ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিলেখা পাঠানোর নিয়মাবলীযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

আল-মুজতাবা : বিশ্বমানবতার অনুপম আদর্শ

আমেরিকার খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ. হার্ট ১৯৭৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন। বইয়ের নাম The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History. উক্ত বইয়ে লেখক এমন একশজন মহান ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন করেছেন, যারা স্ব স্ব যোগ্যতার দ্বারা ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছেন। যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছেন, জ্বালিয়েছেন আলো। এরপর লেখক উক্ত একশজন ব্যক্তির মধ্যে ক্রমবিন্যাস করেছেন এবং সবার উপরে যে নামটি রেখেছেন, সেটি হলো "মুহাম্মদ"।

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
আল-মুজতাবা : বিশ্বমানবতার অনুপম আদর্শ

আমেরিকার খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ. হার্ট ১৯৭৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন। বইয়ের নাম The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History. উক্ত বইয়ে লেখক এমন একশজন মহান ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন করেছেন, যারা স্ব স্ব যোগ্যতার দ্বারা ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছেন। যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছেন, জ্বালিয়েছেন আলো। এরপর লেখক উক্ত একশজন ব্যক্তির মধ্যে ক্রমবিন্যাস করেছেন এবং সবার উপরে যে নামটি রেখেছেন, সেটি হলো "মুহাম্মদ"। হ্যাঁ, লেখকের তালিকায় শীর্ষস্থানে ছিল আমাদের নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র নাম। অবাক করার বিষয়! একজন পশ্চিমা ধর্মপরায়ণ খ্রিস্টান, একজন প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী, কেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে স্বীকৃতি দিলেন?

জবাবটি দিয়েছেন লেখক নিজে। বলেছেনঃ "বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষস্থানে আমি মুহাম্মদকে বেছে নিয়েছি, এ ব্যাপারটি অনেকের কাছে বিস্ময়কর লাগতে পারে। অনেকের মনে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তিনি (মুহাম্মদ ﷺ) ছিলেন মানব ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একইসাথে আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেছেন।" [The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History, New York, 1978, p. 33]

এর বিপরীত চিত্রও আমরা দেখেছি। পশ্চিমা বিশ্বে, প্রথমত ইউরোপ এবং পরে আমেরিকায় যুগের পর যুগ আমাদের নবী ﷺ-কে খুব খারাপভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনো সত্যকে ভেঙ্গেচুরে, কখনো নির্জলা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নির্বোধ পাদ্রীরা বদনাম ছড়িয়েছে আমাদের নবী ﷺ-এর নামে। এর বড় অংশটি এসেছে ক্রুসেড যুদ্ধের সময়কালে। পরবর্তীতে পশ্চিমাদের "ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী" সালমান রুশদী এসব কুৎসা ছড়িয়ে দিয়েছে দুনিয়াজুড়ে। বিষয়টি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন গত শতাব্দীর খ্যাতিমান গবেষক, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম মন্টগোমরি ওয়াট। বলেছেনঃ "মানব ইতিহাসের আর কোনো মহান ব্যক্তিত্বকে পশ্চিমা বিশ্বে এতো বাজেভাবে (so poorly) উপস্থাপন করা হয়নি, যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে মুহাম্মদকে।" [Mohammad At Mecca, Oxford, 1953, p. 52]

এই দ্বিচারিতার কারণ কী? মাইকেল হার্ট আমার নবীর মধ্যে এমন কী দেখেছেন, যা আর কেউ দেখেননি? নাকি অন্যরাও দেখেছেন? ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন আমার নবী? কী মানবিক গুণাবলী ছিল তাঁর মধ্যে, কী কী মূল্যবোধ তিনি মানবজাতিকে শিখিয়ে গেছেন, কতটুকু সাফল্য তিনি লাভ করেছেন; প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের একজন পণ্ডিতও কি সেটি চোখ মেলে দেখেননি? এটি কিভাবে সম্ভব? আমি এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে চাচ্ছি।

পশ্চিমা কুৎসারটনাকারীরা বারবার আমার নবী ﷺ-কে Impostor (ছদ্মবেশী প্রতারক) বলে এসেছে। বুঝাই যাচ্ছে, এরা কথাটি বলেছে অজ্ঞতা থেকে নয়তো বিদ্বেষ থেকে।

প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য একটি নির্বিঘ্ন শান্তিময় জীবন প্রত্যাশা করে। বিনা কারণে ঝড়ঝাপটা এসে জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিক, এমনটি কেউ চায় না। বয়সের প্রথম ৪০ বছর আমার নবীর জীবন ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। বাল্যকাল দারিদ্রের মধ্যে পার করলেও স্নেহের কমতি ছিলনা। বিয়ের পর ঘরে সমৃদ্ধি ফিরেছিল। ব্যবসা করতেন আমার নবী, লাভবানও হয়েছেন। মক্কাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন সম্মানিত। সততার স্বীকৃতিস্বরূপ মক্কাবাসী তাঁকে আস-সাদিক আল-আমিন উপাধি দিয়েছিল। সমাজকল্যাণ সংস্থা হিলফুল ফুযুল-এর কার্যকরী সদস্য ছিলেন তিনি। কা'বা শরীফে হাজারে আসওয়াদ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান দিয়েছেন আমার নবী ﷺ।

৬১০ খ্রিস্টাব্দে একদম সবকিছু পাল্টে গেল। যারা প্রিয় বলে কাছে টানত, তারাই হয়ে ওঠল প্রাণের শত্রু। যারা শ্রদ্ধা করত, তারাই শুরু করল ঠাট্টা-বিদ্রূপ। চোখের সামনে চেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে গেল। চলার পথে তারা আমার নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে, মুখে থুথু দিয়েছে, পথে কাঁটা বিছিয়েছে। তাঁর শিশুপুত্রের মৃত্যুতে উল্লাসিত হয়েছে তাঁর নিজের লোকেরা। পেছন থেকে চাদর পেছিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। সেজদারত অবস্থায় পিঠের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে মরা উটের পঁচা নাড়িভুঁড়ি। পাহাড়ি উপত্যকায় তিনটি বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে। স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে তায়েফ গিয়েছিলেন আমার নবী। পাষাণহৃদয় তায়েফবাসী তাঁর ওপর বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করেছে।

হিজরতের রাতে তাঁকে হত্যা করবে বলে যুবকরা খোলা তরবারি হাতে ঘরের চারপাশে জড়ো হয়েছে। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকিয়েছেন আমার নবী। বলেছেনঃ "তোমার সন্তানরা যদি আমাকে বাধ্য না করত; হে প্রিয় মক্কাভূমি, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।" [জামে আত-তিরমিযি, সহীহ ইবনে হিব্বান]

কী অপরাধ করেছিলেন আমার নবী? কিছুই না। তিনি বলেছেনঃ "এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই।" ব্যস, এটুকুই।

আলতাফ হোসেন হালী বড় সুন্দর বলেছেনঃ "এটি কি বজ্রপাত ছিল, নাকি পথপ্রদর্শকের আহ্বান; আরবের যমিনকে যেটি সমূলে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল।"

মদীনায় যাওয়ার পর তাঁর ওপর যুদ্ধের পর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ৬ষ্ঠ হিজরিতে নিরস্ত্র উমরাহ করতে এসেছিলেন। তাঁকে উমরাহ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। মক্কার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কায় প্রবেশ না করেই ফিরে গেছেন।

একবার চিন্তা করুন। কোনো প্রতারক, যার নিজের ওপরই বিশ্বাস নেই, তার পক্ষে কি জীবনভর ওরকম নিপীড়নের মুখে অটল থাকা সম্ভব? একসময় তো হিম্মত জবাব দিয়ে দিত। কালিমা ত্যাগের বিনিময়ে মক্কাবাসী তাঁকে যেসব লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল; যে কোনো ছদ্মবেশী তাতে মোমের মতো গলে যেত। কিন্তু আমার নবী ﷺ কি একবারের জন্য নিজের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হয়েছেন? একটি দিনের জন্য আপোষ করেছেন? একবার চোখ মেলে দেখুন। আমার নবীর জীবন তো লুকানো গুপ্তধন নয়। কালিমা তায়্যিবার মতো সহজ-সরল ছিল আমার নবীর জীবন। সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয় এই সারল্যের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। বলেছেনঃ "তিনি (মুহাম্মদ ﷺ) খোদাকে মানুষ বলেননি, নিজেকেও খোদার সমতুল্য ভাবেননি। মুসলমানরা খোদা ব্যতীত অন্য কারও উপাসনা করেনা এবং মুহাম্মদ ছিলেন খোদার পয়গাম্বর। এর মধ্যে কোনো জটিলতা নেই, কোনো লুকোচুরি নেই।" [Treatise on Sayings of Muhammad, by Count Lev Nikolayevich Tolstoy]

উল্লেখ্য, তলস্তয়ের বন্ধু ভ্লাদিমির চার্তকভ বলেছেন, তলস্তয় মারা যাওয়ার পর তাঁর কোটের পকেটে একটি ছোট্ট পুস্তিকা পাওয়া গিয়েছিল। পুস্তিকার নাম "মুহাম্মদের বাণী"।

তাহলে মানতেই হবে, আমার নবী ﷺ ছদ্মবেশী ছিলেন না। কেউ তাঁকে নবী বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক; আমার নবী ﷺ নিজে নিজের আহ্বানের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। দুনিয়াকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পূর্বে আমার নবী নিজে ছিলেন সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ 'মুসলিম'। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম মন্টগোমরি ওয়াট নতশিরে স্বীকার করেছেনঃ "যুলুম-নির্যাতন সহ্য করার জন্য তাঁর (মুহাম্মদ ﷺ) সদা তৎপরতা, তাঁর সঙ্গী সাথীদের উত্তম চরিত্র এবং তাঁর চূড়ান্ত সাফল্যগাঁথা- সবকিছু এক বাক্যে তাঁর মৌলিক সততার (Fundamental Integrity) সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাঁকে ছদ্মবেশী প্রতারক বলে গণ্য করলে যতটা না সমাধান আসে, তারচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়।" [Mohammad At Mecca, Oxford, 1953, p. 52]

আমার নবী ﷺ-এর বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিকদের মূল অস্ত্র তিনটি।

এক. প্রেক্ষাপট-পারিপার্শ্বিকতা বাদ দিয়ে কুরআন বা হাদীসের খণ্ডিত অংশ উপস্থাপন করা (Text without context)

দুই. অর্ধসত্য (Twisted Truth)

তিন. ডাহা মিথ্যা (Falsehood)

প্রথমটি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের খণ্ডাংশ হচ্ছেঃ

فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ

"মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে, হত্যা করবে" [সুরা তাওবাহ : ৫]।

এই আয়াতের আগপিছ বাদ দিয়ে, এর প্রেক্ষপট ও উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে কেবল এ অংশটুকু তোলে ধরলে যে কোনো মানুষ শিউরে উঠবে। মধ্যযুগের নিরুদ্যম পাদ্রী থেকে শুরু করে আজকের যুগের ইসলামোফোবিক- আয়াতটি সবার কণ্ঠস্থ। কারণ এর দ্বারা ইসলামকে বদনাম করা যায়। কিন্তু আয়াতটি না এখানে শেষ হয়েছে, না এখান থেকে শুরু হয়েছে। আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে।

৬ষ্ঠ হিজরিতে সংঘটিত হুদায়বিয়ার সন্ধিতে বলা হয়েছিল যে, কুরাইশদের মিত্ররা মুসলমানদের মিত্রদের ওপর আক্রমণ করবেনা। অনুরূপ মুসলমানদের মিত্ররাও এরূপ কাজ করবেনা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই কুরাইশদের মিত্র বনু বকর গোত্র মুসলমানদের মিত্র বনু খোযায়া গোত্রের ওপর হামলা করে। ফলশ্রুতিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ৮ম হিজরিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা বিজয় করে নেন। কিন্তু অফিসিয়ালি মক্কাবাসী মুশরিকদের সাথে কৃত নিরাপত্তা চুক্তি মুসলমানদের পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়নি। ৯ম হিজরিতে আল্লাহ উক্ত চুক্তি বাতিল করে দেন [সুরা তাওবাহ : ১]। এরপর মক্কাবাসী মুশরিক, যারা মুসলমানদেরকে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, যারা বছরের পর বছর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করেছে, তাদেরকে চারমাস সময় দেয়া হয়। বলা হয়, ইসলাম গ্রহণ করো, নতুবা মক্কা থেকে চলে যাও। চারমাস পর নিরাপত্তা চুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত আদেশ কার্যকর হবে। এরপর আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে নেব।

এর পেছনে কারণ ছিল দুটি। প্রথম কারণ ছিল চুক্তিভঙ্গের শাস্তি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আল্লাহ যখন কোনো জাতির প্রতি রাসূল প্রেরণ করেন এবং সেই জাতি রাসূলকে অস্বীকার করে, তখন আল্লাহ ওই জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। পূর্ববর্তী রাসূলদের কউমকে আল্লাহ একই কারণে আসমানি গযব দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছেন। মক্কাবাসী মুশরিকরা যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে অস্বীকার করে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, তখন তাদের প্রতিও এরকম শাস্তি আসার কথা ছিল। পার্থক্য এটি যে, তাদের ওপর আসমানি শাস্তি আসেনি। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ যেখানে অবস্থান করেন, সেখানে আসমানি গযব আসেনা। বরং আল্লাহ তাদেরকে মুসলমানদের হাতে সমূলে পরাজিত করে দিয়েছেন।

বি.দ্রঃ এ নিয়ম নবীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কেবল রাসূলদের জন্য।

উক্ত হুশিয়ারির পর অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কতিপয় মক্কা ত্যাগ করেছিল। শিরকের দুর্গন্ধ থেকে হারাম শরীফ পাক হয়েছিল। তাফসিরে তো আছেই; ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়, উক্ত আয়াতটি ওই সময়কার শত্রুভাবাপন্ন মক্কাবাসী মুশরিক ব্যতীত অন্য কোনো সময়ের, অন্য কোনো স্থানের মুশরিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। উমাইয়া, আব্বাসি, মামলুক, অটোমান, মোঘল প্রমুখ মুসলিম শাসনামনে মুসলিম বিশ্বে অগণিত মুশরিক ছিল, আজও আছে।

প্রশ্ন আসে, অনেক মুশরিক গোত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। চুক্তিও ভঙ্গ করেনি। তাদের ব্যাপারে কী নির্দেশ? তাদের ব্যাপারে নির্দেশ ছিল, "তারা যতক্ষণ চুক্তিতে অটল থাকে, তোমরাও অটল থাকবে" [সুরা তাওবাহ : ৪]। যারা অসহায় নিরপরাধ, যুদ্ধবিগ্রহে ছিলনা। তাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ ছিল, "যদি কোনো মুশরিক আশ্রয় চায়, তবে তাকে আশ্রয় দাও। যেন সে (তোমাদের সাথে থেকে) আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। এরপর তাকে তার নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দাও" [সুরা তাওবাহ : ৬]। এবার এই সবকিছু বাদ দিয়ে দীর্ঘ একটি সুরা থেকে একটি আয়াতের অর্ধাংশ তোলে আনলে পুরো বিষয়টি কিভাবে বোধগম্য হবে?

একই ব্যাপার হাদীসের ক্ষেত্রেও। সহীহ বুখারীসহ অনেক হাদীসের কিতাবে আনাস রা.'র সূত্রে একটি হাদীস এসেছে। উরায়না/উকল গোত্রের ৮ জন লোক মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মদীনায় তারা অসুস্থ বোধ করায় রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে 'যুল জাদর' নামক স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। ওখানে রাষ্ট্রীয় সাদকার উট চরানো হতো। তারা সেখানে গিয়ে উটের দুধ এবং মুত্র (চিকিৎসাস্বরূপ) পান করে আরোগ্য লাভ করল। এরপর ইসলাম ত্যাগ করে, উটের রাখাল ইয়াসারকে হত্যা করে উটের পাল নিয়ে পালিয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে গ্রেফতার করে আনালেন। এরপর তাদের হাত পা কেটে, চোখ উপড়ে মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হলো।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, "হত্যার বিনিময়ে হত্যা" ঠিক আছে। কিন্তু এমন নির্মমতা কেন? এর কারণ হলো, তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় রাখাল ইয়াসারসহ আরও কয়েকজনকে ঠিক এভাবে হত্যা করেছিল [তাবাকাত ইবনে সা'দ, খঃ ২, পৃঃ ১১৪]। তাদের ইসলাম ত্যাগ, ডাকাতি এবং পলায়ন যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ ক্ষমা করেও দেন; রাখালদের সাথে তারা যে পাশবিক আচরণ করেছিল, সেটি কিভাবে ক্ষমা করবেন? ন্যায়বিচার কি নবীর দায়িত্ব নয়?

মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, আনাস রা. যখন হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তখন পরেরটুকুই বলেছেন। পুরো ঘটনা বলেননি। হয়তো তখন সবাই মূল ঘটনাটি জানত, নতুবা তিনি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাই হাদীসের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়নি। পরবর্তীতে ইসলাম-বিদ্বেষীরা এই হাদীসের খণ্ডিত অংশকে সামনে এনে তাদের উদ্দেশ্য সাধন করেছে।

এই হচ্ছে ইসলামোফোবিকদের প্রথম অস্ত্র। তারা আগপিছ বাদ দিয়ে একটি টুকরো হাতে নেয় এবং এর দ্বারা বিদ্বেষ ছড়ায়।

চলবে...

আল-মুজতাবা : বিশ্বমানবতার অনুপম আদর্শ (২য় পর্ব)

ইসলামোফোবিকদের দ্বিতীয় অস্ত্র হচ্ছে অর্ধসত্য। অর্থাৎ সত্যকে ভেঙ্গে, সামান্য মুচড়িয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যেন একদম মিথ্যেও না হয়, আবার উদ্দেশ্যও সাধন হয়ে যায়।

একটি উদাহরণ দিচ্ছি। যদিও ইসলামোফোবিয়ার সাথে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও বুঝতে সুবিধা হবে। এক মহিলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে নালিশ করলেন যে, তাঁর স্বামী তাঁকে নামাজ-রোজা করতে বাধা দেন। নিজেও ফজরের নামাজ আদায় করেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ ওই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠালেন এবং ব্যাখ্যা চাইলেন। ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার স্ত্রী প্রতিদিন নফল রোজা রাখেন। সারা রাত নামাজে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি যখনই তাঁকে কাছে পেতে চাই, হয় তিনি নামাজে, নয়তো তিনি রোজাদার। দ্বিতীয়ত, আমরা বংশগতভাবে গাঢ় ঘুমে অভ্যস্ত। আমি চেষ্টা করি ফজরের সময় জাগ্রত হতে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও জাগতে পারিনা। বিষয়টি পরিষ্কার হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ মহিলাকে বললেন, "তোমার ওপর তোমার স্বামীর হক রয়েছে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।" স্বামীকে বললেন, "চেষ্টা করবে ফজরের সময় জাগ্রত হতে। যদি কোনোভাবেই না পারো, তবে যখন জাগ্রত হবে তখন আদায় করে নেবে।"

ওই মহিলা মিথ্যা বলেননি। কিন্তু তাঁর অর্ধসত্য পুরো বিষয়টিকে পাল্টে দিয়েছে। অবশ্য তিনি এমনটি করেছেন সরল মনে। বিদ্বেষীরা করে ইচ্ছাকৃতভাবে।

এ দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয় আমার নবীর ব্যক্তিগত জীবনে। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিআল্লাহু আনহা'র বিয়ে। ওই বিয়ের সময় আমার নবীর বয়স ছিল ৫৩, আয়েশার বয়স ৯। এ কারণে তারা আমার নবীর শানে খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করে। প্রথা ও সংস্কৃতি সদা পরিবর্তনশীল- এই সহজ সত্যটি না জানার কারণে একটি "স্বাভাবিক" বিষয়কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা হয়। স্বাভাবিক বলতে আজকের যুগের স্বাভাবিক নয়; ৭ম শতাব্দীর আরব সংস্কৃতির স্বাভাবিক।

লক্ষ্য করে দেখবেন, মক্কার মুশরিক এবং মদীনার ইহুদি ও মুনাফিকরা আমার নবীকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা ছড়িয়েছে। পাগল, গণক, যাদুকর, মৃগীরোগী- কত কিছু। কিন্তু একটিবারও তাঁকে Child Molester (যেটি আজ বলা হয়) বলেনি। কেন? কারণ তৎকালীন আরব সংস্কৃতিতে এরকম বিয়ে খুব স্বাভাবিক ছিল। অহরহ হতো।

প্রশ্ন আসতে পারে বাল্যবিবাহ নিয়ে। প্রথমত, ইসলামে বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ নয়। দ্বিতীয়ত, একজন নারীর ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর সে শারীরিকভাবে সাবালিকা হয়ে যায়। আর সাবালিকা দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় মানসিকভাবে বড় হওয়া, তবে সেটি একেকজনের জন্য একেক রকম। সবার মানসিক বিকাশ সমানভাবে হয়না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী গল্পের কথা মনে আছে? হৈমন্তীর বয়স ১১ পেরোনো মাত্র সবাই বলাবলি শুরু করল, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে! মাত্র দেড়শ বছর আগে যদি হৈমন্তীর বিয়ের বয়স ১১ হয়, তবে সাড়ে ১৪শ বছর আগে ৯ বছরের একজন মেয়ের বিয়ে কি এতোই অস্বাভাবিক? যারা আমার নবীর ৫৩ বছর বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা কি খাদিজা রাদ্বিআল্লাহু আনহা'র সাথে বিয়ের সময়কার বয়সটি দেখেননি? খাদিজা ছিলেন আমার নবী থেকে ১৫ বছরের বড়। ওখানে সমস্যা না হলে, এখানে সমস্যা হবে কেন?

যার বয়স নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের এতো মাথাব্যথা, সেই আয়েশা সিদ্দিকা রা. কোনো দিন তাঁর বয়স নিয়ে অস্বস্তি বা উষ্মা প্রকাশ করেননি। আয়েশা খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন। কিছু বলতে চাইলে তিনি মুখ ফোটে বলে দিতেন। বরং তাঁদের জীবন ছিল সুখী দাম্পত্যের উপমা। বিয়ের পরও আয়েশা তাঁর বান্ধবিদের সাথে স্বামীর ঘরে পুতুল খেলতেন। আয়েশা নিজে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা দুজন এক পাত্র থেকে গোসল করতেন, এক পাত্রে একই স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি খেতেন, একজন আরেকজনের মুখে খাবার তোলে দিতেন, দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন, কৌতুক করতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ আয়েশাকে নিজের আড়ালে দাঁড় করিয়ে মসজিদের ভেতর হাবশিদের তলোয়ারবাজি দেখিয়েছেন। ভালোবেসে তিনি আয়েশাকে "আয়েশ" বলে ডাকতেন। আয়েশা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বাইরে থেকে ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে মিসওয়াক করতেন। কারণ তিনি স্ত্রীর সামনে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চাইতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার প্রিয় মানুষ কে? আমার নবী জবাব দিলেনঃ আয়েশা [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]। একজন নারী হিসেবে আয়েশা সিদ্দিকা রা. স্বভাবতই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অন্য স্ত্রীদের প্রতি কিছুটা ঈর্ষান্বিত ছিলেন। তিনি এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

এই সংসার দেখে কি একবারও মনে হয় যে, আয়েশা একজন নির্যাতিত মহিলা ছিলেন? যারা একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, একে অপরকে ভালোবেসেছেন, তাঁরা যদি সুখে থাকেন, তাহলে আপনার তাতে নাক ঢুকানোর কী দরকার?

পশ্চিমারা আমার নবীর একাধিক বিবাহ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ ব্যাপারে প্রথমত দুটি কথা বলা প্রয়োজন।

এক. এসব বিবাহ ছিল আল্লাহর প্রত্যক্ষ নির্দেশ। নবী-রাসূল কখনও আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কিছু করতে পারেন না [সুরা নাজম : ৩-৪]।

দুই. তৎকালীন আরবে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। তাই সে সময়কার এবং আজকের, আরব সমাজের জন্য একাধিক বিবাহ কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। পরিসংখ্যান বলে, আরব সমাজে আজও পুরুষের চেয়ে নারীর অনুপাত বহুগুণ বেশি। তাছাড়া আরব নারীরা অনারব পুরুষকে বিবাহ করতে চায়না।

সম্পর্ক তৈরি করার সবচেয়ে বড় সেতুবন্ধন হচ্ছে বিবাহ। আমার নবীর বিবাহসমূহকে নেহায়েত পার্থিব দৃষ্টিতে দেখলেও এর মধ্যে বড় হিকমত লুকায়িত আছে। এক নজরে আমার নবীর দাম্পত্য জীবন-

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। তাঁর গর্ভে আমার নবীর চার কন্যা (যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলছুম, ফাতিমা) এবং দুই পুত্র (কাসিম, আবদুল্লাহ) জন্মগ্রহণ করেন। খাদিজা ছিলেন আমার নবীর মাক্কী জীবনের গৃহসঙ্গী, বন্ধু, সমর্থক, অভিভাবক এবং প্রথম মুসলিম। তিনি বেঁচে থাকাকালীন রাসূলুল্লাহ ﷺ দ্বিতীয় কোনো বিবাহ করেননি।

২য় স্ত্রী সাওদা বিনতে যাম'আ। তিনি বয়স্ক একজন মহিলা ছিলেন। ঘর-পরিবার সামলে রাখার জন্য আমার নবী তাঁকে ঘরে এনেছিলেন।

৩য় স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবু বকর। তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় সবচেয়ে বেশি। গত পর্বে আমরা এ ব্যাপারে কথা বলেছি।

৪র্থ স্ত্রী হাফসা বিনতে উমর। বদর যুদ্ধে তাঁর স্বামী খুনাইস শহীদ হওয়ার পর তাঁর পিতা উমর রা. তাঁকে পুনরায় বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজছিলেন। তখন আমার নবী হাফসাকে বিয়ে করেন।

৫ম স্ত্রী যায়নাব বিনতে খুযাইমা। তাঁকে বলা হতো গরিবের জননী। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করেন বিধায় তাঁর সম্পর্কে খুব একটা জানা যায়না।

৬ষ্ঠ স্ত্রী উম্মে সালামাহ। তাঁর স্বামী আবু সালামাহ উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। ইয়াতিম সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা উম্মে সালামাকে নিজের ঘরে তোলে নেন আমার নবী।

৭ম স্ত্রী জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস। বনু মুস্তালিক গোত্রের সাথে তিনি যুদ্ধবন্দী হয়ে এসেছিলেন। আমার নবী তাঁকে মুক্ত করে দেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে আমার নবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ ও বিয়ের ফলশ্রুতিতে পুরো মুস্তালিক গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁদের সবাইকে সম্মানের সাথে মুক্ত করে দেন।

৮ম স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশ। তিনি ছিলেন আমার নবীর ফুফাতো বোন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আযাদকৃত গোলাম যায়েদ ইবনে হারিসার সাথে। ওই বিয়ে টিকেনি। যায়েদের সাথে বিচ্ছেদের পর আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাযিল করে আমার নবীর সাথে যায়নাবের বিয়ে দিয়ে দেন।

৯ম স্ত্রী উম্মে হাবিবা রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান। তিনি তাঁর স্বামী উবায়দুল্লাহ'র সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁর স্বামী ইসলাম ত্যাগ করেন এবং অধিক মদ্যপানে মৃত্যুবরণ করেন। বিদেশ-বিভূঁইয়ে একাকী উম্মে হাবিবা খুব অনিরাপদ বোধ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বাদশা নাজ্জাশীর কাছে তাঁকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব পাঠান। বাদশা নাজ্জাশী উম্মে হাবিবাকে আমার নবীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের সংবাদ শুনে উম্মে হাবিবার পিতা, তৎকালীন মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান খুশি হয়ে বলেছিলেনঃ "মুহাম্মদের চেয়ে ভালো স্বামী তুমি আর পাবেনা।"

১০ম স্ত্রী সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই। তিনি ইহুদি নেতা হুয়াই ইবনে আকতাবের কন্যা। খায়বারের যুদ্ধে তিনি যুদ্ধবন্দী হয়ে এসেছিলেন। আমার নবী তাঁকে মুক্ত করে দেন। কেউ কেউ তাঁকে ইহুদি বলে ব্যঙ্গ করতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বলেছিলেনঃ "তারা তোমার মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ। তোমার পিতা (পূর্বপুরুষ) মুসা আ. নবী, তোমার চাচা হারূন আ. নবী এবং তোমার স্বামী মুহাম্মদ ﷺ নবী। তুমি নবীদের ঘরের মানুষ।"

১১শ স্ত্রী মায়মুনা বিনতে হারিস। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর আব্বাস রা. তাঁকে আমার নবীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।

এছাড়াও মারিয়া আল-কিবত্বিয়া নামে একজন মিশরী দাসী ছিলেন। কেউ বলেছেন, তিনি আমার নবীর স্ত্রী ছিলেন। কারও মতে তিনি ছিলেন উম্মুল ওয়ালাদ। তাঁর গর্ভে আমার নবীর কনিষ্ঠ পুত্র ইবরাহিম জন্মগ্রহণ করেন। রাদ্বিআল্লাহু আনহুম আজমাঈন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে বিয়ের সময় তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা ব্যতীত আর কেউ কুমারী ছিলেন না। সবারই আগে বিয়ে হয়েছিল এবং বেশিরভাগের সন্তানাদি ছিল। আমার নবী স্বামীহারা এসব নারীদেরকে নিজের ঘরে তোলে এনেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন, তাঁদের সন্তানদেরকে নিজের সন্তানের মতো লালনপালন করেছেন। ইসলামি শরিয়তে নবীর স্ত্রীদেরকে বলা হয় "উম্মাহাতুল মু'মিনীন" বা বিশ্বাসীদের জননী। মর্যাদার দিক থেকে এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন খাদিজা রাদ্বিআল্লাহু আনহা। এছাড়াও আয়েশা রা., হাফসা রা. এবং উম্মে সালামাহ রা. তাঁদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং দীনের খেদমতের জন্য ইসলামের ইতিহাসে চির অমর হয়ে আছেন।

আমার নবী ﷺ-এর বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিকদের শেষ অস্ত্র হচ্ছে ডাহা মিথ্যাচার। এ দিক থেকে তৎকালীন আরবের মূর্খ আবু জাহেল যেমন, আজকের যুগের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীও তেমন। যুগ পরিবর্তন হয়েছে, শিক্ষাদীক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু মিথ্যা মিথ্যাই থেকে গেছে।

আমার নবী ﷺ প্রথম রাসূল নন, যাকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়েছে। বরং ইতোপূর্বে প্রত্যেক নবী-রাসূলকে নিয়ে লোকেরা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে। আল্লাহ বলেছেনঃ

وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِّن قَبْلِكَ

"নিশ্চয়ই আপনার পূর্ববর্তী রাসূলদেরকেও উপহাস করা হয়েছে" [সুরা আন'আম : ১০]

কিন্তু আমার নবী ﷺ-এর ব্যাপারটি ভিন্ন। অন্য নবী-রাসূলকে আল্লাহ এসব মিথ্যাচারের জবাব শিখিয়ে দিয়েছেন। আর আমার নবীর পক্ষ থেকে স্বয়ং বিশ্বজাহানের প্রতিপালক এসব ঠাট্টা-বিদ্রূপের জবাব দিয়েছেন। আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেনঃ

إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ

"(হে নবী) বিদ্রূপকারীদের জন্য আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট" [সুরা হিজর : ৯৫]

উদাহরণস্বরূপ, মুশরিকরা বলত, মুহাম্মদ ﷺ নিজে কবিতা রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ স্বয়ং এ মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছেনঃ وَمَا هُوَ بِقَوْل شَاعِر "এটি (কুরআন) কোনো কবির কবিতা নয়" [সুরা হাক্কাহ : ৪১]। মুশরিকরা বলত, মুহাম্মদ ﷺ গণক। তিনি জিনের সাহায্যে ভবিষ্যত গণনা করেন। আল্লাহ এ কথারও জবাব দিয়েছেনঃ وَلَا بِقَوْل كَاهِن "এটি কোনো গণকের গণনা নয়" [সুরা হাক্কাহ : ৪২]। মুশরিকরা বলত, মুহাম্মদ ﷺ পাগল। আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেনঃ

مَا أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُون وَإِنَّ لَكَ لَأَجْرًا غَيْرَ مَمْنُون وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ فَسَتُبْصِرُ وَيُبْصِرُونَ بِأَييِّكُمُ الْمَفْتُونُ

"আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনি পাগল নন। আপনার জন্য রয়েছে অশেষ পুরস্কার। নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। অচিরেই আপনি দেখবেন এবং তারাও দেখবে যে, তোমাদের মধ্যে প্রকৃত পাগল কে" [সুরা কলম : ২-৬]

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত, আমার নবীর বিরুদ্ধে মিথ্যাবাদীদের মিথ্যাচার থামেনি। তাদের এহেন মিথ্যাচার আমাদেরকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ নিজেই জানিয়ে দিয়েছেনঃ

وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا

"তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিস্টান) এবং যারা শিরক করেছে, অবশ্যই তাদের কাছ থেকে তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে" [সুরা আলে ইমরান : ১৮৬]

মধ্যযুগের পাদ্রীরা আমার নবীর ব্যাপারে প্রধানত তিনটি মিথ্যা চালু করেছিল।

এক. "মুহাম্মদ ছিলেন মৃগীরোগে আক্রান্ত।" বলাই বাহুল্য, এই নির্জলা মিথ্যা এক মূহুর্তের জন্য টিকে থাকতে পারেনি।

দুই. "মুসলমানরা মুহাম্মদের উপাসনা করে।" এটি কত বড় মিথ্যা, তা বলার প্রয়োজন নেই।

তিন. "মুহাম্মদ ৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছেন।" যদিও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, আমার নবী ﷺ ইন্তেকাল করেছেন ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। এ মিথ্যাচারের কারণ হচ্ছে, খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে ৬৬৬ (Triple Six) দাজ্জালের চিহ্ন। তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছেন?

তবে এসব মিথ্যাচার না আমার নবীর কোনো ক্ষতি করতে পেরেছে, না ইসলামের প্রচার-প্রসার রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। বরং যুগে যুগে পশ্চিমা পণ্ডিতরাই এসব মিথ্যাচার খণ্ডন করেছেন। আমরা সেদিকে যাব ইনশাআল্লাহ।

চলবে...

আল-মুজতাবা : বিশ্বমানবতার অনুপম আদর্শ (৩য় পর্ব)

মানব জীবনের দুটি দিক থাকে। একটি ব্যক্তিগত, আরেকটি সমষ্টিগত। ব্যক্তিগত দিক হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস (Creed/Dogma), ধর্মকর্ম (Modes of Warship), আচার-ব্যবহার (Modes of Behaviour) ইত্যাদি। এগুলো অনেকাংশে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। সমষ্টিগত দিক হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক, শান্তি-সংঘর্ষ এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় কার্যাবলী। এগুলো ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করেনা। বরং পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। আমার নবী ﷺ মহান কেন জানেন? আমার নবী মানব ইতিহাসের একমাত্র সংস্কারক, যিনি এই প্রত্যেকটি বিষয়কে সমানভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। আমেরিকান দার্শনিক জন উইলিয়াম ড্রেপার বলেছেনঃ "রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর ৪ বছর পর, ৫৬৯/৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করে যিনি মানব সভ্যতাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন, তিনি মুহাম্মদ।" [A History of the Intellectual Development of Europe, London, 1875, vol. 1, p. 329-330]

আরবরা ছিল তৎকালীন বিশ্বের নিকৃষ্টতম পৌত্তলিক। যে যমিনে বছরজুড়ে ৩৬০টি মূর্তির পূজা করা হত, সে যমিনে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘোষণা করেছেন কালিমা তায়্যিবাহ لا اله الا الله (এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই)। এরচেয়ে বড় "ইনকিলাবি স্লোগান" মানবজাতি আর কখনও শুনেনি।

এই কালিমা তায়্যিবাহ ৩৬০ থেকে শুরু করে ৩৩ কোটি বানোয়াট খোদাকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছে। এই কালিমা তায়্যিবাহ বিলালের কণ্ঠে 'আহাদুন আহাদ' ধ্বনিরূপে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই কালিমা তায়্যিবাহ উমরের ফরমান হয়ে শুষ্ক নীলনদকে পুনরায় প্লাবিত করেছে। এই কালিমা তায়্যিবাহ আলীর হাত হয়ে খায়বার দুর্গের দরজা টেনে ছিড়ে ফেলেছে। এই কালিমা তায়্যিবাহ শিখিয়েছে- আদেশ আল্লাহর, নিষেধ আল্লাহর, সন্তুষ্টি আল্লাহর, অসন্তুষ্টি আল্লাহর, ভালোবাসা আল্লাহর জন্য, ঘৃণা করা আল্লাহর জন্য, অর্জন আল্লাহর জন্য, ত্যাগ আল্লাহর জন্য, চাওয়া আল্লাহর কাছে, না চাওয়াও আল্লাহর কাছে, জীবন আল্লাহর জন্য, মরণ আল্লাহর জন্য।

একবার এক বেদুইন আমার নবী ﷺ-এর কাছে এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে ইসলাম সম্বন্ধে এমন একটি কথা বলে দিন, যেন আর কখনও আমাকে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে না হয়। রাসূলুল্লাহ বললেনঃ قُلْ آمَنْت بِاَللَّهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ "তুমি বলো, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম। অতঃপর এর ওপর টিকে থাকো।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ঈমান, আরবাঈন ; ইমাম নববী]

বিপ্লব এখানেই শেষ নয়; এ তো কেবল শুরু। জন উইলিয়াম ড্রেপারের সূত্র ধরে বলছি, ৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করা তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামটিও আজ কারো মনে নেই। এর মাত্র ৪ বছর পর আরবের মরুভূমিতে জন্মগ্রহণ করা এক ইয়াতিম শিশু মানব ইতিহাসের পুরো গতিপথ পাল্টে দিয়েছেন। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার জন্য আমার মা-বাবা কুরবান হোক।

বলা হয়, Charity begins at home. অর্থাৎ, ভালো কাজের সূচনা করতে হয় ঘর থেকে। আমার নবী ﷺ ছিলেন এর (সম্ভবত একমাত্র) বাস্তব উদাহরণ। যে মহান মুহাম্মাদী বিপ্লবের কথা আজ আমরা শুনি, সেটি শুরু হয়েছিল খোদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ঘর থেকে, এবং এটিই ছিল এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

আমার নবী সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাকে। এ উম্মতের পথচলা শুরু হয়েছিল উম্মতের জননী খাদিজার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে। খাদিজা ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তাঁর কাছের মানুষ ফাতিমা বিনতে আসাদ (আবু তালিবের স্ত্রী) এবং লুবাবা বিনতে হারিস (আব্বাসের স্ত্রী)-কে। উক্ত দুজন ছিলেন নারীদের মধ্যে ২য় এবং ৩য় মুসলিম।

বি.দ্রঃ নবীর কন্যাদের কথা আলাদা।

পুরুষদের মধ্যে শুরুতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন আলী ইবনে আবি তালিব (১ম), যায়েদ ইবনে হারিসা (২য়) এবং আবু বকর সিদ্দিক (৩য়)। আলী এবং যায়েদ নবীর ঘরের মানুষ। তাঁদের দুজনকে রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজ হাতে লালনপালন করেছেন। আর আবু বকর ছিলেন আমার নবীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মক্কাবাসী মুশরিকদের নিপীড়নের মুখে মুসলমানদের প্রথম যে দলটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেছিল, সেই দলের অগ্রভাগে ছিলেন আমার নবীর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিব, কন্যা রুকাইয়া এবং জামাতা উসমান ইবনে আফফান। একইভাবে মদীনা তায়্যিবায় হিজরতকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন আমার নবীর চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব।

বদর যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষ থেকে যখন 'মুবারাযা' বা মল্লযুদ্ধের আহ্বান করা হয়, তখন আমার নবী ﷺ তাঁর চাচা হামযা, চাচাতো ভাই আলী এবং উবায়দাহ'কে সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন। খায়বারের যুদ্ধে ইহুদিদের দুর্ভেদ্য দুর্গ বিজয় করার জন্য আমার নবী আলীকে পাঠিয়েছেন। আর উহুদ যুদ্ধে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের কেটে টুকরো করা দেহখানি তো পুরো উম্মতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে আল্লাহর রাহে শাহাদতের হক আদায় করে দিয়েছে।

মুসলমানদের প্রথম বিদেশ অভিযান মু'তার যুদ্ধে (বর্তমান জর্ডান) আমার নবী ﷺ ইসলামের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন ঘরের মানুষ যায়েদ ইবনে হারিসা এবং চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিবের হাতে। দূরদেশে আল্লাহর দীনের জন্য শাহাদত বরণ করে যায়েদ এবং জাফর মুহাম্মাদী পরিবারের শোভা বর্ধন করেছেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে বিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কুরাইশদের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য আমার নবী মক্কায় প্রেরণ করেছিলেন তাঁর জামাতা উসমানকে।

বিদায় হজের ভাষণে আমার নবী ﷺ জাহেলি যুগের রক্তপণ এবং সুদপ্রথা নিষিদ্ধ করেছেন। প্রথম যার রক্তপণ নিষিদ্ধ হয়েছিল, তিনি আমার নবীর ভাতিজা আদম ইবনে রাবি'আ ইবনে হারিস। এই ছোট বাচ্চাকে হুযায়েল গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছিল। আদম ইবনে রাবি'আর রক্তপণ ক্ষমা করার মাধ্যমে আমার নবী ﷺ রক্তপণের সংস্কৃতি চিরতরে উৎখাত করে দিয়েছেন।

প্রথম যার প্রাপ্য সুদ নিষিদ্ধ হয়েছিল, তিনি আমার নবীর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব। তিনি জাহেলি যুগে কয়েকজনকে ঋণ দিয়েছিলেন এবং সে সময়কার প্রথা অনুযায়ী বড় অংকের সুদ তাঁর প্রাপ্য ছিল। আব্বাসের সুদ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে আমার নবী ﷺ সুদপ্রথা চিরতরে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল হাজ্জ]

ইসলামের জন্য যখন যত ত্যাগ স্বীকার করার প্রয়োজন হয়েছে, আমার নবীর পরিবারবর্গ এবং কাছের মানুষেরা তার বড় অংশ নিজেরাই করে দিয়েছেন, রাদ্বিআল্লাহু আনহুম আজমাঈন। মুহাম্মাদী বিপ্লব মহান কেন জানেন? কারণ ওই বিপ্লব শুরু হয়েছিল খোদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ঘর থেকে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সমাজ সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দাসপ্রথা সংস্কার।

জেনে রাখা উচিৎ, আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতিকে সমগ্র সৃষ্টির ওপর মর্যাদা দিয়েছেন। বলেছেনঃ

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

"আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি। জলে স্থলে চলাচলের বাহন দিয়েছি, পবিত্র রিযিক দিয়েছি এবং আমার সৃষ্টির অনেকের ওপর তাদেরকে মর্যাদা দান করেছি" [সুরা ইসরা : ৭০]।

ইসলাম দাসপ্রথার প্রবর্তক নয়। আমাদের নবী ﷺ পৃথিবীতে আসার বহু আগে থেকে দাসপ্রথা ছিল, পরেও ছিল। বরং আমাদের নবী ﷺ ছিলেন দাসপ্রথা উৎখাত অভিযানের সূচনাকারী। হ্যাঁ এটি ঠিক যে, তিনি যেভাবে নাম ধরে মদ, জুয়া, সুদ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিলেন, দাসপ্রথা সেভাবে নিষিদ্ধ করেননি। তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতায় সেটি সহজ ছিলনা। কিন্তু শেষের শুরু তিনি করে দিয়েছেন।

সে সময় মানুষকে দাস বানানোর কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।

এক. দাস-দাসীর সন্তানরা দাস হিসেবে গণ্য হত।

দুই. দুর্বল-দরিদ্র মানুষকে অপহরণ করে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত।

তিন. ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে ঋণগ্রহীতাকে দাস বানানো হত।

চার. POW বা যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসরূপে গ্রহণ করা হত।

২য় এবং ৩য় পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ ﷺ এক বাক্যে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। হাদীসে বলা হয়েছে, "তিন শ্রেণীর মানুষের নামাজ কবুল হয়না। তন্মধ্যে একশ্রেণী হলো, যারা স্বাধীন মানুষকে দাস বানায়।" [সুনান আবি দাউদ, সুনান ইবনে মাজাহ]

১ম শ্রেণীর ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা ছিল, যদি কোনো কৃতদাসী তার মনিবের সন্তান জন্ম দেয়, তবে সে সন্তান দাস বলে গণ্য হবেনা। বরং মনিবের স্বাধীন সন্তান বলে বিবেচিত হবে। শুধু তাই নয়। ওই সন্তানের কারণে তার জন্মদাত্রী মা দাসী থেকে উন্নিত হয়ে "উম্মুল ওয়ালাদ" নামক একটি শ্রেণীতে চলে আসবেন। এর পেছনে হিকমত হচ্ছে, যদি হঠাৎ করে সব দাস-দাসীকে একসাথে স্বাধীন মানুষের মর্যাদা দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আরবের কট্টর কৌলীন্যপ্রথায় বিশ্বাসী লোকেরা সহজে মেনে নেবেনা। তাই এমন একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, যাতে কৃতদাসীরা মনিবের ঘরে "উম্মুল ওয়ালাদ"-এর মর্যাদা পায় এবং তাদের গর্ভের সন্তানরা স্বাধীন মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। এর ফলে ধীরে ধীরে তারা সমাজের মূলধারার সাথে মিশে যাবে।

যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ কৌশলী ভুমিকা গ্রহণ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যে দল/গোত্র/জাতির মধ্যে যুদ্ধবন্দীকে দাস বানানোর প্রথা প্রচলিত আছে, তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাস বলে গণ্য করা হবে। আর যারা নিজেরা এ প্রথা অনুসরণ করেনা, তাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানানো হবেনা। এজন্য বদর, উহুদ, খন্দক, মক্কা বিজয় প্রভৃতি যুদ্ধে কোনো যুদ্ধবন্দীকে দাস বানানো হয়নি। কারণ এসব যুদ্ধ ছিল কুরাইশদের বিপক্ষে। কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধবন্দীকে দাস বানানোর প্রথা ছিলনা। অপরদিকে মুরাইসি, খায়বার এবং হুনায়েন যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো হয়েছিল। কারণ ওই যুদ্ধগুলো হয়েছিল যথাক্রমে মুস্তালিক, ইহুদি এবং হাওয়াযিন গোত্রের সাথে। এদের মধ্যে যুদ্ধবন্দীকে দাস বানানোর প্রথা প্রচলিত ছিল।

সমাজের বিপুল সংখ্যক দাস-দাসীকে স্বাধীন মানুষের কাতারে নিয়ে আসতে ইসলাম অনবরত প্রণোদনা দিয়ে এসেছে। হাদীসে বর্ণিত আছে, মুক্তিপ্রাপ্ত কৃতদাসের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে মুক্তিদাতার প্রতিটি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]। দাস-দাসীকে যথেচ্ছা খাটানো, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কিংবা প্রহার করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি কৃতদাসকে প্রহার করার প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে তাঁদেরকে মুক্ত করে দেয়া [সুনান আবি দাউদ]। রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবায়ে কেরাম জীবনভর কত শত দাস মুক্ত করেছেন, তার হিসেব রাখা দুষ্কর।

দাসমুক্তির পথ প্রশমিত করার জন্য ইসলামের সেরা পদ্ধতি ছিল কাফফারা। কসম ভঙ্গ করা, যিহার করা, রোজা ভঙ্গ করা, ভুলবশত হত্যা করা- এসব অপরাধের প্রথম কাফফারা হচ্ছে দাসমুক্তি। পবিত্র কুরআনে কৃতদাস মুক্ত করাকে বলা হয়েছে দীনের সুরক্ষিত ঘাঁটি।

وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ فَكُّ رَقَبَةٍ

"আপনি কি জানেন সুরক্ষিত ঘাঁটি কী? দাসমুক্তি" [সুরা বালাদ : ১২-১৩]।

পশ্চিমা সভ্যতায় (এমনকি প্রাক-আধুনিক যুগেও) কালো, অসহায়, দরিদ্র এবং উপজাতিদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে যে বর্বর অত্যাচার করা হয়েছে, ইসলামি সভ্যতায় এর বিন্দুমাত্র নমুনা পাওয়া যাবেনা। বরং ইসলামি জ্ঞানরাজ্যে মুক্ত দাসদের (মাওয়ালি) পদচারণা মনিবদের চেয়ে হাজারগুণ উজ্জ্বলতর। আধুনিক ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ' যথার্থ বলেছেনঃ "পশ্চিমাদের কাছে মুহাম্মদ হচ্ছেন অপশক্তি। আমি নিজে তাঁর জীবন অধ্যয়ন করেছি। আমার মতামত হচ্ছে, তাঁকে অপশক্তি বলা তো দুরের কথা; বরং তাঁকে বলা উচিৎ বিশ্ব মানবতার রক্ষাকারী।"

চলবে...

আল-মুজতাবা : বিশ্বমানবতার অনুপম আদর্শ (৪র্থ পর্ব/শেষ পর্ব)

ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডেভিড জর্জ হোগার্থ লিখেছেনঃ "গুরুত্বপূর্ণ কিংবা তুচ্ছ; তাঁর (মুহাম্মদ ﷺ) প্রতিটি দৈনন্দিন আচরণ (মুসলিমদের জন্য) অনুশাসন, যা আজ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ সচেতনভাবে অনুকরণ করে যাচ্ছে। গুণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অন্য কোনো ধর্মপ্রবর্তক ওই সম্মানের জায়গায় পৌঁছাতে পারেননি, যেখানে পৌঁছেছেন মুসলমানদের নবী।" [Arabia, Oxford, 1922, p. 52]

আমাদের নবী ﷺ-এর জীবনের সবচেয়ে বড় মানবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে Simplicity. নিতান্তই সহজ-সরল স্বাভাবিক ছিল তাঁর জীবন। তিনি যা করতেন, সবই ছিল স্পষ্ট। হাটার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে হাটতেন। দ্রুত পথ চলতেন। কারও দিকে তাকাতে হলে পুরোপুরি তাকাতেন। দেখা হলে আগে সালাম দিতেন, মুচকি হাসতেন, হাত বাড়িয়ে দিতেন। অতি সাধারণ পোশাক পরতেন। খাবার নিয়ে কখনও আপত্তি করতেন না। থালার একপাশ থেকে খাবার খেতেন। খাওয়ার পর আঙুল চেটে পরিষ্কার করতেন। মাথায় তেল দিয়ে চুল আচড়াতেন। মাটির ঘরে খেজুরের চাটাইয়ের ওপর ঘুমাতেন। সাহাবিদের নিয়ে বসতেন, সুখ-দুঃখের গল্প করতেন, ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতেন। প্রয়োজন হলে বাজারে যেতেন। আযানের শব্দ শুনলে দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে যেতেন। প্রচুর রোজা রাখতেন। নিজের ভাগের কাজ নিজেই করতেন। উটের পিঠে বসা অবস্থায় হাতের ছড়ি মাটিতে পড়ে গেলেও কাউকে তুলে দিতে বলতেন না। উট বসিয়ে নিজেই ছড়িটি তুলে আনতেন। কাউকে ধমকাতেন না। রাগ করলে আবার দ্রুত খুশি হয়ে যেতেন। সবাই যখন হাটত, তিনিও হাটতেন। সবাই বসলে তিনিও বসতেন। কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে উপস্থিত হতেন। বাচ্চারা এসে খেলাচ্ছলে তাঁর হাত ধরত। তিনি কখনও নিজে থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতেন না। ভিখারিকে খালি হাতে বিদায় দিতেন না। সামান্য হাদিয়া পেলে গরিব সাহাবিদের সাথে ভাগ করে খেয়ে নিতেন। কোনো দ্বিচারিতা ছিলনা, কোনো ভান ছিলনা, কোনো লুকোছাপা ছিলনা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আর. বি. স্মিথ (১৭৯৪-১৮৮৪) যথার্থ বলেছেনঃ "তিনি (মুহাম্মদ ﷺ) ছিলেন একইসাথে ধর্মগুরু এবং সম্রাট। তবে তাঁর মধ্যে ধর্মগুরুদের মতো ভণ্ডামি ছিলনা। সম্রাটের মতো বিশাল সেনাবাহিনী ছিলনা। না ছিল কোনো বডিগার্ড, না প্রাসাদ, না বেতন। যদি পৃথিবীর একজন মানুষ এই দাবী করার যোগ্য হন যে, তিনি খোদায়ী শক্তিতে দুনিয়া শাসন করেছেন, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ।" [Mohammed and Mohammedanism, London, 1874, p. 235]

মাত্র ছয় বছর বয়সে আমাদের নবী ﷺ মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পরে যখন মায়ের কবর যিয়ারতে গেছেন, তখন কবরের পাশে বসে শিশুর মতো কেঁদেছেন। বহু বছর পর যখন দুধ মা হালিমা সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, আমার নবী নিজের পরনের চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন হালিমার জন্য। যে উম্মে আইমান তাঁকে ছোটকালে দেখাশুনা করেছেন, আমার নবী কখনও তাঁকে চোখের আড়াল করেননি। যে নারী তাঁকে মায়ের স্নেহে লালনপালন করেছেন, সেই চাচী (আবু তালিবের স্ত্রী) ফাতিমা বিনতে আসাদকে কবরে রাখার পূর্বে আমার নবী নিজে ওই কবরে শুয়েছেন। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাকে জীবনভর ভালবেসে গেছেন। বলেছেনঃ "তাঁর ভালোবাসা আমাকে রিযিক হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়েছে" [সহীহ মুসলিম]। আমেরিকান ইতিহাসবিদ ওয়াশিংটন আর্ভিং লিখেছেনঃ "যখন তিনি (মুহাম্মদ ﷺ) তাঁর শিশুপুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুশয্যায় এসে দাঁড়িয়েছেন, তখন আল্লাহর মর্জির ওপর নিজেকে সপে দেয়ার মনোভাব তাঁর আচরণে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চরম দুঃখের সময় তাঁর এটুকু সান্তনা ছিল যে, অচিরেই তিনি পুত্রের সাথে জান্নাতে মিলিত হবেন। যখন ইবরাহিমকে কবরে রাখা হচ্ছিল, তখন তিনি পুত্রের জন্য দুআ করেছেন। যেন তাঁর পুত্র কবরের কঠিন পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়, আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর রিসালাতের ওপর দৃঢ়ভাবে টিকে থাকে।" [Life of Mahomet, London, 1889, pp. 192-3, 199]

আমাদের নবী ﷺ মানবতার ভেতর মহানুভবতার খোজ করেছেন। হাতের ছোয়ায় তিনি সাধারণকে অসাধারণে পরিণত করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী।

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মহান আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও সাফল্যের পেছনে বড় একটি কারণ ছিল 'নিজেকে জয় করা'। যতবার ধাক্কা এসেছে; ততবার আমার নবী নিজেকে সামলে নিয়েছেন। যতবার আঘাত করা হয়েছে; ততবার তিনি দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে এসেছেন। ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আনফান্সো দ্য লেমার্টিন বলে দিয়েছেনঃ "মহান আদর্শ, সামান্য সরঞ্জাম এবং দীপ্তিমান সাফল্য- যদি এই তিনটি বিষয় দ্বারা মানুষের যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়; তাহলে কার সাহস আছে মুহাম্মদের সাথে অন্য কাউকে তুলনা করার?" [Histoire De La Turquie, Paris, 1854, vol. II, pp. 276-277]

মক্কায় যখন সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলছিল, তখন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ "এক দিন আসবে, যখন তোমরা রোম-পারস্যে ইসলামের পতাকা উড়াবে।" মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে মুসলমানরা রোম-পারস্য বিজয় করে নিয়েছেন।

তায়েফের মাটিতে পাথরের আঘাতে জর্জরিত অবস্থায় আমার নবী হাত তুলেছিলেনঃ "আল্লাহ, তুমি আমাকে কার হাতে ছেড়ে দিয়েছ? এই শত্রুরা কি আমার ভাগ্য নির্ধারণ করবে?" পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছেনঃ "আল্লাহ, যদি তুমি নারাজ না হও, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।" [ইবনে হিশাম]

উহুদ যুদ্ধে প্রিয় চাচা হামযা রা.'র কাটাছেড়া দেহ দেখে বলেছেনঃ "আমি যখন বিজয়ী হব, তখন এক হামযার বিপরীতে তাদের ত্রিশটি লাশ এভাবে বিকৃত করব।" পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেনঃ "মৃতদেহ বিকৃত করা (Mutilation) ইসলামি শরিয়তে চিরতরে নিষিদ্ধ।"

৬ষ্ঠ হিজরিতে মক্কাবাসী মুশরিকদের কাছে নিজেকে প্রায় দমিয়ে রেখে হুদায়বিয়ার সন্ধি করেছিলেন আমাদের নবী ﷺ। সাহাবিরা বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। মক্কাবাসী ওই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার পর তাদের নেতা আবু সুফিয়ান একা একা মদীনার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, যেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বুঝিয়ে-শুনিয়ে চুক্তিটি পুনরায় বহাল করা যায়। এক বছর আগে যারা লাগামহীন শর্ত জুড়ে দিচ্ছিল; এক বছর পর তারাই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে এসেছে। ব্রিটিশ ধর্মতত্ত্ববিদ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি (১৯১৭) অ্যানি বেসেন্ট লিখেছেনঃ "যতবার আমি (রাসূলের জীবন) অধ্যয়ন করি, ততবার আরবের সেই মহান শিক্ষকের প্রতি আমার মনে এক নতুন শ্রদ্ধাবোধ, নতুন ভক্তি অনুভূত হয়।" [The Life And Teachings Of Muhammad, Madras, 1932, p. 4]

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবনের সবচেয়ে বড় বিজয়টি এসেছিল সম্ভবত ৮ম হিজরিতে। না, আমি মক্কা বিজয়ের কথা বলছিনা। মক্কা তো আল্লাহর নবী ﷺ বিজয় করতেন-ই। ওটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল। আমি বলছি, বিজয়ের যে উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন, তার কথা। আল্লাহর নির্দেশ ছিলঃ

إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا

"যখন আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় সমাগত হবে, তুমি দেখবে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দীনের মধ্যে প্রবেশ করছে। অতঃএব তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ" [সুরা নাসর : ১-৩]।

পার্থিব জীবনের সবচেয়ে বড় বিজয়ের প্রাক্কালে আমার নবীর চোখে অহংকারের চাহনি ছিলনা, বল প্রদর্শনের কোনো চেষ্টা ছিলনা। আল্লাহর তরে মাথা নিচু করে ১০ হাজার সাহাবা নিয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছেন। পরনে ওই সাদাসিধে পোশাক, মাথায় কালো পাগড়ি। কণ্ঠে আল্লাহর হামদ-ছানা-তাসবীহ। তিনি মক্কায় ধ্বংসলীলা চালাতে নিষেধ করেছেন। নিজ হাতে কা'বা শরীফ পরিষ্কার করেছেন। আল্লাহর বান্দা হয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেছেন। জাহেলি যুগে যাকে কেউ মানুষের মর্যাদা দেয়নি; আমার নবী সেই বিলালকে কা'বা শরীফের ওপরে উঠিয়ে দিয়েছেন। বলেছেনঃ "বিলাল, আযান দাও।" বিলাল তাঁর কন্ঠের সবটুকু জোর একত্রিত করে বলেছেনঃ "আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার"।

শাস্তির আশঙ্কা বুকে নিয়ে অপরাধী মক্কাবাসী মাথা নিচু করে সামনে দাঁড়িয়েছে। আমার নবী ﷺ শান্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ "আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো প্রতিশোধ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত।" ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্টেনলি লেন-পুল তাঁর Introduction to Higgins, Apology for Muhammad বইয়ে লিখেছেনঃ "সেদিন মক্কার রাস্তায় কোনো রক্ত ছিলনা কেন? লাশের ঢের পড়ে থাকতে দেখা যায়নি কেন? সত্যটি বিশ্বাস করা বড় কঠিন। এবং সেই সত্য হলো, সেদিন মুহাম্মদ কেবল তাঁর শত্রুদের ওপর বিজয় লাভ করেননি; বরং বিজয়ের সেই দিনে তিনি তাঁর নিজেকে জয় করে নিয়েছিলেন। অত্যাচারী কুরাইশদেরকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেদিন একটি ঘর লুটপাট করা হয়নি, একজন নারীকেও অপমান করা হয়নি।"

ইতিপূর্বে বা এরপরে, এরকম বিজয় মানবজাতি আর একটিও দেখেনি।

ভণ্ডনবী মুসায়লামা আমাদের নবী ﷺ-কে প্রস্তাব দিয়েছিল, "চল নবুয়ত ভাগাভাগি করে ফেলি। তুমি অর্ধেক, আমি অর্ধেক।" স্বাভাবিকভাবেই, রাসূলুল্লাহ ﷺ তার প্রস্তাবে কান দেননি। তাই সে 'ব্যথিত' হয়ে লিখেছিলঃ

لنا نصف الأرض ولقريش نصفها ولكن قريش قوم يعتدون

"(কথা ছিল) অর্ধেক পৃথিবী আমাদের, অর্ধেক কুরাইশদের। কিন্তু কুরাইশ সীমালঙ্ঘন করেছে।" [বাকিল্লানী : ই'জাযুল কুরআন, তারিখ তাবারি]

কুরাইশ দ্বারা মুসায়লামা রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবিদের উদ্দেশ্য করেছিল। প্রশ্ন আসে, এই হাস্যকর প্রস্তাব মুসায়লামা কেন দিয়েছিল? জবাব হচ্ছে, সে মনে করেছিল নবুয়ত হচ্ছে দ্রুত উন্নতির সিড়ি। মুহাম্মদ ﷺ নবী হওয়ার কারণে কোথা থেকে কোথায় চলে গেছেন! সে কেন পারবেনা! নবুয়তের আসল অর্থ মুসায়লামা বুঝতেই পারেনি।

যুগে যুগে এরকম হাজারও মুসায়লামা রঙ পাল্টে ধরা দিয়েছিল। কেউ 'উন্নতির আশা' নিয়ে নিজেকে নবী দাবী করেছিল। বাকিরা নবীর মর্যাদাকে টেনে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল। মধ্যযুগে খ্রিস্টান মিশনারি এবং ইহুদি প্রোপাগান্ডিস্টদের দ্বারা এ ধরণের 'হিংসাত্মক মূর্খতা' ইউরোপ-আমেরিকায় ঘাটি গেড়েছিল। পরবর্তীতে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে এগুলো বাকি দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হিংসে হবেনাই বা কেন? একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা একটি আন্দোলন এক জীবনকালের মধ্যে (Within one lifespan) সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ। তাঁর হাতে তাওহীদের নিশান উড়েছে পুরো জাযিরাতুল আরবে। এর ২৫ বছরের মধ্যে ইসলাম পৌঁছে গেছে অর্ধ পৃথিবীতে। এমন চোখ ধাঁধানো সাফল্য এবং মানবজাতির ওপর এক ব্যক্তির এরকম প্রভাব যে কাউকে হিংসায় ভুগাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দুনিয়া কেবল আমার নবীর সাফল্য দেখেছে; চোখের পানি দেখেনি। প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখেছে; ঘাম ঝরানো দেখেনি। প্রাপ্তি দেখেছে; হারানো দেখেনি। বিজয় দেখেছে; পেছনের ত্যাগ দেখেনি।

তবে সত্য বেশিদিন চাপা থাকেনি। ইউরোপে থমাস কার্লাইল এবং আমেরিকায় ওয়াশিংটন আর্ভিং- এ দুই দার্শনিক প্রথমবার নির্মোহভাবে আমাদের নবী ﷺ-কে মূল্যায়ন করা শুরু করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে থমাস কার্লাইল ইংরেজি ভাষার সব গুণবাচক বিশেষণ ব্যবহার করে ফেলেছেন আমাদের নবী ﷺ-এর জন্য। কার্লাইল ও আর্ভিং থেকে শুরু করে আজকের যুগের কেরন আর্মস্ট্রং পর্যন্ত- সবার কলমে ঝরে পড়ে মানবতার মহান শিক্ষক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্য প্রশংসাস্তুতি। যে ভারতের মাটিতে সালমান রুশদীর মতো মিথ্যুকের জন্ম হয়েছিল, সেই ভারতের স্বাধীনতার সেনানী মোহনদাস করমচাঁদ (মহাত্মা) গান্ধী এবং সরোজিনী নাইডু আমাদের নবী ﷺ-কে মূল্যায়ন করতে ভুল করেননি। যেখানে রোগ, সেখানেই রোগের চিকিৎসা।

এই পুরো লেখনিতে আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মু'জিযা-কারামাত নিয়ে একটি কথাও বলিনি। কেবল তাঁর মানবিক যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছি। তাও নিরেট ইতিহাস এবং ভিন্নমতাবলম্বী পণ্ডিতদের দৃষ্টি থেকে। তাই লেখনি সমাপ্ত করছি মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক কে. এস. রামাকৃষ্ণ রাও (মার্চ, ১৯৭৮) এর উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেনঃ "কি এক মনোমোহকর জীবন ছিল তাঁর! মুহাম্মদ ছিলেন একইসাথে আল্লাহর নবী, বিজয়ী সেনাপতি, সম্রাট, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বক্তা, সমাজ সংস্কারক, এতিমের আশ্রয়স্থল, দাস-দাসীর রক্ষাকারী, বিধবার মাথা গোঁজার ঠাই, আইন প্রণেতা, বিচারক এবং দুনিয়াবিমুখ দরবেশ। এবং এই সব মহৎ মানবিক যোগ্যতা বিবেচনায়... মুহাম্মদ ছিলেন একজন মহানায়ক।"

ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার জন্য আমার মা-বাবা কুরবান হোক।

সমাপ্ত