ইসলামের কন্ঠইসলামের কন্ঠ
সম্পাদকীয়আর্কাইভআমাদের পরিচিতিযোগাযোগের মাধ্যম
হাদীস শরীফ

আল-আশরাত্ব : হাদিসে বর্ণিত কিয়ামতের আলামত

ইসলামি আকীদার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। সামগ্রিকভাবে আখেরাতের সূচনা হবে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। তাই মুসলিম মাত্রই প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন আসে- কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?

হাফিজ মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী
আল-আশরাত্ব : হাদিসে বর্ণিত কিয়ামতের আলামত

ইসলামি আকীদার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। সামগ্রিকভাবে আখেরাতের সূচনা হবে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। তাই মুসলিম মাত্রই প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন আসে- কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? বিশেষত, বিশ্বজুড়ে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে এ প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা পবিত্র কুরআনে উক্ত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন এভাবেঃ

إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ

নিশ্চয়ই কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছে রয়েছে।[সুরা লুকমান : ৩৪]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বিষয়টিকে আরও বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন। বলছেনঃ

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي لاَ يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلاَّ هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ لاَ تَأْتِيكُمْ إِلاَّ بَغْتَةً يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ اللّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ

"তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? বলে দিন, এর খবর আমার প্রতিপালকের কাছেই রয়েছে। তিনি নির্ধারিত সময়ে তা অনাবৃত করে দেখাবেন। আসমান ও যমিনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয়। যখন তা তোমাদের ওপর আসবে, অজান্তেই এসে পড়বে। তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি এর অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা উপলব্ধি করে না।" [সুরা আরাফ : ১৮৭]

হাদিসে জিবরীলের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং জিবরাইল আলাইহিস সালামের একটি কথোপকথন পাওয়া যায়। কথোপকথনটি এরূপঃ

قَالَ مَتَى السَّاعَةُ قَالَ ‏مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِل

"জিবরাইল জিজ্ঞেস করেছেন, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? রাসূল ﷺ জবাব দিয়েছেন, এ ব্যাপারে প্রশ্নকর্তার চেয়ে, যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি অধিক জ্ঞাত নন।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

আরেকটি হাদিসে এরচেয়ে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায়। জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

تَسْأَلُونِي عَنِ السَّاعَةِ وَإِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَأُقْسِمُ بِاللَّهِ مَا عَلَى الأَرْضِ مِنْ نَفْسٍ مَنْفُوسَةٍ تَأْتِي عَلَيْهَا مِائَةُ سَنَةٍ

"তোমরা আমাকে প্রশ্ন করো, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে। এর জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই রয়েছে। তথাপি আমি কসম করে বলছি, (সাহাবিদের মধ্যে) বর্তমানে যারা পৃথিবীতে জীবিত আছে, তারা একশ বছর পর জীবিত থাকবে না। [সহীহ মুসলিম ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]

তাহলে বুঝা গেল, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়টি আল্লাহর ইলমের মধ্যে নিহিত। সৃষ্টিকুলকে সে ইলম দেয়া হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর হিকমতের অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ কিয়ামতের কিছু আলামত বা চিহ্ন (Signs of Resurrection) উম্মতকে জানিয়ে গেছেন। হাদিসের পরিভাষায় এসব আলামতকে أشراط الساعة বলা হয়। কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত এসব হাদিসের মধ্যে সহীহ, হাসান, দ্বয়িফ সব শ্রেণীর হাদিস-ই বিদ্যমান। আবার কিছু বানোয়াট কথাবার্তাও রয়েছে, যেগুলোকে হাদিস বলে চালিয়ে দেয়া হয়। উক্ত নিবন্ধে আমরা গ্রহণযোগ্য হাদিসসমূহের আলোকে কিয়ামতের কতিপয় আলামত আলোচনা করব, বি-ইযনিল্লাহ।

এর পূর্বে ৩টি সতর্কীকরণ উল্লেখ করা আবশ্যক।

১. কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত বেশিরভাগ হাদিস আপাতদৃষ্টে খুবই রহস্যময় এবং দুর্বোধ্য। এগুলোর সঠিক ও নিশ্চিত ব্যাখ্যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালো জানেন। কিয়ামতের অনেক আলামত রয়েছে যেগুলো মানবিক যুক্তি-বুদ্ধির উর্দ্ধে। সেগুলো কখন এবং কিভাবে সংঘটিত হবে, তা আমরা জানি না। সুতরাং ইলমে গায়েবের প্রতি আমরা যেভাবে বিশ্বাস রাখি, এ ব্যাপারেও সেভাবে বিশ্বাস রাখা কর্তব্য।

২. কিয়ামতের আলামতসমূহ আল্লাহর ইচ্ছায়-ই সংঘটিত হবে। তাই হাদিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজের মনের মতো করে একটি গল্প বানিয়ে ফেলা নেহায়েত বোকামি হবে। কিংবা কোনো তথ্যকে নিজের ইচ্ছামতো কোনো ঘটনার সাথে জুড়ে দিয়ে সেটিকে কিয়ামতের আলামত বানিয়ে ফেলা অনুচিত হবে। বরং যখন যা হওয়ার এমনিতেই হবে।

৩. সাহস করেই বলছি যে, কিয়ামতের আলামত (বিশেষত বড় আলামত) সংক্রান্ত হাদিসসমূহের ব্যাখ্যায় অনেক উঁচুমানের আলিম-উলামা দু'এক জায়গায় ভুল করেছেন। তাঁরা তাঁদের সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ভূগোল, পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে বিশেষ কোনো আলামতকে সেই সময়ে ঘটমান বিশেষ কোনো ঘটনা, ব্যক্তি বা স্থানের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। পরবর্তীতে দেখা গেছে সেটি সত্য নয়। তাই এ নিবন্ধে আমরা মূলত হাদিস এবং চলমান বাস্তবতার নিরিখে বিষয়গুলো বুঝার চেষ্টা করব। ভুল অবশ্যই হবে, কারণ নবী-রাসূল ব্যতীত আর কেউ-ই ভুলের উর্দ্ধে নয়।

কিয়ামতের আলামতসমূহ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা-

  • ★ গৌণ বা ছোট আলামত (أشراط الساعة الصغری)
  • ★ মূখ্য বা বড় আলামত (أشراط الساعة الکبری)

ছোট আলামতের সংখ্যা অগণিত। বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের আলামত বর্ণিত হয়েছে। প্রক্ষান্তরে বড় আলামত মাত্র ১০টি। যেগুলো এক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ছোট আলামতের মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট ঘটনা হলেও বেশিরভাগ-ই একক কোনো ঘটনা নয়। বরং চলমান ঘটনাপ্রবাহ এবং বিভিন্ন ধরণের প্রবণতা। প্রক্ষান্তরে বড় ১০টি আলামত ১০টি নির্দিষ্ট ঘটনা, যা একের পর এক সংঘটিত হবে।

আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি যে, কিয়ামতের সব আলামত 'খারাপ' নয়। কিছু খারাপ, কিছু সাধারণ। এমনকি অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘটনা রয়েছে, যেগুলো কিয়ামতের আলামত বলে স্বীকৃত।

সংঘটিত হওয়ার দিক থেকে প্রথমে ছোট আলামত প্রকাশ পাবে। এরপর বড় আলামত। বড় আলামতসমূহ শেষ হওয়ামাত্র কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। তাই আমরা প্রথমে ছোট আলামত এবং পরে বড় আলামত নিয়ে কথা বলব।

কিয়ামতের গৌণ বা ছোট আলামতের সংখ্যা অগণিত। আমরা বাছাইপূর্বক কয়েকটি উল্লেখ করব, যাতে মূল প্রসঙ্গ অনুধাবন করা যায়।

কিয়ামতের গৌণ বা ছোট আলামতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • ১. যে সব আলামত ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়ে গেছে।
  • ২. যে সব আলামত ঘটমান। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা নয়; বরং চলমান প্রবণতা।
  • ৩. যে সব আলামত এখনও সংঘটিত হয়নি।

★ যে সব আলামত সংঘটিত হয়ে গেছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো-

১. রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম এবং ইন্তেকাল। এটি কিয়ামতের প্রথম আলামত। আনাস ইবনে মালিক এবং আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুল একত্রিত করে বলেছেনঃ

بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَاتَيْن

"আমি এবং কিয়ামত এইভাবে অবতীর্ণ হয়েছি।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ "আমি কিয়ামতকে সামান্য পেছনে ফেলে দিয়েছি।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

২. চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ

اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ

"কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে।" [সুরা কামার : ১]

মক্কার কাফিরদের চ্যালেঞ্জের জবাবে রাসূল ﷺ হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। [তাফসির তাবারী এবং ইবনে কাসির]

৩. বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় হওয়া। আউফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

اعْدُدْ سِتًّا بَيْنَ يَدَىِ السَّاعَةِ مَوْتِي ثُمَّ فَتْحُ بَيْتِ الْمَقْدِسِ

"কিয়ামতের পূর্বে ছয়টি বিষয় গণনা করো। প্রথমটি আমার ইন্তেকাল। দ্বিতীয়টি বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়। [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল জিযিয়া]

১৬ হিজরিতে মুসলমানরা বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় করেছিলেন।

৪. মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে অগণিত মুসলমানের মৃত্যুবরণ। পূর্বোক্ত হাদিসের একটি অংশ হচ্ছেঃ

ثُمَّ مُوتَانٌ يَأْخُذُ فِيكُمْ كَقُعَاصِ الْغَنَمِ

"অতঃপর একটি মৃত্যু (মহামারী) তোমাদেরকে আক্রান্ত করবে, যেভাবে মেষপালকে আক্রান্ত করে।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল জিযিয়া]

১৮ হিজরিতে 'আমওয়াস' মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২৫ হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন।

৫. সাহাবিদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَقْتَتِلَ فِئَتَانِ دَعْوَاهُمَا وَاحِدَةٌ

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দুটি (মুসলিম) দলের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হবে। যাদের আহ্বান হবে এক।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

৩৬ এবং ৩৭ হিজরিতে যথাক্রমে জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দুটি যুদ্ধেই উভয় পক্ষে সাহাবায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন।

৬. সাহাবিদের ইন্তেকাল। আবু বুরদা রা. তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

أَنَا أَمَنَةٌ لأَصْحَابِي فَإِذَا ذَهَبْتُ أَتَى أَصْحَابِي مَا يُوعَدُونَ وَأَصْحَابِي أَمَنَةٌ لأُمَّتِي فَإِذَا ذَهَبَ أَصْحَابِي أَتَى أُمَّتِي مَا يُوعَدُونَ

"আমি আমার সাহাবিদের দায়িত্বশীল (নিরাপত্তার নিশ্চয়তা)। যখন আমি চলে যাব, আমার সাহাবিদের ওপর সে সব (ফিতনা) আসবে, যার ওয়াদা দেয়া হয়েছে। একইভাবে আমার সাহাবিরা আমার উম্মতের দায়িত্বশীল। যখন আমার সাহাবিরা চলে যাবে, তখন আমার উম্মতের ওপর সে সব (ফিতনা) আসবে, যার ওয়াদা দেয়া হয়েছে। [সহীহ মুসলিম ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]

রাসূল ﷺ এর ইন্তেকালের একশ বছরের মধ্যে (১১০-১১১ হিজরি পর্যন্ত) সব সাহাবি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

৭. দাসীর (উম্মুল ওয়ালাদ) গর্ভ থেকে স্বাধীন সন্তান জন্মগ্রহণ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ

سَأُحَدِّثُكَ عَنْ أَشْرَاطِهَا إِذَا وَلَدَتِ الأَمَةُ رَبَّهَا فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا

"আমি তোমাকে কিয়ামতের কিছু আলামত বলব। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

তাবেয়ীদের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এরকম ঘটনা অহরহ ঘটেছে। ইতিহাসবিদ ইবনে আবি লায়লা বলেছেন, তাবেয়ীদের যুগে বেশিরভাগ বড় বড় আলিম-ফকীহগণ মাওয়ালি (মুক্ত দাস, হালীফ অথবা উম্মুল ওয়ালাদের সন্তান) ছিলেন। বিশ্ববিজয়ী মুসলিম সেনাপতিগণ এবং বিভিন্ন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনেকেই মাওয়ালি ছিলেন। জাহেলিয়াতে যাঁদেরকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়নি, তাঁদের বংশধরদের হাতে আল্লাহ ইসলামের বিজয়কেতন উড়িয়েছেন।

৮. এক সময়ের দরিদ্র, নগ্নপদ, পশুপালকরা নেতৃত্বে আসবে এবং আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। পূর্বোক্ত হাদিসের একটি অংশ হচ্ছেঃ

وَإِذَا كَانَتِ الْعُرَاةُ الْحُفَاةُ رُءُوسَ النَّاسِ فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا وَإِذَا تَطَاوَلَ رِعَاءُ الْبَهْمِ فِي الْبُنْيَانِ فَذَاكَ مِنْ أَشْرَاطِهَا

"(এক সময়ের) বস্ত্রহীন, খালি পায়ের লোকেরা যখন মানুষের নেতা হবে এবং পশুপালকরা আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে, সেটি হবে কিয়ামতের আলামত।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

মধ্যপ্রাচ্যে তেলের খনি আবিষ্কার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আরবের রাজপরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা কিরূপ ছিল তা কারও অজানা নয়। অপরদিকে আজ তারা অর্থের বড়ত্ব প্রদর্শনের জন্য আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, তাও আমাদের চোখের সামনে। অথচ রাসূল ﷺ যখন এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তখন আরবরা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের অন্যতম।

৯. আরবরা অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَكْثُرَ الْمَالُ وَيَفِيضَ حَتَّى يَخْرُجَ الرَّجُلُ بِزَكَاةِ مَالِهِ فَلاَ يَجِدُ أَحَدًا يَقْبَلُهَا مِنْهُ وَحَتَّى تَعُودَ أَرْضُ الْعَرَبِ مُرُوجًا وَأَنْهَارًا

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ধনসম্পত্তি এতো অঢেল হবে যে, এক ব্যক্তি যাকাত নিয়ে বের হবে কিন্তু যাকাত দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাবে না। এবং আরবের যমিন নদীবাহিত তৃণভূমি হয়ে যাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুয যাকাত]

বর্তমানে আরবদের সীমাহীন ধনাঢ্যতা এবং কৃত্রিম পানি সঞ্চালন ব্যবস্থার কথা কারও অজানা নয়।

১০. তুর্ক বা ককেশীয়দের হাতে মুসলমানরা আক্রান্ত হবে। আবু হুয়ায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تُقَاتِلُوا التُّرْكَ صِغَارَ الأَعْيُنِ حُمْرَ الْوُجُوهِ ذُلْفَ الأُنُوفِ كَأَنَّ وُجُوهَهُمُ الْمَجَانُّ الْمُطَرَّقَةُ

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না তোমরা তুর্কদের সাথে লড়াই করবে। যাদের চোখ হবে ছোট, মুখমণ্ডল লালটে, নাক হবে বোঁচা। তাদের চেহারা দেখে মনে হবে চামড়া লেপিত ঢালের মতো।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার]

উলামায়ে কেরামের ঐক্যমত হচ্ছে, এখানে তুর্ক দ্বারা তাতার তথা মোঙ্গল বাহিনী উদ্দেশ্য। হাদিসে উল্লেখিত প্রতিটি ইঙ্গিত ওদের সাথে মিলে যায়। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের নেতৃত্বে বর্বর রক্তপিপাসু মোঙ্গল বাহিনী ১২৫৮ সালে বাগদাদে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। ইতোপূর্বে এবং এর পরেও এরা মুসলিম বিশ্বে বারবার হামলা করেছে।

এগুলো কিয়ামতের গৌণ বা ছোট আলামতের অন্তর্ভুক্ত।

কিয়ামতের গৌণ বা ছোট আলামতের মধ্যে বেশিরভাগ-ই নির্দিষ্ট ঘটনা নয়। বরং ঘটনাপ্রবাহ বা চলমান প্রবণতা। হাদিস থেকে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলামত নিম্নরূপ-

> লাগাতার ফিতনা ছড়াবে। আরবের একটি ঘরও ফিতনা থেকে রেহাই পাবে না।

> ধনসম্পদ এবং পার্থিব সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে, বাজারের সংখ্যা (আধুনিক অর্থে শপিংমল) বাড়বে, মানুষ স্থূলকায় মেদবহুল (Obese) হয়ে পড়বে।

> আরবের যমিন নদীবাহিত তৃণভূমি হয়ে যাবে।

> বিশ্বস্ততা এবং আমানতদারী বিদায় নেবে, মিথ্যা বলাকে শিল্প মনে করা হবে, মিথ্যা সাক্ষী দেয়ার প্রবণতা বাড়বে।

> মানুষের অন্তর কৃপণতায় পরিপূর্ণ হবে। যাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে।

> অত্যাচারী এবং দুর্নীতিবাজ লোকেরা শাসক হবে। তারা গনিমত তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করাকে হালাল মনে করবে।

> খুন-রাহাজানি এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে, হত্যাকারী জানবে না, সে কেন হত্যা করছে। নিহত ব্যক্তিও জানবে না, সে কেন নিহত হচ্ছে।

> বজ্রপাত, ভূমিকম্প এবং ভূমিধ্বসের সংখ্যা বাড়বে।

> ব্যভিচার এবং অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, লোকেরা এগুলোকে স্বাভাবিক আচরণ মনে করবে। মাদকদ্রব্য, নর্তকী এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।

> পুরুষের সংখ্যা কমবে, নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। পুরুষ নারীর অনুগত হবে। মানুষ বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে দেবে।

> লেখনি বৃদ্ধি পাবে, অপরদিকে দুনিয়াব্যাপী মূর্খতা ছেয়ে যাবে। সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার বিবেক থাকবে না।

> মসজিদ সুসজ্জিত হবে, কিন্তু নামাজের জন্য মুসল্লি থাকবে না। মসজিদে চিৎকার চেঁচামেচি করা হবে।

> উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তীদেরকে অভিশাপ দেবে। মন্দ লোকের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাকে সম্মান করা হবে।

> যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে, সময় দ্রুত এগিয়ে যাবে।

> অন্তত ৩০ জন মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার ভণ্ডনবী প্রকাশ পাবে। এদের মধ্যে কতজন প্রকাশ পেয়েছে এবং কতজন বাকি আছে, সেটি আল্লাহ ভালো জানেন।

> ইসলামে তুর্কদের হাতে আরবদের প্রভাব খর্ব হবে।

Note : ১২৫৮ সালে আব্বাসি খেলাফতের পতনের পর আরবদের হাত থেকে মুসলমানদের নেতৃত্ব চলে যায়। এরপর মামলুক, সেলজুক, অটোমান এবং মোঘলরা বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানদের নেতৃত্বে এসেছিলেন। এরা সবাই ছিলেন তুর্ক, অর্থাৎ ককেশীয় বংশোদ্ভূত। দীর্ঘ সাড়ে ছয় শতাব্দী বিভিন্ন এলাকায় এদের হাতে মুসলমানদের নেতৃত্ব ছিল।

> রোমানরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা বলে গণ্য হবে।

Note : হাদিসে উল্লেখিত 'রোমান' দ্বারা বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে (Western Civilization) ধরে নেয়া যেতে পারে। কারণ বর্তমান বৃহত্তর পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেদেরকে তৎকালীন রোমান সম্রাজ্য (Roman Empire) ও সভ্যতার উত্তরাধিকারী মনে করে।

[আলামতসমূহের সূত্রঃ সিহাহ সিত্তাহ, মুসনাদ ইমাম আহমদ, মুসতাদরাক ইমাম হাকিম ও তাবরানী]

প্রসঙ্গত, উপরিউক্ত আলামতসমূহের মধ্যে বেশিরভাগ-ই আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। অন্তত একটি পর্যায় পর্যন্ত সবগুলো আলামত প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আল্লাহুল মুসতা'আন!

গৌণ বা ছোট আলামতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনা হলো-

১. হিজাযে বড় একটি অগ্ন্যুৎপাত হবে।

Note : ১২৫৬ সালে মদীনার দক্ষিণপূর্ব দিকে অবস্থিত একটি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে বিশাল অগ্নুৎপাত সৃষ্টি হয় এবং (আধুনিক গবেষণামতে) প্রায় ২৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উত্তপ্ত লাভা ছড়িয়ে পড়ে। অন্তত তিন মাস পুরো হিজায এলাকা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। উলামায়ে কেরাম ওই অগ্নুৎপাতকে হাদিসে বর্ণিত অগ্নুৎপাত বলে ধরে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সেই অগ্নুৎপাত-ই উদ্দেশ্য, নাকি ভবিষ্যতে এরচেয়ে বড় কিছু হবে তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।

২য় ঘটনা হলো কিয়ামতের পূর্বে কনস্টান্টিনোপল বিজয় হওয়া। এ ব্যাপারে প্রাপ্ত হাদিসগুলো আপাতদৃষ্টে রহস্যময় এবং অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। পরবর্তী পর্বে আমরা বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।

কিয়ামতের গৌণ বা ছোট আলামতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, কনস্টান্টিনোপল বিজয় হওয়া।

আমরা জানি, ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান ২য় মুহাম্মদ (মেহমেত আল-ফাতিহ) কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেছিলেন। কিন্তু হাদিসে এ বিজয়ের কথা বলা হয়নি। বরং অন্য একটি বিজয়কে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা শেষ যুগে সংঘটিত হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

سَمِعْتُمْ بِمَدِينَةٍ جَانِبٌ مِنْهَا فِي الْبَرِّ وَجَانِبٌ مِنْهَا فِي الْبَحْرِ قَالُوا نَعَمْ يَا رَسُولَ اللَّه قَالَ ‏لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَغْزُوَهَا سَبْعُونَ أَلْفًا مِنْ بَنِي إِسْحَاقَ فَإِذَا جَاءُوهَا نَزَلُوا فَلَمْ يُقَاتِلُوا بِسِلاَحٍ وَلَمْ يَرْمُوا بِسَهْمٍ قَالُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ فَيَسْقُطُ أَحَدُ جَانِبَيْهَا قَالَ ثَوْرٌ لاَ أَعْلَمُهُ إِلاَّ قَالَ الَّذِي فِي الْبَحْرِ ثُمَّ يَقُولُوا الثَّانِيَةَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ فَيَسْقُطُ جَانِبُهَا الآخَرُ ثُمَّ يَقُولُوا الثَّالِثَةَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ فَيُفَرَّجُ لَهُمْ فَيَدْخُلُوهَا فَيَغْنَمُوا فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْمَغَانِمَ إِذْ جَاءَهُمُ الصَّرِيخُ فَقَالَ إِنَّ الدَّجَّالَ قَدْ خَرَج‏ فَيَتْرُكُونَ كُلَّ شَىْءٍ وَيَرْجِعُونَ

"তোমরা একটি শহরের কথা শুনে থাকবে, যার একপাশ স্থল, আরেক পাশ সাগর। সাহাবিরা বললেন, জি আমরা শুনেছি। রাসূল ﷺ বললেন, কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না সত্তুর হাজার 'বনী ইসহাক' ওই শহরে যুদ্ধ করবে। তারা তরবারি বা তীর-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করবে না। তারা বলবে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার। এতে শহরের এক দিক ভেঙ্গে পড়বে। এরপর আবার এই কালিমা পড়বে। তখন অন্যপাশ ভেঙ্গে পড়বে। তৃতীয়বার যখন এই কালিমা পড়বে, তখন শহরের দরজা (প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) খুলে যাবে এবং তারা প্রবেশ করবে। যখন তারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিতরণ করতে থাকবে, তখন একটি আওয়াজ শোনা যাবে যে, দাজ্জাল এসে গেছে। তারা সবকিছু ফেলে সেদিকে ছুটে যাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

হাদিসে উল্লেখিত শহরটি কনস্টান্টিনোপল, এতে সংশয় থাকার কথা নয়। এজন্য হাদিসটি অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। কারণ কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক) মুসলমানদের হাতেই রয়েছে। তাছাড়া সুলতান মুহাম্মদের সময় কনস্টান্টিনোপল সেভাবে বিজয় হয়নি, যেভাবে হাদিসে বলা হয়েছে (তাকবিরের মাধ্যমে)। প্রশ্ন আসে, তাহলে কি কনস্টান্টিনোপল মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাবে? এরপর কখন, কিভাবে আবার বিজয় হবে? বনী ইসহাক কারা?

উক্ত হাদিসের ক্ষেত্রে আমরা ইমাম কাযী আয়ায, ইমাম ইবনে কাসির এবং মিশরী মুহাদ্দিছ আহমেদ শাকিরের ব্যাখ্যাগুলো সমন্বয় করে, অন্যান্য হাদিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতার আলোকে একটি সম্ভাবনা দাঁড় করিয়েছি। নিশ্চয়তা দিচ্ছি না, প্রকৃত সত্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালো জানেন।

সম্ভাবনাটি এরূপ- বসফরাস প্রণালি (Bosphorus Strait) নিয়ে চলমান শতাব্দীব্যাপী বিরোধ এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে সরব উপস্থিতির কারণে তুরস্ক ইতোমধ্যে পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হয়েছে। ইরানের সাথে সখ্যতা থাকায় ইহুদিদের চোখেও তুরস্ক এখন দুষমন। এক সময় বিরোধ বাড়বে এবং পশ্চিমা শক্তি হয়তো তুরস্কের ওপর হামলা করবে। এতে তুরস্কের অবস্থা ইরাক-সিরিয়ার মতো নাকাল হয়ে যেতে পারে। অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় তুরস্কের ওপরও পশ্চিমাদের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা বিস্তৃত হবে।

কিয়ামতের পূর্বে পশ্চিমাদের মধ্যে ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। হাদিসে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "রোমানরা (পশ্চিমা শক্তি) আমাক বা দাবিক নামক স্থানে অবস্থান করবে। সংবাদ পেয়ে মদীনা থেকে মুসলিম দল সেখানে পৌঁছাবে। তখন রোমানরা বলবেঃ

خَلُّوا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الَّذِينَ سَبَوْا مِنَّا نُقَاتِلْهُمْ

"যারা আমাদেরকে ত্যাগ করেছে (ইসলাম গ্রহণ করেছে), তাদেরকে ছেড়ে দাও। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব।" মুসলমানরা এমনটি করতে অস্বীকৃতি জানাবে। তখন রোমান এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হবে।"[সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

এ হাদিসে "যারা আমাদেরকে ত্যাগ করেছে" বলে রোমানরা যাদেরকে উদ্দেশ্য করেছে, আগের হাদিসে উল্লেখিত 'বনী ইসহাক' তারাই। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক পশ্চিমা নও-মুসলিম (Converts)। আগের হাদিসে উল্লেখিত রোমান-মুসলিম যুদ্ধ জয়ের পর এই নও-মুসলিমরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। আল্লাহু আ'লাম।

উপরিউক্ত যুদ্ধদ্বয় ছাড়াও আরও কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিয়ামতের আলামতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আলামত হচ্ছে, الْهَرْجُ وَهُوَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ অর্থাৎ গণযুদ্ধ, একের পর এক হত্যা। [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

এসব যুদ্ধকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. উম্মতের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ। ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِذَا وُضِعَ السَّيْفُ فِي أُمَّتِي لَمْ يُرْفَعْ عَنْهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

"একবার যখন আমার উম্মতের মধ্যে তরবারি বের হয়ে আসবে, কিয়ামত পর্যন্ত সেটি আর কোষবদ্ধ হবে না।" [সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান, সুনান আবি দাউদ, সুনান ইবনে মাজাহ]

তৃতীয় খলিফা উসমান রাদ্বিআল্লাহু আনহু'র শাহাদাতের পর মুসলমানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যে তরবারি উন্মুক্ত করেছিলেন, সে তরবারি আজও কোষবদ্ধ হয়নি। উম্মতের পুরো ইতিহাসে ভাইয়ের হাত ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত। আল্লাহুল মুসতা'আন।

২. মুসলিম উম্মাহ'র ওপর সম্মিলিত আক্রমণ। ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يُوشِكُ الأُمَمُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الأَكَلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا

"অচিরেই অন্য জাতিগুলো তোমাদের ওপর হামলা করার জন্য একে অন্যকে আহ্বান করবে, যেভাবে থালা সাজিয়ে খাবারের জন্য আহ্বান করা হয়।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

চোখ খুলে দেখুন, এটি আমাদের আজকের বাস্তবতা। দ্বিধাবিভক্ত এ মজলুম উম্মতের ওপর খোদাদ্রোহীদের অত্যাচার বেড়েই চলছে। আল্লাহুল মুসতা'আন।

৩. কিছু যুদ্ধ হবে, যেগুলোর সময় অনুমান করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَحْسِرَ الْفُرَاتُ عَنْ جَبَلٍ مِنْ ذَهَبٍ يَقْتَتِلُ النَّاسُ عَلَيْهِ فَيُقْتَلُ مِنْ كُلِّ مِائَةٍ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফোরাত নদী (Euphrates) থেকে স্বর্ণের পাহাড় বা খনি উন্মুক্ত হবে। মানুষ এর জন্য যুদ্ধ করবে এবং প্রতি একশজনের মধ্যে নিরানব্বই জন নিহত হবে। [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

সম্ভবত, আল্লাহ এ উম্মতকে যে পার্থিব নিয়ামত (খনিজ সম্পদ) দান করেছেন, পশ্চিমা শক্তি সেগুলো আহরণ করার জন্য লিপ্সু হবে। যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, চলমান শতাব্দীর শুরু থেকে সেসব যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী কর্তৃক ইরাক আক্রমণ করার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল বলে আপনাদের মনে হয়?

৪. রোমান তথা পশ্চিমা শক্তির সাথে মুসলমানদের সন্ধি। আউফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

ثُمَّ هُدْنَةٌ تَكُونُ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ بَنِي الأَصْفَرِ فَيَغْدِرُونَ فَيَأْتُونَكُمْ تَحْتَ ثَمَانِينَ غَايَةً تَحْتَ كُلِّ غَايَةٍ اثْنَا عَشَرَ أَلْفًا

"অতঃপর তোমাদের সাথে বনী আসফারের (রোমান) একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি (Truce) হবে। এতে তারা তোমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে ৮০টি পতাকা নিয়ে যুদ্ধে আসবে, যার প্রতিটির নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল জিযিয়া]

আরেকটি হাদিসে এসেছে, রোমান এবং মুসলমানরা একত্রিত হয়ে তৃতীয় একটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। জয়লাভ করার পর রোমানরা চুক্তি ভঙ্গ করবে। [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

সেই তৃতীয় শক্তি কারা হতে পারে? ইহুদি? মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের শত্রুতা পুরোনো। খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রোটেস্টেন্টরা ইহুদিদেরকে বন্ধু মনে করলেও ক্যাথলিক এবং অর্থোডক্সরা এখনো এদেরকে শত্রু মনে করে।

বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় আরেকটি জাতির কথা মাথায় আসে, চীন। বিভিন্ন দিক থেকে পুরো বিশ্বে চীনের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আল্লাহ ভালো জানেন।

হাদিসে বলা হয়েছে, এরপর রোমানরা ৮০টি পতাকা/দল নিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা করবে, যার প্রতিটিতে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য। অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। অনেকে বলছেন, সেটি হবে NATO ফোর্সেস, কারো মতে জাতিসংঘ। সম্ভাবনাগুলো ফেলে দেয়ার মতো নয়। আল্লাহুল মুসতা'আন।

৫. একেবারে শেষ দিকে আরও এক/একাধিক যুদ্ধ হবে, যাকে হাদিসে الملحمة الكبرى বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সময়মতো আলোচনা করা হবে।

এর মধ্যে একটি পরিবর্তন হয়তো আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন। সেটি হচ্ছে, আন্তঃযুদ্ধে লিপ্ত মুসলমানরা হঠাৎ করে একত্রিত হয়ে যাবে এবং সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করবে। প্রশ্ন আসতে পারে, সেটি কখন এবং কিভাবে হবে? জবাব হচ্ছে, কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহ এক ব্যক্তির হাতে মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত করবেন। তিনি হবেন আল্লাহর খলিফা, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ আল-মাহদী আলাইহিস সালাম।

পরবর্তী পর্বে আমরা ইমাম মাহদীর ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলব, ইনশাআল্লাহ।

ইমাম মাহদীর আগমন কিয়ামতের সর্বশেষ গৌণ বা ছোট আলামত। তিনি পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় বড় আলামত প্রকাশ পাওয়া শুরু হবে।

আলোচনা শুরু করার আগে কয়েকটি কথা-

প্রথমত, পবিত্র কুরআনে ইমাম মাহদীর ব্যাপারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। তবে অন্তত ২০টির মতো হাদিস রয়েছে, যা মাহদীর আগমনকে ইঙ্গিত করে। এজন্য মাহদীর আগমনের ব্যাপারে উম্মতের ইজমা বা ঐক্যমত রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মাহদী সম্পর্কে সুন্নী এবং শিয়া মতবাদে পার্থক্য রয়েছে। আহলে সুন্নাতের মতে, ইমাম মাহদী সর্বশেষ মুজাদ্দিদ। তিনি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামি খেলাফত (الخلافة علی منهاج النبوة) প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রক্ষান্তরে, শিয়াদের কাছে মাহদী 'ইমামে গায়েব' (১২তম ইমাম), যিনি কিয়ামতের পূর্বে প্রকাশিত হবেন। এজন্য শিয়ারা তাঁকে 'মুহাম্মদ আল মুনতাযার' নামে ডাকে।

উল্লেখ্য, আমরা এখানে কেবল সুন্নী মতাদর্শ এবং সুন্নী সূত্রগুলো ব্যবহার করব।

তৃতীয়ত, ইমাম মাহদী কোনো অলৌকিক চরিত্র (Supernatural Character) নন। তিনি রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো তিনি জন্মগ্রহণ করবেন, বেড়ে উঠবেন, মৃত্যুবরণ করবেন।

মাহদী (الْمَهْدِي) শব্দের অর্থ হেদায়াতপ্রাপ্ত। এটি তাঁর নাম নয়; বরং উপাধি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لَوْ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ يَوْمٌ ‏لَطَوَّلَ اللَّهُ ذَلِكَ الْيَوْمَ حَتَّى يَبْعَثَ فِيهِ رَجُلاً مِنْ أَهْلِ بَيْتِي يُوَاطِئُ اسْمُهُ اسْمِي وَاسْمُ أَبِيهِ اسْمَ أَبِي ‏يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ ظُلْمًا وَجَوْرًا

"যদি পৃথিবীতে একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে, আল্লাহ সে দিনকে দীর্ঘায়িত করে দেবেন। যেন আমার আহলে বায়েত থেকে এক ব্যক্তিকে আবির্ভূত করেন, যার নাম হবে আমার নামে এবং বাবার নাম হবে আমার বাবার নামে। তিনি পৃথিবীকে ন্যায় নৈতিকতায় পরিপূর্ণ করে দেবেন, যেভাবে পৃথিবী অন্যায় অবিচারে পরিপূর্ণ ছিল।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

এ হাদিস থেকে আমরা কিছু বিষয় জানতে পারি।

১. মাহদীর আগমনের ব্যাপারে খোদ রাসূলুল্লাহ ﷺ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তবে হাদিসে উল্লেখিত 'একটি দিন' কথাটি আক্ষরিক নয়; বরং গুরুত্ব ও নিশ্চয়তা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

২. মাহদী রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আহলে বায়েতের সদস্য।

৩. মাহদীর নাম হবে মুহাম্মদ, বাবার নাম আবদুল্লাহ।

৪. চরম বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায়-অবিচারের মূহুর্তে মাহদীর আবির্ভাব হবে এবং তিনি পৃথিবীতে ন্যায়-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করবেন।

দুটি হাদিস থেকে মাহদীর পরিচয় স্পষ্ট হয়। উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

الْمَهْدِيُّ مِنْ عِتْرَتِي مِنْ وَلَدِ فَاطِمَةَ

"মাহদী আমার বংশধর, ফাতিমার সন্তানদের মধ্য থেকে।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

আবু ইসহাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ

قَالَ عَلِيٌّ رضى الله عنه وَنَظَرَ إِلَى ابْنِهِ الْحَسَن فَقَالَ إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ كَمَا سَمَّاهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَسَيَخْرُجُ مِنْ صُلْبِهِ رَجُلٌ يُسَمَّى بِاسْمِ نَبِيِّكُمْ

"আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু তাঁর পুত্র হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার এই ছেলে নেতা হবে, যেমনটি নবী ﷺ বলেছেন। এবং তার বংশধর থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন, যার নাম হবে তোমাদের নবীর নামে।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

বুঝা যায় যে, মাহদী সায়্যিদা ফাতিমা রাদ্বিআল্লাহু আনহা'র সন্তানদের মধ্য থেকে আসবেন। এবং তিনি হবেন হাসান ইবনে আলী রা. এর বংশধর।

হাদিস থেকে তাঁর শারীরিক গঠন কিছুটা অনুমান করা যায়। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

الْمَهْدِيُّ مِنِّي أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الأَنْفِ

"মাহদী আমার বংশ থেকে। তার কপাল হবে চওড়া, নাক লক্ষণীয় (ধারালো)।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

আরেকটি হাদিসে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান হয়। আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

الْمَهْدِيُّ مِنَّا أَهْلَ الْبَيْتِ يُصْلِحُهُ اللَّهُ فِي لَيْلَةٍ

"মাহদী আমাদের আহলে বায়েতের মধ্য থেকে। আল্লাহ তাকে এক রাতে পরিশুদ্ধ করবেন।" [সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

বুঝা যায় যে, মাহদী জীবনের শুরু থেকে তেমন কোনো লক্ষণীয় ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন না। বরং একটি রাতে এমন কিছু হবে যে, আল্লাহ তাঁকে উম্মতের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা দান করবেন।

মাহদীর আগমনের প্রেক্ষাপট হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَكُونُ اخْتِلاَفٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ وَيُبْعَثُ إِلَيْهِ بَعْثٌ مِنَ الشَّامِ فَيُخْسَفُ بِهِمْ بِالْبَيْدَاءِ بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَإِذَا رَأَى النَّاسُ ذَلِكَ أَتَاهُ أَبْدَالُ الشَّامِ وَعَصَائِبُ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ

"(আরবের) এক নেতার মৃত্যুতে (ক্ষমতা নিয়ে) দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। তখন মদীনা থেকে এক ব্যক্তি মক্কার দিকে পলায়ন করবেন। মক্কার কিছু লোক তাকে খুঁজে বের করবে এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুকন ও মাকামে ইবরাহিমের মাঝখানে তার হাতে বাই'আত দেবে। তখন সিরিয়া থেকে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হবে, যাদেরকে মক্কা-মদীনার মধ্যখানে 'বাইদা' নামক স্থানে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। যখন মানুষ এ দৃশ্য দেখবে, তখন শাম থেকে আবদালগণ এবং ইরাকের দীনদার ব্যক্তিবর্গ আসবেন এবং তার হাতে বাই'আত দেবেন।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

বি.দ্রঃ 'রুকন' দ্বারা হাজারে আসওয়াদ উদ্দেশ্য। উক্ত হাদিসের সনদ দ্বয়িফ। তবে সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যার দ্বারা এ হাদিসের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়।

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنَ الأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ

"একটি দল কা'বা শরীফ আক্রমণ করতে আসবে। যখন তারা 'বাইদা' নামক স্থানে পৌঁছাবে, তখন সবাইকে যমিনে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

আরেকটি হাদিসে প্রেক্ষাপট আরও পরিষ্কার হয়। ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلاَثَةٌ كُلُّهُمُ ابْنُ خَلِيفَةٍ ثُمَّ لاَ يَصِيرُ إِلَى وَاحِدٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَطْلُعُ الرَّايَاتُ السُّودُ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلاً لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ ‏فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيّ

"তিন ব্যক্তি তোমাদের গুপ্তধন নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে, যারা প্রত্যেকেই নেতার সন্তান। তবে কেউই সফল হবে না। অতঃপর পূর্বদিক থেকে কালো পতাকাধারী একটি বাহিনী আসবে এবং এমনভাবে যুদ্ধ করবে, যা কেউ কখনো করেনি। যখন তোমরা তাকে দেখবে, তার হাতে বাই'আত দেবে। এতে যদি তোমাকে বরফের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়, তবুও। কারণ তিনিই হবেন আল্লাহর খলিফা মাহদী।" [সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

উক্ত হাদিসের সনদও দ্বয়িফ। তবে পূর্বাপর বর্ণনা একে অপরকে সমর্থন করে।

একটি হাদিসে এর পরবর্তী ঘটনা প্রকাশ পায়। আবদুল্লাহ ইবনে হারিছ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَخْرُجُ نَاسٌ مِنَ الْمَشْرِقِ فَيُوَطِّئُونَ لِلْمَهْدِيِّ يَعْنِي سُلْطَانَهُ

"পূর্বদিক থেকে মানুষ বের হবে এবং তারা মাহদীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে।" [সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

এবার আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেক্ষাপট দাঁড় করাতে পারি। কিয়ামতের পূর্বে (হয়তো চলমান শতাব্দীতেই) বৈশ্বিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটবে। অন্তঃকোন্দল এবং পশ্চিমা শক্তির আক্রমণে মুসলমানরা নাজেহাল হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় আরবের জনৈক বাদশার মৃত্যুতে তার ছেলেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। অথবা গোপন খনিজ (স্বর্ণ বা তেল) সম্পদের মালিকানা নিয়ে আরব নেতারা লড়াই করতে থাকবে। মদীনার আহলে বায়েতের এক ব্যক্তি এসব অনাচারের প্রতিবাদ করবেন। শাসকরা তাঁকে আটক/হত্যা করতে চাইলে তিনি মক্কায় চলে আসবেন। যেহেতু ইতোমধ্যে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, সেহেতু মানুষ তাঁকে নেতৃত্বে আসার জন্য আহ্বান করবে। তিনি নেতৃত্বে আসতে অস্বীকৃতি জানালেও মানুষ জোরপূর্বক তাঁর হাতে বাই'আত দেবে। সংবাদ পেয়ে সিরিয়া এবং আরবের (বনী কালব) দুটি বাহিনী তাঁকে হামলা করার জন্য আসবে [সুনান আবি দাউদ]। আল্লাহ একটি বাহিনীকে ধ্বসিয়ে দেবেন, আরেকটির ওপর মাহদীকে বিজয় দান করবেন। তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানরা এসে তাঁর হাতে বাই'আত দেবেন।

উল্লেখ্য, সিরিয়া এবং আরবের বর্তমান নেতৃবৃন্দ এবং তাদের কর্মকাণ্ড দেখে এটি অনুমান করা কষ্টকর নয় যে, ভবিষ্যত অবস্থা আরও খারাপ হবে।

এরপর খোরাসান তথা বর্তমান সেন্ট্রাল এশিয়া এবং সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়া থেকে মুজাহিদরা মাহদীর সমর্থনে ছুটে যাবে। দক্ষিণ এশিয়া বলার কারণ হলো, সম্ভবত এর আগেই এই এলাকায় "কিছু একটা" হয়ে যাবে এবং মুসলমানদের অবস্থান দৃঢ় হবে। এসব মুজাহিদরা ইমাম মাহদীর খেলাফতকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

এটি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত একটি অনুমান মাত্র। প্রকৃত সত্য আল্লাহ ভালো জানেন।

পরবর্তী পর্বে আমরা ইমাম মাহদীর খেলাফতের ব্যাপ্তি এবং তাঁর কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

ইমাম মাহদীর খেলাফত মক্কা মুকাররামাহ থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে যাবে বিশ্বের দিকে দিকে। উল্লেখযোগ্য এলাকাজুড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশাআল্লাহ। ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِيَ الأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا وَإِنَّ أُمَّتِي سَيَبْلُغُ مُلْكُهَا مَا زُوِيَ لِي مِنْهَا

"আল্লাহ আমার জন্য পৃথিবীকে সংকোচিত করে দিয়েছেন। আমি এর পূর্ব-পশ্চিম দেখলাম। আর আমার উম্মতের কর্তৃত্ব ততটুকু জায়গা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, যতটুকু আমাকে সংকোচিত করে দেখানো হয়েছে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান]

হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, মাহদীকে সাহায্যকারী একটি দল আসবে পূর্বদিক থেকে। আগে এ সংক্রান্ত হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নোক্ত হাদিসে কিছুটা অন্যভাবে বলা হয়েছে। আবু হুয়ায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

تَخْرُجُ مِنْ خُرَاسَانَ رَايَاتٌ سُودٌ لاَ يَرُدُّهَا شَيْءٌ حَتَّى تُنْصَبَ بِإِيلِيَاءَ

"খোরাসান থেকে কালো পতাকাবাহীরা বের হয়ে এ্যালিয়ায় গিয়ে অবস্থান নেবে। কোনো কিছুই তাদের গতিরোধ করতে পারবে না।" [সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান]

হাদিসের সনদ দ্বয়িফ। তবে এ ধরণের কয়েকটি বর্ণনা একে অপরকে সমর্থন করে।

এ হাদিস থেকে প্রশ্ন আসে- এ্যালিয়া কোন জায়গা, খোরাসান দ্বারা কী উদ্দেশ্য, কালো পতাকার মাহাত্ম্য কী?

এ্যালিয়া (Aelia) জেরুজালেমের পূর্বনাম। রোমান সম্রাট হেড্রিয়ান এ নামকরণ করেছিলেন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত জেরুজালেমের দাপ্তরিক নাম ছিল এ্যালিয়া। [Encyclopedia Britannica, 11th ed, p. 256]

হাদিসে খোরাসান দ্বারা ঠিক কোন এলাকাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, সেটি আমাদের জানা নেই। তবে আগের যুগে খোরাসান বলা হতো Transoxiana এলাকাকে। সাহাবিরা বলতেন ما وراء النهر‎ বা নদীর ওপাশ। এটি বর্তমান উত্তর-পূর্ব ইরান থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে আফগানিস্তানের উত্তরাংশ, মধ্যখানে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান, পূর্বদিকে কিরগিজিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাংশ, উত্তরে কাজাখস্তানের দক্ষিণাংশ হয়ে পশ্চিমে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশাল এলাকা ছিল। [Encyclopedia Britannica Online, Retrieved 2010]

কালো পতাকার আলাদা কোনো মাহাত্ম্য নেই। হ্যাঁ, খোরাসানি দলের পতাকা হয়তো কালো হবে। তবে এটি কেবল-ই একটি রঙ। এরকম ভবিষ্যদ্বাণীকে কেন্দ্র করে অতীতে অনেক বিভ্রান্তিকর কাজ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

প্রথমেই বুঝে নেয়া উচিৎ যে, আমরা তাকদীরের ওপর দখলদারি করতে পারি না। এমনকি নবী-রাসূল বা ফেরেশতাদেরকেও আল্লাহ এ ক্ষমতা দেননি। এ ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহ ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু'র হাতে ন্যস্ত। আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেনঃ

قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ

"আপনি বলুন, সব বিষয় আল্লাহর-ই অধিকারভূক্ত।" [সুরা আলে ইমরান : ১৫৪]

আল্লাহ প্রদত্ত্ব জ্ঞান থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মতকে যা জানিয়েছেন, কেউ যদি সেগুলো কাটছাঁট করে নিজ উদ্যোগে ইলমে গায়েবকে বাস্তবে রূপদান করে চায়, তবে সেটি নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছু নয়। রাসূল ﷺ খবর দিয়েছেন সত্য। কিন্তু সেসব খবর বাস্তবে ঘটানোর দায়িত্ব আল্লাহর হাতে। আর, আল্লাহ বলেছেনঃ

وَكُلُّ شَيْءٍ عِندَهُ بِمِقْدَارٍ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْكَبِيرُ الْمُتَعَال

"এবং তাঁর কাছে প্রতিটি বিষয়ের নির্ধারিত মাপকাঠি রয়েছে। তিনি অপ্রকাশ্য এবং প্রকাশ্যের জ্ঞানী, সর্বোচ্চ মহান।" [সুরা রা'দ : ৮-৯]

অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ

إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا

"আল্লাহ তাঁর কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি পরিমাপ নির্ধারণ করে রেখেছেন।" [সুরা তালাক : ৩]

তাই আল্লাহ যখন যেটি ঘটাতে চাইবেন, সেটি তিনি ঘটাবেন। কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারবে না। আল্লাহ বলেছেনঃ

وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّه

"জেনে রেখো, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না।" [সুরা তাওবাহ : ২]

কিয়ামতের আলামতকে মনগড়া ব্যাখ্যা করে আমাদের ইতিহাসে কতোজন যে মাহদী সেজেছেন- তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পরে দেখা গেছে, এরা মাহদী তো নন-ই; বরং বেশিরভাগই একেকজন ছোটখাটো দাজ্জাল।

৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় আব্বাসিদের পতাকা ছিল কালো রঙের। তাঁদের সৈন্যরা ছিল পারস্য থেকে আগত নও-মুসলিম এবং সেনাপতি ছিলেন আবু মুসলিম, যার নামের সাথে "খোরাসানী" যুক্ত করা হয়েছিল। কেন জানেন? কারণ তাঁরা মাহদীর হাদিসগুলো নিজেদের ওপর চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পরে দেখা গেছে, মাহদী হওয়া তো দূর কি বাত; অত্যাচারের দিক থেকে এরা উমাইয়াদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না।

এছাড়াও সালেহ ইবনে তারিফ, মুহাম্মদ ইবনে হাসান, মাহদী বিল্লাহ (ফাতেমী শাসক), ইবনে তুমার্ত, মুহাম্মদ জৌনপুরী, শাহ ইসমাইল সাফাভী, আলী মুহাম্মদ সিরাজী, মুহাম্মদ আহমদ সুদানী, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (পরবর্তীতে নবুয়তের দাবীদার), ওয়ালেস ফার্ড মুহাম্মদ, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ কাহতানী (১৯৭৯ সালে জুহাইমান আল-উতাইবী কর্তৃক কা'বা শরীফ আক্রমণকারী দলের সদস্য), আরিফীন মুহাম্মদ (যার দাবী ছিল, তিনি মুহাম্মদ-যিশু-শিব-বুদ্ধের সম্মিলিত রূপ), রিয়াজ আহমেদ গহরশাহী... আমাদের ইতিহাসে জালিয়াত মাহদীদের অভাব নেই। শুনেছি, ইরানের কারাগারে প্রায় তিন হাজার মাহদী বন্দী আছেন!

আজ বিভ্রান্তি আরও প্রকট হয়েছে। যেহেতু ধারণা করা হচ্ছে ইমাম মাহদীর আগমনের সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে, তাই সবাই মাহদী হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বেশি তৎপরতা দেখা যায় জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে। কেউ কালো পতাকা উড়াচ্ছে, কেউ সিরিয়ার ঘুত্বা বা দাবিক এলাকায় গিয়ে আস্তানা গাড়ছে। মাহদী নামটি যেন সবকিছুর আবরণ হয়ে গেছে।

একটি মূলনীতি মাথায় গেঁথে নিন- যে ব্যক্তি নিজেকে মাহদী দাবি করবে, জেনে নেবেন সে একজন মিথ্যাবাদী। কারণ প্রকৃত মাহদী কখনও নিজেকে মাহদী দাবী করবেন না। বরং মানুষ তাঁকে খুঁজে বের করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর হাতে বাই'আত দেবে [فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ, সুনান আবি দাউদ]।

দ্বিতীয়ত, সিরিয়া থেকে মক্কা শরীফ আক্রমণ করতে যাওয়া বাহিনীকে যখন 'বাইদা' নামক স্থানে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, কেবল তখন-ই বুঝবেন যে, ইমাম মাহদী এসে গেছেন। এটি হচ্ছে মাহদীর আবির্ভাবের চিহ্ন [فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنَ الأَرْضِ يُخْسَفُ, মুত্তাফাকুন আলাইহি]। এর আগে নয়।

উম্মত হিসেবে আমাদের উচিৎ আস-সাদিক আল-মাসদূক আল-মুসাদ্দিক আল-মুতাসাদ্দিক আন-নাবী আল-আমীন ﷺ এর প্রতিটি কথার ওপর বিশ্বাস রাখা। কারণ তাঁর একটি নিঃশ্বাসও মিথ্যা হতে পারে না। তবে কখন কী হবে, কিভাবে হবে, কার মাধ্যমে হবে, সেটি আল্লাহ ভালো জানেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

প্রসঙ্গক্রমে কথাগুলো বললাম। পরবর্তী পর্বে আমরা নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা এগিয়ে নেব, ইনশাআল্লাহ।

ইমাম মাহদী পৃথিবীতে অবস্থান করার সময়টি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

الْمَهْدِيُّ مِنِّي... يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ

"মাহদী আমার বংশ থেকে। তিনি সাত বছর শাসন করবেন।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মাহদী]

তাঁর পুরো জীবনকাল সাত বছর নয়; বরং উম্মতের ইমাম হওয়ার পর তিনি সাত বছর পৃথিবীতে থাকবেন। এ সময়ের কার্যক্রমকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি।

১. উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ করে পুনরায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা।

মুসলিম বিশ্বের অবস্থা আমরা জানি। অন্তঃস্থ-বহিঃস্থ শত্রুদের ঘেরাটোপ চারিদিক থেকে আঁটসাঁট হয়ে আসছে। ভবিষ্যত পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হবে, চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

اصْبِرُوا فَإِنَّهُ لاَ يَأْتِي عَلَيْكُمْ زَمَانٌ إِلاَّ الَّذِي بَعْدَهُ شَرٌّ مِنْهُ حَتَّى تَلْقَوْا رَبَّكُمْ

"তোমরা ধৈর্যধারণ করো। যে সময়/যুগ তোমাদের ওপর আসবে, তার পরেরটি এরচেয়ে বেশি খারাপ হবে। এমনকি যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল ফিতান]

চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল বিপর্যয়গ্রস্ত সে সময়টিতে ইমাম মাহদী মুসলিম উম্মাহ'র জন্য ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ার ন্যায় আগমন করবেন এবং উম্মতের নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর হাতে পুনরায় এ যমিনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। নু'মান ইবনে বাশির রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসের শেষাংশ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ

"অতঃপর আবার নববী আদর্শের ভিত্তিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

২. মালাহিম, তথা শেষ যুগের বড় বড় যুদ্ধে মুসলিম উম্মাহ'র নেতৃত্ব প্রদান।

আমরা ইতোপূর্বে যতগুলো যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছি, প্রায় সবগুলো যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ইমাম মাহদী। উদাহরণস্বরূপ সিরিয়ায় রোমান বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ, কনস্টান্টিনোপল অভিযান, পূর্বদিক বা খোরাসান থেকে আগত বাহিনীর হাতে জেরুজালেম বিজয়, ইরাকে দু'একটি যুদ্ধ- সবই হবে মাহদীর নেতৃত্বে। হাদিস থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ. قَالَ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا فَيَقُولُ لاَ ‏إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ ‏تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ

"আমার উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের পথে লড়াই করা থেকে ক্ষান্ত হবে না। যখন ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. অবতীর্ণ হবেন, তখন মুসলিম নেতা তাঁকে বলবেন, আপনি নামাজের ইমামতি করুন। ঈসা আ. বলবেন, না। আপনাদের মধ্যে কয়েকজন বাকি সবার ইমাম। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ উম্মতের জন্য একটি সম্মাননা।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ঈমান]

ওই সময়ের যুদ্ধগুলো এতো ভয়ংকর এবং প্রাণঘাতী হবে যে, বর্ণনা শুনে আত্মা কেঁপে ওঠে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে শুনে) বলেছেনঃ কিয়ামতের পূর্বে শাম এলাকায় রোমান (পশ্চিমা শক্তি) এবং মুসলিম বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হবে। মুসলমানরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করবে। হাদিসের ভাষ্য হচ্ছে-

فَيَقْتُلُونَ مَقْتَلَةً إِمَّا قَالَ لاَ يُرَى مِثْلُهَا وَإِمَّا قَالَ لَمْ يُرَ مِثْلُهَا حَتَّى إِنَّ الطَّائِرَ لَيَمُرُّ بِجَنَبَاتِهِمْ فَمَا يُخَلِّفُهُمْ حَتَّى يَخِرَّ مَيْتًا فَيَتَعَادُّ بَنُو الأَبِ كَانُوا مِائَةً فَلاَ يَجِدُونَهُ بَقِيَ مِنْهُمْ إِلاَّ الرَّجُلُ الْوَاحِدُ

"তারা এমনভাবে যুদ্ধ করবে যে রকম যুদ্ধ কেউ কখনও দেখেনি, দেখবে না। এমনকি একটি পাখি যদি ওপর দিয়ে উড়তে থাকে, সেটি লাশের স্তুপ পার করার আগেই নিচে পড়ে মারা যাবে। প্রতি একশজন মানুষের মধ্যে একজন জীবিত থাকবে, বাকিরা মারা যাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

৩. উম্মতের ওপর স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্পদের প্রাচুর্য।

আল্লাহর রাহে জিহাদ চলমান থাকলেও সামগ্রিকভাবে উম্মতের ইজ্জত বৃদ্ধি পাবে। স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দেবে। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَكُونُ فِي أُمَّتِي الْمَهْدِيُّ... فَتَنْعَمُ فِيهِ أُمَّتِي نَعْمَةً لَمْ يَنْعَمُوا مِثْلَهَا قَطُّ تُؤْتَى أُكُلَهَا وَلاَ تَدَّخِرُ مِنْهُمْ شَيْئًا وَالْمَالُ يَوْمَئِذٍ كُدُوسٌ

"আমার উম্মতের মধ্যে মাহদী আবির্ভূত হবেন । এ সময় আমার উম্মতের ওপর এমন স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, যা আগে কখনও আসেনি। জমি তার সবটুকু (চাষাবাদ) বের করে দেবে। কিছুই ভেতরে রাখবে না। সম্পদের প্রাচুর্য হবে।" [সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

হাদিসের সনদ দ্বয়িফ। তবে এর পক্ষে সহীহ হাদিসের সমর্থন রয়েছে।

জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَكُونُ فِي آخِرِ أُمَّتِي خَلِيفَةٌ يَحْثِي الْمَالَ حَثْيًا لاَ يَعُدُّهُ عَدَدًا ‏

"আমার উম্মতের শেষদিকে একজন খলিফা হবেন, যিনি মানুষকে দুহাত ভরে বেহিসাব সম্পদ বিতরণ করবেন।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান]

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থিত হয়- ইমাম মাহদী এবং শেষ যুগের যুদ্ধে কী ধরণের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে? হাদিসে ঘোড়া, তরবারি, তীর-ধনুক ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা বর্তমান যুগে এসব অস্ত্রের ব্যবহার দেখি না। তাহলে বিষয়টি কিভাবে বুঝব?

জেনে রাখা উচিৎ, আধুনিক মারণাস্ত্রের বয়স দেড়-দুই শতাব্দীর বেশি নয়। পারমাণবিক অস্ত্রের বয়স সবে ৭৫ বছর চলছে। হাইড্রোজেন অস্ত্র আবিষ্কার হয়েছে ৬৭ বছর আগে। তাই এ বিষয়ে প্রাচীন, মধ্য কিংবা প্রাক-আধুনিক যুগের কোনো আলিমের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব না।

এ ব্যাপারে দুটি সম্ভাবনা দাঁড় করানো যায়।

১. হাদিসে ঘোড়া, তরবারি, তীর-ধনুক ইত্যাদি দ্বারা সাধারণ অর্থে যুদ্ধাস্ত্র বুঝানো হয়েছে। এর মানে যখন যে যুগ আসবে, সে যুগের উপযোগী অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হবে।

২. শেষ যুগ আসার আগে পৃথিবী এমন এক মহাযুদ্ধে লিপ্ত হবে যে, মানব সভ্যতা প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে। এরপর যারা অবশিষ্ট থাকবে, তাদেরকে আবার প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করতে হবে।

সম্ভাবনা কোনোটিই ফেলে দেয়ার মতো নয়। প্রথমত, যদি আধুনিক মারণাস্ত্র উপস্থিত থাকে, যেভাবে আজ আছে, তাহলে তীর-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করার কোনো মানে হয়না। তাছাড়া হাদিসে যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, তাতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সে সময়ের যুদ্ধে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হবে। এমনকি তখনকার মারণাস্ত্রের ব্যাপ্তি ও শক্তি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তা আজ অনুমান করাও দুঃসাধ্য। আল্লাহুল মুসতা'আন।

দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াই আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তৃতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হওয়া অলীক কল্পনা নয়। যদি হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে এতে পারমাণবিক, হাইড্রোজেন এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হবে। পৃথিবীর ৯টি রাষ্ট্রের কাছে পারমাণবিক হাতিয়ার রয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েল। হাইড্রোজেন অস্ত্র আছে ৬টি দেশের হাতে। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন এবং ভারত। এ অস্ত্রবল মানব সভ্যতাকে একাধিকবার ধ্বংস করতে সক্ষম। আল্লাহুল মুসতা'আন।

তবে আমাদের কাছে ১ম সম্ভাবনাটি শক্তিশালী মনে হচ্ছে। আল্লাহু আ'লাম।

ইমাম মাহদী পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফিতনা প্রকাশিত হবে। সেই ফিতনার নাম আল-মাসীহ আদ-দাজ্জাল।

হুযায়ফা ইবনে উসাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ.‏ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم وَيَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلاَثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না তোমরা দশটি আলামত দেখবে। ধোঁয়া, দাজ্জাল, দাব্বাহ, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, ঈসা ইবনে মারইয়াম আ. এর অবতরণ, ইয়াজুজ-মাজুজ, পূর্ব, পশ্চিম এবং জাযিরাতুল আরবে তিনটি ভূমিধ্বস। এরপর ইয়েমেন থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে মাহশারের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

আমরা এক এক করে সবগুলো আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আপাতত জেনে নেই যে, এগুলোই হচ্ছে কিয়ামতের মূখ্য বা বড় আলামত।

যদিও কিয়ামতের বড় আলামতের মধ্যে কোনো অনুক্রম (Sequence) নেই, একেক হাদিসে একেক ধরণের ক্রম লক্ষ্য করা যায়। তবুও আলিমগণ প্রায় একমত যে, কিয়ামতের সর্বপ্রথম বড় আলামত হচ্ছে দাজ্জাল।

দাজ্জাল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ইঙ্গিত-ই নেই। তবে হাদিস শাস্ত্রে এতো বেশি বর্ণনা বিদ্যমান যে, দাজ্জালের ফিতনার ব্যাপারে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে।

দাজ্জাল (الدَّجَّالَ) শব্দের অর্থ ধোঁকাবাজ। এটি নাম নয়; উপাধি। জেনে নেয়া উচিৎ, দাজ্জাল দুই ধরণের। এক ধরণের দাজ্জাল হচ্ছে মিথ্যা নবুয়তের দাবীদারগণ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُبْعَثَ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ قَرِيبٌ مِنْ ثَلاَثِينَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّه

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ত্রিশজনের মতো মিথ্যাবাদী দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। এরা প্রত্যেকেই নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করবে।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

দ্বিতীয় প্রকার দাজ্জাল এক ব্যক্তি, যাকে আল-মাসীহ আদ-দাজ্জাল বলা হয়েছে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَا بُعِثَ نَبِيٌّ إِلاَّ قَدْ أَنْذَرَ أُمَّتَهُ الدَّجَّالَ الأَعْوَرَ الْكَذَّابَ

"এমন কোনো নবী নেই, যিনি তাঁর উম্মতকে মিথ্যাবাদী কানা দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্ক করেননি।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল ফিতান, সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

আমাদের আলোচনার বিষয় আল-মাসীহ আদ-দাজ্জাল। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় ফিতনা। হিশাম ইবনে আমির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَا بَيْنَ خَلْقِ آدَمَ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ خَلْقٌ أَكْبَرُ مِنَ الدَّجَّال

"আদম সৃষ্টি থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত দাজ্জালের চেয়ে বড় (ফিতনা) আর নেই।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

বিভিন্ন হাদিস থেকে দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ أَطُوفُ بِالْكَعْبَةِ فَإِذَا رَجُلٌ آدَمُ سَبْطُ الشَّعَرِ يَنْطُفُ أَوْ يُهَرَاقُ رَأْسُهُ مَاءً قُلْتُ مَنْ هَذَا قَالُوا ابْنُ مَرْيَمَ‏.‏ ثُمَّ ذَهَبْتُ أَلْتَفِتُ فَإِذَا رَجُلٌ جَسِيمٌ أَحْمَرُ جَعْدُ الرَّأْسِ أَعْوَرُ الْعَيْن كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ قَالُوا هَذَا الدَّجَّالُ

"আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। (স্বপ্নে) দেখলাম কা'বা শরীফ তাওয়াফ করছি। তখন ফর্সা, কৃশ চুলের এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তাঁর চুল থেকে পানি পড়ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কে? বলা হলো, তিনি ঈসা ইবনে মারইয়াম। এগিয়ে গিয়ে আরেক ব্যক্তিকে দেখলাম। স্থূলকায় দেহ, লালটে বর্ণ, কুঞ্চিত চুল, এক চোখ কানা। তার চোখ পঁচা আঙুরের মতো ফোলা। বলা হলো, এটি দাজ্জাল।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

উবাদাহ ইবনুস সামিত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنِّي قَدْ حَدَّثْتُكُمْ عَنِ الدَّجَّالِ حَتَّى خَشِيتُ أَنْ لاَ تَعْقِلُوا إِنَّ مَسِيحَ الدَّجَّالِ رَجُلٌ قَصِيرٌ أَفْحَجُ جَعْدٌ أَعْوَرُ مَطْمُوسُ الْعَيْنِ لَيْسَ بِنَاتِئَةٍ وَلاَ جَحْرَاءَ

"আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে অনেক বলেছি। আমার আশঙ্কা হয়, তোমরা বুঝতে পারছ কি না। মাসীহ আদ-দাজ্জাল বেটে। তার পা কোঁচকানো, চুল কুঞ্চিত, এক চোখ অন্ধ। আলোহীন চোখটি স্ফীত নয়; আবার কোঠরবদ্ধও নয়।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّهُ شَابٌّ قَطَطٌ عَيْنُهُ طَافِئَةٌ

"সে অধিক কেশবিশিষ্ট এক যুবক। তার এক চোখ নষ্ট।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَإِنَّهُ أَعْوَرُ الْعَيْنِ أَجْلَى الْجَبْهَةِ عَرِيضُ النَّحْرِ فِيهِ دَفَأٌ

"সে অন্ধ। তার কপাল বড়, কাঁধ প্রশস্ত। দেহে বাঁকা ভাব রয়েছে।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

আনাস এবং হুযায়ফা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَكْتُوبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ كَافِرٌ ‏ثُمَّ تَهَجَّاهَا ك ف ر.

يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ كَاتِبٍ وَغَيْرِ كَاتِبٍ

"তার দুই চোখের মধ্যখানে লেখা থাকবে 'কাফির'। এরপর রাসূল ﷺ বানান করে বললেনঃ (আরবি হরফ) কাফ, ফা, রা।

অন্য বর্ণনায়, "প্রত্যেক ঈমানদার এটি পড়তে পারবে। চাই সাক্ষর হোক, চাই নিরক্ষর।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

তাহলে বুঝা যায়, দাজ্জাল একজন মানুষ। একজন যুবক পুরুষ, যার দেহ স্থূলকায়, বেটে গড়ন, গায়ের রঙ লালটে, মাথাভর্তি কুঞ্চিত চুল, বড় কপাল, প্রশস্ত কাঁধ, বাঁকানো শরীর, কোঁচকানো পা। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে অন্ধ। তার এক চোখ নষ্ট, পঁচা আঙুরের মতো। অথবা তার এক চোখ অন্ধ, আরেক চোখ ফোলা। বর্ণনায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। তার দুই চোখের মধ্যখানে স্পষ্ট আরবি হরফে 'কাফির' লেখা থাকবে, যা শুধু ঈমানদাররা পড়তে পারবে। [ইমাম নববী, ইমাম কাযী আয়ায এবং ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর ব্যাখ্যা অনুসরণে]

দাজ্জালের জন্মস্থান হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

الدَّجَّالُ يَخْرُجُ مِنْ أَرْضٍ بِالْمَشْرِقِ يُقَالُ لَهَا خُرَاسَانُ

"দাজ্জাল পূর্বদিকের খোরাসান নামক এলাকা থেকে বের হবে।" [সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান, সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَخْرُجُ الدَّجَّالُ مِنْ يَهُودِيَّةِ أَصْبَهَانَ مَعَهُ سَبْعُونَ أَلْفًا مِنْ الْيَهُودِ عَلَيْهِمْ التِّيجَانُ

"দাজ্জাল ইস্পাহানের ইহুদি পরিবার থেকে বের হবে। তার সাথে থাকবে তিজান পরিহিত ৭০ হাজার ইহুদি।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّهُ خَارِجٌ خَلَّةً بَيْنَ الشَّأْمِ وَالْعِرَاقِ

"সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী পথে বের হবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

হাদিসগুলো এভাবে সমন্বয় করা যায়- দাজ্জালের জন্ম হবে ইস্পাহানের ইহুদি পরিবারে। তবে পরিচিতি ঘটবে ইরাক-সিরিয়ায়। তার সাথে থাকবে ইহুদিরা। আরবি ভাষায় '৭০ হাজার' শব্দটি 'প্রচুর/অসংখ্য' অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইহুদিরা সবাই যে ইস্পাহান থেকে আসবে, এমনটি নয়। সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিরা দাজ্জালের সঙ্গী হতে পারে।

ইস্পাহান বর্তমান ইরানের একটি শহর। অ্যাসিরিয়ানদের হাতে জেরুজালেম ধ্বংস হওয়ার পর ৭২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহুদিরা কৃতদাস হিসেবে পারস্যে এসেছিল। এক সময় ইস্পাহানে সাড়ে ৩ লক্ষ ইহুদির বসবাস ছিল। এখন দশ হাজারের মতো আছে। বাকিরা ইসরায়েল এবং উত্তর আমেরিকায় চলে গেছে। [Iranian Census Report 2016]

উপরোক্ত একটি বর্ণনায় খোরাসানের কথা এসেছে। যেহেতু এক সময় ইরানের পূর্বাংশ এবং আফগানিস্তানসহ বর্তমান সেন্ট্রাল এশিয়াকে খোরাসান বলা হতো (৬ষ্ঠ পর্ব দ্রষ্টব্য), তাই এতে বড় কোনো বৈপরীত্য নেই। আল্লাহু আ'লাম।

এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- দাজ্জালের জন্ম কি হয়ে গেছে?

যেহেতু ইমাম মাহদী পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তখন সে যুবক হবে, তাই ধরে নেয়া যায়, দাজ্জালের এখনো জন্ম হয়নি। কিংবা হলেও হয়তো নিকট অতীতে হয়েছে বা নিকট ভবিষ্যতে হবে, আল্লাহু আ'লাম। জন্মের পর সে সাধারণ মানুষের মতো বেড়ে উঠবে। বিবাহিত হবে কি না জানিনা, তবে নিঃসন্তান হবে [عَقِيمٌ لا يُولَدُ لَهُ, সহীহ মুসলিম]। একদা কোনো একটি বিষয় নিয়ে সে খুব ক্রোধান্বিত হবে। ক্রোধের প্রভাব থেকে সে বুঝতে পারবে, তার মধ্যে কিছু অমানুষিক শক্তি রয়েছে। তখন সে 'দাজ্জাল' হয়ে উঠবে [إِنَّمَا يَخْرُجُ مِنْ غَضْبَةٍ يَغْضَبُهَا, সহীহ মুসলিম]।

কিন্তু একটি হাদিস এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র হাজির করে। ফাতিমা বিনতে কায়েস রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসটির সারসংক্ষেপ হচ্ছে, তামিম দারী নামক খ্রিস্টান ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করার পর বললেন, কয়েক বছর পূর্বে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁরা একটি দ্বীপে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে একটি লোমশ জন্তু দেখতে পান। জন্তুটি নিজের নাম বলে- জাসসাসা। সে তাঁদেরকে একটি দুর্গের ভেতর যেতে বলে। দুর্গে গিয়ে তাঁরা প্রকাণ্ডদেহী এক ব্যক্তিকে শিকলবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলে সে তাঁদেরকে কিছু প্রশ্ন করে। এরপর জিজ্ঞেস করে, উম্মী নবী কি এসে গেছেন? তাঁরা বলেন, হ্যাঁ। এরপর সে তার পরিচয় দিয়ে বলে, আমি হচ্ছি আল-মাসীহ (দাজ্জাল)। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি চল্লিশ দিনে পৃথিবী ভ্রমণ করব। কিন্তু মক্কা এবং ত্বাইবায় (মদীনা) প্রবেশ করতে পারব না। এরপর রাসূল ﷺ বলেনঃ

أَعْجَبَنِي حَدِيثُ تَمِيمٍ أَنَّهُ وَافَقَ الَّذِي كُنْتُ أُحَدِّثُكُمْ عَنْهُ وَعَنِ الْمَدِينَةِ وَمَكَّةَ أَلاَ إِنَّهُ فِي بَحْرِ الشَّامِ أَوْ بَحْرِ الْيَمَنِ لاَ بَلْ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ ما هُوَ

"তামিমের বর্ণনাটি আমার পছন্দ হয়েছে, যেহেতু এটি আমার বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দাজ্জাল 'বাহরে শাম' (ভূমধ্যসাগর) অথবা 'বাহরে ইয়ামান' (আরব সাগর)-এ আছে। না, বরং সে আছে পূর্বদিকে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

এ হাদিসটি নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। হাদিসটি সহীহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটিকে অন্যান্য হাদিসের সাথে সমন্বয় করা কষ্টকর। আমাদের আলিমগণ হাদিসটির দ্বারা "দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে" মর্মে দলিল দিয়েছেন। আর কিছুই বলেননি।

বিষয়টি বুঝার জন্য আমরা দুটি সম্ভাবনা দাঁড় করিয়েছি।

১. আমরা হাদিসটি আক্ষরিক অর্থে নেব। ধরে নেব দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে এবং সে কোনো এক দ্বীপে বন্দী আছে। ধরে নেব দাজ্জালের জন্ম, জন্মস্থান এবং জীবন সংক্রান্ত হাদিসগুলো ভবিষ্যতবাচক নয়; বরং অতীতবাচক। এ ক্ষেত্রে কখন, কোথায়, কিভাবে ইত্যাদি প্রশ্ন আসে। সেই দ্বীপের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন আসে, যেখানে দাজ্জাল বন্দী আছে।

২. অথবা ধরে নেব, আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা তামিম দারী রা.-কে Projection দেখিয়েছেন। Projection বলা হয়, বর্তমান তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে ঘটিতব্য কোনো ঘটনার পূর্বাভাস। সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্য এরকম দেখানো কোনো ব্যাপারই না। যদিও এটি আমাদের অনুমান মাত্র।

কোনটি গ্রহণ করবেন, সেটি আপনাদের ওপর। আমরা একটি কথাই বলব- আল্লাহু আ'লাম, আ-মানতু বিল্লাহি ওয়া রাসূলিহি।

দাজ্জালের ফিতনা দুই স্তরে আসবে। আবু উমামাহ আল-বাহিলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّهُ يَبْدَأُ فَيَقُولُ أَنَا نَبِيٌّ وَلاَ نَبِيَّ بَعْدِي ثُمَّ يُثَنِّي فَيَقُولُ أَنَا رَبُّكُمْ وَلاَ تَرَوْنَ رَبَّكُمْ حَتَّى تَمُوتُوا وَإِنَّهُ أَعْوَرُ وَإِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ

"সে শুরুতে বলবে, আমি নবী। (রাসূল ﷺ বললেন) কিন্তু আমার পরে কোনো নবী নেই। এরপর বলবে, আমি তোমাদের রব। (কিন্তু জেনে রেখো) মৃত্যুর পূর্বে তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে না। দাজ্জাল অন্ধ, কিন্তু তোমাদের রব অন্ধ নন।" [সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান, মুসনাদ ইমাম আহমদ]

যেহেতু ইহুদিরা একজন মাসীহ'র (Messiah) অপেক্ষায় আছে, তাই এসব দাবী শুনে তারা দাজ্জালের লেজ ধরবে।

হাদিসে দাজ্জালের সময়কাল এবং গতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَعَاثَ يَمِينًا وَعَاثَ شِمَالاً يَا عِبَادَ اللَّهِ فَاثْبُتُوا. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا لَبْثُهُ فِي الأَرْضِ قَالَ أَرْبَعُونَ يَوْمًا يَوْمٌ كَسَنَةٍ وَيَوْمٌ كَشَهْرٍ وَيَوْمٌ كَجُمُعَةٍ وَسَائِرُ أَيَّامِهِ كَأَيَّامِكُمْ. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِي كَسَنَةٍ أَتَكْفِينَا فِيهِ صَلاَةُ يَوْمٍ قَالَ ‏لاَ اقْدُرُوا لَهُ قَدْرَهُ. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا إِسْرَاعُهُ فِي الأَرْضِ قَالَ كَالْغَيْثِ اسْتَدْبَرَتْهُ الرِّيحُ

"দাজ্জাল ডানে-বামে ফিতনা সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহর বান্দারা, তোমরা দৃঢ় থেকো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, সে পৃথিবীতে কতোদিন থাকবে? তিনি বললেন, চল্লিশ দিন। এক দিন হবে বছরের সমান, এক দিন মাসের সমান, এক দিন সপ্তাহের সমান, বাকি সাধারণ দিনের মতো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, যে দিন বছরের সমান হবে সেদিন কি আমরা এক দিনের নামাজই পড়ব? তিনি বললেন, না তোমরা হিসেব করে পড়ে নেবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, সে কতো দ্রুত চলবে? তিনি বললেন, যেভাবে বাতাস মেঘমালাকে তাড়িয়ে নেয়।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

এক দিন বছর, পরদিন মাস এবং পরদিন সপ্তাহের ন্যায় হওয়ার বিষয়টি দুইভাবে হতে পারে। হয়তো প্রথম তিনদিন এতো লম্বা হবে যে, এগুলো বছর, মাস ও দিনের মতো মনে হবে। অথবা আক্ষরিক অর্থে বছর মানে ৩৬৫ দিন। এতে দাজ্জালের সময়কাল দাঁড়ায় ১ বছর ২ মাস ১৪ দিন। তবে প্রথম সম্ভাবনাটি শক্তিশালী মনে হচ্ছে।

দাজ্জাল মানুষকে তার প্রভুত্বের দিকে আহ্বান করবে। প্রভুত্ব স্বীকার করলে সে নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে। এমনকি (আল্লাহর দেয়া শক্তিতে) সে কিছু অতিমানবিক কাজ করে দেখাবে। যেমন বৃষ্টি বর্ষণ, অনুর্বর জমিতে ফসল ফলানো, গবাদিপশুর ওলান দুধে পূর্ণ করে দেয়া ইত্যাদি। সে মাটিকে নির্দেশ দেয়ামাত্র মাটি গুপ্তধন বের করে দেবে। এক যুবককে হত্যা করে আবার তাকে জীবিত করে দেখাবে। অপরদিকে যারা তার প্রভুত্ব অস্বীকার করবে, তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। সম্পদের ক্ষতি করবে। দাজ্জাল এক ব্যক্তির সামনে তার মৃত মা-বাবাকে জীবিত করবে। মূলত শয়তানরা মৃত মানুষের রূপ ধরে এসে ধোকা দেবে। [সহীহ মুসলিম, সুনান ইবনে মাজাহ]

হুযায়ফা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَعَهُ جَنَّةٌ وَنَارٌ فَنَارُهُ جَنَّةٌ وَجَنَّتُهُ نَارٌ

"তার সাথে জান্নাত-জাহান্নাম থাকবে। প্রকৃতপক্ষে তার জাহান্নাম হবে জান্নাত এবং জান্নাত হবে জাহান্নাম।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

জান্নাত-জাহান্নাম দ্বারা আগুন-পানি উদ্দেশ্য হতে পারে। একটি বর্ণনায় আগুন এবং পানির কথা বলা হয়েছে [إِنَّ مَعَ الدَّجَّالِ إِذَا خَرَجَ مَاءً وَنَارًا, সহীহ বুখারী]। আবার সুযোগ-সুবিধা বনাম নির্যাতন-নিপীড়ন উদ্দেশ্য হতে পারে।

দাজ্জাল সবখানে প্রবেশ করলেও কিছু এলাকা তার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لَيْسَ مِنْ بَلَدٍ إِلاَّ سَيَطَؤُهُ الدَّجَّالُ إِلاَّ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةَ لَيْسَ لَهُ مِنْ نِقَابِهَا نَقْبٌ إِلاَّ عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا ثُمَّ تَرْجُفُ الْمَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلاَثَ رَجَفَاتٍ فَيُخْرِجُ اللَّهُ كُلَّ كَافِرٍ وَمُنَافِق

"দাজ্জাল প্রত্যেক শহরে যাবে, কিন্তু মক্কা এবং মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। মক্কা-মদীনার প্রতিটি রাস্তায় ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দাজ্জাল থেকে শহরকে রক্ষা করবেন। এরপর (দাজ্জালের পায়ের আঘাতে) মদীনা তিনবার প্রকম্পিত হবে। আল্লাহ এর দ্বারা (ভয় দেখিয়ে) মদীনা থেকে সব কাফির এবং মুনাফিক বের করে দেবেন।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুল মাদীনা]

এছাড়া দাজ্জাল বাইতুল মুকাদ্দাস এবং তুর পর্বতে যেতে পারবে না। [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

দাজ্জালের ফিতনা এতো ভয়ংকর যে, খোদ রাসূল ﷺ এ ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থণা করেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ

سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسْتَعِيذُ فِي صَلاَتِهِ مِنْ فِتْنَةِ الدَّجَّال

"আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নামাজের মধ্যে দাজ্জালের ফিতনা থেকে (আল্লাহর কাছে) আশ্রয় প্রার্থণা করতে শুনেছি।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

মু'আজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

عُمْرَانُ بَيْتِ الْمَقْدِسِ خَرَابُ يَثْرِبَ وَخَرَابُ يَثْرِبَ خُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ وَخُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ فَتْحُ قُسْطَنْطِينِيَّةَ وَفَتْحُ الْقُسْطَنْطِينِيَّةِ خُرُوجُ الدَّجَّال

"বাইতুল মাকদিসে বসতি স্থাপন ইয়াসরিবের বিপর্যয়ের কারণ। ইয়াসরিবের বিপর্যয় মহাযুদ্ধের কারণ। মহাযুদ্ধ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কারণ। কনস্টান্টিনোপল বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের কারণ।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

একই সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে-

الْمَلْحَمَةُ الْعُظْمَى وَفَتْحُ الْقُسْطَنْطِينِيَّةِ وَخُرُوجُ الدَّجَّالِ فِي سَبْعَةِ أَشْهُرٍ

"মহাযুদ্ধ, কনস্টান্টিনোপল বিজয় এবং দাজ্জালের আবির্ভাব ৭ মাস সময়ের মধ্যে ঘটবে।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম, সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান, সুনান ইবনে মাজাহ ; কিতাবুল ফিতান]

উক্ত হাদিসদ্বয় আমাদেরকে একটি অনুক্রম জানিয়ে দিচ্ছে। ইমাম মাহদী যখন ইসলামি খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, তাঁর রাজধানী হবে জেরুজালেম। জেরুজালেম আবাদ হওয়া শুরু হলে মদীনা তায়্যিবাহ ধীরে ধীরে খালি হতে শুরু করবে। রোমান তথা পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ তখনও চলমান। মহাযুদ্ধ (الْمَلْحَمَةُ الْعُظْمَى) একটি নয়; বরং একাধিক হবে। যুদ্ধগুলো প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী হবে, আমরা বারবার উল্লেখ করেছি। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ تَذْهَبُ الدُّنْيَا حَتَّى يَمُرَّ الرَّجُلُ عَلَى الْقَبْرِ فَيَتَمَرَّغُ عَلَيْهِ وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ مَكَانَ صَاحِبِ هَذَا الْقَبْرِ وَلَيْسَ بِهِ الدِّينُ إِلاَّ الْبَلاَءُ

"কসম সেই সত্ত্বার, যার হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ধ্বংস (কিয়ামত) হবে না, যতক্ষণ না এক ব্যক্তি কবরের পাশে গড়াগড়ি করে বলবে, "হায় আজ যদি আমি এই কবরবাসীর জায়গায় থাকতাম!" সে এটি দীনি উদ্দেশ্যে বলবে না; বরং বিপদ আপদের কারণে বলবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

মুসলমানরা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর মাহদীর নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) পুনঃবিজয় হবে। এর পরপরই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। দাজ্জাল যখন দুনিয়াজুড়ে ফিতনা ছড়াচ্ছে, মাহদী তখন শাম এলাকায় অবস্থান করবেন। ঘুত্বা হবে মুসলিম বাহিনীর মূল ক্যাম্প। আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ

"মহাযুদ্ধের সময় মুসলমানদের ক্যাম্প হবে ঘুত্বা।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

ঘুত্বা/গৌত্বা (Ghouta) সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পার্শ্ববর্তী একটি শহরতলি।

মাহদী যখন দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন অবতীর্ণ হবেন আল-মাসীহ ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ بَعَثَ اللَّهُ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ الْبَيْضَاءِ شَرْقِيَّ دِمَشْقَ بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى أَجْنِحَةِ مَلَكَيْن

"যখন দাজ্জালের ফিতনা চলমান, তখন আল্লাহ মাসীহ ইবনে মারইয়ামকে প্রেরণ করবেন। তিনি হালকা জাফরান বর্ণের দুটি চাদর পরিহিত অবস্থায়, দুজন ফেরেশতার কাঁধে ভর করে দামেস্কের মসজিদের পূর্বপাশের সাদা মিনারে অবতীর্ণ হবেন।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

দামেস্কের মসজিদ দ্বারা মসজিদে উমাওয়ী (উমাইয়া মসজিদ) উদ্দেশ্য, এতে আলিমগণ একমত। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক মসজিদটি তৈরি করেছিলেন, যার পূর্বপাশে একটি সাদা মিনার রয়েছে।

ঈসা আ. অবতরণ করবেন ফজরের নামাজের ইকামাতের সময় [إِذْ أُقِيمَتِ الصَّلاَةُ, সহীহ মুসলিম]। তাঁকে ইমামতি করার জন্য আহ্বান করা হবে। কিন্তু তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে বলবেন, "ইমাম আপনাদের মধ্য থেকেই হবেন।" তখন ইমাম মাহদী নামাজের ইমামতি করবেন। জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ

"কেমন হবে সেদিন, যখন ঈসা ইবনে মারইয়াম অবতীর্ণ হবেন, আর ইমাম হবেন তোমাদের মধ্যে একজন।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

নামাজের পর মুসলমানদের নেতৃত্ব চলে যাবে ঈসা আ. এর হাতে। তিনি সেদিনই ছুটবেন দাজ্জালের খুঁজে, যেন এই কাজের দায়িত্ব নিয়েই এসেছেন। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَيَطْلُبُهُ حَتَّى يُدْرِكَهُ بِبَابِ لُدٍّ فَيَقْتُلُهُ

"ঈসা আ. দাজ্জালকে বাবে লুদ এর কাছে খুঁজে পাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ فَأَمَّهُمْ فَإِذَا رَآهُ عَدُوُّ اللَّهِ ذَابَ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ فَلَوْ تَرَكَهُ لاَنْذَابَ حَتَّى يَهْلِكَ وَلَكِنْ يَقْتُلُهُ اللَّهُ بِيَدِهِ فَيُرِيهِمْ دَمَهُ فِي حَرْبَتِهِ

"অতঃপর ঈসা ইবনে মারইয়াম অবতীর্ণ হবেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবেন। আল্লাহর শত্রু (দাজ্জাল) তাঁকে দেখামাত্র এমনভাবে বিচলিত হবে, যেভাবে লবন পানির মধ্যে গলে যায়। এমনকি তিনি যদি তাকে ছেড়ে দিতেন, সে (দাজ্জাল) বিগলিত হয়ে নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তাকে ঈসা আ. এর হাতে হত্যা করবেন এবং তার রক্ত ঈসার বর্শায় দেখিয়ে দেবেন।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

তাহলে বুঝা যায় যে, মাহদী দাজ্জালের বাহিনীর সাথে একাধিকার যুদ্ধ করলেও দাজ্জালের সাথে তাঁর সরাসরি যুদ্ধ হবে না। দাজ্জাল সারা দুনিয়ায় (মক্কা-মদীনা ব্যতীত) ফিতনা ছড়িয়ে যখন জেরুজালেমের দিকে পথ ধরবে, মাহদী তখন দামেস্ক বা ঘুত্বায় অবস্থান করবেন। তিনি দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় ঈসা আ. অবতীর্ণ হবেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে ছুটবেন দাজ্জালের সন্ধানে। 'বাবে লুদ' এর কাছে দাজ্জালকে পাবেন এবং নিজ হাতে হত্যা করবেন।

বাবে লুদ বর্তমান ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব থেকে ১৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত একটি ছোট বসতি।

দাজ্জালকে হত্যা করার পর ঈসা আ. এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী দাজ্জালের অনুচরদের (ইহুদি) ওপর চড়াও হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

ثُمَّ يَقُولُ الْحَجَرُ يَا مُسْلِمُ هَذَا يَهُودِيٌّ وَرَائِي فَاقْتُلْهُ

"এরপর একটি পাথরও ডেকে বলবে, হে মুসলিম, আমার পেছনে এক ইহুদি লুকিয়ে আছে। তাকে হত্যা করো।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

আরেকটি বর্ণনায় এসেছে-

ثُمَّ يُسَلِّطُ اللهُ الْمُسْلِمِينَ عَلَيْهِ فَيَقْتُلُونَهُ وَيَقْتُلُونَ شِيعَتَهُ حَتَّى إِنَّ الْيَهُودِيَّ لَيَخْتَبِئُ تَحْتَ الشَّجَرَةِ أَوِ الْحَجَرِ فَيَقُولُ الْحَجَرُ أَوِ الشَّجَرَةُ لِلْمُسْلِمِ هَذَا يَهُودِيٌّ تَحْتِي فَاقْتُلْهُ

"এরপর আল্লাহ মুসলমানদেরকে দাজ্জালের ওপর বিজয় দান করবেন। মুসলমানরা তাকে এবং তার বাহিনীকে হত্যা করবে। এমনকি একজন ইহুদি যদি গাছ বা পাথরের পেছনে লুকিয়ে থাকে, সেটি মুসলমানকে ডেকে বলবে, তাকে হত্যা করো।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

ওই সময় গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদের আশ্রয়স্থল হবে [إِلَّا الْغَرْقَدَ فَإِنَّهُ مِنْ شَجَرِ الْيَهُودِ, সহীহ মুসলিম]।

Note : ইহুদিদের ওপর ইতিহাসের কিছু অপরিশোধিত রক্তের ঋণ রয়ে গেছে। ঈসা আ. এবং মুসলমানদের হাতে আল্লাহ সেসব ঋণ পরিশোধ করবেন। এখানে এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না।

এরপর ইমাম মাহদীর কী হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে যেহেতু তাঁর সাত বছরের খেলাফতের প্রায় সবটুকুই ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়ে যাবে, তাই ধারণা করা যায় তিনি শীঘ্রই ইন্তেকাল করবেন।

মহাযুদ্ধ শেষ করে অস্ত্র তুলে রাখার আগেই আরেক মহা ফিতনা আবির্ভূত হবে। সেই ফিতনার নাম ইয়াজুজ-মাজুজ।

ইয়াজুজ মাজুজ সংক্রান্ত আলোচনার পূর্বে একটি মূলনীতি জেনে নেয়া খুব জরুরি। সেটি হলো, আমাদের কাছে ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের একমাত্র নিশ্চিত উৎস (Source) হচ্ছে কুরআন এবং হাদিস। আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর রাসূল ﷺ থেকে ইলমে গায়েব সংক্রান্ত যে তথ্য আসবে, সবই গ্রহণযোগ্য। চাই আমাদের বোধগম্য হোক কিংবা না হোক। এ দুটি সূত্র ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে ইলমে গায়েব সম্পর্কে কোনো তথ্য আসলে সেটির নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। সত্য হতে পারে, না ও হতে পারে।

বলার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের প্রাথমিক যুগের তাফসির শাস্ত্রে ইহুদি-খ্রিস্টানদের কিছু লোকাচার বা জনশ্রুতি (Folklore) প্রবেশ করেছিল, যা আজও বিদ্যমান। এগুলোকে الإسرائيليات বলা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের কতিপয় মুফাসসির অতীতের ঘটনাবলী এবং ভবিষ্যত সংক্রান্ত ইলমে গায়েবকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এসব ইসরাইলি জনশ্রুতির আশ্রয় নিয়েছেন। এসব লোকাচার বা জনশ্রুতির মধ্যে কিছু তো অবশ্যই সত্য, আবার কিছু ভিত্তিহীনও রয়েছে। তাই কোনো প্রাচীন কিতাবে ইলমে গায়েব সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া গেলেই সেটি কুরআন-সুন্নাহ'র মতো অকাট্য হয়ে যায় না। বরং কুরআন-হাদিসের আলোকে এটি পরখ করতে হয়।

উল্লেখ্য যে, আমাদের প্রসিদ্ধ হাদিস শাস্ত্র এবং ফিকহ শাস্ত্র এসব লোকাচার থেকে মুক্ত।

ইয়াজুজ মাজুজের আলোচনায় এ মূলনীতি কাজে লাগবে। যদিও ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, তথাপি সংখ্যায় সেগুলো কম। বাদবাকি বেশিরভাগ তথ্যই হয় লোকাচার থেকে প্রাপ্ত, নয়তো উদ্ভট অনুমান।

ইয়াজুজ মাজুজের ব্যাপারে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা বলেছেনঃ

حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِن دُونِهِمَا قَوْمًا لَّا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا قَالُوا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَىٰ أَن تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا

"যখন সে (যুলকারনাইন) দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছালো তখন এমন এক জাতিকে পেল, যারা তার কথা তেমন বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা কি আপনাকে কিছু অর্থ দেব, যেন আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেন?" [সুরা কাহাফ : ৯৩-৯৪]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ

حَتَّىٰ إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ

"এমনকি যখন ইয়াজুজ ও মাজুজকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উঁচু স্থান হতে ছুটে আসবে।" [সুরা আম্বিয়া : ৯৬]

যায়নাব বিনতে জাহাশ রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বৃত্ত বানিয়ে বললেনঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ

"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ধ্বংস আরবের জন্য! এমন এক অকল্যাণ থেকে, যা নিকটবর্তী হয়েছে। আজ ইয়াজুজ ও মাজুজের প্রাচীর এতোটুকু খুলে গেছে।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

প্রশ্ন আসে- ইয়াজুজ মাজুজ (বাইবেলের ভাষায় Gog and Magog) কারা? যুলকারনাইন কে?

ইয়াজুজ মাজুজ আদম সন্তান, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। তাদের বংশধারা সম্বন্ধে বহু কথাবার্তা রয়েছে। একটি রায় হচ্ছে, তারা নূহ আলাইহিস সালামের পুত্র ইয়াফিস এর বংশধর [ইবনে হাজার]। সর্বদিক বিবেচনায় এ মতটি অধিক যৌক্তিক।

নূহ আ. এর চার পুত্র ছিলেন। সাম, হাম, ইয়াফিস এবং কিনান। কিনান কাফির অবস্থায় মহাপ্লাবনে ডুবে মারা যায়। বাকি তিন পুত্র থেকে পরবর্তী পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এসেছে। এ ব্যাপারে কুরআনে একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেছেনঃ

وَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ

"আর আমি তাকে (নূহ) এবং তার পরিবারকে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করেছিলাম। এবং তার বংশধরদেরকে অবশিষ্ট রেখেছিলাম।" [সুরা সাফফাত : ৭৬-৭৭]

বলা হয়, আরব এবং ইহুদিরা সামের বংশধর (সেমেটিক), আফ্রিকান জনগোষ্ঠী হামের বংশধর এবং তুর্কসহ বৃহত্তর ককেশীয় জনগোষ্ঠী ইয়াফিসের বংশধর [ইবনে কাসির]। ইয়াফিসের বংশধরদের মধ্যে দুটি গোত্র হচ্ছে ইয়াজুজ এবং মাজুজ। এরা বর্বর, অসভ্য, বিশৃঙ্খল- এক কথায় Subhuman.

যুলকারনাইন কে ছিলেন, এ নিয়েও নানা মতামত রয়েছে। কেউ তাঁকে নবী বলেছেন। কারো মতে, তিনি মেসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার। কেউ বলেছেন, পারস্য সম্রাট সাইরাস। কেউ বলেছেন, পারস্য সম্রাট ডেরিয়াস।

প্রথম তিনটি রায় অযৌক্তিক। প্রথমত, যুলকারনাইন নবী হওয়ার ব্যাপারে কোথাও কোনো ইঙ্গিত নেই। দ্বিতীয়ত, আলেকজান্ডার এবং সাইরাস দুজনই ছিলেন মূর্তিপূজক। ওদিকে আল্লাহ যুলকারনাইনের প্রশংসা করেছেন। আর, আল্লাহ কখনও মুশরিকদের প্রশংসা করেন না। তবে ডেরিয়াসের ব্যাপারে অনেকে বলেছেন যে, তিনি একত্ববাদে (তাওহীদ) বিশ্বাসী ছিলেন। হতে পারে, আল্লাহু আ'লাম।

আল্লাহু আ'লাম, আমাদের কাছে মনে হয়, যুলকারনাইন একজন প্রাগৈতিহাসিক (Prehistoric) চরিত্র। অর্থাৎ তিনি ওই সময়ের মানুষ, যখনকার ইতিহাস আমাদের কাছে সংরক্ষিত নেই। আমাদের কাছে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার হাজার বছরের বিস্তারিত ইতিহাস বিদ্যমান। কিন্তু মানবজাতির বয়স তারচেয়ে অনেক বেশি।

এতটুকু নিশ্চিত যে, তিনি একজন প্রতাপশালী ন্যায়পরায়ণ মুসলিম (একত্ববাদী) সম্রাট ছিলেন। বিশ্বভ্রমণে বের হয়ে তিনি এক জাতির কাছে গিয়েছিলেন, যারা ইয়াজুজ মাজুজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। যুলকারনাইন লৌহস্তুপ এবং গলিত তামা দ্বারা একটি শক্ত দেয়াল তুলে ইয়াজুজ মাজুজকে ওই জাতি থেকে আলাদা করে দিয়েছিলেন [ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির]।

ইয়াজুজ মাজুজের জনসংখ্যার ব্যাপারে হাদিসে একটি ধারণা পাওয়া যায়। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ আদম আ.-কে বলবেন, হে আদম! তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে জাহান্নামিদের তুলে আনো। আদম বলবেন, হে আল্লাহ! এরা কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে নয়শ নিরানব্বই জন। সাহাবিরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আমাদের কী সম্ভাবনা রইল? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ

أَبْشِرُوا فَإِنَّ مِنْ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ أَلْفًا وَمِنْكُمْ رَجُلٌ

"সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের একজনের অনুপাতে ইয়াজুজ ও মাজুজ হবে এক হাজার।" [মুত্তাফাকুন আলাইহি]

তাহলে বুঝা যায়, সাধারণ একজন মানব সন্তানের অনুপাতে ইয়াজুজ মাজুজের সংখ্যা হচ্ছে এক হাজার! প্রশ্ন আসে, এই বিপুলসংখ্যক রাক্ষুসে জনগোষ্ঠী কোথায় আছে? পৃথিবীপৃষ্ঠে এমন কোন জায়গা আছে, যেখানে এতো মানুষ (!) বন্দী অবস্থায় পড়ে আছে, আর আমরা কেউই জানিনা? কিভাবে বুঝব বিষয়টিকে?

ইয়াজুজ মাজুজের অবস্থান সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। ভৌগলিকভাবেও কেউ এর নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম নন। আমাদের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতিকে ইয়াজুজ মাজুজের তকমা দেয়া হয়েছে। যেমন তুর্ক, মোঙ্গল, চায়নিজ, স্লাভ, দায়লাম ইত্যাদি। যুলকারনাইনের প্রাচীর নিয়েও নানা তত্ত্ব রয়েছে। অনেকে বলেছেন, চীনের মহাপ্রাচীর। একটি বর্ণনামতে, এটি আর্মেনিয়ার আজারবাইজানের মধ্যখানে। কেউ বলেছেন, জর্জিয়া দাগেস্থান এলাকায়। কেউ বলেছেন, তাজিকিস্তানে। কেউ বলেছেন, প্রাচীরটি পানিতে তলিয়ে গেছে। [ইমাম তাবারী, কুরতুবী, মাহমুদ আলুসী, ইবনে কাসির, ইবনে খালদুন, মাওলানা সিওহারবি]

এমনকি একটি রায় হচ্ছে, ওরা মাটির নিচে বাস করে।

প্রথমত, যারা বলেন ইয়াজুজ মাজুজ মাটির নিচে, তাঁরা সম্ভবত রূপকথার গল্প থেকে এ তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। কারণ ইয়াজুজ মাজুজ সাপ, ব্যাঙ বা ইঁদুর নয়; মানুষ। যুলকারনাইন ওদেরকে প্রাচীর দিয়ে আলাদা করেছিলেন। মাটির নিচে পুঁতে ফেলেননি।

দ্বিতীয়ত, যারা চীন-মোঙ্গল ইত্যাদি জাতিকে ইয়াজুজ মাজুজ বলেন, তাদের যুক্তি হচ্ছে, ইয়াজুজ মাজুজের সাথে এসব জাতির চেহারার মিল রয়েছে। খালিদ ইবনে হারমালা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

عراض الوجوه صغار العيون صهب الشعاف ومن كل حدب ينسلون كأن وجوههم المجان المطرقة

"ওদের মুখ চ্যাপ্টা, চোখ ছোট, চুল লালচে-কালো। তারা প্রত্যেক উঁচু জায়গা থেকে ছুটে বের হবে। তাদের মুখমণ্ডল যেন চামড়া লেপিত ঢালের মতো।" [মুসনাদ ইমাম আহমদ]

আমাদের কথা হচ্ছে, কেবল অবয়ব মিলে যাওয়ার কারণে কোনো জাতিকে ইয়াজুজ মাজুজ বলা যুক্তিসংগত নয়। মুফতি মুহাম্মদ শফী বলেছেন, "মোঙ্গলদেরকে ইয়াজুজ মাজুজের জ্ঞাতিগোষ্ঠী বলা যেতে পারে। তবে এরাই (আসল) ইয়াজুজ মাজুজ নয়।"

এছাড়া, চীনের মহাপ্রাচীর যুলকারনাইন তৈরি করেননি। তৈরি করেছেন সম্রাট Qin Shi Huang, ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এটি ইট-পাথর দিয়ে তৈরি; লৌহ-তামা দিয়ে নয়। সবচেয়ে বড় কথা, চীনের প্রাচীর চীনাদেরকে আটকিয়ে রাখার জন্য তৈরি করা হয়নি। বরং বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

তৃতীয়ত, যারা ইয়াজুজ মাজুজের বাসস্থান বলতে ককেশীয় পর্বতমালা, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, দাগেস্থান ইত্যাদি এলাকাকে অর্থ করেন, তাঁদের দলিল হচ্ছে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত بَيْنَ السَّدَّيْن শব্দটি। অর্থাৎ, যুলকারনাইন দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস রা.'র একটি রায় উল্লেখ করা হয়, যার সনদ অনির্ণীত।

আমাদের কথা হচ্ছে, আয়াতের ইঙ্গিত থেকে বৃহত্তর ককেশীয় পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলকে ইয়াজুজ মাজুজের বাসস্থান হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী এদের সংখ্যা কয়েকশ ট্রিলিয়ন! এতো মানুষ কোথায় আছে?

যুলকারনাইনের প্রাচীর সম্বন্ধে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি বলেছেন, "যারা বলেন, প্রাচীরের অস্তিত্ব নেই, তাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাচীর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হয়তো পাহাড়ধ্বস বা পাহাড়সারি পরস্পর মিলে যাওয়ার কারণে এটি পাহাড়ের রূপ নিয়েছে।" এ মতটি আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হয়।

প্রাচীরের অবস্থানের ব্যাপারে ককেশাস পর্বতমালার কথাই মাথায় আসে। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি সম্ভব। ককেশাস পর্বতমালা কৃষ্ণ সাগর (Black Sea) থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর (Caspian Sea) পর্যন্ত বিস্তৃত ১২শ কি.মি দৈর্ঘের এক বিশাল পর্বতমালা। হয়তো যুলকারনাইন এ পর্বতমালার দুটি পাহাড়ের মধ্যখানে প্রাচীর তুলেছিলেন।

আমাদের ধারণা, যুলকারনাইন যাদেরকে বন্দী করেছিলেন, তারা বৃহত্তর ইয়াজুজ মাজুজ জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল। ওরা আজও মানব সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেখানে পড়ে আছে। এ জাতিগোষ্ঠীর অন্যান্য অংশ মানব সমাজেই বসবাস করে, যাদের স্বভাব চরিত্র (বন্দী) ইয়াজুজ মাজুজ থেকে কিছুটা সভ্য। হাদিসে এসেছে, বন্দী ইয়াজুজ মাজুজ প্রতিদিন প্রাচীর খনন করে। কিন্তু পরদিন এসে দেখে সেটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কিয়ামতের পূর্বে সে দেয়াল খুলে যাবে [তিরমিযি, ইবনে মাজাহ]। এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে কিছু আদিম (Primitive) জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে, যারা এখনও মানব সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

এর পরও প্রশ্ন থেকে যায় ইয়াজুজ মাজুজের বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা দুটি সম্ভাবনা দেখি।

১. হয়তো আমরা ইয়াজুজ মাজুজের সংখ্যা বিষয়ক (গত পর্বে উল্লেখিত) হাদিসটি আক্ষরিক অর্থে নেব এবং বলব, এদের প্রকৃত সংখ্যা এবং অবস্থান আল্লাহ ভালো জানেন।

২. নয়তো ধরে নেব, সংখ্যাধিক্য বুঝানোর জন্য রাসূল ﷺ রূপক অর্থে কথা বলেছেন। আল্লাহু আ'লাম।

এবার আসি ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনার দিকে। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِذْ أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى إِنِّي قَدْ أَخْرَجْتُ عِبَادًا لِي لاَ يَدَانِ لأَحَدٍ بِقِتَالِهِمْ فَحَرِّزْ عِبَادِي إِلَى الطُّورِ وَيَبْعَثُ اللَّهُ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ فَيَمُرُّ أَوَائِلُهُمْ عَلَى بُحَيْرَةِ طَبَرِيَّةَ فَيَشْرَبُونَ مَا فِيهَا وَيَمُرُّ آخِرُهُمْ فَيَقُولُونَ لَقَدْ كَانَ بِهَذِهِ مَرَّةً مَاءٌ وَيُحْصَرُ نَبِيُّ اللَّهُ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ حَتَّى يَكُونَ رَأْسُ الثَّوْرِ لأَحَدِهِمْ خَيْرًا مِنْ مِائَةِ دِينَارٍ لأَحَدِكُمُ الْيَوْمَ

"তখন আল্লাহ ঈসা আ.-কে এ মর্মে ওহী পাঠাবেন যে, আমি আমার একধরণের সৃষ্টি বের করতে যাচ্ছি, যাদেরকে মোকাবেলা করার শক্তি কারও নেই। তুমি আমার (মুসলিম) বান্দাদেরকে নিয়ে তুর পর্বতে চলে যাও। আল্লাহ তখন ইয়াজুজ ও মাজুজকে পাঠাবেন, যারা প্রত্যেক উঁচু স্থান হতে ছুটে আসবে। ওদের সামনের অংশ তাবারিয়া হ্রদে (Sea of Galilee) পৌঁছে সব পানি পান করে ফেলবে। পেছনের অংশ এসে (হ্রদের শুষ্কতা দেখে) বলবে, এক সময় হয়তো এখানে পানি ছিল। ঈসা আ. এবং তাঁর অনুসারীরা তুর পর্বতে এমনভাবে অবরুদ্ধ থাকবেন যে, (ক্ষুধার তাড়নায়) তখন একটি মৃত ষাঁড়ের মাথা তাঁদের কাছে একশ স্বর্ণমুদ্রার চেয়ে বেশি মূল্যবান হবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

পৃথিবীজুড়ে ইয়াজুজ মাজুজের তাণ্ডবলীলা চলতে থাকবে। সামনে যা আসবে, সব তারা ধ্বংস করে দেবে। এটি এতো বড় বিপর্যয় যে, আল্লাহ মুসলমানদেরকে এ বিপর্যয় চোখে দেখা থেকেও হেফাযত করবেন।

পৃথিবীজুড়ে ধ্বংসলীলা চালানোর পর ইয়াজুজ মাজুজ আসমানের দিকে তীর ছুড়বে। আল্লাহর নির্দেশে রক্তমাখা তীর তাদের দিকে ফিরে আসবে। তারা বলবে, "পৃথিবীবাসীর পর আসমানবাসীকেও আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি" [সহীহ মুসলিম, মুসতাদরাক ইমাম হাকিম]।

এক সময় আল্লাহ এ বিপর্যয়ের ইতি টানবেন। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَيَرْغَبُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ فَيُرْسِلُ اللَّهُ عَلَيْهُمُ النَّغَفَ فِي رِقَابِهِمْ فَيُصْبِحُونَ فَرْسَى كَمَوْتِ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ يَهْبِطُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ إِلَى الأَرْضِ فَلاَ يَجِدُونَ فِي الأَرْضِ مَوْضِعَ شِبْرٍ إِلاَّ مَلأَهُ زَهَمُهُمْ وَنَتْنُهُمْ فَيَرْغَبُ نَبِيُّ اللَّهِ عِيسَى وَأَصْحَابُهُ إِلَى اللَّهِ فَيُرْسِلُ اللَّهُ طَيْرًا كَأَعْنَاقِ الْبُخْتِ فَتَحْمِلُهُمْ فَتَطْرَحُهُمْ حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ يُرْسِلُ اللَّهُ مَطَرًا لاَ يَكُنُّ مِنْهُ بَيْتُ مَدَرٍ وَلاَ وَبَرٍ فَيَغْسِلُ الأَرْضَ حَتَّى يَتْرُكَهَا كَالزَّلَفَةِ ثُمَّ يُقَالُ لِلأَرْضِ أَنْبِتِي ثَمَرَتَكِ وَرُدِّي بَرَكَتَكِ

"নবী ঈসা আ. এবং তাঁর অনুসারীরা আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। আল্লাহ তখন এক ধরণের সংক্রমণ (Myiasis) পাঠাবেন, যা ইয়াজুজ মাজুজের ঘাড়ে আক্রান্ত করবে। তারা সবাই এক ব্যক্তির মতো (একসাথে) মারা যাবে। ঈসা আ. এবং তাঁর অনুসারীরা নেমে এসে পঁচা লাশ ও তীব্র দুর্গন্ধ ছাড়া এক বিঘত জায়গাও খালি পাবেন না। তাঁরা আবার আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। আল্লাহ উটের ঘাড়ের মতো লম্বা গলার এক ধরণের পাখি প্রেরণ করবেন, যারা লাশগুলো বহন করে নিয়ে ফেলে দেবে, যেখানে আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এরপর আল্লাহ মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, যার থেকে কাঁচা-পাকা কোনো গৃহ বাকি রইবেনা। এতে পৃথিবী ধৌত হয়ে উদ্ভিদশূন্য মৃত্তিকায় পরিণত হবে। এরপর আল্লাহ মাটিকে আদেশ দেবেন, "তোমার ফসল উৎপন্ন করো এবং তোমার সব বারাকাত ফিরিয়ে দাও।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনা শেষ হওয়ার পর পৃথিবী আবার শস্য-শ্যামল অবস্থায় ফিরে যাবে। খাদ্যদ্রব্যে এমন বারাকাত হবে যে, একটি আনার দিয়ে এক দল মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করা যাবে। একটি গাভী বা উটের দুধ বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে [সহীহ মুসলিম]। মানুষের ওপর সুখ-শান্তির জানালা খুলে যাবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَاللَّهِ لَيَنْزِلَنَّ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَادِلاً... وَلَتَذْهَبَنَّ الشَّحْنَاءُ وَالتَّبَاغُضُ وَالتَّحَاسُدُ وَلَيَدْعُوَنَّ إِلَى الْمَالِ فَلاَ يَقْبَلُهُ أَحَدٌ

"আল্লাহ মারইয়ামের পুত্রকে (ঈসা) ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে প্রেরণ করবেন। তখন মানুষের মধ্য থেকে সব হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা দূর হয়ে যাবে। মানুষকে সম্পদ গ্রহণ করার জন্য ডাকা হবে, কিন্তু (যেহেতু সবার কাছে থাকবে) কেউ তা গ্রহণ করবে না।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ঈমান]

উম্মত আবার ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হবে। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لَيُحَجَّنَّ الْبَيْتُ وَلَيُعْتَمَرَنَّ بَعْدَ خُرُوجِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ

"ইয়াজুজ মাজুজের পরও তোমরা অবিরত হজ-উমরাহ পালন করতে থাকবে।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল হাজ্জ]

এটি আল্লাহর নীতি। আল্লাহ বলেছেন, "কষ্টের সাথে সুখ রয়েছে" [সুরা ইনশিরাহ : ৫]। যারা এতোদিন পর্যন্ত মহাযুদ্ধ, দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনার মধ্যেও ধৈর্য এবং ত্যাগের সাথে ঈমান টিকিয়ে রেখেছিল, আজ তাঁদের নিয়ামত প্রাপ্তির পালা। আর আল্লাহ যখন নিয়ামত দেন, তখন নিয়ামতের সমুদ্রই দিয়ে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম করুণাময়, দয়ালু।

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ যে আদর্শ, যে ন্যায়নীতি, যে শান্তি ও মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, সে দীন 'ইসলাম' তখন সারা পৃথিবীজুড়ে পূর্ণতার সাথে প্রতিষ্ঠিত হবে। এরপর আল-মাসীহ আল-সিদ্দীক সায়্যিদুনা ঈসা ইবনে মারইয়াম রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম পৃথিবীকে বিদায় জানাবেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَيُهْلِكُ اللَّهُ فِي زَمَانِهِ الْمِلَلَ كُلَّهَا إِلاَّ الإِسْلاَمَ وَيُهْلِكُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ فَيَمْكُثُ فِي الأَرْضِ أَرْبَعِينَ سَنَةً ثُمَّ يُتَوَفَّى فَيُصَلِّي عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ

"আল্লাহ সে সময় ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম বিলুপ্ত করে দেবেন। ঈসা আ. দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং পৃথিবীতে চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। এরপর তিনি ইন্তেকাল করবেন। মুসলমানরা তাঁর জানাযার নামাজ আদায় করবে।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

সুপ্রসিদ্ধ 'মিশকাতুল মাসাবীহ' কিতাবে ইবনে উমর রা.'র সূত্রে একটি বর্ণনা আছে যে, ঈসা আ.-কে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর রাওদ্বা শরীফে দাফন করা হবে। শায়খ আবদুল হক দেহলভী বলেছেন, রাওদ্বা শরীফে একটি কবরের জায়গা এখনো খালি আছে।

এক সময় আসবে মুসলমানদের বিদায়ের পালা। নাওয়াস ইবনে সাম'আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ بَعَثَ اللَّهُ رِيحًا فَقَبَضَتْ رُوحَ كُلِّ مُؤْمِنٍ وَيَبْقَى سَائِرُ النَّاسِ يَتَهَارَجُونَ كَمَا تَتَهَارَجُ الْحُمُرُ فَعَلَيْهِمْ تَقُومُ السَّاعَةُ

"তারা সুখ-শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকাকালীন আল্লাহ একটি সুবাতাস প্রেরণ করবেন, যা প্রত্যেক ঈমানদারের রূহ কবয করে নেবে। বাকি থাকবে এমন লোক, যারা গাধার মতো জনসম্মুখে পাপাচারিতা করবে। এদের ওপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।" [সহীহ মুসলিম, সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান]

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ يَذْهَبُ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ حَتَّى تُعْبَدَ اللاَّتُ وَالْعُزَّى. فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ كُنْتُ لأَظُنُّ حِينَ أَنْزَلَ اللَّهُ ‏"هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ‏" أَنَّ ذَلِكَ تَامًّا قَالَ ‏إِنَّهُ سَيَكُونُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ رِيحًا طَيِّبَةً فَتَوَفَّى كُلَّ مَنْ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ فَيَبْقَى مَنْ لاَ خَيْرَ فِيهِ فَيَرْجِعُونَ إِلَى دِينِ آبَائِهِمْ

"রাত-দিনের সমাপ্তি ঘটবেনা, যতক্ষণ না লাত-উযযা (মূর্তি) আবার পূজিত হবে। তখন আমি (আয়েশা) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন- "তিনি সেই সত্ত্বা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত এবং সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন। যেন তিনি একে সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা এটি অপছন্দ করে"- তখন আমি ভেবেছিলাম এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে। রাসূল ﷺ বললেন, সেটি হবে এবং যতদিন আল্লাহ ইচ্ছা করেন ততদিন (দীন) বহাল থাকবে। এরপর আল্লাহ একটি সুবাতাস প্রেরণ করবেন, যার দ্বারা ন্যুনতম ঈমানদাররাও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। এরপর এমন লোক বাকি থাকবে, যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কল্যাণ নেই। তারা আবার পিতৃপুরুষের (কুফরি) ধর্মে ফিরে যাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

সে সময় কিয়ামতের অন্যান্য বড় আলামত দ্রুত প্রকাশ পাওয়া শুরু করবে। তবে সেসব (বাকি ৭টি) আলামতের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত যেমন কম, এগুলোর অনুক্রম (Sequence) নির্ধারণ করাও তেমন দুঃসাধ্য।

আল্লাহু আ'লাম, আমাদের ধারণা, বাকি আলামতের মধ্যে الدُخَان বা ধোঁয়া প্রথমে প্রকাশিত হবে। আল্লাহ বলেছেনঃ

فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُّبِينٍ يَغْشَى النَّاسَ هَٰذَا عَذَابٌ أَلِيمٌ

"বেশ তো! তাহলে অপেক্ষা করো সেই দিনের, যে দিন আকাশ দৃশ্যমান ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। যা মানুষকে আবৃত করে ফেলবে। এটি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" [সুরা দুখান : ১০-১১]

হতে পারে, এ ধোঁয়া আসমানি গযব। আবার হতে পারে যে, মহাযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ মারণাস্ত্র ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া বিষাক্ত ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। যেভাবেই দেখি, এটি আল্লাহর আযাব, এতে সন্দেহ নেই।

কিয়ামতের বড় আলামতের মধ্যে তিনটি আলামত হচ্ছে তিনটি خَسْفٌ বা ভূমিধ্বস। একটি পূর্বদিকে, একটি পশ্চিম দিকে, একটি জাযিরাতুল আরবে [সহীহ মুসলিম]। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يَكُونُ فِي آخِرِ هَذِهِ الأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ

এ উম্মতের শেষদিকে ভূমিধ্বস, অবয়ব বিকৃতি এবং পাথরবৃষ্টি হবে।" [সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান]

একের পর এক ভূমিকম্পের ফলে এসব ভূমিধ্বস হবে। বলাই বাহুল্য, এসব Cataclysmic ভূমিকম্পের বিধ্বংসী শক্তি আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

কিয়ামতের বড় আলামতের মধ্যে একটি হচ্ছে طلوع الشمس من مغربها বা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ বলেছেনঃ

يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِن قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا

"যেদিন আপনার প্রতিপালকের কিছু নিদর্শন আসবে, সেদিন কোনো ব্যক্তির ঈমান ফলপ্রসূ হবে না, যদি না সে আগে থেকে ঈমান আনে অথবা ঈমান অনুযায়ী সৎকর্ম করে।" [সুরা আন'আম : ১৫৮]

হাদিসে এ বিষয়টি আরও বিশদভাবে বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا فَإِذَا طَلَعَتْ فَرَآهَا النَّاسُ آمَنُوا أَجْمَعُونَ فَذَلِكَ حِينَ لاَ يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। যখন মানুষ এ দৃশ্য দেখবে, তখন সবাই ঈমান আনবে। কিন্তু তখন কোনো ব্যক্তির ঈমান ফলপ্রসূ হবে না, যদি না সে আগে থেকে ঈমান আনে অথবা ঈমান অনুযায়ী সৎকর্ম করে।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুর রিকাক]

তাহলে বুঝা যায়, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হচ্ছে মহাবিশ্বের বিদায়ঘন্টা। এরপর (নতুন) ঈমান বা আমল কিছুই কবুল হবে না। এমনকি তাওবার দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ

"যে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে তাওবা করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুয যিকর ওয়াদ-দুআ]

প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হওয়া কিভাবে সম্ভব?

জবাব হচ্ছে, আমরা জানি সূর্য একটি নক্ষত্র (Star), যাকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত কক্ষপথে ঘুরছে আমাদের সৌরজগত (Solar System)। আল্লাহ বলেছেনঃ

وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ

"সূর্য পরিভ্রমণ করে নির্ধারিত কক্ষপথে। এটি মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহর) নির্ধারণ করে দেয়া। আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি স্তরসমূহ। অবশেষে এটি খেজুরের শুষ্ক পুরাতন শাখার মতো হয়ে যায়।" [সুরা ইয়াসিন : ৩৮-৩৯]

এরকম কয়েক মিলিয়ন সৌরজগত ধারণ করে অনবরত ঘুরছে আমাদের ছায়াপথ Milky Way Galaxy, যেখানে রয়েছে সূর্যের চেয়ে বহুগুণ বড় বড় নক্ষত্র। আল্লাহ বলেছেনঃ

كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

"সবকিছু মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করছে।" [সুরা আম্বিয়া : ৩৩]

এরকম অন্তত একশ বিলিয়ন ঘূর্ণায়মান ছায়াপথ (Galaxy) নিয়ে গঠিত আমাদের মহাবিশ্ব (Observable Universe)। নির্ধারিত নিয়মে এগুলো চলে, আবার নির্ধারিত নিয়মেই একে অন্যের সাথে সংঘর্ষিত (Galactic Collision) হয়। দ্রুতবেগে ছুটে আসা একটি গ্রহাণুর (Asteroid) সাথে ধাক্কা লেগে একটি গ্রহের কক্ষপথ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। মহাবিশ্বের সুদীর্ঘ ১৩.৭ বিলিয়ন বছর (আনুমানিক) বয়সকালে কতশত Galaxy একে অন্যের সাথে সংঘর্ষের ফলে একত্রে মিশে গেছে, কতশত নক্ষত্র Black Hole বা কৃষ্ণগহ্বরের পেটে বিলীন হয়ে গেছে, তার কোনো হিসেব নেই। আল্লাহ বলেছেনঃ

فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَّوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ

"আমি শপথ করছি নক্ষত্ররাজি বিলীন হওয়ার স্থানের। অবশ্যই এটি একটি মহা-শপথ, যদি তোমরা জানতে।" [সুরা ওয়াকিয়া : ৭৫-৭৬]

অতএব, যে আল্লাহ অগণিত নক্ষত্র এবং অজস্র ছায়াপথকে একে অন্যের মাঝে ধ্বসিয়ে দিতে পারেন, তাঁর পক্ষে সামান্য সূর্যের কক্ষপথ পরিবর্তন করা কি কঠিন বিষয়? নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

এর পরের আলামত হচ্ছে دابة الأرض বা ভূগর্ভস্থ জন্তু। কিয়ামতের ঠিক পূর্বে ভূগর্ভ থেকে একটি জন্তু বের হবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ

وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ

"আর যখন প্রতিশ্রুতি (কিয়ামত) সমাগত হবে, তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি জন্তু বের করব। সে মানুষের সাথে কথা বলবে।" [সুরা নামল : ৮২]

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إِنَّ أَوَّلَ الآيَاتِ خُرُوجًا طُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَخُرُوجُ الدَّابَّةِ عَلَى النَّاسِ ضُحًى وَأَيُّهُمَا مَا كَانَتْ قَبْلَ صَاحِبَتِهَا فَالأُخْرَى عَلَى إِثْرِهَا قَرِيبًا

"প্রথম নিদর্শন হলো পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় এবং পূর্বাহ্নে একটি ভূগর্ভস্থ জন্তুর আবির্ভাব। এর মধ্যে যেটি আগে হবে, পরক্ষণেই এর পরেরটি প্রকাশ পাবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

এ ভূগর্ভস্থ জন্তুটি মক্কা শরীফ থেকে বের হবে [তাফসির ইবনে কাসির]। কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত পূর্বাপর বিষয়বস্তু সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় এবং ভূগর্ভস্থ জন্তুর আবির্ভাব কিয়ামতের একেবারে নিকটবর্তী সময়ের আলামত। বর্তমান যুগের বহু আলিম এ মত পোষণ করেছেন। আমাদেরও তাই মনে হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এ জন্তুর ব্যাপারে আর কিছুই বলেননি। তবে কতিপয় সাহাবির সূত্রে কয়েকটি মাওকুফ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন আবু হুরায়রা রা.'র মতে, জন্তুটি রঙ-বেরঙের হবে। এর দুই শিংয়ের দূরত্ব হবে দীর্ঘ। ইবনে আব্বাস রা.'র মতে, জন্তুটি প্রকাণ্ড কোঁচের মতো। আলী রা.'র ভাষ্যমতে, এটি লোমশ ভাল্লুকের মতো খুরবিশিষ্ট। একটি বর্ণনামতে, জন্তুটি মুমিন ও কাফিরকে পৃথকভাবে মোহরাঙ্কিত করবে।

বলে রাখি, সাহাবায়ে কেরাম আমাদের কাছে সত্য-ন্যায়ের মাপকাঠি। তাঁদের মতামত নির্দ্বিধায় গ্রহণযোগ্য। কিন্তু উপরিউক্ত বর্ণনাগুলো আমাদের কাছে যথার্থ মনে হচ্ছে না। প্রথমত, এ বর্ণনাগুলোর সনদ তথা সূত্র অনির্ণীত। দ্বিতীয়ত, এগুলো হাদিসের প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে জায়গা পায়নি। বিভিন্ন তাফসিরের কিতাবে বিচ্ছিন্ন (মুনকাতি') সনদে এসেছে। তৃতীয়ত, বর্ণনাগুলো অস্বচ্ছ এবং পরস্পর বিপরীতমুখী। তাই, আল্লাহু আ'লাম, আমাদের ধারণা এগুলো সাহাবিদের বর্ণনা নয়। বরং কেউ বা কারা এগুলো তৈরি করে সাহাবিদের নাম সংযুক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহু আ'লাম।

কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত হচ্ছে আগুন। হুযায়ফা ইবনে উসাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَآخِرُ ذَلِكَ تَخْرُجُ نَارٌ مِنَ الْيَمَنِ مِنْ قَعْرِ عَدَنَ تَسُوقُ النَّاسَ إِلَى الْمَحْشَر

"সব শেষে ইয়েমেনের আদন এলাকার নিচু ভূমি থেকে একটি আগুন বের হবে, যা মানুষকে জড়ো হওয়ার স্থানে তাড়িয়ে নেবে।" [সহীহ মুসলিম, সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুল মালাহিম]

প্রশ্ন আসে- জড়ো হওয়ার স্থান কোনটি? জবাব হাদিসে দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

سَتَخْرُجُ نَارٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ أَوْ مِنْ نَحْوِ حَضْرَمَوْتَ قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ تَحْشُرُ النَّاسَ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ عَلَيْكُمْ بِالشَّامِ

"কিয়ামতের পূর্বক্ষণে হাদ্বরামাউত বা এদিকের কোনো এলাকা থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে জড়ো করবে। আমি (আবু হুরায়রা) বললাম, আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি ﷺ বললেন, তোমাদের জন্য রইল শাম।" [সুনান আত-তিরমিযি ; কিতাবুল ফিতান]

এ দুটি হাদিস থেকে আমরা যে সম্ভাবনা দাঁড় করিয়েছি, তা হলো, কিয়ামতের ঠিক পূর্বক্ষণে ইয়েমেনের এডেন বা হাদ্বরামাউত এলাকা থেকে একটি প্রকাণ্ড অগ্নুৎপাত সৃষ্টি হবে। ততদিনে একাধিক মহাযুদ্ধ এবং ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনায় বেশুমার লোক নিহত হয়েছে। মুসলমানরা ইতিপূর্বেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পরপর তিনটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিধ্বসের ফলেও নিশ্চিতভাবে অগণিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাই এ অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে একেবারে কম। যারা থাকবে, তারা আগুন দেখে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে করতে শাম তথা বৃহত্তর সিরিয়ায় গিয়ে জড়ো হবে। এটিই হবে পৃথিবীতে মানবজাতির সর্বশেষ সম্মেলন। কারণ, সময় শেষ।

অগ্নুৎপাতের ফলে মানবজাতির শেষাংশ শামে গিয়ে জড়ো হবে। এই দুর্ভাগারাই মহাকালের সবচেয়ে ভয়াল ঘটনার সাক্ষী হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

مِنْ شِرَارِ النَّاسِ مَنْ تُدْرِكُهُمُ السَّاعَةُ وَهُمْ أَحْيَاءٌ ‏

"কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় সৃষ্টির সবচেয়ে খারাপ লোকেরা জীবিত থাকবে।" [সহীহ বুখারী ; কিতাবুল ফিতান]

একাধিকবার বলেছি, কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে কোনো ঈমানদার অবশিষ্ট থাকবে না [সহীহ মুসলিম]। প্রশ্ন আসে- তাহলে কি পৃথিবী থেকে আল্লাহর নামটিও উঠে যাবে? মুসলমানদের অবর্তমানে কা'বা শরীফের কী হবে? কোথায় থাকবে পবিত্র কুরআন?

জবাব হচ্ছে, এগুলোর কিছুই তখন অবশিষ্ট থাকবে না। না কুরআন, না কা'বা, না আল্লাহর যিকর। উঠিয়ে নেয়া হবে পবিত্র কুরআন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ

لَيُسْرَيَنَّ عَلَى الْقُرْآنِ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَلا يُتْرَكُ آيَةٌ فِي مُصْحَفٍ وَلا فِي قَلْبِ أَحَدٍ إِلا رُفِعَتْ

"এমতাবস্থায় এক রাতে কুরআন উঠিয়ে নেয়া হবে। ফলে মুসহাফে কিংবা মানুষের অন্তরে একটি আয়াতও অবশিষ্ট থাকবে না।" [সুনান আদ-দারেমী]

মুসলমানদের বিদায়ের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বাইতুল্লাহ শরীফ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يُخَرِّبُ الْكَعْبَةَ ذُو السُّوَيْقَتَيْنِ مِنَ الْحَبَشَةِ

"এক হাবশি ব্যক্তি কা'বা ধ্বংস করে দেবে, যার পায়ের নলি হবে ছোট ছোট।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাত্বিস সা'আহ]

স্বাভাবিকভাবেই তখন পৃথিবীতে আল্লাহর নাম মুখে নেয়ার মতো কেউ বাকি রইবে না। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِي الأَرْضِ اللَّهُ اللَّهُ

"কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে আল্লাহ আল্লাহ (যিকর) বন্ধ না হবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ঈমান]

কিয়ামত বলে কয়ে আসবে না। আকস্মিকভাবেই চলে আসবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

تَقُومُ السَّاعَةُ وَالرَّجُلُ يَحْلُبُ اللِّقْحَةَ فَمَا يَصِلُ الإِنَاءُ إِلَى فِيهِ حَتَّى تَقُومَ وَالرَّجُلاَنِ يَتَبَايَعَانِ الثَّوْبَ فَمَا يَتَبَايَعَانِهِ حَتَّى تَقُومَ وَالرَّجُلُ يَلِطُ فِي حَوْضِهِ فَمَا يَصْدُرُ حَتَّى تَقُومَ

"কিয়ামত এতো আকস্মিক হবে যে, এক লোক তার উষ্টীর দুধ দোহন করে দুধের পাত্র মুখের কাছে নেয়ার আগেই কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। দুই ব্যক্তি কাপড় ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু লেনদেন শেষ করার আগেই কিয়ামত হয়ে যাবে। এক লোক পানির হাউয মেরামত করতে থাকবে। মেরামত শেষ করার আগেই কিয়ামত হয়ে যাবে। [মুত্তাফাকুন আলাইহি, শব্দচয়ন সহীহ মুসলিম থেকে]

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিনটি হবে শুক্রবার। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ

"শুক্রবার ব্যতীত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল জুম'আ]

একই সাহাবি থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ إِلاَّ وَهِيَ مُسِيخَةٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ مِنْ حِينَ تُصْبِحُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ شَفَقًا مِنَ السَّاعَةِ إِلاَّ الْجِنَّ وَالإِنْسَ

"প্রতি শুক্রবার ভোর (সুবহে সাদিক) থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাণী কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে উৎকণ্ঠিত থাকে। কেবল মানুষ ও জিন ব্যতীত।" [সুনান আবি দাউদ ; কিতাবুস সালাহ]

এ হাদিসের আলোকে উলামায়ে কেরাম দাবী করেন, কিয়ামত সংঘটিত হবে শুক্রবার সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে।

তাহলে বুঝা যায়, মানবজাতির শেষাংশ শামে জড়ো হওয়ার পর আকস্মিকভাবে কোনো এক শুক্রবার প্রত্যূষে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা শিঙ্গা ফুঁকার নির্দেশ দেবেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ إِلا مَنْ شَاءَ اللَّه ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ

"শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। ফলে আসমান ও যমিনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ (মৃত) হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সে ব্যতীত। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে।" [সুরা যুমার : ৬৮]

শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার দায়িত্বে রয়েছেন ফেরেশতা ইসরাফিল আ.। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

إن طرف صاحب الصور منذ وكل به مستعد ينظر نحو العرش مخافة أن يؤمر قبل أن يرتد إليه طرفه

"শিঙ্গার দায়িত্বশীল (ইসরাফিল) দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তাঁর দৃষ্টি আরশের দিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এই ভয়ে যে, তিনি চোখের পলক ফেলার আগেই আল্লাহর আদেশ এসে যায় কি না!" [মুসতাদরাক ইমাম হাকিম]

শিঙ্গায় প্রথমবার ফুঁক দেয়ার সাথে সাথে সমগ্র সৃষ্টিকুল সজোরে কেঁপে উঠবে। আল্লাহ বলেছেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ

"হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার।" [সুরা হাজ্জ : ১]

কম্পনের ফলে ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে যাবে সবকিছু। আল্লাহ বলেছেনঃ

إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ

"যখন সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যাবে, যখন নক্ষত্ররাজি মলীন হয়ে পড়বে, যখন পর্বতমালা অপসারিত করা হবে।" [সুরা তাকভীর : ১-৩]

অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ

إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ وَإِذَا الْقُبُورُ بُعْثِرَتْ

"যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে, যখন তারকারাজি ঝরে পড়বে, যখন সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে, যখন কবরসমূহ উম্মোচিত করা হবে।" [সুরা ইনফিতার : ১-৪]

তবে জিবরাইল, ইসরাফিল, মিকাঈল, মালাকুল মাউত এবং আল্লাহর আরশবাহী ফেরেশতারা তখনও জীবিত থাকবেন। তাঁদের ওপর মৃত্যু আসবে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার পরে [তাফসির কুরতুবী]। তাঁদের মৃত্যুর পর সৃষ্টিজগতের আর কেউই বাকি রইবে না। বাকি থাকবেন কেবল আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা'আলা, যিনি আছেন আদি থেকে, যিনি রইবেন অনন্তকাল, যিনি বলেছেনঃ

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

"ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। শুধু বাকি থাকবে আপনার মহিমাময় ও মহানুভব প্রতিপালকের সত্ত্বা।" [সুরা আর-রাহমান : ২৬-২৭]

এরপর আল্লাহ সর্বপ্রথম ইসরাফিলকে সৃষ্টি করবেন [তাফসির ইবনে কাসির]। ইসরাফিল দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন। তখন প্রত্যেক প্রাণীকে পুনর্জীবিত করা হবে। আল্লাহ বলেছেনঃ

ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

"অতঃপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন। এরপর তোমাদেরকে জীবিত করবেন। এরপর তোমরা তাঁর দিকে ফিরে যাবে।" [সুরা বাকারা : ২৮]

দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার পর সর্বপ্রথম যিনি পুনরুত্থিত হবেন, তিনি হচ্ছেন আমাদের নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّع

"কিয়ামত দিবসে আমি হব সর্বশ্রেষ্ঠ আদম সন্তান (আদম সন্তানের শিরোতাজ)। আমি কবর থেকে সর্বপ্রথম উত্থিত হব, আমি হব প্রথম শাফায়াতকারী এবং সর্বপ্রথম আমার শাফায়াত কবুল করা হবে।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল ফাদ্বায়িল]

জীবিত হয়ে মানুষ দেখবে হাশরের ভয়াল দৃশ্য। হতভম্ব হয়ে পড়বে। নগ্ন দেহ, ক্লান্ত পায়ে ঘোরের মধ্যে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে থাকবে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ

يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً

"কিয়ামতের দিন মানুষকে জমা করা হবে খালি পায়ে, নগ্নদেহে, খৎনাবিহীন অবস্থায়।" [সহীহ মুসলিম ; কিতাবুল জান্নাহ]

সেদিন, সেই শোচনীয় মূহুর্তে আমরাও সেখানে থাকব। মা-বাবাহীন, স্বজনহীন, সন্তানহীন, বন্ধুহীন হয়ে দৌড়াব হাশরের ময়দানের দিকে। এক আল্লাহ ছাড়া না থাকবে কোনো সহায়, না কোনো শক্তি, না কোনো আশ্রয়। আল্লাহুল মুসতা'আন, আল্লাহুল মুসতা'আন...।

কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত আলোচনা এটুকুই থাকল। পরিশেষে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার রহমতের সাগর আমার পাহাড়সম গোনাহ'র চেয়ে বহুগুণ বড়। অগণিত সালাত-সালাম সেই মহামানবের প্রতি, যিনি "উম্মাতি" বলে স্বীকৃতি দিয়ে দিলে ডুবন্ত নৌকাটি পার হয়ে যাবে।

اللهم يا حي يا قيوم يا ذا الجلال والإكرام أسألك باسمك الأعظم الطيب المبارك الأحب إليك الذي إذا دعيت به أجبت وإذا استرحمت به رحمت وإذا استفرجت به فرجت أن تجعلنا في هذه الدنيا من المقبولين وإلى أعلى درجاتك سابقين واغفر لي ذنوبي ولجميع المسلمين. وصلى اللهم على أشرف الخلق سيد المرسلين نبینا محمد وعلى أهله وصحبه أجمعين - آمین.