ঠিক পরপরই সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছে। এ সুরায় বদর যুদ্ধের উদ্দেশ্য, ঘটনাচক্র, ফলাফল এবং এ সংক্রান্ত শরঈ নির্দেশনা রয়েছে। তাই বদর যুদ্ধের পুরো প্রেক্ষাপট না জানলে সুরাটির প্রসঙ্গ আলোচনা করা কঠিন হয়ে যাবে৷ তাই প্রথমে বদর যুদ্ধ এবং ইসলামের যুদ্ধনীতির ব্যাপারে একটু বিস্তারিত আলাপ করতে চাই।

প্রথমত, একটি বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝা প্রয়োজন, যা আমি আগেও কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি। সেটি হলো, রাসূলগন পৃথিবীতে আল্লাহর আদালতস্বরূপ। তাঁদেরকে প্রেরণ করার মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীতে ঈমান-কুফরের ফয়সালা করে দেন। অর্থাৎ, আল্লাহ যখন কোনো কউম/জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেন, এবং রাসূল সত্যকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ করে দেয়ার পরও ওই কউম/জাতি রাসূলকে অস্বীকার করে, তখন আল্লাহ ওই কউম/জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। কখনো যুদ্ধের মাধ্যমে, কখনো ফেরেশতা প্রেরণ করে, কখনো রোগশোক, কখনোবা আসমানি গযব দিয়ে। নূহ, লুত, হুদ, ছালেহ আ.-দের কউমের কী অবস্থা হয়েছিল, তা আমরা জানি। আল্লাহ এ ব্যাপারটি পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করেছেন-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا

আর আমি আযাবদাতা নই, রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত। [সুরা বনী ইসরাইল : ১৫]

তার মানে হলো, কেবল কাফির বা মুশরিক হওয়ার কারণে এই একটি সুরতেই আল্লাহ এ পৃথিবীতে কাউকে শাস্তি দেন৷ নচেৎ কেবল কাফির বা মুশরিক হওয়ার কারণে (অন্য কোনো অপরাধ না করলে) এ পৃথিবীতে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়না। শিরক-কুফরের শাস্তি কেয়ামত দিবসে।

বি.দ্র ১ঃ নবীদের ব্যাপারটি এমন নয়৷ নবী এবং রাসূল আলাদা বিষয়৷

বি.দ্র ২ঃ একটি জাতিই পৃথিবীতে আছে, যাদের বেলায় এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে। তারা হলো বনী ইসরাইল, যারা ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. কে সম্মিলিতভাবে অস্বীকার করে, তাঁকে হত্যাচেষ্টা করেও সমূলে ধ্বংস হয়নি৷ এর পেছনে একটি লম্বা এবং সুক্ষ্ম উদ্দেশ্য রয়েছে, যা আপাতত আমাদের আলোচনার বাইরে।

দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝা প্রয়োজন। তা হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রিসালাতের জীবনের ধাপ বা পর্যায়সমূহ। মোটাদাগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রিসালাতের জীবনের ধাপগুলো নিম্নরূপ-

১. ব্যক্তিগত পরিসরে দীনের দাওয়াত [নবুয়্যাতের প্রথম ৩ বছর]

২. সমষ্টিগত দাওয়াত [পরবর্তী ১০ বছর]

৩. মুসলমানদেরকে তা'লিম-তারবিয়াত-আত্মশুদ্ধি [পুরো মাক্কী জীবনব্যাপী]

৪. মুখ বুজে সব বিরোধিতা ও অত্যাচার সহ্য করা [মাক্কী জীবনের শেষদিক]

৫. হিজরত বা পটপরিবর্তন [নবুয়্যাতের ১৩তম বছর]

৬. মদীনায় নতুন উম্মাহ গঠন [হিজরতের প্রথম ২ বছর]

৭. মূল শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ [২য় থেকে ৬ষ্ঠ হিজরি]

৮. একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ [হুদায়বিয়ার সন্ধি]

৯. বহির্বিশ্বে দীনের দাওয়াত প্রেরণ [৭ম-৮ম হিজরি]

১০. জাযিরাতুল আরবে অধিকার লাভ [মক্কা বিজয়]

১১. আভ্যন্তরীণ পরিমন্ডলে বিরোধিতা হ্রাসকরণ [খায়বার ও হুনাইনের যুদ্ধ]

১২. আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অবস্থান দৃঢ়করণ [মু'তার যুদ্ধ এবং তাবুক অভিযান]

উপরোল্লিখিত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারলে ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর রিসালাতের জীবনে মোট ১৯টি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তন্মধ্যে ৮টি অভিযান যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। ওই ৮টি ছিল- বদর, উহুদ, খন্দক (আহযাব), মুরাইসি' (বনু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে), খায়বার, মক্কা বিজয়, হুনাইন এবং তায়েফ অবরোধ। কেউ কেউ তায়েফ অবরোধকে এ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে কাদীদ নামক একটি অভিযানকে এ তালিকায় সংযুক্ত করেন৷

নোট ১ঃ যুদ্ধ না হলেও রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাবুক অভিযান ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অভিযান।

নোট ২ঃ পরিধি ও ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় মু'তার যুদ্ধটি অনেক বড় যুদ্ধ হলেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।

মদীনা তায়্যিবায় হিজরত করার ছ'মাস পর থেকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো অভিযান প্রেরণ করতে শুরু করেন। মদীনা থেকে পরিচালিত ইসলামের প্রথম অভিযান ছিল আবওয়া অভিযান। তবে এটি যুদ্ধে পরিণত হয়নি।

প্রথম (ছোটখাটো) যুদ্ধ ছিল সা'দ ইবনে উবায়দুল্লাহ রা. এর নেতৃত্বে। ওই যুদ্ধে ইসলামের পক্ষে প্রথম তীর ছোড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.। এসব অভিযানে বড় কোনো ফলাফল না আসলেও এগুলোর গুরুত্ব কম নয়। এসব অভিযান ছিল মক্কার কুরাইশদের জন্য একেকটি বার্তা৷

প্রথম উল্লেখযোগ্য ফলাফল এসেছিল উশাইরা অভিযানে। কুরাইশদের সিরিয়া-ফেরত একটি ব্যবসায়িক কাফেলার বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।

এরপর কুরাইশদের একটি মিত্র গোত্রের বিপক্ষে “বদরে সুগরা” নামক লড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যারা প্রায়ই মদীনার উপকন্ঠে হানা দিয়ে গবাদিপশু চুরি করতো৷

এরপর রজব মাসে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা. এর নেতৃত্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার অপরপ্রান্তে নাখলা এলাকায় কুরাইশদের ইয়েমেন-ফেরত ব্যবসায়িক কাফেলার গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করার জন্য ৮ জন সাহাবির একটি বাহিনী প্রেরণ করেন৷ যদিও সাহাবিদেরকে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়নি, তবুও তাঁরা ওই কাফেলার ওপর হামলা করে আমর হাদরামি নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করেন। এতে কুরাইশরা ফুঁসে ওঠে৷

এসবের মধ্যখানে কুরাইশদের পক্ষ থেকেও মদীনার উপকন্ঠে দু'একটি অভিযান প্রেরণ করা হয়৷ কিছু রক্তপাত হলেও আল্লাহর রহমতে বড় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল।

এমতাবস্থায় সংবাদ আসে যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন কুরাইশদের ব্যবসায়িক কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কা অভিমূখে ফেরত আসছে। ওই কাফেলায় প্রত্যেক মক্কাবাসীর ছোট-বড় বিনিয়োগ ছিল। তাছাড়া এতে মুসলমানদের সেসব সম্পত্তিও ছিল, যা হিজরতকালে মক্কাবাসী জোরপূর্বক মুহাজিরদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু সুফিয়ানের কাফেলার পথ রুখে দেয়ার চিন্তা করেন৷ ২য় হিজরির ৮ রামাদ্বান রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৩১৩ জন সাহাবি নিয়ে ওই কাফেলাকে আটকে দেয়ার উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ করেন।

একটি বিষয় খেয়াল করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে প্রতিটি অভিযান প্রেরণ করেছেন, যার ফলস্রুতিতে মক্কাবাসী যুদ্ধে আসতে বাধ্য হয়েছে৷ কিন্তু কেন?

হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছেন। প্রশ্ন আসে, কেন?

জবাব হলো, তিনি একজন রাসূল৷ তাঁর দায়িত্ব কেবল দাওয়াত-তাবলীগে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর দায়িত্ব আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করা। যেভাবে আল্লা বলেছেন-

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ

তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্ম/মতের ওপর জয়যুক্ত করেন। [সুরা ছফ : ২৮]

বিশেষত তিনি যেহেতু শেষ রাসূল, তাই তিনি যদি আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করে যেতে না পারেন, তাহলে অন্য কারও পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। অতোএব মুশরিকদের সাথে কোনোরূপ আপোষ-মিমাংসা, কিংবা তাওহীদের ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করা অন্তত সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষে সম্ভব ছিলনা।

আর, মক্কা মুকাররামা যেহেতু দারুল আমান, তাই তিনি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন যেন মক্কায় বসা কাফির সর্দারগণ (কুরআনের ভাষায় أَئِمَّةَ الْكُفْر) বাধ্য হয়ে মক্কা ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

কিছু সমালোচক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক আবু সুফিয়ানের কাফেলার পথ রুদ্ধ করাকে “লুটতরাজ” বলে অভিহিত করেন। ইসলামের ব্যাপারে অজ্ঞতা ও বিদ্বেষ থেকেই তাদের মনে এমন ধারণার জন্ম হয়েছে। নয়তো এ ব্যাপারটি বুঝা খুব কঠিন নয় যে, যখন মুসলিম বাহিনী আবু সুফিয়ানের কাফেলা আটকানোর জন্য বেরিয়েছিল, সে সময়টি ছিল State of War বা যুদ্ধাবস্থা। State of War ওই সময় বা অবস্থাকে বলা হয়, যখন দুটি বিরোধী পক্ষের মাঝে বৈরিতা বৃদ্ধি পেয়ে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এমতাবস্থায় দু'পক্ষই এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা সাধারণ অবস্থায় করা হয়না৷ উদাহরণস্বরূপ- প্রতিপক্ষের রসদ আটকে দেয়া, গোয়েন্দা নজরদারি করা, দুর্বলতার সুযোগ নেয়া, ক্রোধোদ্দীপক কাজ করে প্রতিপক্ষকে উত্তেজিত করা ইত্যাদি৷ এগুলো তখনও ছিল, আজও আছে। দুই দেশের ছোট্ট লড়াই হোক কিংবা বিশ্বযুদ্ধ হোক- আমরা এমন কৌশল প্রয়োগ করতে দেখি। সুতরাং আবু সুফিয়ানের কাফেলার পথ রুখে দেয়ার কাজটি কোনো দিক থেকেই “লুটতরাজ” ছিলনা। এটি ছিল বিষধর সাপকে গর্ত থেকে বের করে আনার উপযুক্ত কৌশল।

তবে একটি বিষয় পরিস্কার, যে বদর যুদ্ধ রক্ষণাত্মক বা আত্মরক্ষামূলক (Defensive) যুদ্ধ ছিলনা। বদর যুদ্ধ ছিল আক্রমণাত্মক (Offensive) যুদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে থেকেই এ যুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছেন। যারা অহেতুক নববী জীবনের সবগুলো যুদ্ধকে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ বলে প্রমাণ করতে চান, তারা নববী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি। উহুদ ও খন্দক ব্যতীত নববী জীবনের সবগুলো যুদ্ধ ছিল আক্রমণাত্মক তথা তাগুতের অপসারণ এবং আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে।

মুসলমানদের আগমনবার্তা পেয়ে আবু সুফিয়ানের কাফেলা পরিচিত পথ ছেড়ে অন্যপথে চলে গেল। তবে তারা মক্কায় বার্তা পাঠালো, মুহাম্মদের বাহিনী আমাদের পথ রুদ্ধ করার জন্য এগুচ্ছে। বার্তা পেয়ে মক্কার মুশরিক নেতৃবৃন্দের মনে শত্রুবিনাশের উন্মাদনা জেগে ওঠল৷ মূহুর্তের মধ্যে জোগাড় করা হলো যুদ্ধাস্ত্র, উট-ঘোড়া, প্রয়োজনীয় রসদ। নেতাদের মধ্যে আবু লাহাব, উতবা ও উমাইয়া যুদ্ধে যেতে রাজি ছিলনা। আবু জাহল এবং উকবা ইবনে আবু মুঈত নানাবিধ ছলাকলা করে আবু লাহাব ব্যতীত বাকি সবার মন বদলাতে সক্ষম হলো। এমনকি আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আকীল ইবনে আবু তালিব, নওফেল ইবনে হারিস প্রমুখ বনী হাশিমের সদস্যবৃন্দ এবং আবুল বুখতুরীর মতো সজ্জন ব্যক্তিও আবু জাহলের চাপে পড়ে যুদ্ধে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবু জাহল হোবল দেবতার কসম করে বলেছিল, আজ আল্লাহ সত্যকে মিথ্যা থেকে পার্থক্য করে দেবেন!

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান পথ পরিবর্তন করেছেন এবং আবু জাহলের বাহিনী যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসছে। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা তাঁর রাসূলকে দুটি কাফেলার মধ্যে একটির ওপর বিজয় দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চাচ্ছিলেন আবু জাহলের বাহিনীর মোকাবেলা করতে। তবুও তিনি সাহাবিদের সাথে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোনো কোনো সাহাবি (যৌক্তিক) ওজর পেশ করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা তো প্রায় হাতিয়ারবিহীন চলে এসেছি৷ যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই।

এ সময় আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। এরপর উমর রা., এরপর মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রা.। এ তিনজনই ছিলেন মুহাজির, যারা ইতোমধ্যে বহু পরীক্ষা দিয়ে এসেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চাচ্ছিলেন আনসারদের মধ্য থেকে কেউ কিছু বলুক। ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে সা'দ ইবনে মুয়াজ রা. ওঠে দাঁড়ালেন এবং মদীনাবাসীর পক্ষ থেকে যুদ্ধের সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন করলেন।

পরিস্থিতি ঘুরে গেল। এবার সামনে কোনো ব্যবসায়ী কাফেলা নয়; বরং এক হাজার সৈন্যের অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী৷

সমরনীতিতে তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কুরাইশ বাহিনীর অবস্থান, কৌশল ও শক্তিমত্তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মুসলিম বাহিনী থেকে দুজন ব্যক্তি মুসাফিরের বেশে বেরিয়ে পড়লেন। এই দুই ব্যক্তি কারা ছিলেন জানেন? এরা হলেন সায়্যিদুনা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (ﷺ) এবং আবু বকর ইবনে আবু কুহাফা রাদ্বিআল্লাহু আনহু।

জি হ্যাঁ! ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নবী এবং সিদ্দীক এতোটাই ঘাম ঝরিয়েছিলেন।

মরুচারী বেদুইনদের কাছ থেকে কুরাইশ বাহিনীর যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবু বকর রা.। বেদুইনরা জানতে চাইল, তোমরা কোথা থেকে এসেছো? তিনি জবাব দিলেন- “আমরা পানি থেকে এসেছি।”

কুরাইশ বাহিনী এগিয়ে এসে মদীনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণে বদর প্রান্তরে অবস্থান নেয়। মুসলিম বাহিনীও বদর প্রান্তরে পৌঁছায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবু স্থাপনের নির্দেশ দিলে সাহাবি আল-হুবাব ইবনুল মুনযির রা. কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তাবু স্থাপন করার পরামর্শ দেন৷ তাঁর যুক্তি ছিল, পানির কূপগুলো পেছনে রেখে সামনে তাবু স্থাপন করলে প্রতিপক্ষের জন্য পানি পর্যন্ত পৌঁছা কঠিন হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।

রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশান্তিদায়ক বৃষ্টি নামে৷ মৃদু হওয়া প্রবাহিত হয়। সাহাবিদের চোখে স্বস্তির তন্দ্রা নেমে আসে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরিয়াদ নিয়ে মহান রবের সামনে দণ্ডায়মান হন।

২য় হিজরির ১৭ই রামাদ্বান সকাল। কুরাইশদের পক্ষ থেকে শেষবারের মতো যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে উতবা ইবনে রাবি'আ এবং হাকিম ইবনে হিযাম। কিন্তু আবু জাহলের ঔদ্ধত্যের কাছে তাদের চেষ্টা গুড়েবালি হয়ে যায়৷

ওদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুআর হাত তখনও নামেনি। কণ্ঠে তাঁর একটিই আরজি- “হে আল্লাহ, তোমার ওয়াদা পূর্ণ করো। সামান্য ক'টি মানুষ নিয়ে হাজির হয়েছি। আজ যদি এরা ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে তুমি আল্লাহর ইবাদত করার মতো কোনো মানুষ বাকি রইবেনা।”

এক সময় হাত দুটো লম্বালম্বি আকাশের দিকে উত্তোলন করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। গা থেকে পরনের কাপড়টি খুলে মাটিতে পড়ে যায়। সাহাবিরা স্তব্ধ, অবাক এবং কিছুটা ভীত৷ প্রিয় নবীর চরিত্রের এ দিকটি তাঁরা কখনও দেখেননি। ধীরপায়ে এগিয়ে যান ছায়াসঙ্গী আবু বকর সিদ্দীক রা.। মাটি থেকে কাপড় তুলে প্রিয় নবীর গায়ে পরিয়ে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলেন- “ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। আপনার রব অবশ্যই তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করবেন।”

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবুর ভেতর চলে যান। খানিকক্ষণ পরই বেরিয়ে এসে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলেন- “আবু বকর, ফেরেশতারা চলে এসেছেন। আমি জিবরাইলকে দেখলাম হলুদ পাগড়ি পরে ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন।”

সাহাবিরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান৷ কমান্ডার-ইন-চিফ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। মুসলিম বাহিনীর সাদা পতাকা মুস'আব ইবনে উমায়ের রা. এর হাতে। মুহাজিরদের একটি স্বতন্ত্র পতাকা আলী রা. এর হাতে, আনসারদের পতাকা সা'দ ইবনে মুয়াজ রা. এর হাতে। ডানপ্রান্তের নেতৃত্বে যুবায়ের ইবনে আওয়াম রা., বাম প্রান্তে মিকদাদ ইবনে আমর রা. এবং পেছনদিকের দায়িত্বে কায়েস ইবনে আবিহ রা.। যুদ্ধ শুরু হয়।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একমুঠো বালু হাতে নিয়ে شاهت الوجوه বলে মুশরিকদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। কতক্ষণের জন্য সবার চোখ অন্ধকার হয়ে গেল৷

তৎকালীন যুদ্ধের প্রথানুযায়ী কুরাইশদের পক্ষ থেকে উতবা ইবনে রাবি'আ মল্লযুদ্ধের (মুবারাযা) জন্য এগিয়ে এলো৷ সাথে তার ভাই শাইবা ইবনে রাবি'আ এবং পুত্র ওয়ালীদ ইবনে উতবা৷ তারা মুসলমানদের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী আহ্বান করল৷ সাথে সাথে আউফ ইবনে আফরা, মু'আউয়িয ইবনে আফরা এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা নামক তিনজন তরুণ আনসারী সাহাবি এগিয়ে আসলেন, রাদ্বিআল্লাহু আনহুম৷ উতবা বলল, “আমরা তোমাদেরকে চিনিনা। তোমাদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা আমাদের লোকদের (মুহাজির) চাই। ওদেরকে পাঠাও।”

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ তিনজনকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। এবার মুসলমানদের পক্ষ থেকে মল্লযুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আলী ইবনে আবু তালিব এবং উবায়দা ইবনে হারিস রাদ্বিআল্লাহু আনহুম। তিনজনই মাক্কী, মুহাজির এবং কুরাইশ বংশের বনী হাশিম গোত্রের লোক। তিনজনই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রক্তসম্পর্কের আত্মীয়। জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বপ্রথম তাঁর স্বজনদেরকেই পাঠিয়েছিলেন।

বয়সের দিক থেকে প্রবীণ ছিলেন উবায়দা রা.। তিনি বিপক্ষ দলের প্রবীণতম যোদ্ধা উতবার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন৷ শাইবার সামনে হামজা রা. এবং ওয়ালীদের সামনে আলী রা.৷ হামজা রা. এর সামনে শাইবা কয়েকটি ক্ষণও টিকতে পারলনা। আলী রা. এর তরবারির আঘাতে ওয়ালীদের প্রাণ নিমিষেই বেরিয়ে গেল। শক্তিক্ষয়ী লড়াইয়ে উবায়দা রা. উতবাকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও উতবার পক্ষ থেকে আসা একটি প্রাণঘাতী আঘাত তাঁর পায়ের উরুদেশে গুরুতর জখম করে দিল। তাঁকে তাবুতে নিয়ে আসা হলো। সেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোলে মাথা রেখে শাহাদত বরণ করলেন উবায়দা ইবনে হারিস রা.। তবে তিনি বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ নন।

বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ ছিলেন উমায়ের ইবনে হুমাম রা.। মূল যুদ্ধ শুরুর পরপরই ওদিক থেকে ছুটে আসা তীরের আঘাতে তিনি শাহাদত বরণ করেছিলেন।

মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কে কী করেছিলেন, সেসব ডিটেইলস খুঁজে বের করা অনেকটাই অসম্ভব। বর্তমান গবেষণামতে যুদ্ধ দেড় থেকে দু'ঘন্টার বেশি স্থায়ী হওয়ার কথা নয়।

১৭ই রামাদ্বান দুপুর গড়ানোর আগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য এক মহান বিজয় সমাগত হলো। প্রথমসারির প্রায় সব নেতাসহ ৭০ জন মুশরিক নিহত হলো, ৭০-৭২ জনের মতো বন্দী হলো। يوم الفرقان বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের এ দিনটিতে ১৪ জন্য সাহাবি আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, রাদ্বিআল্লাহু আনহুম আজমাইন।

বদর যুদ্ধে ইসলামের কুখ্যাত শত্রু আবু জাহল নিহত হয়েছিল। মুয়াজ ইবনে আফরা এবং মু'আউয়িয ইবনে আফরা নামক দুই ভাই তাকে হত্যা করার নিয়ত করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন তাদের নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাতে আবু জাহল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এগিয়ে গিয়ে আবু জাহলের মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেন।

প্রসঙ্গত, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধে নিহত মুশরিক নেতাদের নাম ধরে ধরে তাদের নিহত হওয়ার স্থান বলে দিয়েছিলেন।

যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে ভিন্নমত দেখা দিয়েছিল৷ উমর রা. এদেরকে হত্যা করার পক্ষে ছিলেন। আবু বকর রা. এর মত ছিল মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু বকর রা. এর মতের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে উমর রা. এর সিদ্ধান্তের পক্ষে কুরআন শরীফের আয়াত অবতীর্ণ হয়।

বদর যুদ্ধের পূর্বাপর কাহিনী বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। আমি চাচ্ছিলাম বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও ফিলোসোফি কিছুটা আলোচনা করতে, যেন সুরা আনফালের প্রসঙ্গ বুঝতে সুবিধা হয়। তাই যুদ্ধের কাহিনী আর লম্বা করবনা।

সুরা আনফালের প্রথমদিকে গনিমতের ব্যাপারে পূর্ণ এখতিয়ার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, জিহাদের লক্ষ্য দুনিয়াপ্রাপ্তি নয়৷ জিহাদ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, যদিও পরবর্তীতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদে যোদ্ধাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ সুরাটিতে আল্লাহ বারবার মুসলমানদেরকে তাঁর অপার করুণার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যেন মানুষ ভালোভাবে বুঝে নেয় যে, শক্তি, সাহস, ধৈর্য, সম্মান, বিজয়, সম্পদ, নিরাপত্তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। তাক লাগানো প্রস্তুতি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায়না।

৩২ ও ৩৩ নং আয়াতে রয়েছে একটি চমকপ্রদ বিষয়। মুশরিকরা বলতো, “যদি এ কুরআন সত্য হয় তবে আল্লাহ যেন আমাদের ওপর আসমান থেকে পাথর বর্ষণ করেন।” তাদের জবাবে আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ কখনও তাদেরকে আযাব দেবেন না। এমনকি ক্ষমা প্রার্থণারত থাকা অবস্থায়ও আযাব দেয়া হবেনা।

সুতরাং আজ এতো নাফরমানি করার পরও যে উম্মতে মুহাম্মাদির ওপর আল্লাহর মহা আযাব আসছেনা, তা কেবল এই কারণে যে, রাহমাতুল্লিল আলামিন (ﷺ) আজও আমাদের মাঝে (মদীনায়) শুয়ে আছেন। আমাদের প্রিয় নবী তাঁর উম্মতকে একা ফেলে চলে যাননি৷

সুরার শেষদিকে দান-খয়রাত, হিজরত ও আল্লাহ পথে জিহাদের অনুপ্রেরণা দেয়া হয়েছে। মূলত সুরা আনফালের পূর্বাপর জুড়ে রয়েছে বদর যুদ্ধের খণ্ডখণ্ড বর্ণনা।

সুরা আনফালের সংক্ষিপ্ত আলোচনা এবং আল-কুরআনের রত্নরাজি সিরিজ আপাতত এখানে সমাপ্ত।।